ট্রান্সমিশনে যাবার আগে ঘোষণার কাগজ বড়ুয়াদাকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে যেতে হত। একদিন একটি বাক্য আমি লিখেছিলাম, ‘আপনাদের গান গেয়ে শোনাচ্ছেন……’, বড়ুয়াদা সংশোধন করে লিখতে বললেন, ‘এখন সঙ্গীত পরিবেশন করছেন….’, রেডিওর ভাষার ঘেরাটোপ থেকে তখনও বেরোতে পারেননি, অথচ আমি তো জানি, অডিও ভিসুয়াল মাধ্যমে সংযোগের ভাষা হবে অনেক সহজ, অলংকার অর্জিত। আমরা যে দৃশ্যত: দর্শকের ড্রইংরুমে পৌঁছে যাচ্ছি ওই ছোটবাক্সের মধ্যে দিয়ে! দেখলাম তর্ক করে লাভ নেই, সংশোধিত বাক্যটি লিখে নিয়ে চলে গেলাম, কিন্তু ঘোষণার সময় নিজস্ব ভঙ্গীতে হেসে বললাম, ‘এখন আপনাদের গান গেয়ে শোনাচ্ছেন…..’, এভাবেই ধীরে ধীরে সৃষ্টি হতে লাগল টেলিভিশনের ভাষা।
৫.
রাধা স্টুডিওর গেট দিয়ে ঢুকতেই বাঁ-হাতে ক্যান্টিন, তার সামনে লম্বা বেঞ্চ, চা হাতে আড্ডা মারার জায়গা, ভেতরেও হইহই দিনরাত। এগিয়ে গেলেই সামনে রিসেপশন, তার পাশেই লাইব্রেরি, ফিল্ম লাইব্রেরি, মনে রাখতে হবে, তখন কাজ হত ফিল্মে, ভিডিও এসেছে অনেক পরে।
এই ঘরের সামনেই আলাপ হল লাইব্রেরিয়ান অপর্ণা ব্যানার্জির সঙ্গে, তন্বী, সুশ্রী। এই আলাপ একসময় বন্ধুত্বে পরিণত হয় তখন অপর্ণা অপু আর চৈতালি কেয়া হয়ে গেছে। পাশাপাশি অনেকগুলো ঘর, কনফারেন্স রুম, ড্রামা সেকশন, গ্রাফিক সেকশন। নাটক বিভাগের ঘরের অধিপতি বিভাস চক্রবর্তী, সঙ্গে আছেন সুব্রত মুখার্জি। গ্রাফিকের ঘরে আছেন যে ছবি আঁকিয়েরা তাঁরা হলেন তপতীদি, অর্চনাদি, নির্মলেন্দুদা, সমীর চক্রবর্তী এবং গৌতম ভৌমিক। গৌতমকে চিনি অনেক দিন ধরে, শান্তিনিকেতন আশ্রমিক সঙ্ঘে একসঙ্গে ছিলাম আমরা, যেমন গান গায় তেমন ছবি আঁকে।
এরপর এগোলেই সিঁড়ি, দোতালায় উঠে গেলেই পরপর রয়েছে প্রিয়দর্শী সেন, বিশ্বনাথ দাস এবং অভিজিৎ দাশগুপ্তর ঘর। প্রিয়দর্শীদা ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশনের উচ্চপদস্থ মানুষ হলে হবে কী, খুবই আলাপী, ক’দিনেই ভাব হয়ে গেল। বিশ্বনাথদা দেখতেন স্পোর্টস সেকশন, কত বড় বড় খেলোয়াড়কে দেখেছি ওই ঘরে আসতে। আর অভিজিৎদা ‘Youth Time’ প্রযোজনা করতেন, আর কত ভালো ভালো তথ্যচিত্র যে উপহার দিয়েছেন দর্শককে তার ইয়ত্তা নেই! অভিজিৎদার কোনও স্পেশাল অনুষ্ঠান করতে ঊষা উত্থুপ একদিন এল। এখনকার চেহারার সঙ্গে তার মিল নেই, সেই থেকে আলাপ, আজও দেখা হলে পুরনো দিনের সেই সব কথা হয়।
অভিজিৎদাকে অ্যাসিস্ট করত গোপা ঘোষ, প্রাণোচ্ছল এক মেয়ে, দারুণ গান গায়, যেমন ইংরেজি গান তেমনি বাংলা সেমিক্লাসিকাল! জোরদার এক বন্ধুত্ব হল। অনেক কাল পরে গল্ফ গ্রিনের নতুন বাড়িতে যাওয়ার পর যখন স্পনসারড প্রোগ্রাম চালু হল, তখন রাজার করা প্রথম কাজ বাণী বসুর গল্প নিয়ে ‘মিসেস গুপ্তরা’-তে (‘সম্পর্ক’ সিরিয়ালের অন্তর্গত) প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিল। আরেকটি মেয়ে অভিজিৎদাকে অ্যাসিস্ট করত, তারও খুব ভালো গানের গলা। ওর নাম সীমা।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে সামনের একতলা বিল্ডিং এর দিকে গেলে ডান হাতে প্রথমেই পড়বে শিপ্রাদির ঘর, অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন ডিরেক্টর শিপ্রা রায়। আপাতদৃষ্টিতে খুব কঠিন মহিলা, সব সময় যেন রেগে রেগে কথা বলছেন, কিন্তু হৃদয়টি যে মায়াময় তা বুঝতে সময় লেগেছিল।এই ঘরটির প্রতি আমার কিছুটা দুর্বলতা ছিল কারণ, সেই যে প্রথম দিন এসেছিলাম পঙ্কজদার সঙ্গে দেখা করতে তরুণদের জন্য অনুষ্ঠানে সংযোজনের ব্যাপারে তখন উনি ওই ঘরে বসতেন, অফিস তখনও চালু হয়নি। উল্টোদিকে অলোক সেন বসতেন, অলোকদা দেখতেন বিজ্ঞান প্রসঙ্গ, পাশের ঘরে পঙ্কজদা সাহিত্য-সংস্কৃতি।
আরেকটু এগিয়ে করিডরের এদিকটা যেখানে শেষ, সেখানে যাঁর ঘর তিনি হলেন ইঞ্জিনিয়ার ইনচার্জ, আমরা বলতাম E N C P.T. Srinivasan, কারিগরি বিভাগের অধিকর্তা। করিডরের অন্য প্রান্তের শেষে আমাদের সর্বোময় কর্ত্রী অর্থাৎ স্টেশন ডিরেক্টর মীরা মজুমদারের ঘর। এরই দু’পাশে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে একটি ছোটখাটো মিষ্টি চেহারার দু’-বেণী করা মেয়ের কথা বলি। নাম অনন্যা ব্যানার্জী, তরতর করে ইংরেজি বলে, কথাবার্তায় দারুণ স্মার্ট, সোজাসাপ্টা ভঙ্গী। কিশোরদের অনুষ্ঠান ‘হরেকরকমবা’র (শুনেছিলাম নামটি বিভাসদার দেওয়া) প্রযোজক। ওকে অ্যাসিস্ট করত সরিতা চোপড়া।
ছোটদের অনুষ্ঠান ‘চিচিং ফাঁক’ প্রযোজনা করতেন যূথিকাদি, যূথিকা দত্ত, উনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ দেখতেন, সেটি হল মেয়েদের ম্যাগাজিন প্রোগ্রাম ‘ঘরে বাইরে’। অনন্যার ঘরের উল্টোদিকে লম্বাটে একটা ঘর সংগীত বিভাগের। এ-বিভাগের ইন্দ্রাণীদি, শর্মিষ্ঠাদির কথা আগেই বলেছি, এঁদের সঙ্গে যোগ হল আরেকটি নাম মালতী মুখোপাধ্যায়। সংগীত বিভাগের পাশের ঘরে অবিনাশ চক্রবর্তী বসতেন। কথায় সিলেটি টান, খুব মজার মানুষ। ছিলেন আরেক বিভাসদা, বিভাস বসু, পদমর্যাদা তাঁর বড়সড়। সলিল দাশগুপ্ত দেখতেন পল্লীকথা, সুভাষ রায় ঘটক সুস্বাস্থ্য। অনুশ্রী করত ‘Window on the World’ অনুষ্ঠান, মধুশ্রী মৈত্র তখন বোধহয় ওকেই অ্যাসিস্ট করত। অনুশ্রী, রত্না, বানীদি পরে অন্যান্য কেন্দ্রে চলে যায়। প্রযোজনা বিভাগে মেয়েদের প্রাধান্য হয়ত কিছুটা বেশি ছিল।
আর ছিলেন মি. বড়ুয়া, বয়স্ক অভিজ্ঞ মানুষ, স্নেহ করতেন। একেবারে গোড়ার দিকে আমাদের অ্যানাউন্সমেন্ট দেখতেন বড়ুয়াদা। ট্রান্সমিশনে যাবার আগে ঘোষণার কাগজ বড়ুয়াদাকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়ে যেতে হত। একদিন একটি বাক্য আমি লিখেছিলাম, ‘আপনাদের গান গেয়ে শোনাচ্ছেন…’, বড়ুয়াদা সংশোধন করে লিখতে বললেন, ‘এখন সংগীত পরিবেশন করছেন…’, রেডিওর ভাষার ঘেরাটোপ থেকে তখনও বেরোতে পারেননি, অথচ আমি তো জানি, অডিও ভিসুয়াল মাধ্যমে সংযোগের ভাষা হবে অনেক সহজ, অলংকার অর্জিত। আমরা যে দৃশ্যত: দর্শকের ড্রইংরুমে পৌঁছে যাচ্ছি ওই ছোটবাক্সের মধ্যে দিয়ে! দেখলাম তর্ক করে লাভ নেই, সংশোধিত বাক্যটি লিখে নিয়ে চলে গেলাম, কিন্তু ঘোষণার সময় নিজস্ব ভঙ্গীতে হেসে বললাম, ‘এখন আপনাদের গান গেয়ে শোনাচ্ছেন…’, এভাবেই ধীরে ধীরে সৃষ্টি হতে লাগল টেলিভিশনের ভাষা।
ছোটবেলায় রেডিওতে দুটি অনুষ্ঠান আমার খুব প্রিয় ছিল, ‘শিশু মহল’ আর ‘গল্প দাদুর আসর’, শিশু মহলে ইন্দিরাদি বলতেন, ‘ছোট্ট সোনা বন্ধুরা ভালো আছো তো সব?’ বাক্যটি মনের মধ্যে ছিল তাই ‘চিচিং ফাঁক’-এর খুদে দর্শকদের সম্বোধন করলাম, ‘ছোট্ট বন্ধুরা’ বলে, মনে হল, বেশ যেন আপন হয়ে উঠলাম আমরা পরস্পরের কাছে।
……………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………..
কিছুদিন পর থেকে আমাদের বিভাগ অর্থাৎ, প্রেজেন্টেশন সেকশন দেখতেন পঙ্কজদা। ওঁর নেতৃত্বে আমাদের বলার ভাষায় আরও মাধুর্য এল। আমরা চলতি ভাষা ব্যবহার করতাম কিন্তু তার মধ্যে মান্যতা ছিল। এই মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, আজ তা কতটা রক্ষিত হয়, সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব …………………………….
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved