Robbar

রূপসাধকের প্রাণের ভিতর সুরের ঝরনাধারা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 9, 2025 6:01 pm
  • Updated:December 9, 2025 6:01 pm  

আনন্দময় একটি অস্তিত্ব ছিল বাজারদার। কথা বলছেন, কাজ করছেন, গান করছেন। অমন মাপের শিল্পী, তবু দারিদ্র ছিলই ঘরে। স্থানীয় কিছু উৎসাহী জন তাঁর তৈরি বেশ কিছু বানাম-সুদ্ধ বাজারদাকে নিয়ে গেলেন বেঙ্গালুরু সংস্কৃতি মেলায়, দিল্লি হাটে। বিস্ফারিত নেত্র নাগরিকদের হাতে হাতে বিক্রি হয়ে গেল বানামগুলি। অর্থাগম হল, যা ভেবেছিলেন হয়তো তার চেয়ে কিছু বেশিই, কিন্তু বাজার হেমব্রম রইলেন ম্রিয়মাণ!

জয়া মিত্র

৬.

বাজার হেমব্রমকে সাঁওতাল সমাজে সবাই বলত ‘গুরু বাজার হেমব্রম’, কিন্তু প্রথম আলাপের দিন যখন মুখ্যুর মতো জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি যে এইসব যন্ত্র বাজাতে শিখেছিলেন, আপনার গুরু কে ছিলেন? বাজারদা বলেছিলেন, ‘কেউ না’। পরে যখন দিব্য বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে, বুঝিয়েছিলেন–

“দিদি, আমাদের সমাজে আপনাদের মতো ই-সকল জিনিস আলাদা করে কারু কাছে বসে শিখতে হয় না। এই গান-নাচ এগুলা আমাদের সমাজে পাঁচটা রান্না খাওয়ার মতোই রোজকার জীবনে চলে। ছোটরা জন্ম থেকে দেখে-শুনে। ই-সকলের মাঝেই বড় হয়। হাঁটতে শিখারও আগে থিকে উয়ারা সমাজের সব পরবে সবার সঙে পা মিলায়। হাঁসের ছানা যেমন জন্মেই তৈরায়, হামদের ঘরের ছুটো ছেলেরাও জন্ম থিকে নাচতে, গান কইরতে শিখে। আপনারা একে নাচ-গান বলেন, যেমন অন্যলোককে শুনাবার লেগে। হামদের কাছে ই-কেবল নাচ-গান লয়, সমাজের কাজের নিয়ম। সব গানের অলগ অলগ নাম আছে, সময় আছে। কোনটা করম, কোনটা বিহা-র, কোনটা ধান লাগাবার কালের। নাচও গানের সঙ্গ ধরেই হয়। এই যে যন্ত্রগুলা– ই বাঁশি, বানাম, এও সেই গান-নাচের সঙেই চলে।’

বোলপুরের কঙ্কালীতলায় বাজারদা-র বাড়ি। সাদা-কালো মেশানো গাল থুতনি, নুনমরিচ ঝাঁকড়া চুল। একটু ভারী চেহারা। দেখে তখন আর বোঝা যায় না সেই হিলহিলে পাতলা ছেলেটি, দারিদ্রের জন্য যাকে তার মা-বাবা নিজের পিসি-পিসেমশায়ের ঘরে রেখে গিয়েছিল, জামতাড়ায়। সন্তান না-থাকা সেই পিসি-পিসেমশায় বড় ভালোবাসতেন বালক বাজারকে। এতটাই যে, সুর-পাগল ছেলে পথে গান গেয়ে ভিক্ষা করা লোক দেখে যখন পিসের কাছে আবদার করে– তার ওই গান বাজানো বাক্সটা চাই বলে, নগদ তিন টাকা দিয়ে সেই হারমোনিয়াম কিনে দিয়েছিলেন পিসেমশায়।

এই গল্প বাজারদা নিজেই বলেছিলেন। তারপর হয়ে দাঁড়াল, সেই হারমোনিয়ামের সাদা-কালো রিড টিপে-টিপে নিজে-নিজেই সুর তোলার নেশা। যেখানে যে গান শুনছে, সবগুলো বাজাতে না-পারা পর্যন্ত শান্তি নেই মনে। এর মধ্যে নতুন তরুণ মনের মানুষ এসে পড়েছে ঘরে, বিয়ে হয়েছে। হাতের কাজ হল কাঠের কাজ করা। সেই কাজেও একইরকম গুণ। হাতের কাজ দেখে লোকের বাড়িতে ডাক পড়ে, কোনওদিন বসে থাকতে হয়নি। কিন্তু মাথার মধ্যে সারাদিন সুরের চলাফেরা। এতখানি দখল হল যে, হারমোনিয়ামের সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতি পর্যন্ত খুলে লাগানো শিখে ফেললেন সেই তরুণ বাজার, পরে যিনি তৈরি করতে শিখে যাবেন সাঁওতালদের সবরকম বানাম– সুরযন্ত্র। ছড় টানা কিংবা ঝংকার তোলা, যেমনই বানাম হোক, বাছাই করে নেওয়া একটি কাঠের খণ্ডকে নিপুণ হাতে কুঁদে তোলা নকশা। মানুষের মুখ, পাখি, লতা। তাতে তার বেঁধে, সুর সেধে বাজানো। কিন্তু সে আরও পরের কথা। তার আগে দেখা হল লোকের কাঁধের বেহালার সঙ্গে। হারমোনিয়ামের রহস্য শেখা হয়ে গিয়েছে। সেই হারমোনিয়াম বেচে দিয়ে কেনা হল বেহালা। কিন্তু বেহালায় সুর তোলা কঠিন। রাত্রে ঘরের দাওয়ায় বসে যখন বাজানোর চেষ্টা করতেন, বাজারদার কথামতো, বৌদি বলতেন– আগের যন্ত্রটাই তো ভালো ছিল। এইটা কী বাজনা, ক্ষ্যাপা শিয়ালের মতো শব্দ করে!

শিল্পী: শান্তনু দে

সেই ‘ক্ষ্যাপা শিয়াল’ও একসময় বুকে মোচড় দেওয়া সুরে বাজল। কী ছিল সেই আশ্চর্য হাতে! সেই রূপসাধকের প্রাণের ভিতর! দেখেছি সামান্য একটা বাঁশের মই তৈরি করছেন যখন, তারও দু’পাশের দণ্ডে, যেখানে এসে জোড়া লাগছে পা রাখার ঘাটগুলো, বাঁশের প্রত্যেক ঘাটে ছিলে তৈরি করে দিচ্ছেন সাত পাপড়ির একটি করে ফুলের নকশা। হয়তো কারও নজরই পড়বে না সেখানে, কী আসে যায় তাতে! 

এমন আনন্দময় একটি অস্তিত্ব ছিল বাজারদার। কথা বলছেন, কাজ করছেন, গান করছেন। অমন মাপের শিল্পী, তবু দারিদ্র ছিলই ঘরে। স্থানীয় কিছু উৎসাহী তাঁর তৈরি বেশ কিছু বানাম-সুদ্ধ বাজারদাকে নিয়ে গেলেন বেঙ্গালুরু সংস্কৃতি মেলায়, দিল্লি হাটে। বিস্ফারিত নেত্র নাগরিকদের হাতে হাতে বিক্রি হয়ে গেল বানামগুলি। অর্থাগম হল, যা ভেবেছিলেন হয়তো তার চেয়ে কিছু বেশিই, কিন্তু বাজার হেমব্রম রইলেন ম্রিয়মাণ! ‘এরা নিয়ে গেল ঘরে সাজাবে বলে, ওইগুলা যে বাজনা, উয়াতে সুর উঠে, সুর বাজায়, সে তো জানল নাই’।

শুধু কি বানাম, কতরকম বাঁশি আর তার কত বিচিত্র ধ্বনি। মোটা মুরলি– সে এক অন্যরকম মোটা বাঁশের একহাত লম্বা নল, ভারী, গভীর শব্দ তার। ডু-মুরলি মানে দুইমুরলি। প্রায় দু’হাত লম্বা সরু বাঁশের নল, তার উপর মুখে আড়ে একটি ছেঁদা, নিচদিকে পাঁচটি। মাঝখান বরাবর একটি লম্বা কাটা জায়গার মাঝে শক্ত করে জড়ানো সুতো সেই কাটা জায়গাকে দু’ভাগ করেছে। আলাদা একটা সরু বাঁশের বাঁকা পাইপ দিয়ে ওপরের ফুটোয় ফুঁ দিলে সেই বাতাস একসঙ্গে দুই স্বরে বাজে– একটা গম্ভীর ‘সা’ ধ্বনিতে, অন্যটি সঞ্চরণে। মোবাইল ছিল না তখন। কী যে দুঃখ, ছবি তুলে রাখা হয়নি সেইসব আশ্চর্য সৃষ্টির। বেশ কয়েকবছর পরে নরওয়ের একটি লোককথার চিত্রিত ছোটদের বইয়ে সেই ডু-মুরলির ছবি দেখে উতলা হয়েছিলাম, কিন্তু ছেঁড়া সুতোটির হদিশ শুধোব কাকে! বইটা আছে এখনও।

অসংখ্য বিন্তি মানে গল্পের‌ ভাণ্ডার ছিলেন বাজারদা। তাঁর মুখেই প্রথম শুনেছিলাম রাজা উদুড়দুর্গার গল্প আর গান–

–মুখে পান আর লম্বা লম্বা কোঁচার আড়ে তীরধনু নিয়ে তোমরা কাকে খুঁজছ?
–মুখে পান আর লম্বা লম্বা কোঁচার আড়ে তীরধনু নিয়ে আমরা খুঁজছি আমাদের রাজাকে।

শুনেছি জমসিম বিন্তি, সাঁওতাল সমাজের সৃষ্টি উপাখ্যান। সাঁওতাল গ্রামে প্রতিটি শিশুর জন্মের পর পুরো গ্রাম একসঙ্গে বসে শোনে সেই প্রশ্নের উত্তর, ‘এলেম আমি কোথা থেকে?’ মঙ্গলময়ী এক দেবীর খেলাচ্ছলে গড়া দুই হলুদবরণ পাখি আর সূর্যের কিরণ বেয়ে পৃথিবীতে নেমে আসা এক নারদের গল্প। সেই গল্পে মানুষের জন্মের জন্য মাটি জমা করে বোয়াল মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, কচ্ছপ এমনকী কেঁচো। এরাই তো মানুষের বিধাতা। কী করে মানুষ তবে অকারণে হত্যা করবে এদের?

এই প্রাচীন গাথাগুলি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে শিশুদের বেঁধে রেখেছে নিজেদের প্রথাগুলির সঙ্গে। সুরে বাঁধা বাজারদা যেন এক প্রাচীন বৃক্ষ, সমাজের একটি পাশে সুস্থির হয়ে তাঁর থাকা। কিংবা ঠিক সুস্থির হয়তো নন, যে কোনও আদত শিল্পীর মতোই আগুন তাঁকে পোড়াত। উদ্দাম করে রাখত জীবনের আনন্দবেদনায়। তাঁর সময়মতো বাজারদার কাছে বসা মানে কখনও-বা একটি গভীর কুণ্ডের পাশে বসে থাকা। অনুভব করার চেষ্টা, কী রহস্য ওই মানুষটির মধ্য থেকে এমন আশ্চর্য সব সৃষ্টি তুলে আনে, অথচ বাজারদা যেন জানেনই না, আমল দেন না কোনও বিস্ময়কে। আবার কখনও তাঁর নৈকট্য উৎসারিত হয়ে উঠছে ফুলঝুরির মতো, বিশেষত তরুণ কিশোর শ্রোতাদের কাছে।

কোথায়, কত দূর অবধি যেন তাঁর যাওয়ার কথা ছিল। আমাদের পোড়া দেশে শেষ-অবধি তলোয়ার দিয়েও তো ঘাস কাটাই হয়! ধীরে ধীরে তাঁরও আসে ক্লান্তি। তিনিও ভুলে যান কী অগাধ ক্ষমতা ছিল তাঁর ডুব দেওয়ার। অতল থেকে মাটি তুলে নতুন পৃথিবী গড়ার। যেন তিনি নিজের জীবনকেও আলাদা কোনও মূল্য দিলেন না। 

অনেক বারণ ছিল ডাক্তারদের, হালকা নেশার ফূর্তি তাঁকে ঘিরেই থাকত তবু। গোলমাল ছিল হৃদযন্ত্রে। কখনও একটু বিষণ্ণ হয়ে পড়তেন, আবার কখনও হা-হা করে হেসে উঠতেন। ঠিক তেমন করেই নিজের বড় ছেলের বিয়ের আসরে বাজারদা যেন সুরপাগল, আবার, নাচের মধ্যে আঘাত নামল, স্বর্গেরও বুঝি সহ্য হল না বিনা উপকরণের জীবন নিয়ে এমন প্রসন্ন ফূর্তি। মাত্র ৬১ বছর বয়সে বিদায় না জানিয়েই চলে গেলেন বাজারদা। উঠে গেলেন উৎসবের মাঝখান থেকে। রেখে গেলেন বিচ্ছেদকাতর জীবনসঙ্গিনী, ছেলেমেয়েদের, আর কখনও পূরণ না-হওয়া একটি জায়গা অগণিত মুগ্ধ শ্রোতা-দর্শক-পিপাসুর মনে।

জোহার বাজার হেমব্রম।

___ পড়ুন ধুলোমাটির মুখ কলামের অন্যান্য পর্ব ___

৫. ছুরিকাঁচির ভয়ের চেয়ে বন্দি থাকার ভয় বেশি

৪. ভালোবাসার সাহসের ভাষা জানলে দোভাষীর আর দরকার নেই

৩. যিনি লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেন, বই নিতে দেন– তিনি সর্বশক্তিমান

২. পথের কুকুর, আকাশের কাক-চিল, মাটির পিঁপড়েরও অন্নের ভাবনা গৃহস্থের

১. বেনারসে স্কুলে পড়ার সময় বহেনজির তকলি কাটার ক্লাসে বন্ধুদের ভাগেরও সুতো কেটে দিতাম