রবীন্দ্রনাথের ছবির সঙ্গে ভারতীয় চিত্রধারার নিবিড় সম্বন্ধ না থাকলেও বিশ্বশিল্পের আধুনিক ছবির জগৎ তাঁকে প্রতিনিয়ত উদ্বোধিত করে তুলেছে। সে কেবল শিল্পীর ভিতরের থেকে উঠে আসা একান্ত অভিব্যক্তির প্রকাশ নয়, পশ্চিমের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের প্রত্যক্ষ স্পর্শে তিল তিল করে তা গাঁথা হয়েছে। সচেতন ভাবেই রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় পরম্পরার দিকে নিজের ছবিকে ঘেঁষতে দেননি।
২০.
রবীন্দ্রজীবনের একেবারে প্রান্তে বুদ্ধদেব বসু সপরিবারে প্রায় সপ্তাহদুয়েক কবির সান্নিধ্যে বাস করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের মাটিতে মহাকবির সঙ্গে তরুণ কবির সেই ঝলমলে দিন কেটেছিল গভীর আলাপ আলোচনায়, বিমল আনন্দে, নিবিড় মুগ্ধতায়– এ কথা নিজেই জানিয়েছেন বুদ্ধদেব। চিঠিতে তিনি রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন– ‘এবার শান্তিনিকেতনে এই তেরোদিন পরিপূর্ণ সুখে, শান্তিতে ও আনন্দে কাটিয়েছি, মুগ্ধ হয়েছি, আতিথেয়তায়, সৌজন্যে, বন্ধুতায়, সর্বোপরি আপনার সঙ্গলাভে ধন্য হয়েছি’। বুদ্ধদেব বসুর সব পেয়েছির দেশ তো এখানেই, এই রাঙাধুলোর শান্তিনিকেতনে। সে চিঠির উত্তরে রবীন্দ্রনাথ সস্নেহে লিখেছিলেন– ‘এবারে আশ্রমে থেকে তুমি অনেক ঝুড়ি বকুনি সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছ। আশা করি তার বারো আনাই আবর্জনা নয়’।
রবীন্দ্রনাথের কোনও বকুনিই যে আবর্জনা নয়, সে কথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা এখানে সেই ‘অনেক ঝুড়ি বকুনি’র একটি জরুরি অংশের দিকে তাকাতে চাই, যা ‘প্রবাসী’ পত্রিকার আষাঢ় ১৩৪৮ সংখ্যায় ‘সাহিত্য-গান-ছবি’ শিরোনামে নিবন্ধ বা আলোচনার অন্তর্গত। সেদিন ছবির কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ছবিটা ছবিই, তার বেশী কিছু নয়, কমও নয়।… ভারতীয় অজন্তীয় ওসব কিছু না। ভিতরের থেকে এলো তো এলো, না এলো তো এলো না। চেয়ে দেখো, ছবিটা ছবি হয়েছে কি না। কিন্তু দেখবার দৃষ্টি কই আমাদের? তার জন্যে অনেক দিনের অভ্যেস চাই’।
জীবনের প্রান্তে পৌঁছে চিত্রকলা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের এই নিজস্ব বোধ আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তিনি কি এখানে চিত্রকরের কোনও বিশেষ ধরনের শিল্পশৈলীকে গুরুত্ব দিতে চাইলেন না? ভারতীয় চিত্রধারা বলতে সাধারণভাবে আমরা যা বুঝি, রবীন্দ্রনাথ কি তাকে স্বীকার করেন না? তাহলে অবশ্য ছবির ক্ষেত্রে দেশ-কাল-পরম্পরা– এই শব্দগুলো অর্থহীন হয়ে পড়ে। শিল্পের ভিত তাহলে কোথায় দাঁড়িয়ে? তার শিকড় কোথায়, কোথায় তার বনেদ? সে কি নিতান্তই একমাত্রিক, কেবল শিল্পীর ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্র? চিত্রকরের একান্ত অভিব্যক্তি কি তাহলে তার স্বদেশ, স্বকালের ছায়াকে স্পর্শ করে না? কী ভাবে গ্রহণ করতে হবে কবির ভাবনার অভিমুখ? এই কথার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কি অবন ঠাকুরের ঘরানা, বাংলা কলমের গড়ে ওঠা বা আমাদের শিল্পে জাতীয়তাবাদের আদর্শকে অস্বীকার করতে চাইলেন? এটাই কি বলতে চান যে, পূর্ব আর পশ্চিম বলে কিছু হয় না, শিল্পকে কেবল ভেতর থেকে উঠে আসতে হয়? এই ‘ভিতর থেকে উঠে’ আসার নেপথ্যে দেশ-কাল-মাটির অভিজ্ঞতা কিভাবে গাঁথা হবে শিল্পীর কাজে? অন্যথায় শিকড়হীন শিল্পকলা তার বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলবে না তো?
পরম্পরাহীন শিল্প যে অনেকটা টবের গাছের মতো শৌখিন হয়ে উঠতে পারে– এ আশঙ্কা তাঁর মনেও জেগে উঠেছে। তা সত্ত্বেও সেদিনের আলাপচারিতায় রবীন্দ্রনাথ কেবল ছবিটা ছবি হয়ে ওঠার দিকে জোর দিয়েছেন। বলেছেন, ‘চেয়ে দেখো, ছবিটা ছবি হয়েছে কি না’। বলেছেন ‘দেখবার দৃষ্টির’ কথা, তার জন্য ‘অনেক দিনের’ অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরি। অর্থাৎ ছবি বুঝতে হলে একদিকে যেমন দরকার ‘দেখবার চোখ’ অর্থাৎ চিত্রশিক্ষিত দৃষ্টি, তেমনি চাই তাকে বুঝে নেবার জন্যে ‘অনেক দিনের অভ্যেস’। সেটিই দর্শকের যথার্থ অবলম্বন। নিঃসন্দেহে এই হল শিল্পের সার কথা। ছবি দেখার ‘দৃষ্টি’ তৈরি হয় ছবি দেখতে দেখতেই– এ কথা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি সেই ‘দেখা’র আড়ালে রয়ে গেল রং-রেখা-আকারের কাঠামোতে গড়া ছবি নির্মাণের কথা।
কিন্তু কোন ধরনের ছবি দেখতে দেখতে আমাদের চোখ তৈরি হবে? সেই পুরনো প্রশ্ন এল আবার। সে ছবি কি দেশের না বিদেশের, প্রাচ্যের না প্রতীচ্যের? এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের জবানিতে তেমন স্পষ্ট ইশারা নেই। যদিও আলাপচারিতার মধ্যে যেন তার আভাস দেওয়া রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ যেখানে নিজের ছবি সম্পর্কে বলছেন, সেখানেই রয়ে গেল প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত– ‘এক সময় ছবি আঁকতে বসলুম। আমার খানিকটা background অবশ্য ছিল, অবনীন্দ্রনাথকে, নন্দলালকে ছবি আঁকতে দেখেছি। কিন্তু আমার মনে যেটা এল, সেটা কোনো নোটিশ দিয়ে আসেনি।… কবিতা লিখতে লিখতে কাটাকুটি করতুম, সেই কাটাকুটিগুলো যেন রূপ নিতে চাইতো, তারা হতে চাইতো, জন্ম নিতে চাইতো, তাদের সে দাবী আমি অগ্রাহ্য করতে পারতুম না। পড়ে থাকতো সে লেখা, সেই কাটাকুটিগুলোতে রূপ ফলাতুম, পারতুম না তাদের প্রেতলোকে ফেলে রাখতে। এইভাবে আমার ছবির পালা শুরু’।
আলাপচারিতায় অনায়াসে উঠে এল রবীন্দ্রচিত্রের গোড়ার কথা। এখানে কথার আড়ালে তিনি কি খুলে দিলেন না– শিল্পকলায় পরম্পরার সেই দরজা? অবনীন্দ্রনাথ বা নন্দলালকে ছবি আঁকতে দেখার অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে ‘খানিকটা background’ হিসেবে কাজ করেছে– এ কথায় কি পরম্পরার রেশ রয়ে গেল না? অবনীন্দ্রনাথ বা নন্দলালের কাজের মধ্যে যে ভারতীয় অজন্তীয় ধারা প্রবাহিত, সেখান থেকে তিনি কিছুটা হলেও যদি চিত্রের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে থাকেন, তবে তো ভারতীয় ধারার প্রচ্ছন্ন আঁচ তাঁর ছবিতে রয়ে গেল। তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ এখানে তাঁর নিজের বক্তব্যকে কিছুটা কন্ট্রাডিকট করছেন? পাশাপাশি এও স্বীকার করতে হয়, রবীন্দ্রছবির নিজস্ব ঘরানা অবনীন্দ্র-নন্দলাল থেকে বহু যোজন দূরের, তাদের অবস্থান একেবারে বিপরীত মেরুতে। সবমিলিয়ে এখানে চিত্রী রবীন্দ্রনাথ যেন এক স্ববিরোধী দোলাচলের বৃত্তে অবস্থান করছেন।
তাঁর কথায় আরেকটা দিক খেয়াল করি। কবিতার কাটাকুটি থেকেই ছবির দিকে তাঁর এগিয়ে চলার পাকা সড়ক গড়ে উঠেছে– এ কথা যেমন বর্ণে বর্ণে সত্য। তেমনই মনে রাখতে হয়, তাঁর কবিতায় কাটাকুটির ইতিহাস দীর্ঘকালের। সাধারণ কাটাকুটি থেকেই যদি ছবির সূত্রপাত, তাহলে ছবির জগতে প্রবেশ করতে তাঁর মতো স্রষ্টার এতখানি সময় লাগলো কেন? ইতিহাসের নিরিখে ১৯০৫ নাগাদ ‘খেয়া’র পাণ্ডুলিপিতে ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান’ গানটিকে তাঁর আলংকারিক কাটাকুটির উল্লেখযোগ্য প্রথম নমুনা বলে চিহ্নিত করা চলে। কিন্তু কবিতার সেই আঁকিবুঁকি আর ‘রক্তকরবী’ বা ‘পূরবী’ পর্বের কাটাকুটি কি এক ধরনের? সেখানে যদি কেবল বক্ররেখার জটিল জালের আলপনা, তবে প্রায় দু’দশক বাদে সেইসব কাটাকুটি রূপান্তরিত হয়েছে বিচিত্র জান্তব আকারে। কাটাকুটির এমন বিবর্তনের নেপথ্যে কি কোনও কারণ ছিল না?
ভেবে দখলে, এই সময় কলাভবনের প্রতিষ্ঠা, স্টেলা ক্রামরিশ, আন্দ্রে কারপেলেসের সঙ্গে বন্ধুত্ব, চিন সফর, আর্জেন্টিনায় ভিক্টোরিয়ার আতিথ্য ইত্যাদি অজস্র ঘটনার সমাহার রবীন্দ্রনাথকে ক্রমে ছবির দিকে ঠেলে দিয়েছে। কাটাকুটি করতে করতে একদিন তা হঠাৎ ছবি হয়ে উঠেছে– এই সরল স্বীকারোক্তি একদিকে যেমন ঠিক নয়, তেমনি ছবির ভুবন তাঁকে কোনও ‘নোটিশ’ দিয়ে আসেনি, এ কথা গ্রহণ করার পাশাপাশি জেনে নেওয়া চাই– কবিতার কাটাকুটি থেকে রবীন্দ্রচিত্রের বোঝাপড়ার ইতিহাসটুকু।
একদিনে হয়নি তা। এর আড়ালে আছে বিশের দশকে বিভিন্ন মিউজিয়াম ও গ্যালারিতে বিদেশি ছবি ও ভাস্কর্য দেখার অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে পেরুভিয়ান শিল্পকলা এবং জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের সঙ্গে তাঁর সম্যক পরিচয়। বলতে দ্বিধা নেই, রবীন্দ্রনাথের ছবির সঙ্গে ভারতীয় চিত্রধারার নিবিড় সম্বন্ধ না থাকলেও বিশ্বশিল্পের আধুনিক ছবির জগৎ তাঁকে প্রতিনিয়ত উদ্বোধিত করে তুলেছে। সে কেবল শিল্পীর ভিতরের থেকে উঠে আসা একান্ত অভিব্যক্তির প্রকাশ নয়, পশ্চিমের আধুনিক শিল্প আন্দোলনের প্রত্যক্ষ স্পর্শে তিল তিল করে তা গাঁথা হয়েছে। সচেতন ভাবেই রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় পরম্পরার দিকে নিজের ছবিকে ঘেঁষতে দেননি। এই কারণেই তাঁর গলায় শোনা গিয়েছে, রবীন্দ্রচিত্রকলাকে সমুদ্রের ওপারে রেখে আসার কথা। বার বার বলেছেন, ‘আমার দেশের সঙ্গে আমার চিত্রভারতীর সম্বন্ধ নেই’, ‘আমি বাঙালী বলেই এতো আপন হতে বাঙালীর জিনিস নয়। এই জন্যে স্বতই এই ছবিগুলিকে আমি পশ্চিমের হাতে দান করেচি’।
…………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………
রবীন্দ্রনাথের ছবির সঙ্গে তথাকথিত দেশীয় ভাব যেমন নেই, তেমনি তা একেবারেই দলছুট নয়। পশ্চিমের আধুনিক শিল্পের সঙ্গে তা নিবিড় ভাবে গ্রন্থিত।
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৯: ছবি-আঁকিয়ে রবীন্দ্রনাথ কোন রংকে প্রাধান্য দিয়েছেন?
পর্ব ১৮: ছবি আঁকিয়ে রবিঠাকুরও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন
পর্ব ১৭: রবীন্দ্রনাথের নারী মুখমণ্ডলের সিরিজ কি কাদম্বরী দেবীর স্মৃতিজাত?
পর্ব ১৬: ট্যাক্স না দেওয়ায় রবীন্দ্রনাথের ছবি আটক করেছিল কাস্টমস হাউস
পর্ব ১৫: বাইরে সংযত রবীন্দ্রনাথ, ক্যানভাসে যন্ত্রণাদগ্ধ ছবিঠাকুর
পর্ব ১৪: অমৃতা শেরগিলের আঁকা মেয়েদের বিষণ্ণ অভিব্যক্তি কি ছবিঠাকুরের প্রভাব?
পর্ব ১৩: আত্মপ্রতিকৃতির মধ্য দিয়ে নতুন করে জন্ম নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২: আমেরিকায় কে এগিয়ে ছিলেন? ছবিঠাকুর না কবিঠাকুর?
পর্ব ১১: নন্দলাল ভেবেছিলেন, হাত-পায়ের দুয়েকটা ড্রয়িং এঁকে দিলে গুরুদেবের হয়তো সুবিধে হবে
পর্ব ১০: ১০টি নগ্ন পুরুষ স্থান পেয়েছিল রবীন্দ্র-ক্যানভাসে
পর্ব ৯: নিরাবরণ নারী অবয়ব আঁকায় রবিঠাকুরের সংকোচ ছিল না
পর্ব ৮: ওকাম্পোর উদ্যোগে প্যারিসে আর্টিস্ট হিসেবে নিজেকে যাচাই করেছিলেন রবি ঠাকুর
পর্ব ৭: শেষ পর্যন্ত কি মনের মতো স্টুডিও গড়ে তুলতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ?
পর্ব ৬: রবীন্দ্র চিত্রকলার নেপথ্য কারিগর কি রানী চন্দ?
পর্ব ৫: ছবি আঁকার প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত প্রিয়জনদের মতামত চেয়েছেন
পর্ব ৪: প্রথম ছবি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ামাত্র শুরু হয়েছিল বিদ্রুপ
পর্ব ৩: ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’য় রয়েছে রবিঠাকুরের প্রথম দিকের ছবির সম্ভাব্য হদিশ
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি