
নবান্নর দু’টি পর্ব– চাল-নবান ও ভাত-নবান। চাল-নবানে নতুন ধানের আতপচালের গুঁড়োর সঙ্গে দুধ ক্ষীর নানা ধরনের মিষ্টি এবং ফলমূলের যেন অলৌকিক মিশ্রণ। নলেনগুড়ের পাটালিও অন্যতম উপাদান। কলার পাতায় প্রথমে থাকে নবান্নের চালের মিশ্রণ। সঙ্গে ক্ষীর মিষ্টি ও নলেনগুড়। নবান্নের স্পেশাল মিষ্টান্ন তৈরি হয় নারকেল কোড়া, চিনি এবং ক্ষীর মিশিয়ে। এর নাম ‘পালো মিষ্টি’।
১১.
অঘ্রান মাস। উত্তরে হিমেল হাওয়ার খুনসুটি। শিরশিরিয়ে উঠছে গা-গতর। মাঠে মাঠে সোনার ধান। সুয্যিদেব পাটে বসছেন সকাল সকাল। মাঝে আর ক’টা দিন। তারপর নবান্ন। আলোচাল অর্থাৎ নবানের জন্য আতপ চাল করা, নতুন ধানের জন্য ‘এক সিদ্ধ’ উষ্ণচাল তৈরি করার পাশাপাশি আত্মীয় স্বজনদের নিমন্ত্রণ পর্ব চলছে দ্রুত হারে। সব গাঁয়ে তো একদিনে নবান হয় না।
গ্রামে গ্রামে পাল মশাইদের ফুরসুত মেলা ভার। একেকটা গাঁয়ে অন্তত দশ পাড়ার দশখানি ঠাকুর। তৈরি হচ্ছে দ্রুততার সঙ্গে। নবানের আগের দিনে বাজার-হাট। আগুন দাম শাকসবজির। নানা ধরনের ফলমূল, মিষ্টি। আরেক কয়েক পোন কলা না হলে আর ‘নবান’ কীসের। গোয়ালাপাড়ার ঘুম গেছে উবে। রাত জেগে ক্ষীর মেরে ‘খোয়া’ করার ধূম লেগেছে।

নবানের আগের রাত সাফ-সুতরোর। সবকিছু নতুন চাই। বাসনকোসন মেজে ঝকঝকে তকতকে। নতুন উনুন। সিঁদুর দিয়ে মাঙ্গলিক রেখা টানা সমাপ্ত। উঠোনখানি গোময় মার্জিত। তাতে লাল মাটির গোলা দিয়ে লতাপাতা কাটা। ফাঁকে ফাঁকে আলপনা– শঙ্খলতা, লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, গোলা বা মরাই, ধানের শিস, চন্দ্র-সূর্য, গোরু-মোষ ইত্যাদির ছবি। গুহাচিত্রের মতো রৈখিক অবয়বে সাদা রঙের জেল্লা।
নবান্নের ভোরে অন্নপূর্ণাতলায় বাজছে ঢোল-কাঁসির ঢেমুলে বাদ্য। ছেলেপুলেরা কাকভোরে মাঠে গিয়ে কাকদের নিমন্ত্রণ দিয়ে এসেছে। খেত থেকে আখ এনে কাটছে ব্যস্ত মুরুব্বি। কলার পাতা আগের দিনেই কাটা। মেয়েরা তরকারি কুটে রেখেছে ঝুড়িতে। সাতসকালে বাড়ির গিন্নি স্নান করে নতুন কাপড় পরে উনুনপুজো সেরে চাপিয়েছেন নবান্নের ‘রাশিভোগ’।

নবান্ন এমন এক লোক-উৎসব যা বহু প্রাচীন সংস্কৃতি, লোকাচারে সমৃদ্ধ। কৃষি সংস্কৃতির নানা রঙের স্মৃতিতে বর্ণময়। বাংলার নবান্ন মানে আমন ধানের ফসল কাটার উপক্রমণিকা। নবানের পর শুরু হত আমন ধান কাটা। এখন অবশ্য ছবিটা কিছুটা পালটালেও মূল সুরের হেরফের ঘটেনি।
কৃষিপ্রধান ভারতের নবান্ন অন্যতম কৃষি উৎসব। উড়িষ্যা ছত্রিশগড় ঝাড়খণ্ডে পালিত হয় ‘নুয়াখাই’ বা ‘নওয়াখাই’ নামে। ‘নুয়া’ অর্থাৎ নব এবং ‘খাই’ অর্থাৎ অন্ন। নবান্ন উৎসবের আঞ্চলিক নাম। তবে বাংলার সঙ্গে পার্থক্য আছে বিলক্ষণ। উড়িষ্যা ছত্রিশগড় বা ঝাড়খণ্ডে নবান্ন উৎসব পালিত হয় খারিফ শস্য ওঠার মরসুমে। ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের গণেশ চতুর্থীর পরের দিন অর্থাৎ পঞ্চমী তিথিতে। বাংলায় নবান্ন আমন ধান কাটার প্রাক-লগ্নে অগ্রহায়ণ মাসের শুক্লপক্ষের নির্বাচিত শুভ দিনে।
নুয়াখাই উৎসবও নবান্নের মতো অন্তত ১৫ দিন পূর্বে দিনখন ঠিক করা হয়। একে বলে ‘বেহেরেন’ এবং লগ্ন দেখা। আছে সাফসুতরো, ‘ডাকা হাঁকা’ অর্থাৎ নিমন্ত্রণ করা, ‘কিনাবিকা’ অর্থাৎ নবান্নের বাজারহাট করা, ‘বলিপাকা’, ‘জুহার ভেট’ ইত্যাদির পর সকলে মিলে নুয়া খাওয়া অর্থাৎ নবান্ন গ্রহণ করা। ‘জুহার’ বা ‘জোহার’ শব্দের অর্থ হল প্রণাম বা নমস্কার। বাংলাতেও চাল নবান খাওয়ার পূর্বে নতুন জামাকাপড় পরে ছোটরা বড়দের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়।

নবান্ন কোনও ভুঁইফোঁড় আঞ্চলিক উৎসব নয়। জড়িয়ে আছে বৈদিক সংস্কৃতির রেশ। বৈদিক যুগে পালিত কৃষিজীবীরা কয়েকটি যজ্ঞ বা অনুষ্ঠান সম্পাদন করতেন। কৃষিকেন্দ্রিক যজ্ঞ বা উৎসবকে ‘পঞ্চযজ্ঞ’ বলা হত। চাষের জন্য জমিকর্ষণ উপলক্ষে আয়োজিত সীতাযজ্ঞ। বীজবপনের জন্য যে উৎসব তার নাম ছিল ‘প্রবপন্য যজ্ঞ’। প্রলম্বন যজ্ঞ– ফসল কাটার উৎসব। এছাড়া ফসল ঝাড়াই-মারাই ও সংরক্ষণ করার যজ্ঞের নাম ছিল যথাক্রমে ‘খলযজ্ঞ’ ও প্রজনন যজ্ঞ।
সুতরাং নবান্ন আসলে ফসল কাটার উৎসব প্রলম্বন যজ্ঞের আধুনিক রূপ। অগ্রহায়ণ মাসে ‘আগ্রায়ণ ইষ্টি’ নামে ঋতুযজ্ঞ হত। সেই যজ্ঞে ‘সুনাশীর’ নামে কৃষিদেবতাকে বিশেষ ভোগ নিবেদন করার প্রথা ছিল। সেই থেকেও নবান্ন উৎসবের সূচনা হতে পারে। বাংলাতে অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন উৎসবের খবর পাওয়া যায় বৃহদ্ধর্ম পুরাণ থেকে। উক্ত পুরাণের উত্তরখণ্ডের দশম অধ্যায়ে লেখা হয়েছে,
মার্গশীর্ষে মহাভাগে নবান্নৈঃপূজয়েদ্ধরিম।
পায়সংশর্করা দুগ্ধং দদ্যাৎ কৃষ্ণায় ভক্তিতঃ।।
অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসে নবান্ন দ্বারা হরিপূজা করার বিধি আছে। তাঁকে ভক্তিপূর্বক দুধ, চিনি এবং পায়েস নিবেদন করতে হবে। পরবর্তীকালে শ্রেণি-ধর্ম নির্বিশেষে কৃষিজীবী গ্রাম্য বাঙালির সর্বজনীন লোক-উৎসব হয়ে যায় নবান্ন। কেননা কৃষিজীবী মুসলমানরাও নিজেদের মতো নবান্ন উৎসব পালন করেন।

বাংলায় শুধু আমন ধানের সঙ্গে নবান্ন উৎসব জড়িয়ে নেই। একসময় অঘ্রান ছিল বছরের প্রথম মাস। ‘অগ্র’ শব্দের অর্থ আগে। ‘হায়ণ’ মানে বছর। এই হিসাবে বাংলার নববর্ষ ছিল ১ অঘ্রান। তখন বলা হত মার্গশীর্ষ মাস। নবান্ন– প্রকৃতপক্ষে নববর্ষের উৎসব।
অনেকেই বলেন ‘অগ্রহায়ণ’ শব্দের অভিধানিক অর্থ– বছরের যে সময় শ্রেষ্ঠ ব্রীহি বা ধান উৎপন্ন হয়। অতীতে কণকচূড় কাঙুদ, কলমা, কসুমশালী, খিরখম্বা, গোতমপলাল, ঝিঙাশাল, সীতাশালী, লাউশালী, মুক্তাহার, মৌকলস, গোবিন্দভোগ ইত্যাদি কুলীন আমন ধান কাটা হতো অঘ্রান মাসে। ধানগুলির সাধারণ পরিচিতি ছিল ‘নবানে ধান’। এইসব ধানের অন্ন দিয়ে জমে উঠত নবান্ন উৎসব। রবীন্দ্রনাথ ঐতিহ্যকে স্মরণ করেই লিখেছিলেন, ‘নতুন ধান্যে হবে নবান্ন তোমার ভবনে ভবনে’।
অস্ট্রিক ভাষাভাষি প্রোটো-অস্ট্রালয়েড জনগোষ্ঠীই নাকি প্রথম ধান চাষ শুরু করেন বঙ্গোপসাগরের অববাহিকা অঞ্চলে। বর্ধমান জেলার ‘পান্ডুরাজার ঢিবি’ উৎখননে তাম্রাশ্মীয় যুগের প্রাচীনতম অধিবসতি পর্বে মিলেছে ধানের প্রত্ন-নিদর্শন। সেই শুরু। সেনবংশের তাম্রলিপিগুলিতে দেবদেবী বন্দনার পাশাপাশি ধান্য বন্দনার বাণীচিত্রও খোদিত হয়েছে। ক্রমশ আমন ধান হয়ে ওঠেছে বাঙালি কৃষ্টির অন্যতম মাঙ্গলিক প্রতীক। রাঢ় অঞ্চলে ধানই লক্ষ্মী। ধানেই তাঁর মূর্তির প্রতিষ্ঠা। চৈত্র সংক্রান্তি, ভাদ্র সংক্রান্তি এবং পৌষ সংক্রান্তিতে ধান ও পেঁচা স্থাপনার মধ্য দিয়ে শস্যলক্ষ্মীর আরাধনা।

নবান্নর দু’টি পর্ব– চাল-নবান ও ভাত-নবান। চাল-নবানে নতুন ধানের আতপচালের গুঁড়োর সঙ্গে দুধ ক্ষীর নানা ধরনের মিষ্টি এবং ফলমূলের যেন অলৌকিক মিশ্রণ। নলেনগুড়ের পাটালিও অন্যতম উপাদান। কলার পাতায় প্রথমে থাকে নবান্নের চালের মিশ্রণ। সঙ্গে ক্ষীর মিষ্টি ও নলেনগুড়। নবান্নের স্পেশাল মিষ্টান্ন তৈরি হয় নারকেল কোড়া, চিনি এবং ক্ষীর মিশিয়ে। এর নাম ‘পালো মিষ্টি’। বাড়ির সকলে লাইন দিয়ে বসে চাল-নবান খান। বাড়ির গৃহিণী নতুন বস্ত্র পরে কলার পাতায় চাল-নবান পরিবেশন করেন।
ভাত-নবানে থাকে অন্তত দু’ রকমের শাকের পদ, নানা ধরনের ভাজাভুজি– আখ, মুলো মিস্টি আলু, ডালের বড়া, কলার বড়া ইত্যাদি। সুক্তোর পদ থাকবেই। আলু, কুমরো, কলা, বড়ি দিয়ে অনবদ্য রান্না সুক্তো। তাছাড়া আলু-ফুলকপির ডালনা, মুগডাল, চাটনি এবং গোবিন্দভোগ চালের দুধ-পায়েস। এর নাম রাশিভোগ। এটি গৃহলক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে প্রথমে নিবেদন করেন।

নানা ধরনের মাছের পদও থাকে। কালিয়া ভাজা, রুইমাছের ঝোল, শোলমাছের টক ইত্যাদি। মাংস এদিন থাকে না। পরের দিন ‘বাস-নবান’, সেদিন বাসি খাওয়া নিয়ম। সঙ্গে থাকে খাসির মাংসের গরম ঝোলের যুগলবন্দি। কোনও কোনও গ্রামে তেস-নবানেরও অনুষ্ঠান আছে জমজমাট।
চাল নবান্নের পূর্বেই হরির নবান, গো-নবান, কাকবলি এবং পাখপাখালির নবান দিতেই হবে। হরিতলা অর্থাৎ তুলসিতলায় নতুন প্রদীপ জ্বেলে ধূপধুনো ধরিয়ে পুরোহিত মশাই প্রথমে বিষ্ণু বা কৃষ্ণপুজো করেন। কলার পাতায় চাল-নবান দিয়ে নিবেদন করা হবে হরিকে। কাকবলি দেয় ভোজ্যপ্রদান অনুষ্ঠানে।

নতুন কুলোয় চাল-ডাল-আনাজ ইত্যাদি দিয়ে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে ভোজ্য দান করেন বাড়ির কর্তা। সেই ভোজ্য প্রদানের অংশবিশেষ এবং চাল-নবান কাকের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়। এরই নাম কাকবলি। লোকবিশ্বাস, সেই নবান যদি কাক খায় তাহলে পিতৃপুরুষদের আত্মা সন্তুষ্ট হন। পূর্ব বাংলার লোকেরা নবান্নের ভোরবেলায় কাককে নিমন্ত্রণ দিয়ে আসে নিকটবর্তী কোনও গাছতলায়। সেই নিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সমবেতভাবে ছড়া কাটে। একইভাবে পাখপাখালি ও গোরু-বাছুরকে নবান্ন দেওয়া বিধিবদ্ধ প্রথা। কোনও অনাহুত বা রবাহুত অতিথি কিংবা ভিখারির বাড়িতে আগমন ঘটলে তাঁকেও খাওয়ানো আবশ্যিক নিয়ম।
নবান্ন উৎসবে একাধিক রিচুয়াল পালিত হয়। যেমন সকালের দিকে বিভিন্ন দেবস্থানে বাটা প্রদান। আতপচাল কলা ফলমূলাদি রেকাবিতে সাজিয়ে বিভিন্ন দেবস্থানে প্রদান করা। উল্লেখযোগ্য স্থানগুলি হল গ্রাম্যদেবীর থান, বারোয়ারি পুজোপ্রাঙ্গণ পিরতলা ইত্যাদি। বিকেলের দিকে গিন্নিরা নইপুরানো নামে অনুষ্ঠান করেন। একটি পাত্রে নতুন ও পুরাতন চাল মিশিয়ে সুরেলা কণ্ঠে ছড়া কাটেন।

নই পুরনো নাড়িচাড়ি
নতুন বাঁধি পুরনো খাই
নতুন বস্ত্র নতুন অন্ন
পাই যেন গো জম্মো জম্মো।।
এরপর থেকে নতুন বা পুরাতন চালের ভাত খাওয়ার ছাড়পত্র মেলে। নবান্নে আরও দু’টি ব্রত পালিত হয়। সধবা গিন্নিরা পালন করেন ইতুপুজো। ভোরে উঠে পুকুর বা নদী থেকে ইতুর ঘট ভরে এনে উঠোনের মাঝখানে স্থাপন করেন। দুপুরের দিকে ইতুকে নবান্ন প্রদান করে ইতুর ঘট বিসর্জন করেন। সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় কুমারী মেয়েদের সেঁজুতিব্রত।
নবানে টহলের সিদে দেওয়া নিয়ম। পয়লা কার্তিক থেকে শুরু হয় ভোরবেলায় টহল বা প্রভাতী সংগীত। তার পারিশ্রমিক হিসাবে মহান্তমশাই নবান্নের দিনে গ্রামের বাড়ি বাড়ি চাল, সিধে, টাকা ইত্যাদি সংগ্রহ করেন। শেষ টহলের গানে থাকে ধুলটের গান–
হরে রাম রাম বলো দিন ফুরায়ে এল।
এমন দিন আর হবে না।
এমন মানব জনম পেয়ে রাম পদ
কোন পথে যাবে বলো না।
নবান্নের দেবদেবীর তালিকায় প্রধান স্থান করে আছেন দেবী অন্নপূর্ণা। প্রতিমা বিন্যাসে দেখা যায় দেবী অন্নপূর্ণা স্মিত হাস্যে পরমান্ন প্রদান করছেন ক্ষুধার্ত মহাদেবকে। একপাশে থাকেন ব্যাসদেব বা নারায়ণ। কিংবা মহাদেবের সঙ্গে নন্দী। নন্দীর মূর্তি মানুষের মতো। মূর্তির চালিতে দু’ দিকে দুই পরি বা দেবদূতী। তাঁদের হাতে থাকে চামর। নবান্ন উৎসবের রঙিন মলাট যেন প্রতিমাখানি। বাস-নবানের রাতে দেবীর বিসর্জন হয় ঘটা করে। দেবীর পুজোর সঙ্গে তাঁকে চাল-নবান ও ভাত-নবান প্রদান করা হয়।

নবানে দুই ধরনের কার্তিক পুজো হয়– নবানে-কার্তিক ও পান্তা-কার্তিক। নবান্নের দিন কার্তিকের চারবার পুজো করা নিয়ম। পান্তা-কার্তিকের পুজো হয় পরের দিনে। সেদিন পান্তা ভোগ দেওয়া হয় কার্তিকের উদ্দেশ্যে। আম-বাঙালির গরম ভাতের পাশাপাশি পান্তার প্রতি চিরকালীন আসক্তি তার দেবতা ভাবনায় প্রভাব বিস্তার করেছে।
রাঢ়বঙ্গে প্রায় প্রতিটি গ্রামের একেকটি মূল উৎসব আছে। উৎসবে বাইরে থেকে লোকজনের সমাগম, নানা ধরনের লোকানুষ্ঠান, বাউল গান, কবিগান, যাত্রাপালার আসর বসে। কবাডি, ফুটবল খেলার ফাইন্যাল ম্যাচ হয়। অনেক গ্রামের মূল উৎসব নবান্ন। পূর্ব বর্ধমান জেলার পাঁচঘরা, চাণ্ডুলি, ভাল্যগ্রাম প্রভৃতি জনপদের প্রধান আকর্ষণ নবান্ন উৎসব। নানা ধরনের প্রতিমা, থাকা প্রতিমা, রঙবাহারি মণ্ডপ, আলোকসজ্জা, বিচিত্র বাজনা-সহ শোভাযাত্রা মেলা ইত্যাদির পাশাপাশি যাত্রা, কবিগান, বাউলগানে জমে ওঠে নবান্ন উপলক্ষে কয়েকটি দিনরাত।
বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে নবান্ন উৎসবের যোগ সুগভীর। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে রচিত হয়েছে নবান্নের দেবী অন্নপূর্ণাকে নিয়ে ‘অন্নদামঙ্গল’ বা ‘অন্নপূর্ণামঙ্গল’ কাব্য। সেখানেও আছে দেবীর কাছে অন্নের জন্য প্রার্থনা, ‘আমার সন্তান যেন যেন থাকে দুধে ভাতে’। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নবান্নের কথা আছে। দুঃখবাদী কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ‘নবান্ন’ কবিতায় লিখেছেন,
ধান্যের ঘ্রাণে ভরা অঘ্রানে শুভ নবান্ন আজ,
পাড়ায় পাড়ায় উঠে উৎসব, বন্ধ মাঠের কাজ।

কবি জীবনানন্দ দাশ ‘আবার আসিব ফিরে’ কবিতায় নবান্নের কাক হয়ে পুনর্জন্ম নিতে চেয়েছেন বাংলায়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ছাড়পত্র কাব্যগ্রন্থে ‘এই নবান্নে’ কবিতায় লিখেছেন,
প্রাণের বদলে যারা প্রতিবাদ ক’রেছে উচ্চারণ?
এই নবান্নে প্রতারিতদের হবে না নিমন্ত্রণ?
নবান্ন ক্রমশ সাহিত্যের মোটিফ হয়ে ওঠে। নবান্ন সেখানে বেঁচে থাকার কথা বলে। তিমির বিনাশের জয়গানের প্রতীক হয়ে ওঠে নবান্ন। দুর্ভিক্ষ, আকাল, যুদ্ধ, মন্বন্তর, প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে এক হয়ে লড়াই করার কথা বলে নবান্ন। বিজন ভট্টাচর্যের ‘নবান্ন’ নাটক তার সার্থক দৃষ্টান্ত। চারটি অঙ্কে পনেরোটি দৃশ্যে, প্রায় ৪৫টি চরিত্রের যৌথ অভিনয়ে সৃষ্টি করেছে কালান্তরের ইতিহাস। বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে নবান্ন নাটককে সামনে রেখে ঘোষণা করা হয়েছে বিশেষ কালপর্বটিকে– ‘নবান্নের কাল’ নামে।
আজও আমাদের দেশে দারিদ্র্যসীমার নীচে অসংখ্য বুভুক্ষু মানুষ। কালাহান্ডি, আমলাশোলের রূঢ় বাস্তবতা এখনও বাসি হয়নি। পেটে জ্বলছে ক্ষুধার লেলিহান আগুন। কবি লিখছেন–
স্বপ্ন ছিল দুনিয়ার সমস্ত মা-ই একদিন
সব কুচো কুচো বাচ্ছাদের ধোঁয়া উঠা ভাত বেড়ে দেবে।

নবান্ন আসলে ক্ষুধা জয় করার উৎসব। ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের বাস্তবতা। ব্যাকুল মাতৃমূর্তির অন্নপূর্ণা হয়ে ওঠার লৌকিক কাহিনি।
আলোকচিত্র: অপূর্ব ব্যানার্জি
………………..পড়ুন ঠাকুরদার ঝুলির অন্যান্য পর্ব………………..
পর্ব ১০: বারবণিতাদের আরাধনার মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছিল কাটোয়ার কার্তিক লড়াই
পর্ব ৯: শিশুঘাতক থেকে কেন শিশুরক্ষক দেবতা হয়ে উঠলেন কার্তিক?
পর্ব ৮: তেনাদের পুজো, তেনাদের মেলা-মোচ্ছব
পর্ব ৭: প্রেত মানেই ভূত বা অতীত, কিন্তু সকল প্রেতই ভূত নয়!
পর্ব ৬: কেবল কালী নন, লৌকিক লক্ষ্মী ঠাকরুনও দাঁড়ান স্বামী নারায়ণের বুকে পা রেখেই
পর্ব ৫: মহিষাসুরমর্দিনী নন, কৃষিপ্রধান বাংলায় আদিপূজিতা ছিলেন শস্যদেবী নবপত্রিকা
পর্ব ৪: পুকুরের দেবতা পুকুরের ভূত
পর্ব ৩: পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে লোককথা আর লোকবিশ্বাস
পর্ব ২: পৌরাণিক হিন্দু ও বৌদ্ধ সাহিত্যে দেবতা অথবা মানুষের বন্ধু হিসেবেই স্থান পেয়েছে কুকুর
পর্ব ১: সেকালের ডাকাতির গপ্প
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved