
‘পরবাস গল্প সংকলন’। প্রথম খণ্ড। বইয়ের পিছনের ব্লার্ব ও মুখবন্ধ থেকে জানলাম দীর্ঘ ২৭ বছরে প্রায় হাজার দেড়েক গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘পরবাস’-এ। সেখান থেকেই বেছে নেওয়া হয়েছে সেরা ৩৩টি গল্প। স্বাভাবিক ভাবেই একরাশ নস্ট্যালজিয়া গ্রাস করল। পাশাপাশি বইটি নিয়ে আশাও জাগল। দেড় হাজার থেকে টিকে থাকা ৩৩টি গল্প! কিন্তু মন ভরল কি?
বহু বছর আগের কথা। ইন্টারনেট সবে হাঁটি হাঁটি পা-পা করতে করতে একটু বড় হয়েছে। ফেসবুক নয়, অর্কুটের জমানা সেটা। সেই সময়ে আমি প্রথম ‘পরবাস’ পত্রিকা পড়ি। তখন যে-অফিসে চাকরি করতাম, সেখানে কাজের চাপের প্রাবল্য ছিল না। রোজ বেশ কিছুটা সময় পেয়ে যেতাম এলোমেলো সার্ফিং করার। সেই সময়ই চোখে পড়ে ওয়েব পত্রিকাটি। বেশ লাগত। বাংলা ‘কনটেন্ট’ তখনও নেট ভুবনে অপ্রতুল। সেখানে এত ভালো ভালো লেখা!
পৃথিবী এরপর বহুদূর চলে এসেছে। হাতে এল একটি বই। ‘পরবাস গল্প সংকলন’। প্রথম খণ্ড। বইয়ের পিছনের ব্লার্ব ও মুখবন্ধ থেকে জানলাম, দীর্ঘ ২৭ বছরে প্রায় হাজার দেড়েক গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘পরবাস’-এ। সেখান থেকেই বেছে নেওয়া হয়েছে সেরা ৩৩টি গল্প। স্বাভাবিক ভাবেই একরাশ নস্টালজিয়া গ্রাস করল। পাশাপাশি বইটি নিয়ে আশাও জাগল। ১,৫০০ থেকে টিকে থাকা ৩৩টি গল্প! কিন্তু মন ভরল কি?
……………………………………………………….
বিস্কুট নিয়ে আস্ত বই! কেমন হয়েছে জানেন? জানুন: ভাঙবে, তবু মচকাবে না
………………………………………………………..
এর মধ্যে তিনটি গল্প অনুবাদ। অর্থাৎ, মৌলিক ছোটগল্প রয়েছে ৩০টি। বইয়ের প্রথম গল্প দিবাকর ভট্টাচার্যের। মৃত্যুর পরই তাঁর ছোটগল্প পাঠক সমীপে হাজির হয়। নবারুণ ভট্টাচার্যই লেখক দিবাকরকে ছড়িয়ে দেন মনস্বী পাঠকের মাঝে। তিনি ক্রমে সমাদৃত হয়েছেন পরবর্তী সময়ে। শক্তিশালী এই সাহিত্যিকের অসামান্য গল্প ‘অবিকল্প’। এটিই এই সংকলনের শ্রেষ্ঠ রচনা। সম্ভবত এই ধারণা সম্পাদকেরও। তাই তিনিও বইয়ের শুরুতেই গল্পটিকে স্থান দিয়েছেন। বেদে-বেদেনির ভুবনে পাঠককে হাত ধরে নিয়ে গিয়েছেন দিবাকর। একটি বাঁশির সুর ও তার সামনে কালসাপের উদ্যত ফণা– জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাওয়া চরাচরের এই দৃশ্যকে স্পষ্ট করে তোলেন লেখক। কথা বলেন পাঠকের সঙ্গে। যে কোনও গল্প সংকলনে হেঁটে হেঁটে ঢুকে পড়বে এই গল্প। যা শেষ করার পরও থেকে যায়। সঙ্গে থাকে।
………………………………………………………..
লুবলুর পৃথিবী। ভাইরাল বাংলা গ্রাফিক নভেল। কেমন হয়েছে? জানুন: এ পৃথিবী ভালোবাসিতে জানে
………………………………………………………..
সংকলনের দ্বিতীয় গল্প দয়মন্তী বসু সিং-এর ‘চতুর্থ পুরুষ’ও চমৎকার। বুদ্ধদেব বসুর কন্যার এই গল্প প্রেমের। আসলে ‘চিরস্থায়ী প্রেম’-এর। একটা চিঠির আকারে, এপিস্টোলারি ধাঁচে উত্তমপুরুষে লেখা এই গল্পের বিষয়বস্তু কি খুব নতুন? তা নয়। তবু লেখনীর চমৎকারিত্ব মুগ্ধ করে। নকশাল আন্দোলন কিংবা হিন্দু তরুণী ও মুসলিম তরুণের প্রেমের মতো বিষয় মিলেমিশে গল্পটিকে প্রিয় করে তোলে।
যশোধরা রায়চৌধুরীর ‘শরণার্থী’ও বেশ ভালো। এই গল্প যখন শুরু হয়, তখন বোঝাই যায় না ইউরোপের পটভূমিতে শুরু হয়ে শেষে এসে কোনদিকে তা বাঁক নেবে। তবে পঠন-অভ্যস্ত পাঠক-চোখ কিছুটা এগনোর পর হয়তো আঁচ করবে। কিন্তু তাতেও গল্পটির ‘ম্যাজিক’ নষ্ট হয় না। আচমকাই দেশভাগ, কাঁটাতার, বিচ্ছেদ এসে দেশকালের ঊর্ধ্বে পাঠককে নিয়ে যেতে চায়। একেবারে শেষের ট্রিটমেন্টের জন্যই আদ্যন্ত স্মার্ট গদ্যে লেখা এই গল্পটি মনে থেকে যাবে।
………………………………………………………..
কলকাতার কাবুলিওয়ালা। গবেষণাগ্রন্থই। কেমন হয়েছে? জানুন: দেশাত্মবোধের গল্প বলে কাবুলিওয়ালা
………………………………………………………..
কৌশিক সেনের কোনও বই পড়িনি। তবে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত লেখাপত্র পড়ে ভালো লেগেছিল। সেই প্রত্যাশা থেকেই শুরু করেছিলাম ‘হিমঘরে একা’। গল্পটি শুরুও হয় দারুণ প্রত্যাশা জাগিয়ে। বর্ণনার চমৎকারিত্বে তিনি অনায়াসে নর্থ ডাকোটার তুন্দ্রা অঞ্চলে নিয়ে চলে যান পাঠককে। এরপর সেখানে ঢুকে পড়ে দুর্ঘটনায় কোমায় চলে যাওয়া এক বছর পঞ্চাশের মহিলা এবং এক ডাক্তার। গল্পে রহস্য প্রবেশ করে। কাহিনি তরতর করে এগলেও শেষটা ঠিক পছন্দ হয় না। কেমন বাণিজ্যিক ছবির ‘হ্যাপি এন্ডিং’ ধাঁচে শেষ হয় গল্পটি।
একই ভাবে গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্যের ‘জিগোলো’ গল্পটি নিয়েও প্রশ্ন জাগে। বেশ সহজ গদ্যে এক পুরুষ যৌনকর্মীর কথা শুনিয়েছেন লেখক। এসেছে তাঁর ‘ক্লায়েন্ট’দের কথাও। কিন্তু ছোটগল্পের যে বহুবিধ গন্তব্য হতে পারে, সেদিকে না গিয়ে গল্পটি কিছুটা প্রত্যাশিত ভাবেই শেষ হয়ে যায়। একেবারে শেষে ‘দু’জনের ছায়া মিলে এক’ হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি অবশ্য বুঝিয়ে দেয় গল্পকারের মুনশিয়ানা। তবু কিছু একটা বাকি থেকে যায় যেন।
………………………………………………………..
যোগেন চৌধুরীর রচনাসমগ্র। বহুকালের লেখালিখি। কেমন সে বই? জানুন: কী আঁকছি, কী লিখছি?
………………………………………………………..
হাসান জাহিদের ‘রাবু, ঘাসফড়িং ও ছায়াবীথির গল্প’টি সুলিখিত। কিন্তু প্লট নেহাতই ক্লিশে। বাল্যপ্রেম থেকে শুরু হয়ে ক্যানসার রোগীর আকুতি পেরিয়ে এই গল্প কোথাও পৌঁছে দেয় না। ভালো লাগে গদ্যের চলন। কিন্তু প্রতিনিধিত্বমূলক সংকলনে কেবল সেটুকুর জোরে স্থান পাওয়াটা আশ্চর্য করে বইকি!
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর ‘অব্যক্ত’ সম্পর্কেও সেই কথাই বলতে ইচ্ছে করে। বছর সাতাশের সুজয় এনজিও-তে কাজ করে। কিন্তু ফান্ডে টাকা না ঢোকায় তার বেতন হচ্ছে না। ঘিয়া নদীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সঙ্গে সাইকেল। এক বৃদ্ধাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার সময় তার আলাপ হয়ে যায় বৃদ্ধার পঞ্চদশী নাতনি রুপুর সঙ্গে। মেয়েটির দেওয়া লাল-হলুদ গাঁদাফুল সুজয়কে স্বপ্ন দেখায়। রুপু যেন কী বলতে চেয়েছিল। বয়সে কিছুটা দূরবর্তী এক কিশোরীর মায়া গল্পের প্রোটাগনিস্টকে মগ্ন করতে থাকে। সে কি প্রেমে পড়ে? এই গল্পের মধ্যে একটা সারল্য আছে। তা ভালো লাগে। কিন্তু বাংলা ছোটগল্পের যে অসামান্য সরণি গত ১০০ বছরে গড়ে উঠেছে, সেখানে দাঁড়িয়ে কেবল এইটুকু প্রাপ্তি ‘যথেষ্ট’ বলে মনে হয় না। বিশেষত এমন এক সংকলনে। সেখানে যেন আরও সংহত শিল্পরূপ প্রত্যাশিত থাকে।
………………………………………………………..
এই সময়ের, টাটকা, ভালো উপন্যাস খুঁজছেন? দেখুন তো পছন্দ কি না: জলরঙে আঁকা উপন্যাস
………………………………………………………..
যা পেয়ে যাই সংকলনের সম্পাদকের কলমে। সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় লিখিত গল্পটির নাম ‘নয়ন জেলের নৌকো’। গল্পের শুরুতে মেঘেদের মিছিলের যে বর্ণনা, তা চমৎকার ও অভিনব! প্রত্যাশা জাগে। যা বজায় থাকে শেষ প্যারাগ্রাফ পর্যন্ত। আদ্যন্ত চমৎকার একটি গল্প। কথক চরিত্র ও তার স্ত্রী মহুয়ার এই আখ্যানে ‘পদে পদে বিস্ময়’! একটা রিনরিনে অস্বস্তি গল্পের আগাগোড়া বজায় থাকে। এবং একেবারে শেষে প্রোটাগনিস্টের যে উৎকণ্ঠা, তা গল্পশেষেও যায় না। সার্থক ছোটগল্প হয়তো এমনই হয়। তা চলতে থাকে শেষ হওয়ার পরও। যার অভিঘাতে পাঠকের রক্ত চলকে উঠতে থাকে।
এই সংকলন ‘বাংলা গল্প-সাহিত্যের ক্রম-বিবর্তনের একটি ঐতিহাসিক দলিল’ বলে দাবি করা হয়েছে ব্লার্বে। পড়তে বসে মনে হচ্ছিল বিপুল সংখ্যক থেকে যখন নেহাতই মুষ্টিমেয় গল্পকে বেছে নেওয়া হল, তখন কী ছিল তার ‘প্যারামিটার’? ভাবতে বসলে মনে হয়, সুখপাঠ্য হওয়াটাই হয়তো প্রাথমিক শর্ত হিসেবে ধরা হয়েছিল। রবিবাসরীয় দুপুরে খাওয়ার পরে যাঁরা সংবাদপত্রের সাময়িকীতে প্রকাশিত গল্পে আরাম খোঁজেন, তাঁদের সপাট টানে লেখা ছোটগল্পই সবচেয়ে পছন্দ। সেই শর্ত এই সংকলনও পূরণ করে। হয়তো সেটাই সম্পাদকের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কোনও কোনও গল্প যেমন শেষের পরও বুকপকেটে ঢুকে পড়ে, সব গল্পে সেই আমেজ নেই। তবু স্মার্ট গদ্যের চলনে আখ্যানপাঠের নরম সুখ যাঁরা চান, তাঁদের হয়তো বেশিরভাগ গল্পই পছন্দ হবে। তবে সেই সঙ্গে এই প্রশ্নও জাগে– সম্পাদক আরেকটু ‘কড়া’ হলেও পারতেন। তাতে সংকলনটি হয়তো কিছুটা ক্ষীণকায় হত। কিন্তু সব শ্রেণির পাঠকের প্রাপ্তির ঝুলিটাই পরিপূর্ণ হত। ছাপা সুন্দর। বানানের খুব বড় ভুল তেমন একটা চোখে পড়ল না।
পরবাস গল্প সংকলন: প্রথম খণ্ড
নির্বাচন ও সম্পাদনা: সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
পরবাস
৩৯৫ টাকা
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved