বৃষ্টিধোয়া শেয়ালদা স্টেশনের প্যাচপ্যাচে কাদা, মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের মতো খানা-খন্দের গচ্ছিত জল, পথচলতির গুলতানি, মুটে-মজুরের গুঁতোয় সেঁধিয়ে যাওয়ার মধ্যে বিরক্তি মিশ্রিত একটা আলগা ভালোলাগা আছে। কেমন যেন আলগোছে আদিম কলকাতায় ফিরে যাওয়া যায়। বৃষ্টি-বাদলার জল-কাদায় ছপর-ছপর করা এমনিই বিশেষ প্রিয়। তার ওপর পুরাতন শুঁড়িখানা নামক মায়াকুম্ভ তল্লাশির অর্থ, মুকুলের সোনার কেল্লা সন্ধান! আপিসেরই এক বন্ধুবর শেয়ালদার ‘গ্র্যান্ড টাওয়ার’ নিয়ে মেলা ঘ্যানরঘ্যানর করে কানের পোকা বের করে দিয়েছিল মাঝে। ‘টাওয়ার’ না গেলে নাকি নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাল টানার মাধুর্য বোঝা যাবে না।
৬.
কবে, কখন, কী ভাবে যে বিজ্ঞাপনখানা হাতে এসে পড়েছিল, আজ আর মনে নেই। তবে হলদেটে কাগজে তার শব্দের ছোপ, মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময়বোধকের ব্যবহার, আদর-আপ্যায়নের আমন্ত্রণ, কিছুমাত্র ভুলিনি।
সারাদিনের পরিশ্রমের পর আপনার
দেহ ও মনকে সুস্থ করে তুলতে হলে
উপাদেয় খাদ্য ও পানীয়ের
!!! প্রয়োজন !!!
Wine & Food
টাওয়ার হোটেল রেস্টুরেন্ট
সকল প্রকার খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা আছে।
আপনার ক্লান্তি মোচনের সকল ভারই আমরা গ্রহণ করব।
বৃষ্টিধোয়া শেয়ালদা স্টেশনের প্যাচপ্যাচে কাদা, মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের মতো খানা-খন্দের গচ্ছিত জল, পথচলতির গুলতানি, মুটে-মজুরের গুঁতোয় সেঁধিয়ে যাওয়ার মধ্যে বিরক্তি মিশ্রিত একটা আলগা ভালোলাগা আছে। কেমন যেন আলগোছে আদিম কলকাতায় ফিরে যাওয়া যায়। বৃষ্টি-বাদলার জল-কাদায় ছপর-ছপর করা এমনিই বিশেষ প্রিয়। তার ওপর পুরাতন শুঁড়িখানা নামক মায়াকুম্ভ তল্লাশির অর্থ, মুকুলের সোনার কেল্লা সন্ধান! আপিসেরই এক বন্ধুবর (লেখায় আজকাল নাম লিখলে বেজায় রাগ করে) শেয়ালদার ‘গ্র্যান্ড টাওয়ার’ নিয়ে মেলা ঘ্যানরঘ্যানর করে কানের পোকা বের করে দিয়েছিল মাঝে। ‘টাওয়ার’ না গেলে নাকি নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাল টানার মাধুর্য বোঝা যাবে না। ৪০০ টাকার লজ, ১০ টাকার রোনাল্ডো বিড়ি, ৩০ টাকার মাছ-ভাতের জীবন যাঁদের। কিংবা সারাদিন গাধার খাটুনি খেটে রাত্তিরের বনগাঁ লোকাল ধরেন যাঁরা। নিজেও কোথাও থেকে শুনেছিলাম যে, শেয়ালদা-র টাওয়ারে আলাদা ড্রেস কোড চলে! স্যান্ডো গেঞ্জি-প্যান্ট বা লুঙ্গি! নোনা দেওয়াল থেকে যিশু ছলছল চোখে না তাকালেও মাথার উপর ঘটর-ঘটর করে যে ফ্যানখানা ঘোরে, তা নিঃসন্দেহে খ্রিস্টযুগের! বেয়ারা নুন-লঙ্কা মাখানো পেয়ারা দিয়ে যায়। বিয়ার-হুইস্কি-রাম যে কোনও ফোয়ারার যা একমাত্র সহযোগী বা সহচরী!
ভাবিনি, বিস্তর গলিঘুঁজি ঘুরে, একে-তাকে-ওকে জিজ্ঞেস করে, শেয়ালদা ফ্লাইওভারের পাশে যে টাওয়ারের সামনে দাঁড়াব, তা দেখে ফোয়ারার নয়, ‘ফুয়েরার’-এর মেজাজ হয়ে যাবে! এই নাকি লোকজনের এত সাধের টাওয়ার! এর জন্য এত নালঝোল, এই বিটকেল বকচ্ছপের এত বোলবোলাও? রামোঃ। মনে-মনে আপিসের বন্ধুবরের উদ্দেশ্য একচোট গাল পেড়ে নিলাম। পাড়ব না? দিলে পুরো বিকেলটা মাটি করে! পাঁঠার মাংস কখনও কাঁটাচামচ দিয়ে খাওয়া যায়? শোভাবাজার রাজবাড়িতে কখনও রাম্পওয়াক হবে? আদিমতা আর আধুনিকতা (সেটাও অক্ষম) জোট বাঁধে কখনও ? সামান্য ণত্ব-ষত্ব জ্ঞান নেই?
জরাজীর্ণ ১২৫ বছরের পুরনো বাড়ির বগলে যে ঝিকমিক-চিকমিক বার, নাম যার গ্র্যান্ড টাওয়ার, তাকে তোমরা বেড়ালও বলতে পারো, রুমালও বলতে পারো, চন্দ্রবিন্দুও বলতে পারো! কারণ, জগাখিচুড়ি পাকিয়ে তা যে আদতে ঠিক কী, তার ঠিক-ঠিকানা নেই। আশপাশের শিয়ালদা চত্বরের চ্যাঁ-ভ্যাঁ, ফেরিওয়ালার হাঁকডাক, ঝিরঝিরে বৃষ্টির ঝুপসি অন্ধকারের মধ্যে কি না বারের নামে মুখে রং মেখে বাবাজীবন সং সেজেছেন! ভেতরে গেলে গা-পিত্তি আরও জ্বলে যাবে। শস্তার কায়দাবাজি লাইট, দেওয়াল জোড়া পুরনো কলকাতার কয়েকগাছি ছবি, বাতানুকূল যন্ত্রের চাপা আর্তনাদ, খুপচি-খুপচি টেবল-চেয়ার, উর্দি পরা বেয়ারা। অথচ লাগোয়া টাওয়ার লজে ঝুল জমেছে, দেওয়ালে মৃত্যুর দিন গুনছে ক্লান্ত পলেস্তারা। বারের ছাদ থেকেও পুরনো দিনের ফ্যানের নিথর আংটা দেখলাম মনে হল। বুঝলেন, কেন টাওয়ারকে পূর্বে বিটকেল বকচ্ছপ লিখেছিলাম?
আর যতটা ন্যক্কারজনক তার এ হেন নয়া বাহার, ততধিক লজ্জাজনক তার পানাহার। ফাঁকা (নাকি ফাঁপা) টাওয়ারে ঢোকা মাত্র, দু’জন উর্দিধারী শশব্যস্তে টেবিলের এক কোনা দেখিয়ে দিলেন। ওখানেই নাকি বসতে হবে! কারণ তখনই বিভিন্ন ট্রেন থেকে নেমে পিলপিলিয়ে এমন খদ্দের আসবে যে, পুঁচকে বার মূহূর্তে ‘মাল’-গাড়ি হয়ে যাবে! দুঃখের হল, লেখার তাড়নায় অতি কষ্টে ঘণ্টাখানেক বসে থেকেও একটা পিঁপড়ের দেখাও পেলাম না! কর্মীরা বসে সান্ধ্য গজল্লা করছেন। সাত বার ডাকলে একবার উত্তর আসছে। কারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই, ন্যূনতম আগ্রহ নেই। যাই হোক, সত্তর বার ডাকার পর একজন জগৎ কৃতার্থ করে এলেন। এসে কী কী নেই, তার ফর্দ গড়গড়িয়ে বলে গেলেন! বাডওয়াইজার নেই, বিরা নেই, কার্লসবার্গ নেই। ছাপানো তালিকায় লেখা আছে সবিস্তার। কিন্তু নেই। থাকার মধ্যে সবেধন নীলমণি টিউবর্গ আর কিংফিশার (ঠাঁটবাঁট দেখাতে হলে তা কিন্তু থাকাও উচিত)। পিতৃপুরুষের অসীম পুণ্যে শেষ পর্যন্ত দু’পাত্তর ওল্ড মঙ্ক পেলাম। সঙ্গে আদাকুচি। ছ্যাতরানো ছোলা। খাবার কী আছে জানতে চাওয়ায়, আবার একখানা ফর্দ ধরানো হল, ফের জানানো হল, কী কী নেই! খুঁজে পেতে নুনে কাটা ফিশ ফিঙ্গার জোটানো গেল, যার খোকা সাইজের চার পিসের দাম একশো আশি টাকা! মানে, দু’পেগ রাম আর সামান্য খাবার খেতে পাঁচশোর কাছাকাছি চলে যাবে। হুইস্কি কিংবা বিয়ার হলে খরচ আরও বেশি।
কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না, এতটা অধঃপতন হল কীভাবে? নিম্ন-মধ্যবিত্ত, খেটে খাওয়া শ্রেণি এত খরচ করে এখানে আসবে নাকি? কখনও সম্ভব? পরতায় পোষাবে?এক কালে শুনেছিলাম, টাওয়ারে বিয়ারের দাম বাজারদরের চেয়ে কুড়ি-পঁচিশ টাকা বেশি নেওয়া হত মাত্র। চাইলেই মিলত নুন-লঙ্কা মাখা পেয়ারার টুকরো। কোভিডের ঈষৎ আগেও বিয়ার বোতল পিছু দু’শো গিয়েছে। দু’জন এলে চারখানা বড় বিয়ার আর চার-পাঁচ রকম খাবার (মুরগি-ফিশ ফ্রাই-ডিমের ডেভিল সহযোগে, খাবার আগেও বাইরে থেকে আনানো হত, আজও তাই। তফাত হল, ‘নেই’-এর তালিকা ‘আছে’-র জায়গা নিচ্ছে ক্রমশ) সর্বমোট মেরেকেটে বারোশো লাগত। আর এখন দু’জন মিলে চরণামৃতের মতো মদ আর খুঁদকুড়ো খাবার খেতেই আটশো চলে যাবে! অবশ্যি আগে হলদে দেওয়াল আর প্লাস্টিকের লাল চেয়ার ছিল। কড়িবরগার ঝিমুনি ছিল। ঘড়ঘড়ে পাখার হাহাকার ছিল। পায়ের কাছে মেনি বেড়াল ছিল। এখন সেখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বড়লোকি বাতাস। মেনিও আর আসে না, ল্যাজ পেতে বসে না।
পুরনো খরিদ্দারও কি আসে? আসে নাকি ট্রেন-জনতা?
‘ধুর, ধুর। অনেক কমে গিয়েছে। এত দাম করলে পারে আসতে,’ ব্যাজার মুখে বলছিলেন এক উর্দিধারী। পুনরায় শুধোলাম, ‘এক সময় তো কুড়ি-পঁচিশ টাকা বেশিতে বিয়ার পাওয়া যেত শুনেছি।’ ঝটিতি উত্তর আসে, ‘হুঁ। আর এখন একশো পঁচিশ টাকা বেশিতে!’ পাশ থেকে আবার একজন ফুট কাটলেন, ‘আমরা তো কর্মচারী। পাঁঠা মালিকের। তা, এবার মালিক পাঁঠা কোত্থেকে কাটবে, ল্যাজা না মুড়ো, মালিকের ব্যাপার।’
যা বুঝলাম, এই নতুন মালিক মহাশয়ই যত নষ্টের গোড়া! মার্কিন ফেরত এ আমরিকি বাবু (কী যেন এক গুহ মজুমদার, ভুলে গিয়েছি) গত সেপ্টেম্বর থেকে টাওয়ারের সমস্ত বোলচাল বদলে দিয়েছেন। পীতজ্বর আক্রান্ত দেওয়াল, ক্ষয়াটে কড়িবরগা, পেয়ারের মেনি, শস্তার মদ, পেয়ারা টুকরো, শাকালুর কোয়া, সব বরখাস্ত হয়ে গিয়েছে। বাতিল হয়ে গিয়েছে ‘টাওয়ার’-এর পুরনো ঘর, ফুরনো ঘর, কুড়োনো জঞ্জাল। সর্বাধিক বাতিল হয়েছে ‘দো ঘণ্টো কা শের’-রা। যারা নিত্য আসত। মদে চুমুক দিয়ে অচেনাদের সঙ্গে এক গেলাসের বন্ধুত্ব করত। দেশের সরকার ফেলে দিত। প্রধানমন্ত্রী বদলে দিত। তারপর শেয়ালদা বাজারের কম দামি তরতরকারি কিনে ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে যেত। কেউ কাউকে চিনত না। তবু কেউ কাউকে ভুলত না।
সে ‘টাওয়ার’ আর নেই। গত সেপ্টেম্বর থেকে তা ভেঙে পড়েছে। মাতালরা বহু দিন হল কানেকশন পায় না। শেয়ালদায় যে গ্র্যান্ড টাওয়ার আছে এখন, তা দেখে, ‘ডি লা গ্র্যান্ডি’ কিংবা ‘ইয়াক, ইয়াক’ কিছু আর বলাও যায় না। করারই নেই কিছু।
পুরোটাই যে আজ ওয়াক, ওয়াক!
লেখার সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিগুলো ইন্টারনেট সূত্রে প্রাপ্ত
… পড়ুন বারবেলা-র অন্যান্য পর্ব…
৫. যে পানশালার প্যাঁচালো সিঁড়ি, খোলা জানালা, লাল মেঝে-খসা পলেস্তারায় পুরনো প্রেমিকার মায়া
৪. একসময় কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল নিউ ক্যাথে রেস্তোরাঁ-কাম-বারে
৩. ‘চাংওয়া’-র কেবিনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাসরঘর!
২. মহীনের ঘোড়াগুলির প্রথম ‘আস্তাবল’ ডিউক
১. তেতাল্লিশের মন্বন্তরে ‘বার’ থেকে ‘রেশন সেন্টার’ হয়ে উঠেছিল ব্রডওয়ে