শিক্ষকদের থেকে নীতিশিক্ষা পাওয়ার যে রেওয়াজ একসময় ছিল, তা কি আজও আছে? একটা সময় ছাত্ররা ভয় পেত, শ্রদ্ধা করত শিক্ষকদের। তাঁদের বেতন ছিল কম, জীবনযাপনে স্বাচ্ছল্য ছিল না। কিন্তু চারিত্রিক সম্পদে ও নৈতিকতায় তাঁরা ছিল অনেক ধনী। যার অংশ ভাগ করে নিতেন স্নেহের ছাত্রদের সঙ্গে। বিনিময়ে পেতেন সম্মান। আজ শিক্ষক দিবসে ‘আদর্শ শিক্ষক’ বেছে সংবর্ধনা দিতে হয়। আগে প্রায় সকলেই ছিলেন ‘আদর্শ’। কিন্তু এখন তাঁরা বিরল প্রজাতির, প্রায় অবলুপ্ত। এখনকার শিক্ষকদের থেকে ক’জন ছাত্র নৈতিকতার পাঠ নিতে আগ্রহী, সংশয় থেকেই যায়।
শিক্ষার লক্ষ্য কী? নৈতিক ও প্রায়োগিক শিক্ষা দেওয়া– যাতে কেউ সক্ষম, আত্মবিশ্বাসী ও মানবিক হয়ে ওঠে। কারও কারও মত, চরিত্র গঠনই শিক্ষার আদত উদ্দেশ্য। কোনও এককালে হয়তো এই দ্বিতীয় যুক্তিটাই সকলে নির্দ্বধায় মেনে নিতেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে কেউ বুকে হাত রেখে বলতে পারবেন না, তাঁদের শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য চরিত্র গঠন। বস্তুত, পেশাগত জীবনে বা ব্যবসায় সুপ্রতিষ্ঠিত করাই বর্তমান শিক্ষা ‘ব্যবসা’র একমাত্র লক্ষ্য। তাতে নীতি শিক্ষার আদৌ প্রয়োজন আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলাই আমাদের প্রবণতা। সার্বিক মূল্যবোধের অবক্ষয় আজ সমাজকে ক্রমশ ভঙ্গুর করে তুলছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অস্থির, চঞ্চল, বৃদ্ধি পাচ্ছে আত্মহত্যার প্রবণতা, সামাজিক ও গার্হ্যস্থ হিংসা। যা রোধ করতে পারে সঠিক নীতি-শিক্ষা। কিন্তু রুটিন সিলেবাসের বাইরে আমরা আমরা কতটুকু মানুষ তৈরির জন্য ভাবছি?
নীতি শিক্ষা কী? সহজ কথায় সৎ আচরণ, নৈতিক কর্তব্য ও মানবিক হতে শেখায় যে শিক্ষা। মনুষ্যত্বের শিক্ষা। যা অর্জন করতে হয়। এবং সেটা আত্তীকরণ করা হয় পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজ থেকে। একটি শিশু ছোট থেকে যা শেখে, সেটাই তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম শিক্ষা হয়ে থেকে যায়। শিশুমন অনুকরণ করে, তারপর বারবার অনুশীলনে তা অভ্যাসে পরিণত হয়। তাই বাড়িতে বাবা-মা, অন্য আত্মীয়স্বজনের ভূমিকা এত গুরুত্বপূর্ণ। বর্ধিত সংসারে, যৌথ পরিবারে যে দায়িত্ব সকলে ভাগ করে নিত, বর্তমান নিউক্লিয়াস পরিবারে তা ততটাই কঠিন। বাবা-মা– দু’জনেই চাকরিজীবী হলে তো বলাই বাহুল্য! ভোগবাদী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত আমরা নিজেরাই তো বিভিন্ন নীতিবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছি। নীতিবোধ আঁকড়ে থাকলে জীবনে উন্নতি হবে না, এটা তো আমাদেরই ভাবনা! সৎভাবে, সরল জীবনযাপনের মধ্যে যে আলাদা আনন্দ আছে, আধুনিক ভোগবিলাসের জীবনে তা অনেকেরই অজানা। তাহলে নীতিশিক্ষা বাচ্চারা পাবে কোথা থেকে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কেরলের কাল্লাম্বালামের কেটিসিটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করেছেন ‘আইরিস’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি কেরলের প্রথম রোবট-শিক্ষিকা। যখনই কোনও পড়ুয়া প্রশ্ন করে, তা তাদের সিলেবাস থেকে হোক বা যে কোনও বিষয়ে, আইরিস কিছুক্ষণের মধ্যেই উদাহরণ এবং রেফারেন্স-সহ উত্তর দেয়। প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। কিন্তু আইরিস সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তবে সমস্যা যে নেই, তা-ও নয়। প্রথমত, সে আবেগ বুঝতে পারে না। ফলে তার ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগ নেই।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কেন, বিভিন্ন স্কুলের পাঠক্রমে মর্যাল সায়েন্স আছে তো। নিয়মিত ক্লাস হয়, পরীক্ষা হয়। তা থেকেই তো নৈতিকতার পাঠ নিতে পারে শিশুরা। অথচ, বাড়িতে আসা কোনও অবাঞ্ছিত ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে না চাইলে নিজের সন্তানকেই বাবা বলেন, ‘বলে দাও, বাবা বাড়ি নেই’। চোখের সামনে সন্তান দেখছে, বাবা-মা-গুরুজনরা অক্লেশে মিথ্যাচার করছে। কোনও শিশু পরীক্ষায় ভাল ফল করতে না পারলে স্থান-কাল-পাত্র ভুলে শিক্ষকদের যোগ্যতা সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলছেন অভিভাবকরা। বাস্তব বলছে, শুধু স্কুলে মর্যাল সায়েন্স পড়িয়ে বা পাঠ্যে নীতিশিক্ষা সংযোজন করে কাউকে নৈতিকতার প্রকৃত পাঠ দেওয়া সম্ভব নয়। পড়ুয়া নিজের জীবনে তা বাস্তবায়ন করার কথা মোটেও ভাবে না। শুধু সিলেবাসে থাকা কিছু নীতিকথা, বাণী, প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষায় নম্বর তোলা তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সম্প্রতি কেরলের কাল্লাম্বালামের কেটিসিটি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করেছেন ‘আইরিস’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি কেরলের প্রথম রোবট-শিক্ষিকা। যখনই কোনও পড়ুয়া প্রশ্ন করে, তা তাদের সিলেবাস থেকে হোক বা যে কোনও বিষয়ে, আইরিস কিছুক্ষণের মধ্যেই উদাহরণ এবং রেফারেন্স-সহ উত্তর দেয়। প্রতিটি বিষয়ের জন্য বিশেষজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। কিন্তু আইরিস সর্ববিষয়ে বিশেষজ্ঞ। তবে সমস্যা যে নেই, তা-ও নয়। প্রথমত, সে আবেগ বুঝতে পারে না। ফলে তার ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সুযোগ নেই। দুই, সিলেবাসে থাকা নীতি শিক্ষা হয়তো সে বুঝিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু বাস্তব জীবনের নৈতিকতার পাঠ সে দিতে অক্ষম। অনেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলছেন, ‘নীতি’ বিষয়টা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কীভাবেই বা শেখাবে? যদি তার এ বিষয়ে নির্দিষ্ট ধারণা না থাকে। যেমনটা আমরা শিখেছি আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছ থেকে।
এখানেই উঠছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শিক্ষকদের থেকে নীতিশিক্ষা পাওয়ার যে রেওয়াজ একসময় ছিল, তা কি আজও আছে? একটা সময় ছাত্ররা ভয় পেত, শ্রদ্ধা করত শিক্ষকদের। তাঁদের বেতন ছিল কম, জীবনযাপনে স্বাচ্ছল্য ছিল না। কিন্তু চারিত্রিক সম্পদে ও নৈতিকতায় তাঁরা ছিল অনেক ধনী। যার অংশ ভাগ করে নিতেন স্নেহের ছাত্রদের সঙ্গে। বিনিময়ে পেতেন সম্মান। আজ শিক্ষক দিবসে ‘আদর্শ শিক্ষক’ বেছে সংবর্ধনা দিতে হয়। আগে প্রায় সকলেই ছিলেন ‘আদর্শ’। কিন্তু এখন তাঁরা বিরল প্রজাতির, প্রায় অবলুপ্ত। এখনকার শিক্ষকদের থেকে ক’জন ছাত্র নৈতিকতার পাঠ নিতে আগ্রহী, সংশয় থেকেই যায়।
তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা থাকা রোবট শিক্ষক-শিক্ষিকার আদৌ নীতিশিক্ষা দিতে সক্ষম কি না, এই প্রশ্নটাই বর্তমানে অবান্তর। নীতিশিক্ষা সম্পর্কে পাঠক্রমে যা আছে, সেটা একজন বাস্তবের শিক্ষক যেভাবে পড়াচ্ছেন, রোবটও সেভাবে বা তার চেয়েও ভাল শেখাতে পারছে কি না, সেটার মূল্যায়ন হলেই চলবে। যদি দেখা যায় পড়ুয়াদের কৌতূহল ‘যন্ত্র-শিক্ষিকা’ মেটাতে পারছে, তাহলে সে ‘নীতিশিক্ষা’ দিতে পারল কি না, তা আর গুরুত্বপূর্ণ থাকে না। নৈতিকতার পাঠ নেওয়ার সুযোগ সমাজের বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে আছে। সচেতনভাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমালোচনা করার আগে ভাবতে হবে, আমরা আদৌ ‘মানুষ’ নাকি ‘অমানুষ’? আমাদের কি নৈতিক অধঃপতন হয়নি? আমরা কি ধীরে ধীরে আবেগরহিত ‘যন্ত্রে’ পরিণত হইনি?