ওভালের লাঞ্চরুমে পরিচিত খাদ্যদ্রব্য বলতে ছিল ভাত। সঙ্গে ‘তেইশটি খাদ্যগুণসম্পন্ন’ সেদ্ধ লতা-পাতার ‘বাগান’। আমিষ ছিল বটে, কিন্তু সে কিছুতেই মিশতে চাইত না! কাঁটা চামচ দিয়ে ‘ল্যাম্ব’ কাটতে গিয়ে বড় বিপত্তিতে পড়েছিলাম। ভেড়া বাবাজি ‘হরলিক্স’ খেয়েছিলেন বোধহয়! ইলাস্টিকের মতো বাড়তে-বাড়তে তো চুইংগামে পরিণত হয়েছিলেন প্রায়! লাঞ্চ মেনুর ট্রে’তে নববধূর সলজ্জ সাজে শিঙাড়াও আবিষ্কার করেছি একদিন!
হোয়াই এভরিথিং ইজ সো স্পাইসি? ডোন্ট ইউ হ্যাভ সামথিং নর্ম্যাল? গেট মি সাম স্যুপ!
গরগরে গলা, টকটকে লালমুখো এ সায়েবের বড় বদনাম আছে। যে সায়েব রাজকোট মিডিয়া সেন্টারের লাঞ্চরুমে প্রবল চেঁচামেচি জুড়েছেন এখন। এ সায়েব, একে বুড়ো, তায় ঠোঁটকাটা! কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে যিনি বরাবরের সিদ্ধহস্ত, ‘সিদ্ধপুরুষ’ই প্রায়! কেন মনে নেই, বিশ্বজয়ের পরপর মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত বিলেত সফরে গেল যেবার। সুরেশ রায়নাকে বল হাতে দেখেও আম্পায়াররা মন্দ আলোয় খেলা বন্ধ করায় বেজায় চটে গিয়েছিলেন ইনি। গালমন্দ করে বলেছিলেন, ‘ইউ আর কিউয়িং আপ টু ব্যাট এগেন্সট রায়না ইন দিস লাইট। মাই গ্র্যান্ডমা কুড হ্যাভ প্লেড হিম উইথ আ স্টিক!’
নিখুঁত ধরেছেন মশায়, অহো! একশোয় একশো, ইনিই সেই। ইনিই ‘প্রিন্স অফ ক্যালকাট্টা’-র জনক, বাঙালির পছন্দের বুড়ো সায়েব, পিতৃদত্ত নাম যাঁর জিওফ্রে বয়কট! মাথায় ইয়া বড় ‘হ্যাট’ পরে ঘোরেন, চাঁচাছোলা কমেন্ট্রি করেন, আর পান থেকে চুন খসলে ক্রিকেটারের কান আচ্ছাসে মুলে দেন! তা সে যত তালেবরই হোক না কেন। কিন্তু বয়কট সায়েব এখন পড়েছেন বিপাকে। রাজকোটের ‘ঝাল ফ্রেজি’ চাখতে গিয়ে আপাতত তাঁর নাকের জলে, চোখের জলে। কিন্তু তাতেও থেকে-থেকে হুমকি দেওয়া থামছে না। কাঁচুমাচু মুখের বাবুর্চিকে শাসাচ্ছেন, ‘স্যুপ লাও, সসেজ লাও।’
‘লাও’ তো বটে, কিন্তু সসেজ আনে কে! নিরামিষাশীরা মাফ করবেন। কিন্তু রাজকোটের মতো ‘সাত্ত্বিক’ ক্রিকেট-সেন্টার ভূ-ভারতে দুটো আছে কি না সন্দেহ! গোটা শহর ফুঁড়ে ফেললেও একটা পাতে দেওয়ার মতো আমিষ রেস্তোরাঁ জুটবে না। মুর্গি-টুর্গি বিক্রি যত রাস্তার ধারে, যার ‘খুশবু’ আর ‘সুরত’ দেখলে আর যা-ই হোক, প্রাণে ধরে পেটে দিতে সাহস হয় না। সুরাপ্রেমীদের দফাও ও রাজ্যে পুরোই রফা। বোর্ডিং পাস কিংবা ট্রেন টিকিট থাকলে সপ্তাহে বরাদ্দ এক বোতল, তা-ও চড়া দামে। রাজকোট বড় কঠিন ঠাঁই ভায়া, সন্ধেয় ওখানে লোকে ‘আহ্নিক’ করে আইসক্রিম দিয়ে (ষোলোআনা সত্যি, এক অটোচালক বলেছিলেন একবার, ব্যাজার মুখের বাঙালি সওয়ারিকে)! চতুর্দিকে খালি নাম-না-জানা নিরামিষ পদের বাহার, এবং কিম্ভুতকিমাকার তার স্বাদ! হোটেলের হেঁশেল থেকে ‘ফাউল কারি’ না জুটলেও অন্তত ডিম জোটে (কোনও কারণে সেটা নিরামিষ গোত্র), তবে মাঠে সেটুকুও নয়। সেখানে বাজরার রুটি, চাট্টি ডাল আর বিকট যত সবজির ‘বসন্ত’! শুধু মিষ্টি আর লস্যিটা খাসা। বছর সাত আগে রাজকোটে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট কভার করতে গিয়ে বয়কট সায়েবকে দেখে তাই দুঃখই হচ্ছিল। ‘স্ট্রবেরি অ্যান্ড ক্রিম’-এর দেশের লোক তিনি। টোস্ট-ওমলেট-বেকন-সসেজের পুরোদস্তুর ইংলিশ ব্রেকফাস্ট দিয়ে ‘কুলকুচি’ করা অভ্যেস। সেই জিভে কি আর ‘ঝাল ফ্রেজি’র ঝাল সহ্য হয়? জিভের ছাল যে উঠে যাবে!
ইংরেজিতে তুমুল হম্বিতম্বি করে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলেন বয়কট। স্যুপ-পাঁউরুটি এসেছিল খুব সম্ভবত। বিশেষ ফুর্তি না হলেও উদরপূর্তি হয়েছিল শেষে। তবে সাত বছর পর জীবনের প্রথম বিলেত গিয়ে বড় অনুতাপে ভুগছিলাম। গত জুনে ওভালে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনাল করতে গিয়ে। কেবল মনে হচ্ছিল, সেদিন রাজকোটের সেই খাবার-দাবারের অ্যাদ্দিন ধরে বাপান্ত করা উচিত হয়নি। আসলে নিখাদ ভারতীয় তো, নিজের দেশের খুঁত ধরাটা রক্তে। ‘যস্মিন দেশে যদাচার’-এর বচন আমরা প্রায়শই ভুলে যাই, হাড়ে-মজ্জায় টের পাই একবার দেশের বাইরে গিয়ে পড়লে।
না, ভারত টেস্ট ফাইনাল খেলছে বলে, ভারতীয় সাংবাদিকরা দামী ফ্লাইট টিকিট কেটে ফাইনাল কভার করতে গিয়েছেন বলে, ওভাল লাঞ্চরুমে কোনও জামাইআদরের বন্দোবস্ত ছিল না। পরিচিত খাদ্যদ্রব্য বলতে ছিল ভাত। সঙ্গে ‘তেইশটি খাদ্যগুণসম্পন্ন’ সেদ্ধ লতা-পাতার ‘বাগান’। আমিষ ছিল বটে, কিন্তু সে কিছুতেই মিশতে চাইত না! কাঁটা চামচ দিয়ে ‘ল্যাম্ব’ কাটতে গিয়ে বড় বিপত্তিতে পড়েছিলাম। ভেড়া বাবাজি ‘হরলিক্স’ খেয়েছিলেন বোধহয়! ইলাস্টিকের মতো বাড়তে-বাড়তে তো চুইংগামে পরিণত হয়েছিলেন প্রায়! লাঞ্চ মেনুর ট্রে’তে নববধূর সলজ্জ সাজে শিঙাড়াও আবিষ্কার করেছি একদিন! ভারতীয়রা মধ্যাহ্নভোজে শিঙাড়া খান, এ হেন ‘এক্সক্লুসিভ’ খবর কোন ‘উর্বর মস্তিষ্ক’ পাচকদের সরবরাহ করেছিলেন, জানি না। জানার ইচ্ছেও করেনি। ভারতীয় সাংবাদিকদের একজন নিজ উদ্যোগে খুঁজেপেতে কিছু ভারতীয় প্রাতরাশ নিয়ে আসতেন রোজ, তাই দিয়েই একযোগে সবার খাওয়া হয়ে যেত। দুপুরেরটা ‘নাম কা ওয়াস্তে’। লোক দেখিয়ে নেড়েচেড়ে স্রেফ রেখে দেওয়া। শেষে পরের পর অভিযোগ জমা পড়ায় খাবারের হাল ফিরেছিল ফাইনালের শেষ দিন।
তা হলে? বয়কট, আথারটন, হুসেনদের প্রতি আমাদেরই বা এত দায় কীসের? ভারতে এসে তাঁদের ঝাল লাগল কি না, টাকরা খসে পড়ল কি না, আমরাও বা দেখতে যাব কেন? নেই তো দায়। আমরা কিছু দেখতেও যাব না। বিলেত খেলা কভার করতে গেলে যদি সুনীল গাভাসকরের দেশের লোককে মানিয়ে নিতে হয়, তা হলে জ্যাক হবসের দেশের লোককেও ভারতে তাই করতে হবে। মানিয়ে নিতে হবে। দাঁড়ান দেখি, ভবিষ্যৎ ক্রিকেট সূচিটা একবার বের করি। ইংল্যান্ড ভারতে কবে আসছে দেখে রাখি, দেখে রাখি রাজকোটে খেলা-টেলা পড়েছে কি না?
অ্যান আই ফর অ্যান আই, স্যর। অ্যান আই ফর অ্যান আই। চালাকি চলবে না, স্বাদের বদলা হবে স্বাদ দিয়ে!
দারিদ্রে লালিত, আজন্ম বস্তুসুখে বঞ্চিত মেয়েটি যেন এক আশ্চর্যময়ী। সে দুয়ারের ভিখারিকে ভিক্ষা দেয় পিছনপানে সংকটের দিকে তাকাতে তাকাতে, মৃদু ভীত, অপারগ, যে সমস্যাগুলি সে এখনও পুরোপুরি বোঝে না, তাকে বুঝছে কিন্তু বুঝছে না... পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে ভাইয়ের গুরুত্ব বেশি সে জানে।