ফিলিস্তিনি মেয়ে হিবা কামাল সালেহ্ আবু নাদার জন্ম হয়েছিল (১৯৯১) সউদি আরবে, কারণ তাঁর পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে সেদেশে আসতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৪৮-এর নক্বা-র সময়ে ফ্যলাস্তিনের বেইত্ জিরজা গ্রাম থেকে ভূমিচ্যুত করা হয়েছিল তাঁদের। বড় হয়ে হিবা স্বদেশের মাটিতে ফেরেন, প্রথমে বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতক হন, এরপর গাজ়ার অল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে স্নাতকোত্তর। কাজ শুরু করেন রুসুল সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটিতে। কবিতা লেখা শুরু করেন, কারণ ফ্যলাস্তিনে আগ্রাসন আর প্রতিরোধ– দুইয়েরই সবাক সাক্ষী হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন।
৮.
কী লেখা হবে সেই কবির এপিটাফে? মাথার উপরে মৃত্যুবাহী বিমানের কর্কশ গর্জন আর বালিশের নিচে কবিতার খাতা রেখে যে কবি ঘুমোতে যান বধ্যভূমিকে ‘শুভরাত্রি’ বলে! তিনি জানেন, পুরো দেশটাই যখন বধ্যভূমি তখন তাকে ছেড়ে যেতে নেই। শত্রু চেতাবনি দিয়ে চলে, ‘দক্ষিণ ফাঁকা করো! উত্তরে চলে যাও, উত্তরে, আরও উত্তরে।’ কবি উত্তর দেন, ‘তোমরা চলে যাও। চিরতরে। এদিকে ফিরেও তাকিও না আর। এদেশের রুক্ষ মাটিতে গুঁড়ো হয়ে মিশে আছে শহীদের অস্থিমজ্জা। দু-হাতের পাতায় আগলে আমরা দাফন করেছি তাঁদের। এখন আমরা তাঁদের পাহারা দিচ্ছি। যাও তোমরা, যাও।’ তীক্ষ্ণ হেমন্তের রাতে কবি বেঁচে থাকেন আরব বসন্তের সকালকে বালিশের নিচে রেখে। শাহিদ (সাক্ষী) হয়ে কালকেও হয় তাঁকে লিখে যেতে হবে সত্যিটুকু, অথবা… শহীদ হতে হবে।
এই গাজ়া-য় আমাদের প্রত্যেকে
মুক্তিযুদ্ধের হয় সাক্ষী, নতুবা শহীদ।
প্রত্যেকে আমরা অপেক্ষায় আছি ঈশ্বর
শেষত কী হয়ে আমরা তোমার কাছে পৌঁছই।
এরমধ্যেই জন্নতে আমরা নতুন একটা
শহর গড়তে শুরু করে দিয়েছি, দ্যাখো!
এখানে ডাক্তার আছে, রুগী নেই,
কোনও রক্তক্ষরণ নেই।
শিক্ষকদের ক্লাসে গাদাগাদি নেই,
ছাত্রদের জন্য বকাবকি নেই।
যন্ত্রণা আর বিচ্ছেদক্লান্ত
কোনও পরিবার নেই।
সাংবাদিকেরা সেখানে লিখছে
চিরন্তন প্রেমের রিপোর্টাজ,
ছবিও তুলছে তার।
সব্বাই তারা গাজ়া থেকে এসে পৌঁছেছে।
জন্নতের এই নতুন গাজ়ায়
কোনও দখলদারি নেই।
খুব তাড়াতাড়ি
তা সত্যি হয়ে উঠছে।
খুব, খুব তাড়াতাড়ি।
ফিলিস্তিনি মেয়ে হিবা কামাল সালেহ্ আবু নাদার জন্ম হয়েছিল (১৯৯১) সউদি আরবে, কারণ তাঁর পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে সেদেশে আসতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৪৮-এর নক্বা-র সময়ে ফ্যলাস্তিনের বেইত্ জিরজা গ্রাম থেকে ভূমিচ্যুত করা হয়েছিল তাঁদের। বড় হয়ে হিবা স্বদেশের মাটিতে ফেরেন, প্রথমে বায়োকেমিস্ট্রিতে স্নাতক হন, এরপর গাজ়ার অল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে স্নাতকোত্তর। কাজ শুরু করেন রুসুল সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটিতে। কবিতা লেখা শুরু করেন, কারণ ফ্যলাস্তিনে আগ্রাসন আর প্রতিরোধ– দুইয়েরই সবাক সাক্ষী হয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। কবি হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠার সময়েই, ২০১৭ সালে, আরব দুনিয়াকে চমকে দিয়ে বেরিয়েছিল তাঁর প্রথম ও শেষ (সময়ই বা পেলেন কতটুকু!) উপন্যাস অল-উক্সুজিন লায়সা লিল-মওতে (অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!)। বহু-আলোচিত এই উপন্যাস হিবাকে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পরিচিতি দিল।যদিও প্রথম প্রেম ছিল স্বভূমি, দ্বিতীয় কবিতা। অব্যাহত রইল কবির কলম।
এরপর? মৃত্যু, আর কী? সাক্ষী অথবা শহীদ– কিছু তো একটা হতেই হত, তিনি দুই-ই হলেন না হয়! ২০২৩-এ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধআমালিয়াত তুফাঁ অল-আক্সা (অপারেশন অল-আক্সা ফ্লাড)-এ আক্রান্ত ও আতঙ্কিত হয়ে ইসরায়েল যখন লাগাতার এয়ার-স্ট্রাইক শুরু করল গাজ়া স্ট্রিপের ওপর, তখন তাঁদের হুমকিতে মাথা নুইয়ে যাঁরা দক্ষিণ গাজ়া ছেড়ে চলে যেতে রাজি ছিলেন না, হিবা তাঁদেরই একজন। তাঁর বাড়ি ছিল ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্সের হামলার লক্ষ্যবস্তু খোদ খান ইউনিসে, গণহত্যার কেন্দ্র হিসাবে যে জায়গাটি বারবার সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে এসেছে। অক্টোবরের শুরুতেই যেখানে ইসরায়েলি বিমানহানায় গুঁড়িয়ে গিয়েছিল গর্বের অল-কারারা কালচারাল মিউজিয়াম। ২০ অক্টোবর রাত্তিরে গুঁড়িয়ে গেল তাঁর বাড়ি। সে রাতেও কি গাজ়াকে শুভরাত্রি বলেছিলেন হিবা? পরদিন সকালে পোড়া ধ্বংসস্তূপে খুঁজে পাওয়া গেল হিবা কামাল সালেহ্ আবু নাদার লাশ। আর তাঁর কবিতার খাতাটিও। কবিতা বোধহয় অত সহজে পোড়ে না।
এই গাজ়ায় রকেটের ঝলকানির থেকে রাত বিচ্ছিন্ন।
বোমার আওয়াজের থেকে নৈঃশব্দ বিচ্ছিন্ন।
ভয় দেখানো সবকিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন প্রার্থনার শান্তি।
আলোহীনতা থেকে বিচ্ছিন্ন শাহাদাতের আলো।
শুভরাত্রি, গাজ়া।
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ
কিন্তু কেন আমরা এত হিংস্র হয়ে উঠলাম? কেন তাকে পিটিয়ে মারার আগে খেতে দিলাম? কী জানি, একেক সময় মনে হয়, পথের ধারে যে মাংসর দোকানের সামনে দিয়ে আমরা যাতায়াত করি আর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি, সেখানেও কাটার আগে পাঁঠাকে কাঁঠাল পাতা খেতে দেওয়া হয়।