উপার্জনের মানসিকতা নিয়ে তো আমি– আমি কেন আমরা অনেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নে যাইনি। আমার তো মনে আছে মাসের রোজগার অনেক সময় শূন্য সত্ত্বেও আমরা দিব্যি হাসতে হাসতে সদলবলে অফিসের পাশেই ক্রিমিয়া কাফেতে (তার অনতিদূরেই ক্রিমিয়া সেতু, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর প্রতিরোধ করার জন্য ব্যারিকেড তৈরি হয়েছিল) গিয়ে, গ্রীষ্মকাল হলে সেখানকার লনে ছাতার তলায় বসে দিব্যি নিশ্চিন্ত মনে কনিয়াক খেতাম– না, কোনও কোটিপতির ঘাড় ভেঙে নয়, যে শূন্য পেয়েছে সেও এই খরচের ভাগ সমান বহন করত।
অরুণ সোম
২১.
সোভিয়েত ইউনিয়নের কোটিপতিরা
‘ফুরনের কাজ’-এ রোজগারের সুবাদে আমরা বিষ্ণুদাকে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নের কোটিপতি’ বলতাম। কথাটা, আমার যতদূর মনে হয়, প্রাথমিকভাবে রুশিরাই রটিয়েছিল, কেননা এমনিতেই সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুবাদকরা যে-পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের খুব কম লোকেরই সেই সুযোগ ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম, ফুরনের কাজ। আমাদের ‘মাইনে’ বলতে কিছু ছিল না, কাজও আমরা করতাম বাড়িতে বসে, অনুবাদের পাণ্ডুলিপি যিনি মূল রুশের সঙ্গে মেলাতেন, সেই রুশ সম্পাদকের সঙ্গে বসে অনুবাদ সংশোধন ও পরিমার্জনার জন্য মাসে এক-আধবার অফিসে যেতে হত, এছাড়া মাসে দু’দিন– মাসের ৪ ও ১৯ তারিখে অবশ্যই যেতে হত। ৪ তারিখে মাসের রোজগারের টাকা থেকে কিছুটা আগাম দেওয়া হত, ১৯ তারিখে আগাম থেকে কেটে নিয়ে রোজগারের বাকি টাকাটা দেওয়া হত। আমাদের কাউকে কাউকে অনেক সময় মাসের টাকা বুঝে নিতে গিয়ে খালি হাতে ফিরে যেতে হয়েছে– এমনকী, কোনও কোনও সময় এ-ও দেখা গিয়েছে যে, আগাম নেওয়ার ফলে উল্টে প্রকাশন সংস্থার কাছে অনুবাদকই ঋণী হয়ে বসে আছে।
কিন্তু এই পাওয়া-না-পাওয়াও বা কম-বেশি রোজগার নিয়ে অনুবাদকদের মধ্যে যে রেষারেষি ছিল বা কারও মনে কখনও ঈর্ষার উদ্রেক হত, এমনটি আমার কখনও মনে হয়নি। কখন-সখন দ্বিজেনদা (দ্বিজেন শর্মা) হয়তো ঠাট্টা করে বলেছেন, ‘চল কোটিপতি বিষ্ণুদার বাড়ি গিয়ে ওঁর ঘাড় ভেঙে কনিয়াক খাওয়া যাক।’ কিন্তু সে তো নিছকই ঠাট্টা– কনিয়াক তো আমরা আমাদের নিজের পয়সাতেই খেতে পারতাম। অথচ মঙ্গলদার একটা লেখাতে দেখলাম, ‘গত অক্টোবর মাসে আমার মোট রোজগার হয়েছিল ৫২৫ রুবল (টাকায় রুবলের Exchange Rate হল ৯.৫ টাকায় এক রুবল)। দেখে অরুণ সোম ভদ্রলোক তো রীতিমতো ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠলেন, রটাতে লাগলেন আমি নাকি সোভিয়েত দেশের কোটিপতি হতে যাচ্ছি’ (‘মস্কোর দিনগুলি’: ঊর্মিলা চট্টোপাধ্যায়, পৃ. ৬০, সপ্তাহ পাবলিকেশনস, ২০০৭) (বাঁকা হরফ আমার)। ঈর্ষা কেন হতে যাবে? তাহলে কি ননীদা আমাকে ঈর্ষা করে কোটিপতি হব বলেছিলেন?
উপার্জনের মানসিকতা নিয়ে তো আমি– আমি কেন আমরা অনেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নে যাইনি। আমার তো মনে আছে মাসের রোজগার অনেক সময় শূন্য সত্ত্বেও আমরা দিব্যি হাসতে হাসতে সদলবলে অফিসের পাশেই ক্রিমিয়া কাফেতে (তার অনতিদূরেই ক্রিমিয়া সেতু, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর প্রতিরোধ করার জন্য ব্যারিকেড তৈরি হয়েছিল) গিয়ে, গ্রীষ্মকাল হলে সেখানকার লনে ছাতার তলায় বসে দিব্যি নিশ্চিন্ত মনে কনিয়াক খেতাম– না, কোনও কোটিপতির ঘাড় ভেঙে নয়, যে শূন্য পেয়েছে সে-ও এই খরচের ভাগ সমান বহন করত। আর সেই সময় ননীদা থাকলে (ননীদা বা বিষ্ণুদা অবশ্য বেশিরভাগ সময়ই থাকতেন না– ওঁদের টাকাটা অন্য কেউ তুলে বাড়িতে দিয়ে আসতেন, ননীদারটা তো সভেত্লানাই তুলতেন।) তো কথাই ছিল না– ‘কোটিপতি’ হোন বা ‘ফকির’ই হোন, তখন তিনিই আমাদেরকে আপ্যায়ন করতেন।
অবশ্য কোটিপতি হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা এবং তার প্রতি চরম ঔদাসীন্য ও তার পরিণতি– এই দুয়েরই দৃষ্টান্ত আমি পরবর্তীকালে মস্কোয় আমার কর্মজীবনে আমাদের দু’জন সহকর্মীর মধ্যে দেখেছি। প্রথমজন ছিলেন ‘প্রগতি’র হিন্দি বিভাগের জনৈক সহকর্মী। শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে নজর না দিয়ে প্রচুর খেটে এক বছরের মধ্যে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে দামি দামি আসবাবপত্র আর কার্পেট দিয়ে ঘর সাজালেন, কিন্তু দু’বছরের মাথায় মারাত্মক ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ওখানেই দেহরক্ষা করলেন। দ্বিতীয়জন আমাদের বাংলা বিভাগেরই সহকর্মী খালেদ চৌধুরী। তিনি আর দ্বিজেন শর্মা একই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন অনুবাদকের কাজে যোগ দিতে। উনি একজন স্বশিক্ষিত মানুষ, অসাধারণ পণ্ডিত, আর সবচেয়ে বড় কথা দারুণ আড্ডাবাজ! আড্ডা বসলে তিনিই হতেন তার মধ্যমণি। বাংলাদেশে আড্ডাবাজদের মহলে উনি ‘প্রভু’ বলে পরিচিত ছিলেন। অন্যেরা কাজকর্ম সেরে তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে আসতেন, কিন্তু তাঁর নিজের আড্ডার কোনও সময়-অসময় ছিল না। ফলে অনুবাদের কাজ আর এগোয় না। কিন্তু ‘প্রগতি’তে ও ফুরনের কাজ তাই রোজগারপাতি বন্ধ হওয়ার মুখে। ‘প্রগতি’র অনুবাদকরা অন্য আরও কয়েকটি প্রকাশ ভবনেও অনুবাদকের কাজ করতেন, যেহেতু সেসব জায়গায় বাঁধা ধরা কোনও অনুবাদক বা সম্পাদক রাখার ব্যবস্থা ছিল না। এইরকম একটি প্রতিষ্ঠান ছিল ‘সোভিয়েত নারী’ পত্রিকা। পত্রিকাটির বাংলা অনুবাদ সম্পাদনার কাজ ননী ভৌমিক করে আসছিলেন, তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সে কাজ খালেদ চৌধুরীকে ছেড়ে দিলেন (পরবর্তীকালে কাজের দায়িত্ব আমি পেয়েছিলাম)। এতেই স্ত্রী আর দুই শিশুসন্তান নিয়ে তার পরিবার দিব্যি চলছিল। আসরও জমজমাট।
কিন্তু ‘প্রগতি’ তা শুনবে কেন? সেখানে যে যত কম কাজই করুক না কেন, নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ কাজ তাকে দিতেই হত– তা নইলে প্রকাশন সংস্থার পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যেত। ওরা যাকে কালেকটিভ বলত, সেই পুরো কর্মী দলকেই এর জন্য খেসারত দিতে হত। ফলে তাঁর তিন বছরের কাজের মেয়াদ শেষ হতে ‘প্রগতি’ তাঁর চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে রাজি হল না, আরও কিছুদিন তিনি সেখানে সে দেশের অতিথি হয়ে কাটলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মস্কোর আসর ছেড়ে দিয়ে তাঁকে দেশে ফিরে যেতে হল।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি
দু’জন মানুষ– একজন রাষ্ট্রের প্রধান, আর একজন বিজনেস টাইকুন– যিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পর্যন্ত নন, তাঁদের সিদ্ধান্তে গত দু’-তিন সপ্তাহে এত মানুষের চাকরি চলে যাচ্ছে, এত সংস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এত গুরুত্বপূর্ণ কাজ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যে, হিসাব রাখা যাচ্ছে না।