মেয়রের অফিস দখল করে নিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। সন্ধ্যা ৬.৫৫-তে শহরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন প্রেসিডেন্ট। দেখতে দেখতে বন্ধ হয়ে গেল কেন্দ্রীয় দূরদর্শনের সম্প্রচার, কাজ করছে একমাত্র রিজার্ভ চ্যানেল। মার্কিন টেলিভিশন কোম্পানি CNN-এর কল্যাণে দূরদর্শনের পর্দায় দেখতে পেলাম শহরের রিং রোড ধরে চলেছে সাঁজোয়া গাড়ি। জানা গেল কেন্দ্রীয় দূরদর্শন চলে গেছে বিদ্রোহীদের দখলে। সেখানকার প্রথম কয়েকটি তলায় চলছে সশস্ত্র সংঘর্ষ। দুশ্চিন্তা নিয়ে পথে বের হলাম। তখন রাত দশটা। না, লোক চলাচল, যান চলাচল অব্যাহত আছে, রাস্তায় তেমন কোনও চাঞ্চল্যও লক্ষ করলাম না, ঘটনা নিয়ে পথে লোকজন যে জটলা পাকিয়ে আলোচনা করছে, তাও নয়।
৫৪.
রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের পার্লামেন্ট অভিযান
১৯৮৯ সালের ২৬ মার্চ
তখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন অটুট ছিল। নতুন গণপ্রতিনিধি কংগ্রেস নির্বাচনের প্রথম দফাতেই কমিউনিস্ট প্রার্থীদের শোচনীয় পরাজয় ঘটল। তার পরের বছর ওই মার্চ মাসেই, ১২-১৫ তারিখের গণপ্রতিনিধিসভার অধিবেশনে সোভিয়েত সংবিধানের ষষ্ঠ ধারা (সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় ভূমিকার স্বীকৃতি) বাতিল করে দেওয়া হল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সুপ্রিম সোভিয়েতের সভাপতির জায়গায় প্রবর্তিত হল সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টের পদ। মিখাইল গর্বাচ্যোভ নির্বাচিত হলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কার্যনির্বাহী প্রেসিডেন্ট। প্রথম প্রেসিডেন্ট এবং শেষ প্রেসিডেন্টও বটে।
অন্যদিকে ওই বছরই ২৯ মে বরিস ইয়েলৎসিন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পরিসদের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। শুরু হয়ে গলে দুই পক্ষের মধ্যে আইনের লড়াই।
১৯৯১ সালের ১৭ মার্চ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সঙ্গে রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ প্রজাতন্ত্রের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নও ওই গণভোটে যুক্ত হল।
রাশিয়ার ভোটাধিকারপ্রাপ্ত জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ এতে অংশগ্রহণ করেছিল। রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট পদ প্রবর্তনের পক্ষে শতকরা ৭০ জন মত প্রকাশ কর, তবে একই সঙ্গে শতকরা ৭১ জন মানুষই ইউনিয়নে থাকার পক্ষে মত প্রকাশ কর। পুরো ব্যাপারটাই একটা প্রহসন– সবচেয়ে বড় বিরোধ আর কী হতে পারে? ইউনিয়ন থাকবে, আবার রাশিয়ার সার্বভৌমত্বও থাকবে? বিশেষত ইতিমধ্যে যখন সার্বভৌমত্ব ঘোষণার সুযোগ নিয়ে ইউনিয়নভুক্ত অনেকগুলি প্রজাতন্ত্র একে একে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে বা যাওয়ার উদ্যোগ করছে।
সবই রুশ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের মর্জি মাফিকই চলছিল। বলা যেতে পারে পরিকল্পনামাফিকই চলছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ পর্যন্ত নামফলকে পরিণত হওয়ায় রুশ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনই দেশের সর্বময় কর্তার আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। কিন্তু নতুন রুশ ফেডারেশনের পার্লামেন্টে ইয়েলৎসিন স্বস্তিতে থাকতে পারলেন না: পদে পদে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সঙ্গে তাঁকে আপস করে চলতে হচ্ছিল। সংস্কারনীতি প্রবর্তনের পথে অনরবরত বাধাপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট তাই অনন্যোপায় হয়ে প্রচলিত সংবিধান লঙ্ঘন করে হুকুমনামাবলে ১৯৯৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ভেঙে দিলেন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের পার্লামেন্ট।
এই ঘটনায় শুধু রাজধানী মস্কোয় নয়, সমগ্র রাশিয়ার কোথাও সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় এতটুকু ছন্দপতন ঘটেনি।
প্রেসিডেন্ট নিজেই সেদিন সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণে এই পদক্ষেপ যে অসাংবিধানিক তা স্বীকার করেছেন। যদিও একই নিশ্বাসে বলেছেন, ‘অবশ্য প্রয়োজনীয়’।
আজ থেকে দু’-বছর আগে, ১৯৯১ সালের আগস্টে কমিউনিস্টদের ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সময় জনমানসের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করার সৌভাগ্য আমার হয়নি, তখন আমি রাশিয়ার বাইরে ছিলাম। কিন্তু ফিরে আসার পর এদেশের লোকজনের মুখে শুনেছি কয়েকদিন পার্লামেন্ট ভবন ও রেড স্কোয়ারের আশপাশে কিছু সংখ্যক মানুষের উত্তেজনা ছাড়া আর কোনও প্রতিক্রিয়া নাগরিক জীবনযাত্রায় পরিলক্ষিত হয়নি। এবারেও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
ব্যবসার সূত্রে কলকাতা থেকে মস্কোয় এসেছে আমার পরিচিত এক যুবক, বঙ্গসন্তান। রুশ ভাষা জানে না, এখানকার বেতার-দূরদর্শন ও পত্র-পত্রিকার ভাষা তার বোধগম্য নয়। ২২ তারিখ সকাল দশটা নাগাদ তার ফোন পেলাম। কণ্ঠস্বরে বিস্ময় ও উত্তেজনা গতকাল রাত বারোটায় সে বাড়ি ফিরেছে, রাস্তাঘাটে কোনও উত্তেজনা বা অস্বাভাবিক কিছু তার নজরে পড়েনি, অথচ এইমাত্র কলকাতা থেকে টেলিফোনে জরুরি কল পেয়ে তার ঘুম ভাঙে– মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় নাকি সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে, দাঙ্গা-হাঙ্গামা হচ্ছে। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম আমার মেয়েরা সকাল আটটায় স্কুলে বেরিয়ে গেছে। বাস ও মেট্রো গাড়ি বদল করে যেতে হয় এক ঘণ্টার পথ। অতএব বুঝতেই পারছ।
তবে শহরে সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর আনাগোনা, পুলিশ বাহিনীর টহল ইদানীং যেন একটু বাড়াবাড়ি রকমের। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কৈফিয়ত– অপরাধীর সংখ্যা বড় বেশি বেড়ে গেছে। একেবারে মিথ্যে নয়।
শুধু বেআইনিভাবে পালামেন্ট ভেঙে দেওয়াই নয়, পার্লামেন্ট ভবনের বিদ্যুৎ, জল ও গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে, দেশের সাংবিধানিক আদালতের রক্ষী তুলে নিয়ে আরও একটি সংবিধান বিরোধী কাজ করলেন প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন। ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে বন্ধ হয়ে গেল পার্লামেন্টের মুখপত্র ‘রসিস্কায়া গাজেতা’, সেই সঙ্গে আরও কয়েকটি সংবাদপত্র। সরকারি প্রতিনিধিদের বক্তব্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ওগুলি পরে আবার প্রকাশিত হবে। অর্থাৎ ‘ইজভেস্তিয়া’ পত্রিকাকে যেমন সরকার কুক্ষীগত করেছিলেন, এগুলিরও সেই হাল হতে চলেছে।
পশ্চিমের সরকারি মহল, বিশেষ করে ক্লিন্টন সরকার যখন ভাব দেখান যে, ইয়েলৎসিনের এই চাল তাঁদের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল, তখন তা বিশ্বাস করা শক্ত হয়ে পড়ে। ঘটনার অন্তত দশদিন আগে থেকে রাশিয়ার বিদেশমন্ত্রী পশ্চিমি নেতাদের কাছে সরাসরি ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন চূড়ান্ত পদক্ষেপ করার প্রস্তুতির কথা। ইয়েলৎসিন নিজেও গোপন রাখেননি গত কয়েক মাস ধরে। তা সত্ত্বেও ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর ক্লিন্টন যখন ইয়েলৎসিনকে টেলিফোনে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি আশ্বাস দিতে পারেন যে এতে ভালো হবে এবং সকলে এটি মেনে নেবে?’ তখন কেমন যেন খাপছাড়া মনে হয়।
একটি স্যুররিয়ালিস্ট দৃশ্য
মস্কো ৭ অক্টোবর, ১৯৯৩
রাজধানীর কেন্দ্রস্থলে যখন গোলাবারুদ সহযোগে প্রচণ্ড সামরিক সংঘর্ষ চলছে, যখন পার্লামেন্ট ভবনের ভেতর ও বাইরে মুহুর্মুহু বেশ কয়েকটি করে মানুষের লাশ পড়ে যাচ্ছে, তখনও শহরের অন্যান্য অংশে অব্যাহত রয়েছে নাগরিক জীবনযাত্রা, নির্বিঘ্নে চলাচল করছে যানবাহন, গমগম করছে দোকানপাট।
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল সেদিন– গত ৪ অক্টোবর। চোখের সামনে ট্যাঙ্কের কামানের গোলায় দেখতে দেখতে পুড়ে কালো হয়ে গেল ১৬ তলা সাদা বাড়িটা– রাশিয়ার পার্লামেন্ট ভবন– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের White House-এর অনুকরণে যার নাম এদেশে দেওয়া হয়েছিল White House.
২১ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টের সঙ্গে বনিবনার অভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন যখন পার্লামেন্ট ভেঙে দিলেন তারপর থেকে সরকারবিরোধী সাংসদরা পার্লামেন্ট ভবনে আশ্রয় নিয়ে ইয়েলৎসিন-বিরোধী অভিযান চালাতে লাগলেন – কার্যত সূচনা করলেন দ্বৈত শাসনের। তখন থেকে দেশের রাজনৈতিক মহলে যে-উত্তেজনা শুরু হয়েছিল, তার অবসান ঘটল ৩-৪ অক্টোবরে সামরিক হস্তক্ষেপে। ৩ তারিখ সন্ধ্যা সাতটা থেকে ৪ তারিখ সন্ধ্যা পাঁচটা– দশ ঘণ্টার সামরিক অপারেশনে পুড়ে কালো হয়ে গেল সাদা বাড়িটা। রাজধানীর হাজার হাজার কৌতূহলী জনতার সঙ্গে দ্বিতীয় দিন আমিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম সেই মহাদৃশ্য– সাক্ষী হয়ে রইলাম ইতিহাসের এক যুগান্তকারী ঘটনার।
এর আগে কয়েক দিন ধরেই শহরের কয়েকটি জায়গায় পার্লামেন্ট পক্ষাবলম্বী দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী ও কমিউনিস্ট দলগুলি এবং রায়ট পুলিশের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ চলছিল। মোলতভ্ ককটেল, বহ্নুৎসব, লাঠিচার্জ পরিচিত দৃশ্য। বিশেষ আগ্রহ জাগায় না।
৩ তারিখ শনিবার সন্ধ্যাবেলায় তাই যথারীতি গিয়েছিলাম এক বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা দিতে। পথেই শুনেছিলাম মেয়রের অফিস দখল করে নিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। সন্ধ্যা ৬.৫৫-তে শহরে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলেন প্রেসিডেন্ট। দেখতে দেখতে বন্ধ হয়ে গেল কেন্দ্রীয় দূরদর্শনের সম্প্রচার, কাজ করছে একমাত্র রিজার্ভ চ্যানেল। মার্কিন টেলিভিশন কোম্পানি CNN-এর কল্যাণে দূরদর্শনের পর্দায় দেখতে পেলাম শহরের রিং রোড ধরে চলেছে সাঁজোয়া গাড়ি। জানা গেল কেন্দ্রীয় দূরদর্শন চলে গেছে বিদ্রোহীদের দখলে। সেখানকার প্রথম কয়েকটি তলায় চলছে সশস্ত্র সংঘর্ষ।
দুশ্চিন্তা নিয়ে পথে বের হলাম। তখন রাত দশটা। না, লোক চলাচল, যান চলাচল অব্যাহত আছে, রাস্তায় তেমন কোনও চাঞ্চল্যও লক্ষ করলাম না, ঘটনা নিয়ে পথে লোকজন যে জটলা পাকিয়ে আলোচনা করছে, তাও নয়।
সংবাদের একমাত্র সূত্র CNN-এর তার সরাসরি সম্প্রচার চলছে সারারাত। ফোকাস-এর জায়গা তিনটি – মেয়রের অফিস, দূরদর্শন কেন্দ্র, সাদা বাড়ি। সামরিক বাহিনী ও ট্যাঙ্ক জমা হচ্ছে সাদা বাড়ির সামনে।
গভীর রাতে CNN-এর সংবাদে জানা গেল, মেয়রের অফিস ও দূরদর্শন কেন্দ্র দখলের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। পরদিন সকাল সাতটা থেকে সাদা বাড়ির আশপাশে গুলিগোলা চলছে– দু’-তরফ থেকে। দালানের সামনে নদীর ধারে জমেছে হাজার দশেক কৌতূহলী জনতার ভিড়। দূরদর্শনে সে-দৃশ্য দেখে সাহস করে আমিও বেরিয়ে পড়লাম। কাছের মেট্রো স্টেশনটাই শুধু কেন যেন বন্ধ, অগত্যা কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হল।
সর্বত্র মানুষের ভিড়। আনকেই মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে সাদা বাড়ির কাছাকাছি বাড়িঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ে সেখানকার জানলা থেকে সে-দৃশ্য দেখতে। সাদা বাড়ির উল্টোদিকে কুতুজভস্কি প্রস্পেক্টর বাড়িগুলোর সব জানলা দখল হয়ে গেছে– ড্রেস সার্কলে সিট খালি সেই। এরা সৌভাগ্যবান দর্শক। তবে অপরিচিত লোকজনকে বাড়ির লোকে ভেতরে ঢুকতেই বা দেবে কেন?
এরই মধ্যে কারা যেন কী করে একটা বাড়ির খোলা ছাদে ওঠার একটা খিড়কি দরজা আবিষ্কার করেছিল। এখানে প্রবেশ অবাধ। জনতার স্রোতে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে কোনওমতে ছাদে পৌঁছনো গেল। এখান থেকে সাদা বাড়ি আর তার চত্বর পরিষ্কার চোখে পড়ে। নোভি আর্বাতের সেতু জনতার ভিড়ে ভেঙে পড়ার উপক্রম। অনেকের হাতে ক্যামেরা, বাইনোকুলার। এরা যেন থিয়েটার হলে ‘ব্যালকনির দর্শক’। নীচে কার হাতে যেন পেরিস্কোপও দেখতে পেলাম। মনে পড়ে গেল ছোটবেলায় স্টেডিয়ামের বাইরে র্যাম্পার্টে দাঁড়িয়ে ফুটবল খেলা দেখার সময় কাউকে কাউকে পেরিস্কোপ ভাড়া খাটাতে দেখতাম।
রোদ ঝলমলে সাদা দালানের ওপর ট্যাঙ্ক আর মেশিনগান থেকে ঘন ঘন গোলা পড়ছে। প্রথম গোলা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্তব্ধ হয়ে গেছে মিনারের ঘড়িটা– তখন বেলা ১০.০৩ মিনিট। নিরাপদ দূরত্ব থেকে সবটা যেন একটা খেলার দৃশ্য। প্রতিটি মোক্ষম গোলাবর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের দিক থেকে হাততালি পড়ছে, জয়ধ্বনি উঠছে। নিচে যারা প্রথম সারির দর্শক তারা অনেকে মাটিতে শুয়ে পড়ছে, অনেকে আবার আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পিছিয়ে যাচ্ছে–পরমুহূর্তে আবার ফিরে যাচ্ছে যে যার জায়গায়। দালানের পাঁচতলা ও ষোলো তলা থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসছে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। একসময় ভাঙা জানলার ভেতর থেকে দমকা হাওয়ায় বাইরে ছড়িয়ে পড়ে আসতে থাকে রাশি রাশি কাগজ– কোনও এক ফিল্মে যেন এ-দৃশ্য দেখেছি। হলিউডের কোনও কলাকুশলীর কাছেও ঈর্ষণীয় এফেক্ট.
সাদা বাড়ির মাত্র ১৫০ মিটার দূরত্বে আর একদল কৌতূহলী জনতা আত্মঘাতী খেলায় মেতে উঠেছে। বেশ কিছু স্কুলের ছেলে-মেয়ে সর্বত্র ছুটোছুটি করছে– আজ ছুটির দিন। যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলায় ওরা মজা পাচ্ছে। শখের ফোটোগ্রাফাররা ছবি তুলছে, মহিলারা সাজগোজ করে কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কারও কারও হাতে বাজারের থলি। যেন ছুটির দিনে ভ্রমণে বেরিয়েছে।
মাথার ওপর সাঁই সাঁই করে বুলেট উড়ছে– একথা ভাবতেই গোটা দৃশ্যটাকে কেমন যেন অবাস্তব মনে হয়। নাকি surreal বলা ঠিক হবে?
বিকেল চারটের দিকে গুলিগোলা অনেকটা শান্ত হয়ে আসতে ছাদ থেকে নীচে নেমে এলাম। নদীর ধারে সেতুর কাছটায় আসতে-না-আসতে শুনতে পেলাম সাদা বাড়ি থেকে একদল লোক বেরিয়ে আসছে শ্বেত পতাকা হাতে। দাঁড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু অতদূর থেকে, ভিড়ের মাঝখান থেকে সাদা চোখে কিছু দেখা যায় না। যাদের কাছে বাইনোকুলার আছে তাদের মুখে ধারাবিবরণী শুনে সন্তুষ্ট থাকতে হল। পাশ থেকে একজন টিপ্পনী কাটল: ‘হুঁ হুঁ, সাদা বাড়িতে ঢুকেছিল লাল পতাকা হাতে, এখন কালো বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল শ্বেত পতাকা হাতে।’
আক্ষেপ হচ্ছিল বিনা পয়সার এই নাটকের শেষ দৃশ্যটা দেখতে পেলাম না একটা বাইনোকুলারের অভাবে। বাড়ি ফিরে দেখলাম দূরদর্শনের পর্দায় CNN-এর কল্যাণে। ঘুরে-ফিরে বারবারই দেখানো হচ্ছিল। এরপর এমন শিক্ষণীয় একটা আমজনতার মনে গাঁথা না হয়ে যাবে কোথায়? বারবার কেন যেন মনে পড়ছিল ১৯৭৩ সালের চিলে-র কথা– সেখানে প্রেসিডেন্ট ভবনের ওপর কামান দাগার ঘটনার কথা। চিলে-র এক সাংবাদিক বন্ধুকে একথা বলতেই তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন সেখানে জনসাধারণের প্রতিরোধ ছিল, এখানে জনসাধারণ নীরব দর্শক। তফাত আছে বইকি।
বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা
মস্কো, ২৫ অক্টোবর, ১৯৯৩
৩-৪ অক্টোবরের ট্র্যাজিক ঘটনায় রাশিয়ার তথা বেশ কিছুসংখ্যক শিল্পী ও সাহিত্যিকের যে একটা অগ্রণী ভূমিকা ছিল, তাঁদেরও যে একটা অবদান ছিল, সেকথা একেবারে অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৫ সেপ্টেম্বর মস্কোর উপকণ্ঠে এক বাগানবাড়িতে প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ছত্রিশজন কথাশিল্পীদের একটি দল। তাঁরা তাঁকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যতদূর সম্ভব কঠোর ও চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। পরিবর্তে লেখক ও শিল্পীসমাজের পক্ষ থেকে সরকারকে ব্যাপক সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এঁরা কি উস্কানিদাতা?
একুশে আইন
মস্কো। ২৪ অক্টোবর, ১৯৯৩
ডামাডোলের বাজার। নিত্যই পালটাচ্ছে নিয়ম কানুন। এই সেদিন পার্লামেন্টের বিদ্রোহ দমনের পরদিনই চালু হয়ে গেল কঠোর সেন্সর ব্যবস্থা। সরাসরি সেন্সর প্রথায় প্রতিবাদস্বরূপ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় সম্পাদকীয় ও রিপোর্টের জায়গায় দেখা দিতে লাগল সাদা জায়গা। দু’-দিন পরে সেন্সরপ্রথা অন্য রূপ ধারণ করল– আত্ম-সেন্সর অর্থাৎ পত্রিকা সেন্সর ছাড়াই বের হবে, কিন্তু পরে সেন্সর হবে। তখন আপত্তিকর কিছু বের হলে পত্রিকার সেই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করা হবে, বেশ কয়েকবার এরকম আইন লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল দশটি পত্রিকা। গত ১৩ অক্টোবর আইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। তাদের মধ্যে প্রাভ্দা ও সোভিয়েত রাশিয়া ফিরে পেতে পারে প্রকাশের অধিকার, যদি তারা পত্রিকার নাম পাল্টায়, প্রধান সম্পাদককেও পাল্টায়। এখনও নির্ধারিত হয়নি তাদের ভাগ্য। কে নির্ধারণ করবে তাও কারও জানা নেই।
এই ফাঁকে পালটাচ্ছে আরও একটি শর্ত। ২০ অক্টোবর প্রেসিডেন্টের প্রশাসন দপ্তরের প্রধান সের্গেই ফিলাতভ্ এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানালেন মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে প্রেসিডেন্টের নির্বাচনের কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ, ১৯৯৪ সালের ১২ জুন, সাধারণ নির্বাচনের ছ’মাস পরে প্রেসিডেন্টের যে পুর্নর্নির্বাচনের যে কথা ছিল, কার্যত তা হচ্ছে না– ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারছেন। কিন্তু কথা যে ছিল, তিনি নির্বাচনে দাঁড়াবেন? এর জবাব এল: কথা দেওয়া হয়েছিল সোভিয়েতগুলির চাপে পড়ে– সেই সোভিয়েতই এখন আর নেই– সেগুলি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তবে আর কার সঙ্গে আপস? আর এক অদ্ভুত যুক্তি।
…………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট। সেই রুশ সোভিয়েত ফেডারেটিভ প্রজাতন্ত্র নেই, অথচ তার প্রেসিডেন্ট আছেন– এত বড় অসংগতিও মেনে নিতে হচ্ছে?
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৫৩। নাম বদলের গোলকধাঁধায় অসঙ্গতি বেড়েছে, ঐতিহ্যকে রক্ষা করা যায়নি
পর্ব ৫২। মস্কোর আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মিছিলে ভারতের পতাকা থাকবে না-ই বা কেন?
পর্ব ৫১। পত্র-পত্রিকায় ঘোষণা করা হল কাস্ত্রো আসছেন, তবে ইনি মেক্সিকোর সোপ অপেরা স্টার
পর্ব ৫০। খোলা হাওয়ায় মানুষের আর কোনও কিছু নিয়েই চিন্তা নেই, অন্ন চিন্তা ছাড়া
পর্ব ৪৯। সোভিয়েত-মুক্ত রাশিয়াকে কে রক্ষা করবে?
পর্ব ৪৮। বর্ষশেষে মানুষ পেল দারিদ্র, এখন লোকে ধার-দেনা করে চা-কফি খাওয়া শুরু করেছে
পর্ব ৪৭। মুক্ত দিনে ব্যালের দেশ রাশিয়ায় ‘আধুনিক ব্যালে’ শেখাতে আসছে ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রুপ
পর্ব ৪৬। অক্টোবর বিপ্লবের উচ্ছ্বাস কোনও দেশে কমলে, অন্য দেশে বাড়তে থাকে
পর্ব ৪৫। ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’ আর পালিত হবে না, পালিত হবে বড়দিন– চোখের সামনে বদলে যাচ্ছিল সোভিয়েত
পর্ব ৪৪। রাজনীতিতে অদূরদর্শিতার ফল যে কত সুদূরপ্রসারী, তার প্রমাণ আফগানিস্তান
পর্ব ৪৩। জানলা দিয়ে পূর্ব জার্মানি দেখতে দেখতে গর্বাচ্যোভ বলেছিলেন, তাহলে এখানেই শেষ!
পর্ব ৪২। পেরেস্ত্রৈকা শুরু হলে বুঝেছিলাম ‘প্রগতি’ ‘রাদুগা’– এসব কিছুই থাকবে না
পর্ব ৪১। কল্পনা যোশীর তুলনায় ইলা মিত্রকে অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি বলে মনে হয়েছে
পর্ব ৪০। বেসরকারিকরণের শুরু দিকে রাস্তাঘাটে ছিনতাই বেড়ে গেছিল, কারণ সব লেনদেন নগদে হত
পর্ব ৩৯। হাওয়া বদলের আঁচ অনেকেই আগে টের পেয়েছিল, বদলে ফেলেছিল জীবনযাত্রা
পর্ব ৩৮। শুধু বিদেশে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ করেও ছোটখাটো কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন বহু ভারতীয়
পর্ব ৩৭। একটা বিদেশি সাবানের বিনিময়েও নাকি মস্কোয় নারীসঙ্গ উপভোগ করা যায়– এমনটা প্রচার করেছে ভারতীয়রা
পর্ব ৩৬। মস্কোর ঠান্ডায় লঙ্কা গাছ দেখে পি.সি. সরকার বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে বড় ম্যাজিক হয় নাকি?’
পর্ব ৩৫। রুশদের কাছে ভারত ছিল রবীন্দ্রনাথের দেশ, হিমালয়ের দেশ
পর্ব ৩৪। সোভিয়েত শিক্ষায় নতুন মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা খামতি থেকে গিয়েছিল
পর্ব ৩৩। দিব্যি ছিলাম হাসপাতালে
পর্ব ৩২। মস্কোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ ডাক্তাররা অধিকাংশই মহিলা ছিলেন
পর্ব ৩১। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার জন্য
পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো
পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা
পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি