যদি আমরা ভাবি ব্রহ্ম কোনও একটি অনির্দেশ্য অনন্তের মধ্যে পূর্ণ হয়ে আছেন, তাহলে আমাদের মনে হয়, আমাদের কেবল-চলার কোনও পরিসমাপ্তি নেই, কোনও স্থিতি নেই। যদি ঠিকমত জানি যে তিনি আমাদেরই অন্তরাকাশে আমাদেরই অন্তরাত্মায় ‘সত্যং জ্ঞানমনন্তং’ রূপে সুগভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত আছেন, তাহলেই পরিপূর্ণতার উপলব্ধিতে আমরা স্থির হতে পারি, বাসনা তখন আর বৃথা আমাদের ঘুরিয়ে মারে না। সংসার আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু ব্রহ্ম আমাদের মধ্যেই আছেন।
১৪.
বৈশাখ মাসে বিয়েবাড়ির প্রচুর নিমন্ত্রণের খুশির মধ্যে একটি স্বাস্থ্যকর সামঞ্জস্যের কথা মনে আসে। যে বয়সে খাবার লোভটা বেশি ছিল, নিমন্ত্রণের সংখ্যা থাকত কম। এখন শরীরের আহার গ্রহণের সাধ ও সাধ্য দুই-ই যখন কমেছে, নিমন্ত্রণের সংখ্যা বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই তাঁদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে কৈশোরের একজন শিক্ষককে স্মরণ করেন, স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দে অথবা দায়িত্ববোধের তাগিদে। যাঁরা মনে রাখেন না, তাঁদের সংখ্যা স্বভাবতই স্বাস্থ্যকরভাবে অনেক বেশি। বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে বর অথবা বধূর সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে সাক্ষাতের বাড়তি আনন্দে প্রফুল্ল হয় মন, আর, আহার গ্রহণের সময় অবধারিত মনে হয় ‘বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে’। ভাগ্যিস খাবার ইচ্ছেটা কমেছে, শরীরের ওপর কি অত্যাচার হত তা না হলে।
গত সপ্তাহে উপাসনাগৃহে ‘জন্মোৎসব’ অভিভাষণ আলোচনা করেছিলাম, এ সপ্তাহে বেছে নিলাম ‘পরিণয়’। বুঝতে চাইলাম কেন রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘পরিণয় তো সমাপ্তই হয়ে গেছে, সেখানে আর কোনো কথা নেই। এখন কেবল অনন্ত প্রেমের লীলা।’
আমরা নিয়ত দেখছি, চারিদিকে সংসারে সৃষ্টির খেলা চলেছে অবিরাম। ক্রমাগত ব্যাপ্তি থেকে সংহতি, আবার সংহতি থেকে ব্যাপ্তি। ক্রমাগত আঘাত থেকে প্রতিঘাতে, রূপ থেকে রূপান্তরে সবকিছুই সমানে একটা কোনও পরিণতির দিকে চলছেই, অথচ এই চলার কোথাও শেষ হচ্ছে না। আমাদের শরীর-মন-বুদ্ধিও প্রকৃতির এই চক্রাকার পথেই ঘুরে চলেছে। বাড়া-কমা, যোগ-বিয়োগে এক অবস্থা থেকে আর এক অবস্থায় ক্রমাগত তার চলা। যেভাবে অগণিত গ্রহ-নক্ষত্র কেবলই চলেছে, আমরা মানুষেরাও যেন সেই অনন্ত পথে কেবল চলছি। মনে হচ্ছে, কোথাও একটা পৌঁছনোর আছে কিন্তু কোনওকালেই পৌঁছতে পারছি না। রবীন্দ্রনাথের মনে তাই প্রশ্ন জাগছে, ‘আমাদের অস্তিত্বই কি এইরকম অবিশ্রাম চলা, এইরকম অনন্ত সন্ধান? এর মধ্যে কোথাও কোনোরকম প্রাপ্তির, কোনোরকম স্থিতির তত্ত্ব নেই?’ উত্তর খুঁজে নিচ্ছেন নিজেই। বলছেন, ‘ব্রহ্মকেই পাওয়া যায়, সংসারকে পাওয়া যায় না।’
সংসারের তত্ত্বই হচ্ছে সরে যাওয়া, তাকে চরমভাবে পাওয়ার চেষ্টা করলে কেবল দুঃখই পেতে হয়। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া, পেটে অথবা মনে নানা খিদের চাবুক খেয়ে ছুটেই মরি, ছুটতে না পারলে আস্তাবলেও নয়, সোজা ভাগাড়ে হয় ঠাঁই। ‘পাওয়ার তত্ত্ব কেবল একমাত্র ব্রহ্মেই আছে। কেননা তিনিই হচ্ছেন সত্য।’
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আমাদের মধ্যেই একটি নিত্যধাম আছে। সেখানে দেশকালের রাজত্ব নয়, সেখানে ক্রমসৃষ্টির পালা নেই। সেই অন্তরাত্মার নিত্যধামে পরমাত্মার পূর্ণ আবির্ভাব পরিসমাপ্ত হয়েই আছে। তাই উপনিষৎ বলছেন– সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম যো বেদ নিহিতাং গুহায়াং পরমে বোমন্ সোহশ্লতে সর্বান্ কামান, সহ ব্রহ্মণা বিপশ্চিতা। সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যোম, যে পরম ব্যোম, যে চিদাকাশ, অন্তরাকাশ, সেইখানে আত্মর মধ্যে যিনি সত্যজ্ঞান ও অনন্তস্বরূপ পরব্রহ্মাকে গভীরভাবে অবস্থিত জানেন, তার সমস্ত বাসনা পরিপূর্ণ হয়।’
…………………………………………………………………………………………………
সংসারের তত্ত্বই হচ্ছে সরে যাওয়া, তাকে চরমভাবে পাওয়ার চেষ্টা করলে কেবল দুঃখই পেতে হয়। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া, পেটে অথবা মনে নানা খিদের চাবুক খেয়ে ছুটেই মরি, ছুটতে না পারলে আস্তাবলেও নয়, সোজা ভাগাড়ে হয় ঠাঁই। ‘পাওয়ার তত্ত্ব কেবল একমাত্র ব্রহ্মেই আছে। কেননা তিনিই হচ্ছেন সত্য।’
…………………………………………………………………………………………………
যদি আমরা ভাবি ব্রহ্ম কোনও একটি অনির্দেশ্য অনন্তের মধ্যে পূর্ণ হয়ে আছেন, তাহলে আমাদের মনে হয়, আমাদের কেবল-চলার কোনও পরিসমাপ্তি নেই, কোনও স্থিতি নেই। যদি ঠিকমতো জানি যে, তিনি আমাদেরই অন্তরাকাশে আমাদেরই অন্তরাত্মায় ‘সত্যং জ্ঞানমনন্তং’ রূপে সুগভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত আছেন, তাহলেই পরিপূর্ণতার উপলব্ধিতে আমরা স্থির হতে পারি, বাসনা তখন আর বৃথা আমাদের ঘুরিয়ে মারে না। সংসার আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু ব্রহ্ম আমাদের মধ্যেই আছেন। তাই সংসারকে আমরা কোনওভাবেই পেতে পারি না, কিন্তু ব্রহ্মকে আমরা পেয়ে বসে আছি।
‘পরমাত্মা আমাদের আত্মাকে বরণ করে নিয়েছেন– তাঁর সঙ্গে এর পরিণয় একেবারে সমাধা হয়ে গেছে। তার আর কোনোকিছু বাকি নেই, কেননা তিনি একে স্বয়ং বরণ করেছেন। কোন্ অনাদিকালে সেই পরিণয়ের মন্ত্র পড়া হয়ে গেছে। বলা হয়ে গেছে– যদেতৎ হৃদয়ং মম তদন্তু হৃদয়ং তব। এর মধ্যে আর ক্রমাভিব্যক্তির পৌরোহিত্য নেই।’ এই উপলব্ধি থেকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘পরিণয় তো সমাপ্তই হয়ে গেছে, সেখানে আর কোনো কথা নেই। এখন কেবল অনন্ত প্রেমের লীলা।’
চিরদিনের জন্য যে বরকে পাওয়া হয়েই গেছে, তাঁকেই আবার হারিয়ে হারিয়ে পাচ্ছি, নানা রসে পাচ্ছি। সুখে দুঃখে, বিপদে সম্পদে, লোকে লোকান্তরে। যতক্ষণ ঘোমটা খুলে বরকে না দেখি, কেবল বরের সংসারটাই দেখি, ততক্ষণ যেখানে আমাদের রানির পদ, সেখানে দাসী হয়ে থাকি। ভয়ে মরি, দুঃখে কাঁদি।
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৩। জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতা খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব