১৪ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ১৬ জানুয়ারি ২০২৩– ফেসবুক ওয়ালে এই সময় পর্বে বাছাই ৩০টি লেখা নিয়ে এই সংকলন। তবে বিষয় আলোচনা দিয়ে দাঁড়ি টানলে এই গ্রন্থ পর্যালোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ বইয়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, ফেসবুকের ‘দেয়াল লিখন ‘-এ যে পাঠক প্রতিক্রিয়া, তার সংযোজন। সাহিত্যকর্মের আঙিনা হিসেবে যতই ফেসবুকের ভূমিকাকে গুরুত্বহীন হিসেবে দেখা হোক, পাঠক-লেখকের সরাসরি সংযোগের উপায় হিসেবে এই মাধ্যমের উপযোগিতাকে অস্বীকারের উপায় নেই। দুই মলাটে বন্দি ‘দেয়াল লিখন’-এ নিজের লেখার সঙ্গে সেই পাঠ প্রতিক্রিয়াকে যুক্ত করে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন লেখক রামকুমার।
জীবনস্রোতে মিশে থাকে মানুষের পোড়খাওয়া যাপনের গুঁড়ো। বিশেষ-নির্বিশেষ, স্বকীয় হোক বা সাদামাটা– সেই পাঁচমিশালি কথকতাকে জুড়ে রাখাই জীবনের অভিপ্রায়। চায়ের ঠেক কিংবা রোয়াকের আড্ডায় সেই চলিষ্ণু জীবনের নানা পরত ভেসে ওঠে, মিলিয়েও যায়। শুধু জীবনের গল্প বয়ে চলে। চরিত্রের ভিতরে যে নির্যাস, তা শিখিয়ে যায় জীবনের মূল্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় স্থান-কাল-পাত্র। চেনা ছবি পালটায়। রোয়াক ভেঙে সেখানে ভিড় করে নিঃস্তব্ধতার আগাছা। চায়ের দোকানের মজলিশ ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। শুধু থেকে যায় জীবনের স্রোতধারা। ফেসবুক সেই বয়ে চলা কথকতার নতুন উঠোন। যেখানে মত ও পথের সহাবস্থান মানুষকে মানুষের পরিচিতবৃত্তে শামিল হওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছে। সাহস জুগিয়েছে বিরোধিতার।
আসলে বিচ্ছিন্ন নয়, বন্ধুত্বের পরশে জুড়ে থাক স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা, আলাপ আর আদান-প্রদানের সাহচর্যে গড়ে উঠুক এক সোশাল দুনিয়া– এমনটাই তো শুরুর দিনে চেয়েছিলেন ফেসবুকের স্রষ্টা। যাত্রাপথের আনন্দগান সঙ্গী করে সেই মাধ্যম মহীরুহ হবে; তার দেওয়ালে স্মৃতির অক্ষরমালা গড়বে মানুষ, হয়ে উঠবে গল্প আসরের চণ্ডীমণ্ডপ, ভেবেছিলেন কি জুকারবার্গ সাহেব? হয়তো ভাবেননি। যেমন ভাবেননি রামকুমার মুখোপাধ্যায়।
বছর তিনেক আগে ত্রিপুরা বইমেলার অনলাইন উদ্বোধনে গুগল মিটে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিপত্তি। আর বিপত্তারণ হিসেবে ফেসবুকের শরণাপন্ন হওয়াটাই লেখক রামকুমারের সামনে খুলে দিয়েছিল এক নতুন দিগন্ত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, সাহিত্য অকাদেমি, বিশ্বভারতীর মতো প্রতিষ্ঠানের সুহৃদদের ‘ফ্রেন্ড-রিকোয়েস্ট’-এর অনুরোধ এড়িয়ে তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি ফেসবুক থেকে নিজেকে বিরত রাখা। ফেসবুকে ‘দেয়াল লিখন’ সেই সূত্রে মাধ্যম হয়েছে লেখক রামকুমারের সাহিত্যসাধনায়। পরবর্তীতে ‘ভিরাসত’-এর উদ্যোগে তা হয়ে উঠেছে আস্ত একটা গ্রন্থ, যার পাতার আনাচকানাচে নানা স্মৃতির পদচারণা।
কীভাবে? আরও একটু তলিয়ে যাওয়া যাক।
স্মৃতি ধ্রুবতারা নয়, আশ্বিনের মেঘের মতোই তার সঞ্চরণ। এই আছে, তো এই নেই। অতীত-বর্তমানের দোটানায় হয়তো স্মৃতির ওপর সময়ের পলি পড়ে, কিন্তু মুছে যায় না। মনের অলিন্দে হঠাৎ দমকা হাওয়া ধাক্কা দিলে অতীতের ধুলোমাখা স্মৃতি জেগে ওঠে। তাকে অক্ষরমালায় সাজিয়ে না তুললে ফের হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে বিস্তর। সেই সূত্র ধরেই লেখক রামকুমারের কলমে ভিড় করে এসেছে কখনও পুরুলিয়ায় মহাশ্বেতা দেবীর শবর-পরবের স্মৃতি, কখনও কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ।
কথাকার রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত যে পাঠক-সমাজ, তাদের কাছে তাঁর সাহিত্যের বিষয়বৈচিত্র অজানা নয়। লেখক রামকুমারের ধনপতি যত না মঙ্গলকাব্যের, দুখে কেওড়া, নঙ্গরচন্দ্র যত না কল্পনাজাত, তার চেয়েও বেশি রক্তমাংসের, আর সেটা সম্ভব হয়ে উঠেছে রামকুমার মুখুজ্জের রচনাশৈলীর গুণে। তাঁর বিষয় নির্বাচন ও অন্তর্দৃষ্টির ছোঁয়ায় স্মৃতিচারণ সুখপাঠ্য, অতীতের কথা বর্তমানের নিরিখে প্রাসঙ্গিক। তাই ‘অজিত কৌর ও অপর্ণার কথা’-র সূত্র ধরে যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির কথা জানতে পারি, তা আজকের ভারতে বিরল হলেও লেখকের চিন্তায় অহেতুক নয়। সমন্বয়ের সেই শৃঙ্খল বাস্তবে কতটা ভঙ্গুর, তা পরিষ্কার হয়ে যায় এই লেখার পাশে লেখকের আরেক স্মৃতিচারণ ‘আতঙ্ক, শোক আর লজ্জার বগটুই’-কে রাখলে।
মনুষ্যত্বের সমন্বয় বোধ মাটিতে মিশে যায় ‘বীরের ভূমি’ খ্যাত বীরভূমে, যেখানে জলজ্যান্ত ন’জনকে পুড়িয়ে মারা হয়। রাজনৈতিক কারণে পুলিশ-প্রশাসন নির্বিকার, কিন্তু সমাজবদ্ধ হিসেবে সাধারণ মানুষের দায়বদ্ধতা? সেই জীর্ণ মানবিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন লেখক। এই কষ্টকর চেনা পৃথিবীর বাইরে যে আরও একটা জগৎ আছে, যেখানে জীবনের যন্ত্রণাকে ম্লান করে জিতে যায় দায়বদ্ধতা– তারও সন্ধান দিয়েছেন রামকুমার মুখোপাধ্যায়। কখনও তা সোমেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্রসঙ্গে, কখনও তা আবার তারাপদ সাঁতরার স্মৃতিচারণে।
রামকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখার জগতের বিস্তীর্ণ পরিসর জুড়ে আছে উত্তর-পূর্ব ভারত, উত্তর-পূর্বের জনজীবন, সংস্কৃতি ও তার কথাকাররা। সেই ভাবনার খেয়ালেই গুয়াহাটির পরিণীতা ও লুটফা এসেছেন, এসেছেন নবকান্ত বড়ুয়া, এসেছে তেমসুলা আওয়ের ভাঙাচোরা চলার পথ। এসবের পাশে ‘শিবময়ানন্দ মহারাজকে নিয়ে টুকরো স্মৃতি’ কিংবা ‘পুরস্কার ও রবীন্দ্রনাথ’ পাঠককে এক মুগ্ধতার জগতে নিয়ে যায়, যার ঠিক উল্টোমেরুতে রয়েছে ‘সুভাষদার রাজনীতি, সুভাষদাকে নিয়ে রাজনীতি’-র প্রসঙ্গ, যা জাগিয়ে তোলে হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস।
১৪ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে ১৬ জানুয়ারি ২০২৩– ফেসবুক ওয়ালে এই সময়পর্বে বাছাই ৩০টি লেখা নিয়ে এই সংকলন। তবে বিষয় আলোচনা দিয়ে দাঁড়ি টানলে এই গ্রন্থ পর্যালোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। এ বইয়ের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, ফেসবুকের ‘দেয়াল লিখন’-এ যে পাঠক প্রতিক্রিয়া, তার সংযোজন। সাহিত্যকর্মের আঙিনা হিসেবে যতই ফেসবুকের ভূমিকাকে গুরুত্বহীন হিসেবে দেখা হোক, পাঠক-লেখকের সরাসরি সংযোগের উপায় হিসেবে এই মাধ্যমের উপযোগিতাকে অস্বীকারের উপায় নেই। দুই মলাটে বন্দি ‘দেয়াল লিখন’-এ নিজের লেখার সঙ্গে সেই পাঠ প্রতিক্রিয়াকে যুক্ত করে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন লেখক রামকুমার। বাখতিনের বহুস্বরতার সঙ্গে ফেসবুকের এই পাঠ প্রতিক্রিয়ার মিল খুঁজে পেয়েছেন তিনি। মত ও মতান্তরের বাঁধুনিতে তৈরি হয়েছে এক অনন্য কথামালার সেতু। সেই যাত্রাপথে লেখকের সৃষ্টিকর্মের সঙ্গে চিরস্থায়িত্ব পাওয়া পাঠকের জন্য বড় প্রাপ্তি বইকি!
দেয়াল লিখন
রামকুমার মুখোপাধ্যায়
ভিরাসত
৪০০