শচীন-বিরাট পর্ব পেরিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট আবার নতুন ভোরের দ্বারপ্রান্তে। সেই উদিত সূর্যের প্রতীক হয়ে ভাস্বর শুভমান, যশস্বীর মতো নতুন জ্যোতিষ্ক। সিমিং উইকেটে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে তাঁদের ব্রহ্মাস্ত্র একটাই– ভয়ডরহীন ক্রিকেট। ইংল্যান্ডে ভারতীয় দল মুখ থুবড়ে পড়বে– সেই রসালো চর্চা আপাতত গিল, যশস্বীদের ব্যাটিংবিক্রমে হিমঘরে। গিল, জয়সওয়ালদের এই ভারত আসলে ‘বোল্ড জেনারেশন’। আত্মসমর্পণ নয়, অর্জন করতে এসেছে।
২২.
দেখতে দেখতে একযুগ। ২০১৩ থেকে ২০২৫– এক যুগই তো বটে। এই দ্বাদশ বর্ষে কতই না পরিবর্তনের ঢেউ, এই সমাজ, সংসারে। সেই উজানস্রোতে সবচেয়ে বেশি হয়তো আর্দ্র হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট। কত পালাবদলের মধ্যে দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট আজও রত্নগর্ভা। আজও গৌরবান্বিত।
বছর বারো আগে ফিরে গেলে বিশ্বের যেকোনও প্রান্তে ভারতীয় দল টেস্টে খেলতে নামলে দেখা যেত দৃশ্যটা। চিরাচরিত দৃশ্য। ভারতের প্রথম দ্বিতীয় উইকেটের পতন মানেই সেই দৃশ্য অবশ্যম্ভাবী। ড্রেসিংরুমের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসছেন এক ক্রিকেটসাধক। যেন ব্রাহ্মমুহূর্ত সমাগত। ঐশ্বরিক এক আবির্ভাব। যা দেখার আশায় গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ। আকুতি আর উল্লাস মিলেমিশে তৈরি হচ্ছে এক আবেগঘন মুহূর্ত। ব্যাট হাতে শচীন তেণ্ডুলকর। যেন ভক্তের তৃষ্ণা মেটাতে যেন আবির্ভূত হয়েছেন ঈশ্বর! ম্যাথু হেডেন, সেই ভিনদেশি তারাও যেন উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটে ধ্রুবসত্যকে– ‘আই হ্যাভ সিন গড। হি ব্যাটস অ্যাট নাম্বার ফোর ফর ইন্ডিয়া।’
২০১৩-র শীতকাতর ডিসেম্বর। জোহানেসবার্গ। ভারত ২৪/২। গ্যালারির চোখ সেই ড্রেসিংরুমে। আশা একটাই– পরিত্রাতা হয়ে দেখা দেবেন তিনি। ড্রেসিংরুমের দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসবেন, ধাপে ধাপে সিঁড়ি-পথ পেরিয়ে পা রাখবেন সবুজ ঘাসে। বিচরণ করবেন স্বমহিমায়। এলেন তিনি, কিন্তু শচীন নন। এক তরুণ তুর্কি! চোখে যাঁর আগুন। শরীরে জেতার খিদে, নিশ্বাসে আগ্রাসন। যে ডেল স্টেইন, মর্নি মর্কেলদের আগুনে স্পেলের সামনে এতক্ষণ খাবি খাচ্ছিলেন ভারতীয় ওপেনাররা, তাদেরকে মাঠের বাইরে হেলায় ছুঁড়ে ফেললেন চিরাচরিত পুল, সাহসী কভার ড্রাইভে। ভারতীয় দর্শক আচমকাই আবিষ্কার করল, ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন যুগ সমাগত। শচীন তেণ্ডুলকর অবসর নিয়েছেন। বিপন্ন ভারতকে উদ্ধার করতে আর ২২ গজে দেখা যাবে না ‘মাস্টার ব্লাস্টার’-কে। তাহলে শচীনোত্তর যুগে কে সামলাবে গুরু দায়িত্ব? চার নম্বরে ভরসার স্তম্ভ হবেন কে? জোহানেসবার্গে চাবুক হাঁকড়ানো প্রতিস্পর্ধায় নিজ উপস্থিতিতে এক তরুণ বুঝিয়ে দিয়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটে নতুন সূর্যের উদয় আসন্ন। তিনি বিরাট কোহলি!
এক যুগ পর আবার সেই পরিস্থিতি। এবারও বিদেশের মাটি। দক্ষিণ আফ্রিকার বদলে এবার ইংল্যান্ড। বিরাট কোহলি অবসর নিয়েছেন। অবসর নিয়েছেন রোহিত শর্মা। একটা যুগ ফুরিয়ে গেছে দেখতে দেখতে। সেই ক্রান্তিলগ্নে বিলেত-সফরে ভারতীয় টেস্ট টিম। আনকোরা এক ভারতীয় দল। যা দেখে গ্রেম সোয়ানের মতো প্রাক্তন তারকা টিপ্পনি জুড়তে ছাড়েননি, ‘অ্যাসেজ প্রস্তুতির জন্য এটাই ইংল্যান্ডের সেরা সুযোগ।’ ভারতীয় দল ধারেভারে এতটাই ক্ষীণ! এতটাই ন্যুব্জ? ২২ গজে ন্যূনতম প্রতিরোধের ক্ষমতা কি তাদের নেই? সেই অপ্রিয় প্রশ্নগুলোকে লক্ষ্য করে জ্যা-মুক্ত তীরের মতো ছুটছিল একটা ছেলে। অবাধ্য সেই ছুট, বাধাহীন। গর্বিত স্পর্ধায় মোড়া শরীরী ভাষায় আধিপত্যের ছাপ, যেন ফুটে বের হচ্ছিল এক নতুন ভারত। দুঃসাহসিক মনোভাব যাঁদের পরিচয়। যশস্বী জয়সওয়ালের মতো আগ্রাসী মনোভাব শুভমান গিলের পরিচয় নয়। তবে তিনি যে আগ্রাসী, তা স্পষ্ট ভারত অধিনায়কের স্থিতধী ব্যাটিং-প্রজ্ঞায়। শতরানের পর চিরাচরিত হেলমেট খুলে অভিবাদন শুধু নয়, যে ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল তাঁর গলায়, তাতে ভারতীয় ক্রিকেটমহল একবাক্যে মানবে– বিরাটের ছেড়ে যাওয়া চার নম্বর স্থান সুযোগ্যের হাতে সমর্পিত।
শচীন-বিরাট পর্ব পেরিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট আবার নতুন ভোরের দ্বারপ্রান্তে। সেই উদিত সূর্যের প্রতীক হয়ে ভাস্বর শুভমান, যশস্বীর মতো নতুন জ্যোতিষ্ক। সিমিং উইকেটে প্রতিপক্ষকে গুঁড়িয়ে দিতে তাঁদের ব্রহ্মাস্ত্র একটাই– ভয়ডরহীন ক্রিকেট। ইংল্যান্ডে ভারতীয় দল মুখ থুবড়ে পড়বে– সেই রসালো চর্চা আপাতত গিল, যশস্বীদের ব্যাটিংবিক্রমে হিমঘরে। গিল, জয়সওয়ালদের এই ভারত আসলে ‘বোল্ড জেনারেশন’। আত্মসমর্পণ নয়, অর্জন করতে এসেছে। লিডসে যশস্বী-শুভমান-পন্থ ত্রয়ী শতরান উসকে দিয়েছে ২৩ বছর আগে ২০০২-এর স্মৃতি। যে মঞ্চে সেঞ্চুরি করে ভারতের জয়ের পথ প্রশস্ত করেছিলেন শচীন-রাহুল-সৌরভ।
প্রজন্ম বদলায়। ব্যাটনও। ভারতীয় ক্রিকেটে এখন সেই ‘ট্রানজিশন পিরিয়ড’।
শচীন নেই। বিরাট নেই। তো কী হয়েছে! যশস্বী আছেন। শুভমান আছেন। বোল্ড ইন্ডিয়া আছে। ভয়কে জয় করার মন্ত্রগুপ্তি তাঁদের নখদর্পণে!
…………………… পড়ুন ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব …………………….
পর্ব ২১: কিং কোহলি দেখালেন, ধৈর্যের ফল বিরাট হয়
পর্ব ২০: মনকে শক্ত করো টেস্ট, রাজা আর ফিরবেন না
পর্ব ১৯: মুকুল কিংবা ফিলিস্তিনি বালক, খুঁজে চলেছে যে যার ঘর
পর্ব ১৮: ধোনিবাদ: ধাঁধার চেয়েও জটিল তুমি…
পর্ব ১৭: সাদা সাদা কালা কালা
পর্ব ১৬: গতবারের বিক্রি প্রতিবারই ছাপিয়ে যায় বইমেলা, কারণ দামবৃদ্ধি না পাঠকবৃদ্ধি?
পর্ব ১৫: সেন ‘মায়েস্ত্রো’কে ভুলে বাঙালি দেখিয়েছে, সে আজও আত্মবিস্মৃত
পর্ব ১৪: শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসই বাঙালির প্রকৃত সান্তা
পর্ব ১৩: প্রবাসে, দোতলা বাসে, কলকাতা ফিরে আসে
পর্ব ১২: না-দেখা সেই একটি শিশিরবিন্দু
পর্ব ১১: ঘোর শত্রুর বিদায়বেলায় এভাবে বলতে আছে রজার ফেডেরার?
পর্ব ১০: অভিধানের যে শব্দটা সবচেয়ে বেশি মনুষ্যরূপ ধারণ করেছে
পর্ব ৯: জোট-অঙ্কে ভোট-রঙ্গ
পর্ব ৮: দক্ষিণ বিসর্জন জানে, উত্তর জানে বিসর্জন শেষের আগমনী
পর্ব ৭: পুজো এলেই ‘সর্বজনীন’ নতুবা নিঃসঙ্গ?
পর্ব ৬: এক্সক্লুসিভের খোয়াব, এক্সক্লুসিভের রোয়াব
পর্ব ৫: শাসন-সোহাগের দ্বন্দ্বসমাস
পর্ব ৪: পাঁকাল সাধনায় নাকাল
পর্ব ৩: দেখা ও না-দেখার সিদ্ধান্ত
পর্ব ২: মহাবিশ্বে যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে