Robbar

বিষাক্ত পৌরুষের সামূহিক উল্লাস

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 16, 2025 8:07 pm
  • Updated:September 16, 2025 8:07 pm  

অ্যাকশন ছবির প্রাথমিক ফাঁদ হল পৌরুষ-নির্ভরতা, এমনকী কেন্দ্রে নারী থাকলেও দেখা যায় সেই নারী আসলে হাইপার-ম্যাস্কুলিনাইজড। বহু অ্যাকশন ছবিই vigilante গোত্রের হয়; সেখানে দেখা যায় একজন সামাজিক মানুষ আইন হাতে নিয়েছে ক্রাইমের বিরুদ্ধে লড়তে। মুশকিল হল, সমাজে অপরাধে জড়িত থাকে মূলত নিম্নবিত্তের মানুষ, অথবা অন্তজ্য গোষ্ঠীর মানুষ, অথবা সংখ্যালঘু মানুষ। তাদেরকে একতরফা ‘ক্রিমিনালাইজ’ করে দেওয়া এইরকম ছবির একখানি ফাঁদ। আবার পুলিশ বা মিলিটারি কেন্দ্রিক ছবিতে প্রায় মিলিটারি স্টেটের প্রতি জনপ্রিয় বাসনা প্রতিভাত হয়, যা সবরকমভাবেই গণতন্ত্র-বিরোধী। অথবা উগ্র-জাতীয়তাবাদ, অন্য (বিশেষ করে প্রতিবেশি ছোট আকারের) দেশের প্রতি বিদ্বেষ, এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ– এ’ও এই ধরনের ছবির প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

অনিন্দ্য সেনগুপ্ত

২৩.

আগেই বলেছি, অ্যাকশন কোনও জঁর নয়, যে কোনও ছবি অ্যাকশন-ধর্মী হতে পারে। অতএব, যখন আমরা জঁর আলোচনা করি তখন আখ্যানের ধরন, চরিত্রের ধরন, প্রেক্ষাপট ইত্যাদির যে আলোচনা হয় অ্যাকশনধর্মী ছবিতে, তার রকমফের পাওয়া যায়। তাও আমরা কিছু আলগা বৈশিষ্ট্যের কথা ভাবতে পারি।

আমার কাছে খুব আলগাভাবেই এরকম ছবি দু’ধরনের হয়, স্টান্ট সেট-পিস বা অ্যাকশন সেট-পিস নির্ভর (যেমন ধূম, মিশন ইম্পসিবল বা জেমস বন্ড বা অনেক সুপারহিরো ছবি) অথবা এমন চরিত্র বা আখ্যান নির্ভর, যেখানে ভায়োলেন্স একেবারেই কেন্দ্রীয় হয়ে থাকে। প্রথম টাইপের ছবি অনেক সময়েই নিজেকে সিরিয়াসলি নেয় না, যেমন ধরুন সদ্য মুক্তি পাওয়া নোবডি ২ যদি দেখেন, বা রজার মুর অভিনীত জেমস বন্ডের ছবিগুলি। দ্বিতীয় টাইপের ছবিগুলি অনেক সময়েই সিরিয়াস হয়ে যায়, তাতে আখ্যানের কেন্দ্রে থাকে প্রতিশোধ, ক্রাইম, মিলিটারি বা পুলিশজাতীয় আইনের রক্ষক, এবং টেররিস্ট বা গ্যাংস্টার জাতীয় আইনের উল্টো‌দিকের গোষ্ঠীর সংঘর্ষ।

অধিকাংশ অ্যাকশন-ধর্মী ছবিতেই প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যাওয়ার বিবিধ ফাঁদ পাতা থাকে। যাঁরা কমার্শিয়াল ছবি মানেই বিনোদন ভাবেন, তারা এইসবের ধার ধারেন না। এক্ষেত্রে আমার এই ধন্দ লাগে যে, বিনোদন অ-প্রগতিশীলই হবে সে কেমন কথা? অন্যথায়, বহু নির্মাতারাই এই ব্যাপারে সচেতন থাকেন, এবং জঁরের এহেন মতাদর্শ নিয়ে তাদের ছবি প্রশ্নও তোলেন, যেমন বহু ওয়েস্টার্নে আমরা দেখেছি, অথবা গত কিস্তিতেই তারান্তিনোর ছবি নিয়ে যেভাবে আলোচনা করেছিলাম।

অ্যাকশন ছবির প্রাথমিক ফাঁদ হল পৌরুষ-নির্ভরতা, এমনকী কেন্দ্রে নারী থাকলেও দেখা যায় সেই নারী আসলে হাইপার-ম্যাস্কুলিনাইজড। বহু অ্যাকশন ছবিই vigilante গোত্রের হয়; সেখানে দেখা যায় একজন সামাজিক মানুষ আইন হাতে নিয়েছে ক্রাইমের বিরুদ্ধে লড়তে। মুশকিল হল, সমাজে অপরাধে জড়িত থাকে মূলত নিম্নবিত্তের মানুষ, অথবা অন্তজ্য গোষ্ঠীর মানুষ, অথবা সংখ্যালঘু মানুষ। তাদেরকে একতরফা ক্রিমিনালাইজ করে দেওয়া এইরকম ছবির একখানি ফাঁদ। আবার পুলিশ বা মিলিটারি কেন্দ্রিক ছবিতে প্রায় মিলিটারি স্টেটের প্রতি জনপ্রিয় বাসনা প্রতিভাত হয়, যা সবরকমভাবেই গণতন্ত্র-বিরোধী। অথবা উগ্র-জাতীয়তাবাদ, অন্য (বিশেষ করে প্রতিবেশি ছোট আকারের) দেশের প্রতি বিদ্বেষ, এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ– এও এই ধরনের ছবির প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে।

এইবার কথা হল, এইসব ব্যাপার যাদের দোষের মনে হয় না, তাদের কিছু যাবে আসবে না। আজকাল তো তেমনই মনে হয়, যে এসবে কারও কিছু যায় আসে না। বরং এসব কথায় মানুষ বিরক্ত হয়। কিন্তু আমিই বা এই বয়সে তার সঙ্গে তাল মিলাই কীভাবে?

ক.

‘ফার্স্ট ব্লাড’-এর শুরুতে জন র‍্যাম্বো

১৯৮২ সালে মুক্তি পায় সিলভেস্টার স্ট্যালোন অভিনীত ফার্স্ট ব্লাড। সেই ছবিতে আইকনিক হয়ে ওঠে জন র‍্যাম্বোর চরিত্র। আট ও নয়ের দশকে পরপর আরও দুটো ছবিতে র‍্যাম্বো মানেই তৃতীয় বিশ্বে নরসংহারে লিপ্ত মার্কিন ওয়ান-ম্যান আর্মি।

কিন্তু ফার্স্ট ব্লাড-এর ধরনটা আদপেই এরকম ছিল না। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে আমেরিকার বাঁধা-ধরা সৈন্য ছিল না। তাই আমেরিকান মিলিটারিকে ঘর থেকে ছেলে তুলে নিয়ে ফেলতে হয়েছিল পৃথিবীর অন্য গোলার্ধে, ট্রপিকাল একটি দেশে। সেই দেশের গরিব চাষাদের হাতে সেইসব ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মার্কিন যুবকদের হার একটা প্রজন্মের ট্রমা তৈরি করেছিল। ইদানীং আমাদের দেশে যে অন্য দেশকে ‘ক্যালানো’ জাতীয়তাবাদের পরম ধর্ম মনে করা হয়, ছয় ও সাতের দশকের আমেরিকার মানুষরা আদপেই তা মনে করত না। দেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় অন্য দেশে যুদ্ধ করা, ঘরের ছেলে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের শারীরিক বা মানসিকভাবে জখম করিয়ে ফেরত আনাটাকে তখনকার আমেরিকার সাধারণ মানুষের একেবারেই পছন্দ ছিল না। অর্থাৎ উগ্র জাতীয়তাবাদে ভাটা পড়েছিল। 

ফার্স্ট ব্লাড-এ দেখা যায় একজন যুদ্ধফেরত সৈনিক, সে দেশে ফিরেই বোঝে যে তার এখানে না আছে সম্মান, না আছে নিরাপত্তা। কেন যে সে তার জীবনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় সময়টা মৃত্যু ও বিপন্নতার সঙ্গে যুঝে নষ্ট করল সেটাই সে বুঝতে পারছে না। এইবার দেখা যায় যে জাতীয় মানসিকতার ভিত্তি যে পৌরুষের সংস্কৃতি, তার সঙ্গেই তার সরাসরি সংঘর্ষ ঘটল। যে ছোট শহরে সে এসেছে, সেইখানে করাপ্ট পুলিশের গুন্ডামির দাপট। র‍্যাম্বোর মতো ছাদহীন মানুষদের প্রতি তাদের ঘোরতর সন্দেহ; তার ওপর যুদ্ধ থেকে ফিরেছে বলে কি এমন মাথা কিনে নিয়েছে, তারা তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে হ্যারাস করতে শুরু করে। র‍্যাম্বোর মনে তখন শত্রুপক্ষের হাতে অত্যাচারের ক্ষত একেবারে দগদগে, অর্থাৎ ঘোরতর পিটিএসডি-র শিকার। একসময়ে তার মাথার তার গেল কেটে, তার কাছে আর দেশের মানুষ পরদেশের শত্রুর কোনও তফাত রইল না। সে একটা ব্যাপারেই প্রশিক্ষিত; অতএব সেই স্কিলই বাকি ছবিতে তার আত্ম-পরিচয় হয়ে গেল।

কিন্তু ফার্স্ট ব্লাড-এ পরের ছবিগুলির মতো হেলায় র‍্যাম্বো একের পর এক খুন করেনি। এই ছবির নায়ক বরং অনেক ভালনারেবল, নরম ও সাবমিসিভ শুরুর দিকে। এই ছবির ভিতে আছে পৌরুষের সংস্কৃতির যে কাঠামোগত ইন্টারনাল কনফ্লিক্ট; যে কনফ্লিক্ট সেই ওয়েস্টার্ন থেকে জন উইক অবধি আছে। একজন একাকী মানুষ যিনি কিংবদন্তিসম, তাকে এবার যখন তখন চ্যালেঞ্জ করবে উটকো লুম্পেনরা। ভাবটা হল এই যে– হ্যাঁ রে, তুই নাকি হেভি পুরুষশ্রেষ্ঠ হয়েছিস, নে তোকে চ্যালেঞ্জ করলাম! তবে ফার্স্ট ব্লাড-এর শুরুতে জন র‍্যাম্বো যে কীরকম কুশলী যোদ্ধা তা কেউই সেই মফসসলের দাপুটে পুলিশরা জানত না। অতএব ছবির প্রথম অ্যাক্টে আমরা যা পাই তা আমাদের পাড়ার স্কুল বা ক্লাবেও পাওয়া যায়, হ্যারাসমেন্ট আর bullying, আখেরে যা পর্যবসিত হয় র‍্যাগিং-এ। পৌরুষের এই ধরনের ইন্টারনাল কনফ্লিক্টকেই এই ছবিতে প্রফেশনাল পুলিশ আর ফ্রিলান্সিং মিলিটারির (এরকম যদি কিছু বলা যায়) কনফ্লিক্টে পরিণত করা হয়। ছবির একদম শেষে র‍্যাম্বোর যে মোনোলগটি আছে, তাতে বোঝা যায় এই কনফ্লিক্টের কোনও সহজ সুরাহা নেই। র‍্যাম্বো আর পাঁচটির মতোই উলুখাগড়া। ফার্স্ট ব্লাড-এর বিষাদাচ্ছন্ন নিউরোসিস।

এক কথায়, অ্যাকশনধর্মী ছবিকে যে অগভীর, প্রতিক্রিয়াশীল হতেই হবে তার কোনও মানে নেই। ডেভিড মোরেল রচিত মূল উপন্যাসে ভিয়েতনাম-ফেরত র‍্যাম্বো ছবির শেষে মারা যায়। স্ট্যালোন তাকে মারলেন না, এবং তৈরি করলেন ফ্র্যাঞ্চাইজি। স্ট্যালোনের হাতে র‍্যাম্বো সিরিজ প্রায় অগভীর জাতীয়তাবাদী ক্যারিকেচারে পরিণত হবে। একাধিক ছবিতে র‍্যাম্বো ওয়ান-ম্যান মিলিটারি হয়ে কমিউনিস্ট ও ভিনদেশিদের রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে; বিশেষ করে ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত রাম্বোর শেষ ছবিটা যাকে বলে এম্ব্যারিসিংলি ট্রাম্পপন্থী বেশ খারাপ ছবি। কেন, তার বিস্তারে এখন যাচ্ছি না। ট্রাম্পের নীতি যাদের ভালো লাগে, তাদের এই ছবি দিব্যি লাগতে পারে। কিন্তু ছবি যাদের ভালো লাগে, এই ছবির মেকিং তাদের বেশ খারাপ লাগবে। একমাত্র চতুর্থ খণ্ডে সেই প্রথম ছবির মুড কিছুটা ফেরে।

খ.

সেরকমটি হয়, যখন সেরকমটি চাওয়া হয়। যেমন ইদানীংকার ‘massy’ ভারতীয় ছবিতে। আমার ইদানীংকার অ্যাকশন ছবি, বিশেষ করে ভারতবর্ষে বানানো, ভালো লাগে না। আজকে সেই নিয়ে কিছু কথা বলি। অন্যত্র ‘অ্যানিমাল’ জাতীয় ছবিকে আমার কেন হয় ফ্যাসিস্ট, নয়তো ফ্যাসিজম-কামী ছবি মনে করি তা বলেছি, সার্চ করলে পেয়ে যাবেন। তার পুনরুক্তি করব না। এইটুকুই বলি, হিটলার যখন তার রক্ত-গরম করা বিদ্বেষী ভাষণ দিতেন, তখন বিশ্বাসী শ্রোতাদের অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে হত যে তিনি ঠিক কথা বলছেন। আবার অনেকে হয়তো ছিলেন, যাঁরা মনে করতেন যে তিনি যা বলছেন তা অশুভ, কিন্তু তাঁরা সম্মোহিত হয়ে থাকতেন। ইদানীংকালের massy অ্যাকশন ছবির ধরনটা ঠিক ওইরকমই। আপনি দেখছেন যা যা হচ্ছে, তা যেন ঠিক নয়, কিন্তু আপনাকে মেসমেরাইজ করে রাখা হচ্ছে। 

অনেকে বলেন ‘অ্যানিমাল’-এ যাই থাকুক না কেন, ক্রাফট তো ভালো। এ কেমন কথা বলুন তো? আপনাকে ব্ল্যাকমেল করে চিঠি পাঠানো হল; আর আপনি বললেন– যাই লিখে থাকুক, হাতের লেখাটা তো ভালো– সেরকম। অনেকে বলেন, বিনোদনই তো, বাস্তব জীবনের সঙ্গে এর সম্পর্কই বা কী? এইগুলো হয় ছেঁদো যুক্তি, নয় কুযুক্তি। আমি ‘অ্যানিমাল’ দেখিনি; কিন্তু ছবিটা মুক্তি পাওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এই ছবির সমস্ত প্রধান ‘মোমেন্টস’ দেখে ফেলেছিলাম। কোথায়? রিলে, হলে মোবাইল দিয়ে তোলা ভিডিও। আমার এইটা বিশ্বাস করার ঢের কারণ আছে যে, এই রিলে ভরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াটা ছবিটার পাবলিসিটি স্ট্র্যাটেজির অন্তর্গত; এবং ছবিটির ফর্মও সেভাবেই নির্ধারিত হয়েছে। আমি সেই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দেখেছি অনুপমা চোপরা বা সুচরিতা ত্যাগীর মতো ক্রিটিকদের, যাদের ‘কবীর সিং’ বা ‘অর্জুন রেড্ডি’ পছন্দ হয়নি, তাদের পোস্টের তলায় ‘অ্যানিমাল’-ভক্তদের ট্রোলিং। অর্থাৎ, এই ছবির সমর্থকরা আদপেও ছবিটি দেখে এন্টারটেইনড হয়ে ভুলে যায়নি। তারপর তারা রিল বানিয়েছে, ট্রোল করেছে, সারাদিন সোশাল মিডিয়ায় ছবিটি নিয়ে বুঁদ হয়ে থেকেছে। কিন্তু সেসব থাক। যা আমার বলার যে এই গোত্রের ছবিগুলি অ্যাকশন সিনেমা হিসেবেও আমার কাছে মধ্যমানের বা নিম্নমানের।

প্রথমত, এই ছবির যে massy শৈলী, যা নায়কের ‘নায়কত্ব’-কে হাইপারস্টাইলাইজ করে, এবং টুকরো টুকরো শটের মাধ্যমে প্রলম্বিত ও ‘elevated’ করে– তাতে অ্যাকশনের যে মূল ড্রামাটিক টেনশন, তা একেবারেই শূন্য হয়ে যায়। নায়ক এমনই অতিনায়ক হয়ে যায়, যে তার সামনে আর কোনও প্রতিপক্ষই সমমানের নয়। অতএব নায়কের বিপন্নতা বা ভালনারেবিলিটির জায়গা থাকে না। জন উইকও এরকম কিংবদন্তিসম; কিন্তু সেখানে প্রতিটা ফাইট সিনে উইকও যে রণক্লান্ত হচ্ছে, উপস্থিত বুদ্ধির জেরে মরতে গিয়েও বেঁচে যাচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে সৌভাগ্য সহায় হচ্ছে, এই ভাবটা বজায় থাকে। কিন্তু ভারতীয় ছবির নায়কগুলির যেন কোনও ক্লান্তিই নেই, তাই জন উইক যখন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে, এরা তখন swag-এর মহিমায় দৃশ্যকে ম্যারিনেট করে। একের সঙ্গে বহুর যে দ্বন্দ্ব, অথবা উপর্যুপরি আরও শক্তিশালী বিপক্ষের, সেই নাটকীয়তা এইসব ছবিতে অনুভবই করা যায় না। এবং এই হাইপারস্টাইলাইজড শৈলীর ফলে দৃশ্যগুলি যথারীতি অত্যন্ত খারাপ ফাইট কোরিওগ্রাফিতে পর্যবসিত হয়। প্রভাস গদাইলস্করি ঢঙে এলেন, ছ’-সাত খানা মুশকো লোক হামলে পড়ল, প্রভাস কনুই নাড়ালেন, তারা ছিটকে উড়ে গেল– এটা ভালো ফাইট কোরিওগ্রাফি নয়।

অ্যাকশন ছবি সবসময়েই প্রযুক্তির উদযাপন। সেইজন্যই জেমস বন্ডের ছবি যত পুরনো হয়, ডেটেড লাগে। কিন্তু আলোচ্য ছবিগুলি হয়ে উঠেছে প্রযুক্তির মাধ্যমে পুঁজির ডিসপ্লে। ইদানীং যে নৃশংসতার অতিরিক্ততা দেখতে পাই এইসব ছবিতে, সেইগুলো হল প্রস্থেটিক্স এবং ডিজিটাল এফেক্টসের অতিব্যবহারের ফল। অর্থাৎ, আমরা এগুলো এখন ‘পারছি’, তাই প্রতিটা ফাইট সিনই হবে সেগুলির শোকেস। আগে হয়তো বলেছি, তারান্তিনো তার ছবিতে আদপেই সিনেমাটিক ভায়োলেন্সকে ‘বাস্তববাদী’ করে তুলতে চান না, কিন্তু এইসব ছবিতে ‘হাইপাররিয়ালিজম’-এর চাষ হয়। প্রতিটি ক্ষত, আঘাত, রক্তপাত হতে চায় একদম ভিসেরাল। এখানে প্রযুক্তির কাজই হল পুরুষ-শরীরের এক্সট্রিমিটির অতিবাস্তবতা তৈরি করা। মাঝে মাঝে মনে হয় যে আসলে এই ইমেজগুলি বর্তমান উপমহাদেশীয় ম্যাস্কুলিনিটি যে কী প্রচণ্ড ভঙ্গুর ও ক্রাইসিস-আকীর্ণ, তারই ডিনায়াল, অতএব অতিরঞ্জন।

এবং তাই পুঁজি আর প্রযুক্তির ক্রাচে দাঁড়িয়ে ওঠে মতাদর্শ। এইসব ছবি আখেরে হয়ে উঠছে টক্সিক রাইট উইং পৌরুষের বিজ্ঞাপন। একজন দাড়িওয়ালা পুরুষ (অনেক ক্ষেত্রেই চল্লিশোর্ধ), রক্ত-ঘাম-কালি-ঘিলু-নোংরা মেখে দাঁড়িয়ে আছেন, হাতে চপার বা কুঠার; তার মধ্যে ভালনারেবিলিটির ছিটেফোঁটাও নেই, তিনি চাইছেন শত্রু জবাই করার পর পর্দার সামনের জনতা তার পায়ের কাছে গড় করুক। রাইট উইং নেতা বা হেজে যাওয়া রকস্টারের মতো এইসব নায়কের সম্মুখবর্তীতা; এই অ্যাগ্রেসিভ ভঙ্গিটিই আসলে বশংবদ mob-এর সিটি বা উল্লাসের আহ্বান। এইসব আলট্রাভায়োলেন্ট ছবির নন্দনতত্ত্বের এখানেই শুরু, এখানেই শেষ। এর উৎস তামিল-তেলুগু ছবি, অধুনা প্যান-ইন্ডিয়ান ইভেন্ট ফিল্মে এর বিস্তার চলছে, বাংলাদেশে শাকিব খানের ছবি পরপর এই ইমেজ অনুকরণ করে চলেছে, দেবের কাছে ‘খাদান’-এর পর ‘রঘু ডাকাত’-এ, জিৎ-এর কাছে ‘লায়ন’-এ– এইটাই চায় ভক্তরা।

এই ছবিগুলি স্রেফ মুহূর্ত তৈরি করে; সেই মুহূর্তগুলি গেঁথে তোলা আর প্রায়োরিটিতে থাকে না। থাকবেই না, কারণ দৃশ্যগুলি অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তার ফলে যে জিনিসটা বাতিলের খাতায় চলে যায় তা হল আখ্যান আর চরিত্রায়ণ। অর্থাৎ, হৃদয়স্পর্শী গল্প, যেখানে সামাজিক অন্যায়ের ফলে আন্ডারডগ নায়কের সাফারিং তার ভায়োলেন্সকে ক্যাথার্টিক তীব্রতা দেবে, সেইরকম গল্প আর এই পরাক্রমী নায়কের তুঙ্গমুহূর্তমালায় কীভাবে পাবেন? পাবেন তো এক সাইকোপ্যাথ সিরিয়াল কিলারের জননেতা হিসেবে মহিমা!

এক কথায়, একসময়ে খুব আলোচনা হত যে ভায়োলেন্ট সিনেমার সমাজের ওপর ভারি কুপ্রভাব পড়ে। আমার মনে হয়, ইদানীং অ্যাকশন ছবির ওপর ভায়োলেন্ট সমাজের বড্ড কুপ্রভাব পড়ছে!

…পড়ুন এই কলামের অন্যান্য পর্ব…

২২. আধুনিক অ্যাকশনের দৃষ্টান্ত এবং ব্যতিক্রম– ‘কিল বিল’ ও ‘জন উইক’

২১. অ্যাকশন! সিনেম্যাটিক ও শারীরিকের যুগলবন্দি

২০. গথিক ও তান্ত্রিক– প্রাগাধুনিকের ভীতি

১৯. ভিন্নতার আতঙ্ক– দ্য এক্সরসিস্ট এবং লাভক্রাফট

১৮. হরর! শরীর নিয়ে মনের ভয়?

১৭. কালচার ইন্ডাস্ট্রির ফ্যান্টাসি কি মূলত ভিন্ন মধ্যযুগের কল্পনা?

১৬. কল্পবিজ্ঞান শুধু ইতিহাসের মোড় বদলেই পাল্টায়নি, ইতিহাসের বিরুদ্ধেও গেছে

১৫. সাই-ফাই, ফ্যান্টাসি, হরর– তিনটে জঁরেই অবাস্তব নিজেকে মেলে ধরেছে বাস্তবের মতো করে

১৪. ফিউডাল রক্ষণশীলতা থেকে পুঁজিবাদী শিকড়হীনতায় পতনের গল্প বলে গডফাদার ট্রিলজি

১৩. গ্যাংস্টার জঁর– সভ্যতার সূর্যগ্রহণের মুহূর্ত ছায়ামূর্তিদের গল্প বলার সময়

১২. ফাম ফাতাল নারীর আর্কেটাইপের কি কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি আছে, না সে কেবলই একটি ‘টাইপ’?

১১. রহস্যসন্ধানীর পালাবদল, ফিল্ম নোয়া আর আমরা

১০. ফিল্ম নোয়া– নাগরিক আলোর মধ্যে আঁধারের বিচ্ছুরণ

৯. ‘দ্য হেটফুল এইট– এখন ওয়েস্টার্ন যেরকম হতে পারত

৮. একটি মৃতদেহ দেখানো ও না-দেখানোর তফাত থেকে বোঝা যায় ‘শোলে’ শুধুমাত্রই অনুকরণ নয়

৭. যখন জঁর নিজেকে নিয়েই সন্দিহান

৬. আমেরিকার ‘হয়ে ওঠা’-র কল্পগল্প

৫. একটি সভ্যতার হয়ে ওঠার মিথোলজি 

৪: পশ্চিমে এল এক নারী, বেজে উঠল অমর সংগীত

৩. জঁরের ফর্দ– দৃশ্য, শব্দ, প্রেক্ষাপট

২. ট্যাক্সি ড্রাইভার এবং তার পূর্বসূরি দুই নায়ক ও একটি ছদ্মবেশী জঁর

১. ভাঙনের শহরে এক নামহীন আগন্তুক এবং চারখানি গল্পের গোত্র