Robbar

স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 27, 2024 8:55 pm
  • Updated:August 27, 2024 8:58 pm  

তখন ঘরে ঘরে টিভি ছিল না, পাড়ায় হয়তো একটি বাড়িতে টিভি, সবাই জড়ো হতেন সেখানে। আমিও প্রথম দিন গেলাম পাড়ার এক পরিচিতের বাড়িতে। কাঠের ঢাকনা দু’পাশে সরিয়ে টিভি সেট চালু করা হল। ঝিরঝির করে লাইন আসছে, ঠিক মতো দেখা যাবে কি না, সংশয় গৃহকর্তার। তারপরেই ভেসে ওঠে ছবি, শর্মিষ্ঠাদির, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে জানায়, ‘নমস্কার’। হ্যাঁ, কলকাতা টেলিভিশনের প্রথম ঘোষিকা শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত। অনেক জায়গায় বলা হয়, আমি বা শাশ্বতী টেলিভিশনের প্রথম মুখ, কথাটা ভুল।

চৈতালি দাশগুপ্ত

পরদিন সকালবেলা লালে-হলুদে মেশানো বাটিকের শাড়ি পরে (যেহেতু শুনেছি শান্তিনিকেতন, তাই বাছলাম বাটিকের শাড়ি) সেজে গেলাম টেলিভিশন সেন্টারে। গেট দিয়ে ঢুকে যে কাঠচাঁপা গাছের কথা বলেছিলাম, তার তলা থেকে কুড়িয়ে নিলাম কিছু ফুল। তখনও বিশদে জানি না কী বিষয় নিয়ে সংযোজনা করব কিন্তু সাজটি পরিপাটি হওয়া চাই তো!

মিউজিক সেকশনের ঘরে গিয়ে দেখি ও মা! এ কী! আমার একান্ত ভালোবাসার শ্রদ্ধার মানুষ বাচ্চুদি বসে আছেন– নীলিমা সেন। গিয়ে প্রণাম করি। বিস্ময়ের তখনও বাকি, এলেন সুপ্রিয়দা, সুপ্রিয় ঠাকুর, পাঠভবনের তৎকালীন অধ্যক্ষ আর এলেন সংগীতজ্ঞ সুভাষ চৌধুরী। বাচ্চুদি গাইবেন রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান, সুপ্রিয়দা পড়বেন কবিতা, সুভাষদা বাজাবেন এসরাজ। আমাকে পুরো অনুষ্ঠান উপস্থাপন করতে হবে এই নির্দেশ দিলেন প্রযোজক। বাচ্চুদি কী কী গান গাইবেন জেনে নিয়ে আমি একটা কাগজে চটপট লিখে ফেলি– কীভাবে গাঁথব অনুষ্ঠান। এত তাড়াতাড়ি যে লেখাটা সম্ভব হবে সেটা ভাবেননি ইন্দ্রাণীদি, লেখাটা পড়ে শোনালাম, খুশি হলেন। শর্মিষ্ঠাদিকে তারিফ করলেন আমাকে নির্বাচন করার জন্য। এরপর গেলাম স্টুডিও চত্বরে, স্টুডিও সংলগ্ন এক চিলতে জায়গার মধ্যে মেক আপের সরঞ্জাম নিয়ে যিনি রয়েছেন জানলাম তাঁর নাম সিরাজুল ইসলাম। হালকা মেক আপের পরে কিছু আগে তোলা ফুলগুলি লাগিয়ে নিয়ে আমার নিজস্ব স্টাইলে সেজে নিই। এবার যেতে হবে স্টুডিও ফ্লোরে।

Buy Nilima Sen - Songs On Rabindranath | Musiccircle

তারিখটা ১৯৭৫-এর ১৪ জুলাই, কলকাতা টেলিভিশনের স্টুডিওতে আমার প্রথম পদার্পণ। নাচের সময় যেমন স্টেজে প্রণাম করে উঠতাম, সেরকম মনে মনে প্রণাম করে পা রাখি সেখানে। সুন্দর করে সেট সাজানো হয়েছে অনুষ্ঠানের জন্য। প্রথমে যাঁর সঙ্গে আলাপ হল, তিনি হলেন ফ্লোর ম্যানেজার ধ্রুব মিত্র, সৌম্যদর্শন, কথা বলেন কী সুন্দর করে, ভালো লেগে গেল। তিনটে ইয়া বড় বড় ক্যামেরা, বলে দিলেন আমাকে কোন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে, তবে সবাইকে একসঙ্গে নেবে অন্য ক্যামেরা, সেটা বুঝতে হবে ক্যামেরার ওপর একটা লাল আলো জ্বলবে, তা দেখে। এবার আলাপ হল ক্যামেরা অপারেট করছেন যে-তিনজন তাঁদের সঙ্গে– সুব্রত কর, শাক্যসিংহ ধর, বনবিহারী পাহাড়ী, পরবর্তীকালে যাঁরা হয়ে উঠেছিলেন আমার বন্ধু, আমার স্বজন। ক্যাপশন স্ট্যান্ডে রাখা কতকগুলি কাগজের বোর্ড, অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের নাম লেখা, একটি বোর্ডে লেখা, উপস্থাপনায় চৈতালি সেন, বেশ শিহরণ হল দেখে! স্টুডিওর একপাশে কাচের দেওয়াল, সেখান  দিয়ে দেখা যাচ্ছে অনেককে, বলা হল, ওখান থেকেই রেকর্ডিং করা হবে।

…………………………………………………………………

পড়ুন গানস অ্যান্ড রোজেস: বব ডিলানের এই গান ভবিষ্যৎবাণীর মতো নিদান দেয়– যুদ্ধ আসন্ন

…………………………………………………………………

ধ্রুব মিত্র কাউন্ট ডাউন শুরু করলেন, স্টুডিও জুড়ে নিস্তব্ধতা! কীভাবে কিউ দেবেন সেটা আগে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, এবার কিউ দিলেন ধ্রুবদা, আমি ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে শব্দের পর শব্দ, কথার পর কথা গাঁথলাম। একটু আগেও বুক ধুকপুক করছিল কিন্তু ক্যামেরা চালু হতে সেটা একেবারে চলে গেল, আমি স্বচ্ছন্দে বলে গেলাম। আমার বলার পরে বাচ্চুদি ধরলেন তাঁর প্রথম গান ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল…’। এরপর সুপ্রিয়দার কবিতা পাঠ, আমার কথা, আবার গান। বাচ্চুদি শেষ গান যখন গাইছেন, ‘আজি তোমায় আবার চাই শুনাবারে…’ তখন স্টুডিওর অত আলোর মধ্যেও মনে হচ্ছে বাদলের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। স্টুডিওর কাচের দরজা ঠেলে বাইরে এসে দেখি অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে।

সুপ্রিয় ঠাকুর

এ-সবই সলতে পাকানোর গল্প, প্রদীপখানি জ্বলতে অর্থাৎ সম্প্রচার শুরু হতে তখনও প্রায় একমাস বাকি।

১৯৫৯-এ দিল্লির আকাশবাণী ভবন থেকে একটা মেক শিফ্ট স্টুডিও থেকে সম্প্রচার শুরু হয়েছিল, তখন সপ্তাহে মাত্র দু’দিন করে এক ঘণ্টার ট্রান্সমিশন হত। মূলত উন্নয়নমূলক শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা হত। তারপর ১৯৬৫-তে দিল্লি টেলিভিশন এবং ১৯৭২-এর বম্বে (অধুনা মুম্বই) টেলিভিশন শুরু হয়েছিল। কলকাতার ক’দিন পরেই ১৫ অগাস্ট শুরু হয়েছিল মাদ্রাজে (অধুনা চেন্নাই)। যাঁর পরিকল্পনায় এবং উদ্যোগে টেলিভিশনের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। টেলিভিশনকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি একটি প্রকল্প নিয়েছিলেন, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিদিন একটি করে ট্রান্সমিটারের উদ্বোধন হবে। এই প্রকল্প খুবই সফল হয়েছিল।

এল কলকাতার পালা। সময় যত এগিয়ে আসতে থাকে কাজের তৎপরতা বাড়ে তত। যখনই যাই দেখি সাজো সাজো রব। এরই মধ্যে একদিন পঙ্কজদা নিয়ে গেলেন এই কর্মযজ্ঞের সর্বময় কর্ত্রী স্টেশন ডিরেক্টর মীরা মজুমদারের ঘরে। প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এক কথায় ‘এলিগেন্ট’, আভিজাত্যপূর্ণ চেহারা। ওঁদের মধ্যে আগে কী কথাবার্তা হয়েছিল জানি না, পরিচয় হওয়ার পর কেবল জিজ্ঞেস করলেন গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট কবে বেরোবে, আমিও জানালাম। খুব একটা বাক্য বিনিময় হয়নি, গম্ভীর প্রকৃতির মনে হল। পরে জেনেছিলাম, আমাকে অ্যানাউন্সার হিসেবে নেওয়ার জন্য পঙ্কজদা ওঁকে বলেছিলেন। যে পদের জন্য ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল গ্র্যাজুয়েট।

…………………………………………………………………

পড়ুন ছবিঠাকুর: কলাভবনে নন্দলালের শিল্পচিন্তার প্রতি কি সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছিলেন না রবীন্দ্রনাথ?

…………………………………………………………………

সেই বিশেষ দিন এসে গেল। ১৯৭৫-এর ৯ আগস্ট। শুরু হল কলকাতা টেলিভিশনের সম্প্রচার। তখন ঘরে ঘরে টিভি ছিল না, পাড়ায় হয়তো একটি বাড়িতে টিভি, সবাই জড়ো হতেন সেখানে। আমিও প্রথম দিন গেলাম পাড়ার এক পরিচিতের বাড়িতে।

কাঠের ঢাকনা দু’পাশে সরিয়ে টিভি সেট চালু করা হল। ঝিরঝির করে লাইন আসছে, ঠিক মতো দেখা যাবে কি না, সংশয় গৃহকর্তার। তারপরেই ভেসে ওঠে ছবি, শর্মিষ্ঠাদির, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে জানায়, ‘নমস্কার’। হ্যাঁ, কলকাতা টেলিভিশনের প্রথম ঘোষিকা শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত। অনেক জায়গায় বলা হয়, আমি বা শাশ্বতী টেলিভিশনের প্রথম মুখ, কথাটা ভুল। সম্প্রচার শুরুর আগে থেকেই উপস্থাপনায় এসেছি সে গল্প আপনাদের বলেছি কিন্তু নিত্যদিনের ঘোষণায় এসেছি অনেক পরে, তার আগে অবধি সংযোজক ছিলাম। আমাদের আগে অনেক ঘোষিকা ছিলেন, তাঁদের কথা পরে বলব। প্রথম দিনের সম্প্রচারে বিশিষ্ট অতিথি যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে দিল্লি থেকে এসেছিলেন, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী বিদ্যাচরণ শুক্লা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশংকর রায় এবং তাঁর স্ত্রী মায়া রায়, রাজ্যের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেছিলেন, রুমা গুহ ঠাকুরতার পরিচালনায় ক্যালকাটা ইউথ কয়ার। প্রথম দিনের সংবাদ পাঠক তরুণ চক্রবর্তী।

……. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব……

পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে