মানিক চক্রবর্তীর সামগ্রিক লেখালেখি বহুদিনই পাঠকের নাগালের বাইরে। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর নির্বাচিত কবিতা ও গদ্যের দু’টি ছোট সংকলন। এবার ‘ধানসিড়ি’ প্রকাশ করেছে ‘রচনা সংগ্রহ’। যেহেতু এটা প্রথম পর্ব হিসেবে প্রকাশিত, আশা করা যায় বাকি লেখাগুলিও ধীরে ধীরে পর্বাকারে প্রকাশিত হবে। নতুন করে মানিক চক্রবর্তীর সঙ্গে সঙ্গে পরিচয় ঘটবে এ যুগের পাঠক, এমনকী লেখকদেরও!
‘কত কবি মরে গেল, চুপিচুপি একা একা’– শুধুই কি কবি? তাহলে রতন ভট্টাচার্য, সমীর চৌধুরী, সোমনাথ ভট্টাচার্যরা হারিয়ে গেলেন কীভাবে? বাংলা সাহিত্যের শক্তিশালী অথচ বিস্মৃত গদ্যকারদের এই তালিকার অন্যতম নাম মানিক চক্রবর্তী। পাঠকের ‘উইশ ফুলফিলমেন্ট’-এর দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করে যে গল্প-উপন্যাস তিনি লিখেছিলেন, তা অবশ্য ‘বাজার’কে তোয়াক্কা না করেই লেখা। নিজের লেখাকে তিনি বলতেন ‘ইনস্ট্যান্ট রাইটিং’। তিনি কবিতাও লিখেছেন। যা ‘অ্যান্টি পোয়েট্রি’। ‘পনেরো হাজার শব্দে গণেশ-পরিবার’ নামের আশ্চর্য উপন্যাসটির কথা মাঝে মাঝে শোনা গেলেও মানিকের সামগ্রিক লেখালেখি বহুদিনই পাঠকের নাগালের বাইরে। এমনকী, উল্লিখিত উপন্যাসটিও। কয়েক বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর নির্বাচিত কবিতা ও গদ্যের দু’টি ছোট সংকলন। এবার ‘ধানসিড়ি’ প্রকাশ করেছে ‘রচনা সংগ্রহ’। যেহেতু এটা প্রথম পর্ব হিসেবে প্রকাশিত, আশা করা যায় বাকি লেখাগুলিও ধীরে ধীরে পর্বাকারে প্রকাশিত হবে। নতুন করে মানিক চক্রবর্তীর সঙ্গে সঙ্গে পরিচয় ঘটবে এ যুগের পাঠক, এমনকী লেখকদেরও!
প্রথম পর্বের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ নিঃসন্দেহে ‘পনেরো হাজার শব্দে…’। গণেশ, তার স্ত্রী নমিতা, ভাই ধনেশ এবং পুত্র শংকর— এদের নিয়েই গণেশ পরিবার। গণেশ আর্জেন্টিনার সমর্থক। ‘নীল আর সাদা ডোরাকাটা জামা এবং কালো প্যান্ট পরে যারা ফুটবল খেলে।’ নিজের প্রাত্যহিকতা থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া একজন মানুষ আর্জেন্টিনা নামের এক সুদূর দেশের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। আসলে কলেজ জীবন তার পেনফ্রেন্ড ছিল সেদেশের এক যুবতী মার্তা মিলেসি। ‘প্রাণোচ্ছ্বল যুবতীর বন্ধুত্ব পেয়ে যেন গোটা দেশটাই গিলে খেয়ে ফেলতে চাইল রাতারাতি, যতই অসম্ভব তা হোক না কেন!’ অল্প বয়সের পত্রমিতালির সেই ঝোঁক নির্মাণ করে দিয়েছিল গণেশের জীবনটাই। মার্তা মিলেসির চিঠি আসা বন্ধ হয়ে গেলেও এক কাল্পনিক রেখা টেনে নিজেকে লাতিন আমেরিকার সঙ্গে জুড়তে গিয়ে চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গণেশ। চিরকালের মতো। সে কি আসলে নিঃসঙ্গতার সুড়ঙ্গ দিয়ে নিজের কাছেই পৌঁছতে চায়? তার সম্পর্কে স্ত্রী নমিতার বিশ্লেষণ– ‘তুমি যেন একটা কচ্ছপের মতো, যাকে দেখে ঠিক বোঝা যায় না কিছু ভাবছে, না কি না ভাবছে—’ ভাষা ও বর্ণনায় এমন নিপুণ, তীব্র লক্ষ্যভেদী অথচ স্বল্পায়তন আখ্যানের সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে কোনও পূর্ব বা উত্তরসূরি নেই।
বইয়ে উপন্যাসটি ছাড়াও তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘দয়ার আগে কি পরে’ এবং বেশ কিছু অগ্রন্থিত গল্প রয়েছে। মানিক চক্রবর্তীর গদ্যে বারবার এক বিস্ফোরণের সম্ভাবনা তৈরি হয়। যেন সলতের আগুন দ্রুত ধাবমান সম্ভাব্য পরিণতির দিকে। এক চাপা শ্বাসের মতো গল্পের চলন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাঠককে কেবল সম্ভাবনার (নাকি আশঙ্কা) দিকেই এগিয়ে দেয়। ‘কিছু একটা হবে’ থেকে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত কিছুই ঘটে না সেই অর্থে। অথবা যা ঘটে, তা নাটকীয় নয় বলেই পাঠকের অন্তর্মহলে তা ‘ঘটনা’ বলেই চিহ্নিত হতে চায় না সহজে। অন্তত যতক্ষণ না পাঠক তাঁর লেখার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নিজের দাদা রমেশ সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাচ্ছে বুঝেও বাড়ি থেকে অবলীলায় বেরিয়ে আসে অশোক। সে কিন্তু জানে ‘থার্ড স্ট্রোক, এবং মৃত্যু।’ রমেশের ছেলে গোপি ও বউমা কী ভাববে, তারা কীভাবে শশব্যস্ত হবে– এমন পরিস্থিতিতে সেসব সে ভাবতে থাকে বাড়ির উলটো দিকের এক চায়ের দোকানে বসে। ‘দু-এক সেকেন্ড থেকে গেলেই হত। ইচ্ছে করে অশোক থেকে গেল না।’ এই আশ্চর্য নির্লিপ্তির সামনে পাঠক কার্যতই চমকে ওঠে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
যেমন ‘রুদ্ধ সংবাদ’। নিজের দাদা রমেশ সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাচ্ছে বুঝেও বাড়ি থেকে অবলীলায় বেরিয়ে আসে অশোক। সে কিন্তু জানে ‘থার্ড স্ট্রোক, এবং মৃত্যু।’ রমেশের ছেলে গোপি ও বউমা কী ভাববে, তারা কীভাবে শশব্যস্ত হবে– এমন পরিস্থিতিতে সেসব সে ভাবতে থাকে বাড়ির উলটো দিকের এক চায়ের দোকানে বসে। ‘দু-এক সেকেন্ড থেকে গেলেই হত। ইচ্ছে করে অশোক থেকে গেল না।’ এই আশ্চর্য নির্লিপ্তির সামনে পাঠক কার্যতই চমকে ওঠে। কেন অশোক এমন করল, তা বুঝতে গল্পটির সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে। তার উৎকণ্ঠা, এই বুঝি গোপি এল খবর দিতে! ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে তার মনোজগৎ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনও ‘নাটক’ তৈরি হয় না। যেমন ‘উচ্চ-মাধ্যমিক মেয়ে’। ষোড়শি মিলি আচমকাই যেন বদলে গিয়েছে। কিশোরী মেয়েকে নিয়ে অনিল অথবা জুঁই দু’জনেই উৎকণ্ঠায় ভুগতে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মেয়েকে স্বাভাবিক করে তোলার লড়াই চালায় তারা। অনিল বুঝে পায় না, কী হয়েছে মিলির। ‘মিলির কোনও গোপন বেদনা? যৌনবেদনা? উন্মেষের প্রথম ঊষাতে জীবনসঙ্গী বা দেহসঙ্গী হিসেবে কাউকে পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষাজনিত মনোকষ্ট, তা থেকে উদাস হয়ে যাওয়া ধীরে-ধীরে?’ বহুদিন পরে মিলিকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে অনিল। বাবা ও মেয়ের সেই যাত্রাই ফুটে উঠেছে গল্পজুড়ে। এখানেও পাঠককে শেষপর্যন্ত মুখোমুখি হতে হয় সলতের ধাবমান আগুনের। কিন্তু সম্ভাব্য বিস্ফোরণ তথা কোনও নাটুকে সমাপ্তি চান না বলেই মানিক লেখাটিকে নিয়ে যান ভিন্নতর সমাপ্তির দিকে। আসলে ‘ইনস্ট্যান্ট রাইটিং’ ছিল মানিকের লিখনরীতি। তাঁর উদ্দেশ্যই ছিল এইভাবে অগোছালো কথনের ভিতর দিয়ে এক দুনিয়া নির্মাণ। এই ঘটনাহীনতা, এই নির্লিপ্তির ভিতর দিয়েই তিনি সেই দুনিয়াকে রক্তমাংসের করে তোলেন।
মানিকের ‘শীতের রাতে শোওয়া’ এক নির্মম আখ্যান। দিবাকর আর তার পিসি একসঙ্গে থাকে। এই পিসি কিন্তু তার রক্তমাংসের কেউ হন না। বয়সে বছর দশেকের বড় এই মহিলার সঙ্গে আসলে এক গোপন যৌন সম্পর্কের খতিয়ান রচনা করে চলেছে দিবাকর। এই যৌনতা ঠিক স্বাভাবিক নয়। বরং তা এক রুক্ষ, গা শিরশিরে চাপা দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে যায় বাড়ি জুড়ে। অন্যদিকে পিসির মেয়ে চন্দনা, যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল দিবাকর। সেই চন্দনার সাধে গিয়ে দিবাকরের যে অভিজ্ঞতা হয়, সেই নিষ্ঠুরতাকে নির্মাণ করতে তীব্র অথচ সপাট এক ভাষা ব্যবহার করেছেন মানিক।
আবার ‘দয়ার আগে কি পরে’ গল্পে মিহির ও হরবিলাসের সম্পর্ক নিছক মনিব-ভৃত্যের সম্পর্কের মতো নয়। অসংখ্য সবুজের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক সবুজ বাড়িতে থাকে তারা। ‘পুরো ব্যাপারটার মধ্যে বেশ একটা অসৎ ভাব রয়েছে। মিহির এ-বাড়িতে থাকে।’ এই বাড়িতেই এসে উপস্থিত হয় একটি মেয়ে। সে মিহিরের সহকর্মী। এই গাছগাছালির ভিতরে এক অচেনা পরিবারের এক রাতের অতিথি সে। ‘ওপরে অসংখ্য নক্ষত্র, রেলওয়ে লাইনটা অনেক উঁচু হয়ে এখান থেকেই দূরে-দূরে সরে যাচ্ছে, রাত আটটা-টাটটা হবে এবং শীত খুব একটা বেশি না– এরকম পরিবেশে যেন কিছু একটা ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।’ অর্থাৎ এখানেও সেই বিস্ফোরণের আশঙ্কার ভিতর দিয়ে গদ্যের চলন। শেষে গল্প যেখানে দাঁড়ায়, তা আপাতভাবে রোমাঞ্চকর নয়। কিন্তু এই গল্পের এর চেয়ে অবধারিত সমাপ্তি হয়তো হতেই পারত না। তা এক অব্যর্থ গন্তব্যে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে লক্ষ্যবিদ্ধ ছুরির মতো। মানিক চক্রবর্তীর গল্পের চরিত্ররা অনেক সময়ই হেরে যাওয়া মানুষ। ‘ভোরবেলার কাঁচা রক্ত’ গল্পে দিলীপ দুই দেওয়ালে দুই বউদির ছবি লাগানোর মধ্য দিয়ে আসলে কী চাইছে? সে নির্মাণ করতে চায় এক ফ্রেম। যেখানে ঢুকে সে স্তব্ধ হয়ে যাবে। আবার ‘রুনুর নখ সাতদিনে কতটা বড়ো হয়েছে’ গল্পে রুনু ব্রতীনের মৃত্যুর পর নতুন জীবন শুরু করতে চায় শুভর সঙ্গে। আর এই পরিস্থিতিতে বারবার তার নজরে পড়ে নিজের নখের দিকে। ‘হঠাৎ, হঠাৎই তবু আঙুলগুলোর দিকে নজর পড়ে। চিলতে-চিলতে নখ– ভাবে, কেটে নিতে হবে। যা হোক সময় করে কেটে সমান করে নিতে হবে।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত নখ কেটে ওঠার সময় রুনুর হয়নি। এই গল্পের শেষে এক চরম বেদনার মুহূর্ত রয়েছে। সেই মুহূর্ত পেরিয়ে রুনু শেষ পর্যন্ত কোথায় পৌঁছয়? কোথাও কি পৌঁছতে পারি আমরা? মানিকের জগৎ আমাদের সেই ব্যর্থতাকেই নির্মাণ করতে থাকে সুচারু ভঙ্গিতে।
চেনা ছক ভেঙে ‘খুচরো নৈতিকতা’র বাইরে নিজের গল্পকে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন মানিক। গত শতকের নয়ের দশকের একেবারে গোড়ায় তাঁর মৃত্যু। এই আলোছায়া মাখা ভার্চুয়াল সত্তার জীবনে, কৃত্রিম মেধার সময়ের বহু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাঁর গল্প-উপন্যাস। কিন্তু যেভাবে তিনি মানুষের একাকিত্ব, তাঁর হেরে যাওয়া কিংবা মেনে নেওয়ার ব্যর্থতাকে এঁকেছেন, তা কিন্তু আধুনিক। এই সময়ের বুকেও সেই গদ্যের নিজস্ব চলন জারি থাকে। শেষের পরও।
রচনা সংগ্রহ ১
মানিক চক্রবর্তী
সম্পাদনা: পৃথ্বী বসু, অনির্বাণ বসু
প্রকাশক: ধানসিড়ি। মূল্য: ৪৭৫