
সার্থক শিল্পের দু’টি গুণের কথা বলেছিলেন (‘আর্স পোয়েতিকা’) লাতিন কবি হোরাতিউস: উপকারী ও সুন্দর। আশ্চর্য লাগে, লেওনার্দো নিজের শিল্প-সংক্রান্ত নোট্সে কোথাও সৌন্দর্যের প্রসঙ্গ তোলেননি। অথচ বারবার স্বগত-প্রশ্ন রেখেছেন: ‘কী সেই বস্তু, যা একটি মুখকে সুন্দর করে তোলে?’ কাব্য, সংগীত এমনকী মূর্তিশিল্পের তুলনায় ছবিকে ‘সুন্দর’ প্রমাণ করতে চেয়ে লিখছেন: ‘ছবি হচ্ছে মূক কাব্য, আর কাব্য হচ্ছে অন্ধ ছবি’।
ডায়মন্ডস অফ দ্য ডাস্টহিপ। ভার্জিনিয়া উলফ বলতেন। ছাইয়ের স্তূপের মধ্যে থেকে অমূল্য রতনটুকু তুলে আনা। তাৎক্ষণিকতার সত্যস্পৃহায় উজ্জ্বল অমোঘ মুহূর্তরতন। আনসেনসরড। অলংকারভারবর্জিত। আচারের উপরচালাকিহীন নগ্ন, গতিময় সত্য। ডায়েরি। স্বগতকথনের এই ভাষ্য আমার ভালো লাগে। অন্য যে কোনও ক্রাফটেড শৈলির চেয়ে বেশি। টেক্সচুয়াল ভয়েরিজমের এই আশ্চর্য গোপন প্রবণতা আমায় বারবার টেনে নিয়ে গিয়েছে এই পথে। এই পাঠে। আইনস্টাইনের কেঠো-তাত্ত্বিক জুরিখ নোটবুক থেকে শুরু করে ফ্রিদা কাহলোর বিষাদক্লান্ত ভিজ্যুয়াল জার্নাল অবধি। আসলে যে কোনও সৎ রচনাই, বোধ হয়, সূচনা ও প্রস্থানবিন্দুতে এসে মিলে যায়– মিলে যায় স্বগতোক্তির গূঢ় নির্দেশে।

গত চারদিন ধরে পড়ছি লেওনার্দো দা ভিঞ্চির ডায়েরি। বলা ভালো, নোটবুক। আন্তর্জাল সহায়। এ চর্চার প্রবেশক হিসেবে যদি ভিঞ্চির যাবতীয় ছবিপত্রকে ধরি, তবে সহায়ক হিসেবে অবশ্যই তার দায় খানিক বর্তাবে ‘শিল্পচিন্তা’ নামক ক্ষুদ্র পুস্তিকাটির ওপর। ‘ক্ষুদ্র’ এ কারণেই যে, প্রায় ৪০ বছর ধরে লেখা অন্তত বিশ-পঁচিশ হাজার পৃষ্ঠা নোট্সের অতি সামান্যই সংকলিত করা গিয়েছে এই ৭৮ পৃষ্ঠার বাংলা পুস্তিকাটিতে। সম্পাদক-অনুবাদক সুকান্ত চৌধুরী ভূমিকায় যাকে ‘গোষ্পদে জলধিদর্শন’ বলে উল্লেখ করেছেন। তবু এ সংকলনটির গুরুত্ব এখানেই যে, ‘শিল্পী’ লেওনার্দোর মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোকে এই এক চিলতে পরিসরে বেশ খানিকটা একত্র করা গেছে। কেননা, লেওনার্দোর বহুধাবিস্তৃত মেধার সত্তাগুলির মধ্যে ‘শিল্পী’ সত্তাটিই সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও প্রচারিত।

যদিও লেওনার্দোর ক্ষেত্রে ‘শিল্পী’ শব্দটি ব্যবহারে ব্যক্তিগতভাবে আমার আপত্তি রয়েছে। বরং ‘শিল্পবিজ্ঞানী’ শব্দটি অধিকতর সাযুজ্যপূর্ণ বলে মনে হয়। লেওনার্দো নিজেই শিল্প সম্পর্কে লিখতে গিয়ে ‘সায়েন্তিয়া দেল্লা পিত্তুরা’ বা ‘সায়েন্স অফ আর্ট’ শব্দটি বারবার বিভিন্ন পাণ্ডুলিপিতে ব্যবহার করেছেন। এবং এখানেই তাঁর নোট্স অন্য শিল্পীদের চেয়ে পৃথক। ব্যতিক্রমী। খানিকটা ‘শুষ্কং কাষ্ঠং’ গোত্রীয়ও। একবার কবি দেবারতি মিত্রের লেখার খাতা পড়তে গিয়ে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল লেওনার্দোর প্রায় পৌনে শতাব্দী পরে লেখা পন্তর্মো-র দিনলিপির কথা। জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে খাতার মার্জিনে অসুস্থ দেবারতি লিখে রাখছেন বিভিন্ন ওষুধের নাম। ‘লেখো আয়ু, লেখো আয়ু’। আর পন্তর্মো, ফ্লোরেন্সের সান লরেঞ্জো গির্জায় ফ্রেস্কো আঁকার বিবৃতির সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন ডায়েট, জুড়ে দিচ্ছেন খাবার হজম-সংক্রান্ত ব্যক্তিগত নির্দেশ। লিখে রাখছেন, কীভাবে প্রতিবার প্রদর্শনীর ছবি শেষ করার পর তাঁর অর্শের প্রকোপ বেড়ে যায়। তুলনায় লেওনার্দো অনেক বেশি নৈর্ব্যক্তিক। আলব্রেখ্ট ড্যুরারের মতো। কখনও কখনও অস্কার ব্লুমনারের মতো। হাজার হাজার পৃষ্ঠা জুড়ে লিখে রাখছেন নিজের সূক্ষ্ম, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের জগতটিকে। যে জগৎ দৃশ্যমান, উন্মুক্ত, দু’ চোখের পরিধির মধ্যে ধরা দেয়। কেননা ‘চোখ ভুল করে কম’। তার গতি সংশয়বাদ থেকে সরে গিয়ে ক্রমশ রেনেসাঁসের দিকে। যে ‘চোখ’ সংশয়বাদের গ্রাহ্যসীমার মধ্যেই পড়ে না, তাকেই মূল অবলম্বন করে তুলছেন। আর লিখে রাখছেন চিত্রকলাবিজ্ঞানের একেবারে গোড়ার ধাপগুলি– আলোছায়া, রং, পরিপ্রেক্ষা, শিল্পের জ্যামিতি, স্ট্যাটিক এবং ডায়নামিক ফিগার স্টাডির অনুপুঙ্খ বিবরণ। লিখে রাখছেন আলোর সঙ্গে ছায়ার, রঙের সঙ্গে সঙ্গে রঙের, আলো-ছায়ার সঙ্গে রঙের, আলো-ছায়া-রঙের সঙ্গে চোখে দেখা দূরত্বের মৌলিক সম্পর্ক। লিখে রাখছেন আত্মনির্দেশিকা: কীভাবে আঁকতে হবে ঝড়ের বিক্ষিপ্ততা, রাত্রির আলোকশূন্যতা, যুদ্ধের বর্বরতা; কীভাবে আঁকতে হবে অন্ধকার, আলো, এমনকী বাতাস– হ্যাঁ, বাতাসও লেওনার্দোর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিসীমা অতিক্রম করে না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে পড়তে গিয়ে মনে হয়, অ্যাকাডেমিক রিয়েলিজমের প্রাথমিক পাঠ। লিখছেন এবং প্রশ্ন করছেন। অনবরত। শিশুর মতো প্রশ্ন। অজস্র ‘কেন’ এবং সেইসব ‘কেন’-র অজস্র সম্ভাব্য কারণবিন্যাস; আর সেই অনন্ত জিজ্ঞাসার ভূমায় দাঁড়িয়ে অজস্র ছোট-ছোট স্কেচ করছেন, নিখুঁত স্কেচ, বারবার– ঠিক যেমনটা সতেরো শতকের গোড়ায় পৌঁছে ফ্রান্সিস বেকন বলবেন: ‘বাস্তব পর্যবেক্ষণের দ্বারা ছোট-ছোট উপলব্ধি সংগ্রহ করা’– তেমনভাবে, বোঝার চেষ্টা করছেন, কেননা বুঝতে পারার আনন্দই ‘মহত্তম’ আনন্দ। গ্রেটেস্ট প্লেজার। সোনার হরিণটিকে ধরার ইতিহাস সেখানে তুচ্ছ।

সার্থক শিল্পের দু’টি গুণের কথা বলেছিলেন (‘আর্স পোয়েতিকা’) লাতিন কবি হোরাতিউস: উপকারী ও সুন্দর। আশ্চর্য লাগে, লেওনার্দো নিজের শিল্প-সংক্রান্ত নোট্সে কোথাও সৌন্দর্যের প্রসঙ্গ তোলেননি। অথচ বারবার স্বগত-প্রশ্ন রেখেছেন: ‘কী সেই বস্তু, যা একটি মুখকে সুন্দর করে তোলে?’ কাব্য, সংগীত এমনকী মূর্তিশিল্পের তুলনায় ছবিকে ‘সুন্দর’ প্রমাণ করতে চেয়ে লিখছেন: ‘ছবি হচ্ছে মূক কাব্য, আর কাব্য হচ্ছে অন্ধ ছবি’। এবং সুন্দরের প্রতি এই অক্লান্ত পক্ষপাত জারি রাখতে শরণ নিচ্ছেন গণিতের– ‘কবি ও চিত্রকরের মধ্যে মীমাংসা’ অংশে এসে লিখছেন: ‘চোখের দৃষ্টি বিশ্বের সব সৌন্দর্য আলিঙ্গন করে… চোখ হল অঙ্কশাস্ত্রের রাজা’! চিত্রকলা, সৌন্দর্য এবং গণিতের এমন আশ্চর্য সমন্বয় আমাদের এনে ফেলে স্থপতি মার্কুস ভিত্রুভিউসের সেই বিখ্যাত ছবিটির সামনে। যা আরও পরে লেওনার্দোর ব্যাখ্যায় বিজ্ঞান-ইতিহাসের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে দাঁড়াবে। ঠিক যেমন গিবের্তি, ব্রুনেল্লেস্কি, আলবের্তি কিংবা মাসাচ্চিও-দের স্থাপত্য ও চিত্রশিল্পের বৈজ্ঞানিক দিকটি, বিশেষত পরিপ্রেক্ষার জ্যামিতিক ভিত্তি বিষয়ক গবেষণার বৃত্তটি সম্পূর্ণ করবেন লেওনার্দো। প্রমাণ রেখে যাবেন পম্পেও লিওনির কাছে। আরও অনেক বছর পর ছেপে বেরবে ‘ত্রাত্তাতো দেল্লা পিত্তুরা’। ডারউইন পড়বেন সেই নোট্স। আবিষ্কার করবেন মানুষ ও ঘোড়ার পায়ের অ্যানাটমিকাল বিন্যাসের বিবর্তনগত সম্পর্ক। একটি বিরাট সমবেত, যৌথ চক্র, এবং মানবেতিহাসের আশ্চর্য সমাপতন।

কৌতূহল হয়, লেওনার্দো কখনও কোনও পূর্ণাঙ্গ লেখা লিখলে তা এই নোট্সগুলোর মতো নান্দনিক হত কি না। কঠিন বস্তুর পরিমাপ, আকার-আয়তন পরিবর্তন থেকে জল প্রকৌশল সম্পর্কিত যন্ত্রপাতি, অনুপাতের তত্ত্ব থেকে যুদ্ধাস্ত্রের পরিকল্পনা, ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি থেকে শাশ্বত গতির তত্ত্ব, মানুষ ও অন্যান্য পশুপাখির অ্যানাটমি থেকে চিত্রকলা, কাব্য ও অন্যান্য শিল্প-মাধ্যমের দার্শনিক বিরোধ– এমন বিচিত্র বিষয়ে এই যে অসংখ্য বিক্ষিপ্ত এন্ট্রি, যার সেই অর্থে সুস্পষ্ট কোনও লক্ষ্য নেই; কিংবা হয়তো আছে– আছে পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ-সিদ্ধান্তের চিরন্তন ক্রম-অনুসৃত এক স্বশিক্ষার যাত্রাপথ, আছে কোনও একটি বিষয়কে ভিত্তি করে একেবারে মৌলিক স্তর পর্যন্ত অনুসন্ধানের সত্যপিপাসা– গ্রিকরা যাকে বলতেন ‘ফিলোসোফোস’; গুহ্য আরশিলিপিতে লেখা কখনও দু’-চারটি লাইন, কখনও কয়েকটি পৃষ্ঠার দীর্ঘ অনুচ্ছেদ, সহায়ক নকশা, খুচরো আঁকিবুকি– এক শিল্পী, এক প্রকৃতি-দার্শনিক, এক বিজ্ঞান-অন্বেষকের স্বগতভাষণ। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ক্ষেত্রে যেমন, এমনকী ছবির ক্ষেত্রেও– অসংখ্য খসড়া করার পর হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র ছবিই সম্পূর্ণ করছেন। এই এলোমেলো অবিন্যস্ত খসড়ার ধরনই লেওনার্দোর নোট্সের নান্দনিক ভিত্তি। আর ঐতিহাসিক ভিত্তিটি অবশ্যই রেনেসাঁসের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তা খানিকটা সমসাময়িককে অতিক্রম করে যাওয়ায়– শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন– প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই; খানিকটা মানুষ ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্ককে দেখার প্রেক্ষিত বদলে; আর খানিকটা ‘শিল্পী’-কে ‘কারিগর’ থেকে ‘দার্শনিক’-এ উন্নীত করায়। যেমনটি লিখেছেন সুকান্ত চৌধুরী, এ পুস্তিকার ভূমিকায়: ‘দ্বিতীয়োক্ত মনীষীরা (লেওনার্দো ও মিকেলেঞ্জেলো) একাধারে শিল্পী ও দার্শনিক, সত্যসন্ধানী। যেন পরবর্তীকালে বেকনের বিখ্যাত উক্তির আগাম দায় নিয়ে এঁরা (বিশেষত লেওনার্দো) সত্যিই সম্পূর্ণ জ্ঞানের জগতটা তাঁদের রাজত্ব বলে দখল করে ফেলেছেন।’

ভূমিকাটি অবশ্যই এ বইয়ের মূল্যবান সংযোজন। মূল্যবান অনুবাদ-সংক্রান্ত তথ্যসূত্রগুলিও। অনুবাদটি ইংরেজি থেকে নয়, বরং সরাসরি ইতালিয় ভাষায় লেখা প্রামাণ্য গ্রন্থগুলি থেকে করা হয়েছে। এ সংকলনটির মূল সহায় ভাতিকানোর প্রাসাদে সংরক্ষিত ‘উরবিনুস ১২৭০’ কোদেক্স-টি, যা লেওনার্দোর মৃত্যুর ১৩২ বছর পরে, ১৬৫১ সালে, ‘ত্রাত্তাতো দেল্লা পিত্তুরা’ (চিত্রকলা বিষয়ক নিবন্ধ) নামে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮১৭ সালে গুল্যিয়েলমো মান্ৎসি, এবং আরও পরে ১৮৮৩ সালে জাঁ-পল রিখটের এই মূল পাণ্ডুলিপি সম্পাদনা করে পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন। ‘দেল্লা পিত্তুরা’ বাদে ‘শিল্পচিন্তা’ সংকলনের অন্যান্য কিছু লেখার উৎস– কোদেক্স ‘আতলান্তিকুস’ এবং ইউরোপের বিভিন্ন গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত বেশ কয়েকটি অগ্রন্থিত পাণ্ডুলিপি। লেখাগুলি সটীক, এবং এগুলি যে বিষয় অনুযায়ী সুচয়িত এবং সুসম্পাদিত তা অস্বীকার করার জায়গা নেই। তবে এমন যত্ন নিয়ে করা পুস্তিকাটির দ্বিতীয় সংস্করণের দ্বিতীয় মুদ্রণে এত বিপুলসংখ্যক মুদ্রণপ্রমাদ বইটির গুরুত্ব ও বিষয়ভারকে খানিক ম্লান করে। পাশাপাশি এ-ও মনে হয়, লেওনার্দোর অসংখ্য নকশা ও স্কেচ, বিশেষত যেগুলি পাঠের সহায়ক, তা যদি টেক্সট-এর সঙ্গে গ্রন্থবদ্ধ আকারে যেত তবে এ সংকলনটি আরও অমূল্য হয়ে উঠত। তবু এ বইটি যে, অন্তত আমার মতো ইংরেজি-বিমুখ অস্থিরমতি পাঠককে একরকম জোর করেই লেওনার্দো-পাঠের সমুদ্রের দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং বাংলাভাষার পাঠকদের জন্য লেওনার্দোর শিল্পচিন্তা চর্চার একটি পরিসর খুলে দিয়েছে– তার জন্য প্রকাশকের সাধুবাদ প্রাপ্য।
শিল্পচিন্তা: লেওনার্দো দা ভিঞ্চি
অনুবাদ ও সম্পাদনা: সুকান্ত চৌধুরী
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা
১৫০/-
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved