আমার এত সাহস কোথা থেকে এল গান গাওয়ার? এই বাংলা বাজারে কোথা থেকে আসে এই দুঃসাহস! হে হে, জিন? জিন থেকে, না যাপন থেকে? শুধুই কি পারিবারিক সাহস?
১.
দলাপাকানো সুতলিটা লেপটে রয়েছে পিচের রাস্তার ওপর। রুপোলি বারুদের একটা পাতলা আস্তরণ তার চারদিকে। গতকাল রাত-কাঁপানো শব্দে আছড়ে পড়েছিল কোনও না কোনও দলের পেটো। সাদা হাতাঅলা গেঞ্জি আর ধুতিটাকে প্রায় ল্যাঙটের মতো পরে, সত্তরের রাজপথ হোসপাইপ দিয়ে ধুয়ে যেত যে লোকটা, তার নাম জানা হয়নি কখনও। ভোরবেলা, বারান্দার ওপরে খবরের কাগজটা, দমাস করে পড়লেই ঘুম ভাঙত। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতাম, লোকটা চাপা কলের সঙ্গে হোসপাইপ লাগিয়ে কী যত্নের সঙ্গে ধুয়ে দিচ্ছে রাস্তার শরীরের আনাচকানাচ। উঁচু হয়ে ফোয়ারার মতো জল এসে পড়ত পিচরাস্তার বুকে। দারুণ লাগত দেখতে সে জল পড়া। গঙ্গার সঙ্গে কানেক্টেড চাপা কল দিয়ে গঙ্গার জল আসত। ওই নাম-না-জানা লোকটা, টিপ করে জল ফেলছে গতরাতের ফেটে যাওয়া বোমের পড়ে থাকা সুতলির ওপর। গঙ্গার জলে উঠে যাচ্ছে বারুদের রুপোলি দাগ। সুতলিগুলো জড়ো হচ্ছে নর্দমায়। গঙ্গার ঘোলা জলের তোড়ে ভেসে যাচ্ছে গত রাতের বিপ্লব।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
কোলাপসেবল গেটে কেউ একটা ধাক্কা দিচ্ছিল। বাবার নাম ধরে ডাকতেই, আমি চটাং করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে একজন অচেনা লোককে দেখলাম গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। স্কুল থেকে এসেছে শুনে ঘাবড়ে গেছিলাম। সামনের মাস থেকে আমাকে স্কুলে দেওয়ার কথা। সেটা নিয়ে একটু ঘাবড়েও ছিলাম ক’দিন। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ইনফ্যান্টে ভর্তি করা হয়েছে আমাকে। আজ থেকে পাক্কা ৫৪ বছর আগের কথা বলছি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সব কথা স্পষ্ট মনে থাকে না। কিছু কিছু দৃশ্য জীবনে দাগের মতো থেকে যায়। সবথেকে ছোট বয়সের কথা কী মনে আছে, ভাবতে গিয়ে একটু ধন্দ শুরু হয়ে গেল। সেদিন পোলিওর ভ্যাকসিন নিতে যাওয়ার কথা ছিল, গেলাম না। ভাইয়ের সঙ্গে একটা রুমাল নেওয়া নিয়ে ঝগড়া করে জেদ দেখানোর জন্য বাবা রেগেমেগে ভাইকে নিয়ে চলে গিয়েছিল, আমাকে বাড়িতে রেখেই। সেটাই কি আমার সবচেয়ে পুরনো স্মৃতি? কারণ কেন জানি না, আমার মনে আছে, সেদিন আমি দুধ খেয়েছিলাম বোতলে– একটা দু’-মুখো দুধ খাওয়ার কাচের বোতল থেকে। মুখ দুটো ছোট-বড় ছিল। দুধের বয়সের কি কিছু মনে থাকে? কিন্তু যেটা স্পষ্ট মনে আছে, সেটা একটা দুপুরবেলা। তখনও আমি স্কুলে ভর্তি হইনি। দিনের খাটাখাটনির পর মা আমাকে আর ভাইকে ঘুম পাড়াত। আসলে মায়ের ঘুমটা দরকার পড়ত স্বাভাবিকভাবেই। বর-শ্বশুর-শাশুড়ি-তিন দেওর-এক ননদ– তার ওপর বিবাহিত ননদের এক মেয়ে, প্লাস আমার আর সন্টাইয়ের মতো দুই বিচ্ছু ছেলেকে ভোরবেলা থেকে সামলে একটু ঘুম দরকার ছিল রায়বাড়ির সবথেকে আদুরে, সবথেকে ছোট্ট মেয়েটার। সে-ই ছিল মজুমদার বাড়ির একমাত্র বউমা কিনা! আমাদের ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়ত। আর মায়ের ঘুমের সুযোগ নিয়ে শুরু হত আমাদের যা যা করা যায়, সেই বয়সে– তার প্রায় সবই।
কোলাপসেবল গেটে কেউ একটা ধাক্কা দিচ্ছিল। বাবার নাম ধরে ডাকতেই, আমি চটাং করে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে একজন অচেনা লোককে দেখলাম গেটের সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে। স্কুল থেকে এসেছে শুনে ঘাবড়ে গেছিলাম। সামনের মাস থেকে আমাকে স্কুলে দেওয়ার কথা। সেটা নিয়ে একটু ঘাবড়েও ছিলাম ক’দিন। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, ইনফ্যান্টে ভর্তি করা হয়েছে আমাকে। আজ থেকে পাক্কা ৫৪ বছর আগের কথা বলছি। যতটুকু মনে পড়ছে– জন, আমার স্কুলের বাসের দারোয়ান, আমাকে ইংরেজিতে কী একটা বলায় আমি বুঝতে না পেরে বলেছিলাম, ‘ক্যালকাটা’। জন জিজ্ঞাসা করেছিল আমার নাম, আর আমি বুঝেছিলাম কোথায় থাকি জিজ্ঞাসা করছে বোধহয়। সেন্ট পল্সের কে. জি. স্কুলের বাস ড্রাইভার, শম্ভুদা, সেটা জানার পর আমাকে ‘ক্যালকাটা’ নাম দিয়ে দিয়েছিল। তখন আমার অষ্টোত্তর শতনাম প্রায়। মায়ের ‘শিলান’, বাবার স্ট্রেট ‘শিলু’, ছোটকাকুর ‘খোকা’, ঠাকুরদার ‘শিলটন’, পাশের বাড়ির মারোয়ারি দিদির ‘শিঙ্কু’, কাজল কাকুর ‘শিল্টু’, স্কুল বাসে ‘ক্যালকাটা’ আর কোড্ডের দাদুর ‘রসসিন্ধু’। রসগোল্লা খেতে ভালবাসতাম বলে দাদু ওই নাম দিয়েছিল কি না জানি না, কিন্তু আমার মায়ের বাবার দেওয়া ওই ‘রসসিন্ধু’ নামে কেউ কখনও ডাকেনি। দাদুই ডাকত কেবল। দাদু সবাইকে নিজস্ব দেওয়া নামে ডাকাতে একটু মজা পেতেন। রস ছিল দাদুর।
নানাভাবে মনে আছে দাদুকে, তার সব অবশ্য মিষ্টি ছিল না। কাছারি থেকে ফেরার সময় দাদুর পার্সোনাল সাইকেল রিকশায় পা রাখার জায়গায় ঝুড়ি ভরে যেমন আম-লিচু আসত, তেমনই আবার ওই সাইকেল রিকশায় কাছারি যাওয়ার সময় দাদুকে টাঙি নিয়েও যেতে দেখেছি। ইয়েস, টাঙি। ধারালো টাঙি নিয়ে রামতরণ রায়কে দেখেছি সিউড়ির কাছারিতে যেতে। অকুতোভয়। সে গল্প বলব, অন্যদিন। আমার দাদু-ঠাকুরদাদের চিনলে, আমাকে চিনতে সুবিধে হবে। পাঠকদের বোঝার সুবিধে হবে, আমার এত সাহস কোথা থেকে এল গান গাওয়ার। এই বাংলা বাজারে কোথা থেকে আসে এই দুঃসাহস! হে হে, জিন? জিন থেকে, না যাপন থেকে? শুধু কি পারিবারিক সাহস? পাড়াতুতো সাহস, পাড়াতুতো হিউমার, পাড়াতুতো অন্যরকম ভাবনার চর্চা না পেলে কি আর সাহস পেতাম অন্য রকম কিছু ভাবার?
আমার পরিবারের মতো পাড়াতেও অন্য রকম ভাবনার প্র্যাকটিস ছিল। বলব সে কথা।
…শিলালিপি-র অন্যান্য পর্ব…
শিলালিপি পর্ব ১১: ব্রিটিশদের তাক করতে বোমা বাঁধা হয়েছিল, আজ বুথ দখল করতে
শিলালিপি পর্ব ১০: আমি গুন্ডা হলেও জনপ্রিয় গুন্ডাই হতাম
শিলালিপি পর্ব ৯: বারবার শূন্য থেকে শুরু করতে হলেও রাজি আছি
শিলালিপি পর্ব ৮: শিলাজিৎ মুম্বইতে কী হারাবে পাগলা, মুম্বই হারিয়ে ফেলতে পারে শিলাজিৎকে
শিলালিপি পর্ব ৭: চাকরি ছাড়ার পরদিন দেরি করে ঘুম থেকে উঠেই চিৎকার– ‘আমি আর টাই পরব না’
শিলালিপি পর্ব ৬: পকেটমারির ভয়ে মাইনের দিন ১০ কিমি হেঁটে বাড়ি ফিরতেন বাবা
শিলালিপি পর্ব ৫: আমার জীবনে আমি চোরের জন্য বাজেট রাখি
শিলালিপি পর্ব ৪: বিদ্যাসাগরের কথা কেমন যেন ঘেঁটে গেছিল আমার সেদিন
শিলালিপি পর্ব ৩: আমি স্মার্ট চোর ছিলাম, ওয়ালেট বুঝে চুরি করতাম
শিলালিপি পর্ব ২: গুলি থেকে বাঁচিয়েছিল উত্তরের গলি, আমি ছিলাম সাক্ষী