
সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক জায়গায় অঞ্জন দত্তের থিয়েটার নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। হওয়া উচিতও। কারণ, থিয়েটারের ক্ষণস্থায়িত্ব। থিয়েটারে অঞ্জন দত্তের কামব্যাক ও সেরা ‘ফর্মে’ থাকতে থাকতে অবসরগ্রহণ অন্তত মানুষটাকে নতুন ভাবে আবিষ্কারের প্রবণতা জাগিয়ে তুলেছে। সেই জাগরণের মাধ্যম হতে পারে ‘থিয়েটার নিয়ে অঞ্জন’। গ্রন্থের আকার বড় নয়, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। কিন্তু মাদকতা থেকে যায়।
একটা মানুষ আলাদা… জানলা দিয়ে গোটা পৃথিবী দেখে। সুদিন আসবে বলে আগুন জ্বালায়। খ্যাপা শহরে একা একা হারিয়ে যায়। এই মানুষটার বহু রূপ, বহু চেহারা। কখনও তিনি গিটার বাজিয়ে এক বেকার যুবকের প্রেমের গল্প বলেন। কখনও বা তখনের চালচিত্র ও এখনের চালচিত্রকে মিলিয়ে দেখেন। এই মানুষটাকে দেখে, শুনে, পড়ে বড় হয়েছে একটা প্রজন্ম। শুধু দু’চোখ মেলে সেভাবে জানা হয়নি এই মানুষটার শিল্পীসত্তার জন্মরহস্য। সে হল থিয়েটার। গায়ক, সুরকার, গীতিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক অঞ্জন দত্তর ধাত্রীভূমি। তাই চিরচেনা হয়েও অচেনা থেকে যান অঞ্জন। গানে তিনি ‘আমি অন্য কিছু নই’ বলতেই পারেন, কিন্তু থিয়েটার মঞ্চে তিনিই ‘মারা’, তিনিই ‘লিয়ার’।

শিল্পী অঞ্জন দত্তের অভিযান শুরু মঞ্চে। অভিজিৎ বসু কথোপকথনের মাধ্যমে সেই শিল্পী মানুষটাকে খোঁজার চেষ্টা ব্ল্যাকলেটার্স থেকে প্রকাশিত ‘থিয়েটার নিয়ে অঞ্জন’ গ্রন্থে। এই শহরে বসে তিনি ১৯টা নাটক পরিচালনা করেছেন। তার কতটুকু জানি? তার স্বকীয়তার কতটুকু মূল্য দিতে পেরেছি? সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক জায়গায় অঞ্জন দত্তের থিয়েটার নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। হওয়া উচিতও। কারণ, থিয়েটারের ক্ষণস্থায়িত্ব। এই আছি, এই নেই। ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে রাখা যায়। কিন্তু দৃশ্য-শ্রাব্য-বোধ্য এমন একটা মাধ্যমের যে সরাসরি প্রভাব, তা ধরা হবে কীভাবে। এই সমস্যা চিরকালীন। থিয়েটারে অঞ্জন দত্তের কামব্যাক ও সেরা ‘ফর্মে’ থাকতে থাকতে অবসরগ্রহণ অন্তত মানুষটাকে নতুন ভাবে আবিষ্কারের প্রবণতা জাগিয়ে তুলেছে। সেই জাগরণের মাধ্যম হতে পারে ‘থিয়েটার নিয়ে অঞ্জন’। গ্রন্থের আকার বড় নয়, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলা যায়। কিন্তু মাদকতা থেকে যায়। অনেকটা তাঁর গানের মতো।
গ্রন্থটি লিখিত কয়েকটি ভাগ আছে। শিক্ষাগুরু বাদল সরকার থেকে বার্লিন-ব্রেখট হয়ে লিয়ার অভিনয় ইত্যাদি। অলিখিত ভাগটি মোটামুটি তিন প্রকার। এক– অঞ্জন দত্তের থিয়েটার যাপনের সূত্রপাত। যে মানুষটাকে আমরা গায়ক বা সিনেমা অভিনেতা হিসেবে জানি, তাঁর চরিত্রের সাবটেক্সট খোঁজা। মায়ের গয়না ধার করে বাদল সরকারের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা। পরে সেই শিক্ষাগুরুর সঙ্গে সম্মানজনক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। কীভাবে সার্ত্রর ‘মেন উইদাউট শ্যাডোজ’ থেকে ‘স্বীকারোক্তি’ করে ‘মারা/সাদ’-এ চলে আসা। মৃণাল সেনের ‘খারিজ’-এ অভিনয়, থিয়েটারের জন্য বার্লিন যাত্রা, অনসম্বলে নাটক দেখা ইত্যাদি। জীবনে হোক বা থিয়েটারে– বিশ্বাস করা যে গোষ্ঠীর থেকে ব্যক্তি বড়। এগুলো অভিজ্ঞতার মতো। যাঁরা শিল্পীর ভক্ত, তাঁরা নতুন করে অঞ্জন দত্তকে আবিষ্কার করবেন। কেন অঞ্জন দত্তের গান শুধু তাঁরই নিজস্বতার বাহক, থিয়েটারের গল্প দিয়ে একটা যোগসূত্র টেনে নিতে পারবেন।

আরেকটা দিক হল, থিয়েটারের অঞ্জন দত্তের সঙ্গে আলাপ। যাঁরা কমবেশি তাঁর অভিনয় দেখেছেন, সেই দর্শক বুঝতে পারবেন, কোথায় অঞ্জন আলাদা? কেন আলাদা? কীভাবে আলাদা? সেটা শুধু থিয়েটার নয়, সিনেমার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই শহরে বিভিন্ন নাটকে একই সঙ্গে একজন শিল্পী চার-পাঁচটি চরিত্রে অভিনয় করছেন। কিন্তু তাতে চরিত্রগুলো যথার্থ হয় কি? অনেক সময়ই হয়তো হয় না। সেই অভিনেতার ব্যক্তিত্বের জেরে বড়জোর একটা স্থিতাবস্থা তৈরি হয়। অঞ্জন এর তীব্র বিরোধী। তিনি চরিত্রের মধ্যে যাপনে বিশ্বাসী। সিনেমার ক্ষেত্রেও সেই বিশ্বাস রাখেন। বলতেই পারেন, সিনেমা ও থিয়েটার, দুটো ক্ষেত্রেই অভিনেতা হিসেবে প্রস্তুত হওয়ার প্রক্রিয়া একই– ‘একজন পরিচালক হিসেবেও আমি চাইব আমার অভিনেতারা যথেষ্ট প্রস্তুত হয়েই, মানে চরিত্রটা সম্পর্কে একটা বোঝাপড়া তৈরি করেই তবে যেন রিহার্সালে আসেন। চরিত্র টেক্সট-এ আছে, ওটা রিহার্সালে হয় না। রিহার্সালে কিছু কো-অর্ডিনেশন তৈরি হয় মাত্র।’
অঞ্জন দত্ত নিজেই বলতে থাকেন, কীভাবে সেই প্রস্তুতি চলে। কীভাবে তিনি চরিত্রকে নির্মাণ করেন। সেখান থেকে সোজা চলে আসা যায় আরেকটি ধাপে। যেখানে অঞ্জন দত্তের আর কোনও পরিচয় থাকে না, সেখানে তিনি শুধু থিয়েটারের আত্মীয়। অভিজিৎ বসু খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে আবিষ্কার করেন, সেই শিল্পীকে যিনি নিজের টেক্সটের সন্ধানে বাদল সরকারের সঙ্গ ত্যাগ করেন। ব্রেখট থেকে রবীন্দ্রনাথে, যাঁর অনায়াস যাতায়াত। লিয়ারে জোকার সেজে ওঠার ভাঁড়ামিকে প্রতিষ্ঠা করেন এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজের বীজমূলে। এই উচ্চারণগুলো শুনলে মনে হয়, এক সমাজনিষ্ঠ শিল্পী গল্পের ছলে তাঁর দর্শন বলে যাচ্ছেন। এই পাঠ সবার জন্য নয়, যাঁদের নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে থিয়েটার, যাঁরা নাটকের ফাটকে আটকা পড়েছেন তাঁদের জন্য। সব শেষে রইল অঞ্জন দত্তের উপলব্ধি, ‘‘এতকিছু করে বাদলদা যা করছিলেন, তা হল নিজেকে মানে আমার ‘আমি’টাকে জানতে উনি আমায় ভীষণভাবে সাহায্য করেছিলেন। আজ এই বয়সে এসে বুঝতে পারি, একজন অভিনেতার নিজেকে জানাটা সবথেকে জরুরি। নানা সিচুয়েশন, আমার পরিবেশ, চারপাশের মানুষকে চেনার ভেতর দিয়ে উনি আমার মন, মাথা, গোটা অস্তিত্বের অনেকগুলো দরজা-জানলা খুলে দিয়েছিলেন। সেটা ভবিষ্যতে একজন অভিনেতা হয়ে-ওঠার জন্য আমাকে প্রভূত সাহায্য করেছিল।’’ এই নিজেকে চেনা-জানা তো তাঁর গানেরও ভাষ্য।

এখানে একটা ঝুঁকি ছিল। অঞ্জন দত্ত বললে যেহেতু গানের বিষয় চলেই আসে, তাই সেটার ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার একটা আশঙ্কা থেকেই যায়। তবে অভিজিৎ বসু সেই যুদ্ধে জিতেছেন। থিয়েটারের অঞ্জন দত্ত মানে শুধু থিয়েটারই অঞ্জন দত্ত। বরং তাঁর উপলব্ধিকে সঙ্গ দিতে হাজির হন ছন্দা দত্ত। ব্যক্তিগত জীবন ও থিয়েটারি জীবনে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের বাইরে দেখে অঞ্জন দত্তকে দেখতে সাহায্য করে। রয়েছে অঞ্জন দত্ত পরিচালিত ও অভিনীত নাটকের তালিকা।
আর রয়েছে আক্ষেপ। ‘আরও একটা লিয়ার’ দিয়ে তিনি মঞ্চাভিনয় থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর গান, সিনেমা থেকে যাবে। কিন্তু দেহপট সনে নট হয়তো তাঁর থিয়েটারি চর্চার গুরুত্ব হারিয়ে যাবে। অনেকক্ষেত্রে শুধুমাত্র সংখ্যার জেরে অনেক কিছু টিকে যায়। অঞ্জন দত্ত মানে আপস করেননি, কিন্তু পরিমাণে ঘাটতি করে ফেলেছেন। তাই থিয়েটারি দুনিয়ায় বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তাঁর নিজের উপরও ‘ল্যাম্পে’র আলো ফেলে। নিজে বলেই বসেন, ‘যেখানে বাদল সরকারই হারিয়ে গিয়েছেন, সেখানে আমি কে?’ কে না-হয়, সেটা মহাকাল ঠিক করুক। সমকালের দর্শক-পাঠক হিসেবে বরং ‘নাটুকে’ অঞ্জন দত্তকে জানিয়ে রাখি, ‘শেষ বলে কিছু নেই।’
থিয়েটার নিয়ে অঞ্জন: কথাবার্তায় অভিজিৎ রায়
ব্ল্য়াকলেটার্স
২৫০্
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved