আমাদের সাদা-কালো দিনের সংগ্রহে রাখার মতো কত যে অনুষ্ঠান হয়েছে। একেবারে শুরুর দিনগুলিতে উদয় শঙ্করের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। অমূল্য সে অনুষ্ঠান এখনও দেখতে পাওয়া যায়। সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেওয়া, সেটি আর দেখতে পাওয়া যায় না। যেমন আর পাওয়া যায় না, ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’, যেখানে সুবিনয় রায় গেয়েছিলেন, ‘এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে…’ অথবা বাংলার বাউলদের নিয়ে করা তথ্যচিত্র।
১৯৮২ সালে অনেকগুলো ঘটনা ঘটে গেল। ১৫ আগস্ট দিল্লি দূরদর্শন রঙিন হল। সে বছরে ১৯ নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিনে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হল এশিয়ান গেমস। এশিয়ান গেমস দিল্লি দূরদর্শন থেকে টেলিকাস্ট করার পরিকল্পনা হল। কিন্তু যতই ১৯৫৯-তে সপ্তাহে দু’দিন এক ঘণ্টার ট্রান্সমিশন এবং ১৯৬৫ থেকে নিয়মিত ট্রান্সমিশনের সূচনা হোক না কেন– সর্বভারতীয় স্তরে সে তখনও নবীন, তাই এটা বেশ একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। এশিয়ান গেমসের মতো বিরাট কর্মযজ্ঞ কভার করার জন্য যে টিম ও পরিকাঠামো দরকার, তা তাদের ছিল না, সেই কারণে বিভিন্ন স্টেশন থেকে বাছাই করা কিছু প্রযোজক ও সহযোগী প্রযোজকদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বলা বাহুল্য, কলকাতা থেকে গেলেন ক্যামেরাম্যান, গ্র্যাফিক আর্টিস্ট-সহ বিশিষ্ট প্রযোজক ও সহকারী প্রযোজকদের বিরাট এক দল। যাঁরা গেলেন তাঁদের জন্য তো বটেই, সমগ্র কলকাতা দূরদর্শনের জন্য বিষয়টি অত্যন্ত সম্মানজনক এবং বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। কিন্তু কলকাতা দূরদর্শনের জন্য যেটি খারাপ ঘটে, সেটি হল মিস্টার শিব শর্মার ডাক এল দিল্লি থেকে, ভারতের টেলিভিশনে এশিয়াডকে সম্প্রচার করার গুরুদায়িত্ব দেওয়া হল তাঁকে। এরপর আর ফিরে আসেননি তিনি। ফলে মাত্র এক বছরের কিছু বেশি সময় আমরা থাকতে পেরেছিলাম তাঁর ছত্রছায়ায়। কলকাতা স্টেশন অমন সজ্জন, ডিসেন্ট এবং গুড অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আর কখনও পায়নি। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিমত।
এশিয়ান গেমস টেলিকাস্ট-এর প্রোডাকশনের ইনচার্জ করা হয় শর্মাজিকে, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ইনচার্জ ছিলেন মিস্টার ভি. ভি. রাও, যিনি বেশ কিছু দিন পুনার ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউটে শিক্ষকতা করেন। এফটিআইআই-এর আরেক প্রাক্তন শিক্ষক মিস্টার জয় চণ্ডীরামও ছিলেন এশিয়ান গেমসের প্রোডাকশন সাইডে। এশিয়ান গেমস দেখতে পাওয়া গিয়েছিল রঙিনে। অভিজিৎ দাশগুপ্ত ছিলেন ওপেনিং এবং ক্লোজিং সেরিমনি সম্প্রচারের নেতৃত্বে। এশিয়াড সম্প্রচারের বিপুল সাফল্যের পর শর্মাজি ‘এশিয়াড জ্যোতি অ্যাওয়ার্ড’ পান। এর দু’এক বছর পরে ‘ডিডিজি’ (Deputy Director General) ও আরও পরে ‘ডিজি’ (Director General) হয়েছিলেন।
রাজধানী থেকে ফিরি নিজের কেন্দ্রে, নিজের কর্মক্ষেত্রে। আগেই বলেছিলাম স্থায়ী পদে তিনজন প্রেজেন্টেশন অ্যানাউন্সার ছিলাম। তার মধ্যে রুমা চ্যাটার্জি চাকরি ছেড়ে বম্বে চলে গেল ওর স্বামীর কর্মস্থলে। রইলাম আমরা দু’জন– চৈতালি-শাশ্বতী, শাশ্বতী-চৈতালি– মানুষজন দুটো নাম একসঙ্গে উচ্চারণ করেন, যেন একই সত্তা।
কত অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে, শম্ভু মিত্রকে রাজি করানো গিয়েছিল অভিনয় শিক্ষার কয়েক পর্বের এক ধারাবাহিকের জন্য, সম্ভবত রবিবার রবিবার সেটা টেলিকাস্ট হত। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর দল নিয়ে এসেছেন, শঙ্খচিলের গান, জন হেনরির গান, ‘বাঁচবো বাঁচবো রে আমরা…’ উদাত্ত কণ্ঠে গাইছেন, আমাদের ওই ছোট্ট স্টুডিও তখন গমগম করছে, এসব শুনেছি, দেখেছি। গানের অনুষ্ঠানের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল, দেখা হত বালসারাজির সঙ্গে– ভি. বালসারা, অত্যন্ত অমায়িক মানুষ। হেমন্তদা, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা আর না-ই বললাম, অমন সদাশিব মানুষ আর দেখলাম কই! সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, উৎপলা সেন– এঁদের মধ্যে নির্মলাদির সঙ্গেই গল্প হত বেশি, ঝরঝর করে কথা বলতেন। ওঁদের অভিজ্ঞতার ঝাঁপি থেকে টুকরো টুকরো ঘটনা শোনার সৌভাগ্য হয়েছে। পরে আরও দু’জন সংগীতশিল্পীর সঙ্গে আমার সুন্দর সম্পর্ক তৈরি হয়, আরতি মুখোপাধ্যায় ও হৈমন্তী শুক্লা। আমার অবসর গ্রহণের পরে যখন আমি মাঝে মাঝে কাজ করতে যাই দূরদর্শনে সেরকম সময় কথায় কথায় অনুষ্ঠানে আরতি মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, প্রাণের মনের অনেক অজানা কথা সেদিন বলেছিলেন ।
আমাদের সাদা-কালো দিনের সংগ্রহে রাখার মতো কত যে অনুষ্ঠান হয়েছে। একেবারে শুরুর দিনগুলিতে উদয় শঙ্করের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। অমূল্য সে অনুষ্ঠান এখনও দেখতে পাওয়া যায়। সত্যজিৎ রায়ের সাক্ষাৎকার শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেওয়া, সেটি আর দেখতে পাওয়া যায় না। যেমন আর পাওয়া যায় না, ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’, যেখানে সুবিনয় রায় গেয়েছিলেন, ‘এমনি করে ঘুরিব দূরে বাহিরে…’ অথবা বাংলার বাউলদের নিয়ে করা তথ্যচিত্র।
এক বিকেলে আমাকে আর শাশ্বতীকে বলা হল পরের দিন আমাদের নিয়ে ট্রায়াল রান হবে, কিছুদিনের মধ্যেই কালার আসবে তারই প্রস্তুতি হিসেবে। শুনে তো আমার মহা আনন্দ, কিন্তু শাশ্বতীর মুখটা চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করি, কী হল। ও বলল, ‘তোর কথা ভাবছি, এবার তুই কী করবি, কখনও তো ম্যাচিং ব্লাউজ দিয়ে শাড়ি পরিস না। যে কোনও শাড়ির সঙ্গে তোর ইচ্ছেমতো ব্লাউজ পরে নিস, সাদাকালোয় অসুবিধে ছিল না, এবার তো রঙে বোঝা যাবে!’ আমি হা হা করে হেসে উঠি, বলি, ‘আরে দেখোই না, যা-ই পরি না কেন, সেটা ক্যারি করতে পারাই আসল কথা, তুমি চিন্তা কোরো না।’
পরদিন দুপুরে আমাদের যিনি ইএনসি (Engineering in Charge) তাঁর ঘরে ট্রায়াল রান হল। আমি পরেছিলাম, কালচে লাল শাড়ির সঙ্গে গাঢ় নীল ব্লাউজ। শাশ্বতী পরেছিল হালকা নীল রঙের শাড়ির সঙ্গে হুবহু ম্যাচিং ব্লাউজ। যখন মনিটরে ছবি দেখান হল, ও আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, ‘কেয়া, তোর ছবিটাই তো বেশি ভালো দেখাচ্ছে। আমার ছবির চেয়ে অনেক বেশি ব্রাইট।’ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলি,‘ তাই তো আমি কাল তোমায় বলেছিলাম চিন্তা করো না কারণ ছবিতে কী ভালো লাগবে সে ব্যাপারে আমি হানড্রেড পার্সেন্ট সিওর ছিলাম।’ সেদিন আরেকটা কথা বলেছিলাম যা আজ সত্য, ‘এই কন্ট্রাস্ট পরাটাই একদিন ফ্যাশন হয়ে উঠবে, দেখে নিও।’ আজকাল মাঝে মাঝে ওকেও দেখি, ঢাকাই শাড়ির সঙ্গে প্রিন্টেড ব্লাউজ পরতে।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved