রবীন্দ্রনাথ বলছেন পরমাত্মার ধর্মই আত্মারও ধর্ম। সর্বলোকে আপনাকে পরিকীর্ণ করা। পরমাত্মার পাপের বাধা নেই, তাই সর্বত্রই তাঁর প্রবেশ। আমাদের পাপ আছে, পাপের বন্ধন মোচন করাই তাই আমাদের আত্মার প্রার্থনা। এই প্রার্থনা সমস্ত ফুলের কুঁড়িতে, কচি পাতায়, বিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে যুগযুগান্তর ধরে অনুরণিত হয়ে চলেছে, আমাকে প্রকাশ করো।
২১.
ধর্মীয় প্রচারের প্রাবল্য বাড়ছে বলে মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। কোনও কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের প্রচেষ্টা বেশি চোখে পড়ে। ধর্মীয় প্রচারের মধ্যে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা জারির প্রবণতা দেখলে রবীন্দ্রনাথের একটি অভিভাষণের কথা মনে পড়ে, ‘সেরকম ভাবে প্রচার করলে মনে হয় যেন ঈশ্বর কতকগুলি নিজের ইচ্ছামত আইন করে দিয়েছেন, সেই আইনগুলি লঙ্ঘন করলে বিশ্বরাজের কোপে পড়তে হবে। সে কথাটাকে এইরূপ ক্ষুদ্র ও কৃত্রিম ভাবে মানতে পারি নে।’ এই উক্তি উপাসনাগৃহে ‘আদেশ’ শীর্ষক অভিভাষণে। তাঁর উপলব্ধি, ‘তিনি কোনো বিশেষ আদেশ জানান নি, কেবল তাঁর একটি আদেশ তিনি ঘোষণা করেছেন, সমস্ত বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের উপরে তাঁর সেই আদেশ– সেই একমাত্র আদেশ। তিনি কেবলমাত্র বলেছেন, ‘প্রকাশিত হও। সূর্যকেও তাই বলেছেন, পৃথিবীকেও তাই বলেছেন, মানুষকেও তাই বলেছেন। সূর্য তাই জ্যোতির্ময় হয়েছে, পৃথিবী তাই জীবধাত্রী হয়েছে, মানুষকেও তাই আত্মাকে প্রকাশ করতে হবে।’
প্রকাশিত হওয়ার এই আদেশ যেখানেই বাধা পায়, বিশ্বজগতের যে কোনও প্রান্তেই হোক, সেখানেই বন্ধনের বিকার বিনাশের কারণ হয়ে ওঠে। ফুল ফুটে ওঠার কথা ভুলে কুঁড়িতেই শুকিয়ে যায়। নদীর স্রোত শ্যাওলা আবর্জনায় রুদ্ধ হয়ে সমুদ্রে পৌঁছনোর পথ হারিয়ে ফেলে। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে, ধর্মশাস্ত্রে যে বিভিন্ন কাজ না করার উল্লেখ থাকে, সেগুলি এই প্রকাশিত হওয়ার আদেশটিকে বাধামুক্ত করার জন্যই। বুদ্ধদেবের কথা উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ব্যাধি-জরা-মৃত্যু আকীর্ণ দুঃখের যে কারণ তাঁর ধ্যানে খুঁজে পেয়ে বুদ্ধদেব আনন্দিত হয়েছিলেন, সে-ও এই আদেশেরই সত্য। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মানুষ আত্মাকে উপলব্ধি করলেই, আত্মাকে প্রকাশ করলেই মুক্তিলাভ করে। সেই প্রকাশের বাধাতেই তার দুঃখ।
এই প্রকাশের বাধা দূর করার জন্যই তিনি শীল গ্রহণের উপদেশ দিলেন। লোভ হিংসা বিলাসের যে আবরণ আত্মার প্রকাশের বাধা হয়ে থাকে, প্রতিদিনের নিয়ত অভ্যাসে সেগুলি মোচন করে ফেলার জন্য। এই আবরণগুলি মোচন হলেই আত্মা নিজের বিশুদ্ধ স্বরূপ লাভ করতে পারে। আত্মার সেই স্বরূপটি কিন্তু শূন্যতা নয়, নৈষ্কর্ম নয়। সে স্বরূপটি নিখিলের প্রতি প্রেম। মৈত্রী করুণায় পরিপূর্ণ এই প্রেমের বিস্তারেই আত্মা নিজের স্বরূপকে পেতে পারে, সূর্য যেমন আলো বিকীর্ণ করেই নিজের স্বরূপকে পায়।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন পরমাত্মার ধর্মই আত্মারও ধর্ম। সর্বলোকে আপনাকে পরিকীর্ণ করা। পরমাত্মার পাপের বাধা নেই, তাই সর্বত্রই তাঁর প্রবেশ। আমাদের পাপ আছে, পাপের বন্ধন মোচন করাই তাই আমাদের আত্মার প্রার্থনা। এই প্রার্থনা সমস্ত ফুলের কুঁড়িতে, কচি পাতায়, বিশ্বের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে যুগযুগান্তর ধরে অনুরণিত হয়ে চলেছে, আমাকে প্রকাশ করো। মানবাত্মার এই চিরন্তন প্রার্থনা উচ্চারিত হয়েছে মৈত্রেয়ীর প্রার্থনাতেও, আমাকে প্রকাশ করো। আমি অসত্যে আচ্ছন্ন, আমাকে সত্যে প্রকাশ করো। আমি অন্ধকারে আবিষ্ট, আমাকে জ্যোতিতে প্রকাশ করো। আমি মৃত্যুর দ্বারা আবিষ্ট, আমাকে অমৃতে প্রকাশ করো। হে আবিঃ, হে পরিপূর্ণ প্রকাশ, তোমার মধ্যেই আমার প্রকাশ হোক, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ কোনও বাধা না পাক।
প্রকাশের বাধা মুক্ত হলে আমরা পরমাত্মার স্বভাবটি লাভ করতে পারব। মনের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে, মনের অধীশ্বর হব। আপন আত্মার যে সত্য নির্মল আলো, সমস্ত চিন্তায়, বাক্যে, কর্মে সেই আলো প্রকাশ পাবে, লোভের ক্ষোভে সে আলো ঢাকা পড়বে না। অভিভাষণের শেষ বাক্যটি হল, ‘বুদ্ধ সমস্ত মানবের হয়ে নিজের জীবনে এই পরিপূর্ণ প্রকাশের প্রার্থনাই করেছিলেন– এ ছাড়া মানুষের আর দ্বিতীয় কোনো প্রার্থনাই নেই।’
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২০। ভিতরের সাধনা আরম্ভ হলে বাইরে তার কিছু লক্ষণ টের পাওয়া যায়
পর্ব ১৯। মানুষের পক্ষে মানুষ হয়ে ওঠা সব থেকে কঠিন
পর্ব ১৮। যে হৃদয় প্রীতিতে কোমল, দুঃখের আগুন তাকেই আগে দগ্ধ করে
পর্ব ১৭। সাধনায় সাফল্যের আভাস মিললে সেই পথচলা সহজ হয়
পর্ব ১৬। প্রকৃতি ব্যক্তিবিশেষ মানে না, তার কাছে সকলে সমান
পর্ব ১৫। যিনি অসীম তিনি সীমার আকর হয়ে উঠেছেন ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা
পর্ব ১৪। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া
পর্ব ১৩। জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতা খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব
আমাকে মাঝে মাঝে বম্বে ডাইং-এর ফ্যাক্টরিতে পাঠাতেন মিসেস ওয়াড়িয়া। তোয়ালে, বিছানা চাদর, বালিশের ওয়াড় এমনকী, লুঙ্গিরও ডিজাইন। শিল্পের এই বিচিত্র ব্যবহার ভুলব না। লোকে বলে, ফ্যাশন ধনীদের জন্য। আসলে সমস্ত কিছুই শেষ পর্যন্ত চাপানো হয় দরিদ্র শ্রেণি আর সাধারণ নাগরিকের ঘাড়ে।