যদুবাবুর বাজারের ঘিঞ্জি দোরে, ওই প্যাঁচালো সিঁড়ি-খোলা জানালা-লাল মেঝে-খসা পলেস্তারার অবুঝ আদরে, এই একটা বস্তুই যে রয়েছে আবহমানকাল ধরে। সেই ১৯৩৫ থেকে। মায়া, অপার মায়া। অবিকল যা বেলা বোস, রঞ্জনা, মেরি অ্যানদের মতো। ছুঁয়েও ছোঁয়া যায় না যা, মিলিয়ে যায় মেঘের মতো। তবু ফিরে-ফিরে আসতে হয় তার টানে। বারবার। কী করা যাবে, পানশালা হোক বা প্রেমিকা, পৃথিবীর যে কোনও মায়ার নিয়মই যে তাই। তার মাধুকরী সংগ্রহে কাঙাল হওয়াই অমোঘ নিয়তি, একমাত্র পরিণতি!
৫.
আমার জানলা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায়
একটু বর্ষা, একটু গ্রীষ্ম, একটুখানি শীত…
এ জানলার পাশে বসলে, আকাশের সঙ্গে যদুবাবুর বাজারও দিব্য দেখা যায়! আস্ত বর্ষা, আস্ত গ্রীষ্ম, অনেকখানি শীত। অবিশ্যি জানলা না বলে ‘গবাক্ষ’ কিংবা ‘বাতায়ন’-এর মতো নিপাতনে সিদ্ধ দাঁতভাঙা শব্দ প্রয়োগই এক্ষেত্রে সমীচীন! আকারে সে এতই প্রকাণ্ড। মরুক গে! আসল হল, নবাবিয়ানা! ‘বার’ নামক এক বৈঠকখানায় বসে বাজার-দোকানের ‘গরিব আদমি’দের করুণা দেখানোর সুযোগ ছাড়ে নাকি কেউ? বাস-রাস্তা আর ‘বার’-এর মধ্যিখানে এক অদৃশ্য রুদ্ধদ্বার বিরাজ করে এসেছে বরাবর। খিটখিটে সহোদরের মতো ওরা দুই, আলাদা দুই পৃথিবী। বাস-রাস্তার চার আনা-ছ’আনার রোজগেরে জীবন কেমন বেমালুম বদলে যায় ‘বার’-এর দ্বার ঠেলে ঢুকলে। তখন সে চার আনা-ছ’আনাই ঘণ্টাদুয়েক লাট সাহেবির স্বর্ণমুদ্রা! কী জানেন, মানুষ সবচেয়ে বেশি অভিসম্পাত দেয় নিজেকে। নিজের জীবনকে। এবার যদি বারে বসে, জানলা দিয়ে নিজেরই ঘ্যানঘ্যানে জীবনকে চাক্ষুষ করা যায়, গড়গড়ার ফুড়ুক-নলে টান দিতে-দিতে শ্লেষাত্মক হাসি হাসা যায়, তা হলে তো তোফা মশাই!
লিখলাম যাহা, ভবানীপুরের তৃপ্তি বার অ্যান্ড রেস্তোরাঁয় সমস্ত উপলব্ধ তাহা। এবং অতীব সুলভ মূল্যে। তবে যে জানলার কথা বলছি, তার সঙ্গে গলাগলি দূরত্বে এক বিশাল আয়নাও আছে। তা কেন, কী উদ্দেশ্যে, পানশালায় কী তার প্রয়োজন, কিছুই বড় জানা-টানা যায় না আর। তৃপ্তি যে নব্বই বছরের অশীতিপর এখন। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে ভূমিষ্ঠ হওয়া এক বট-অশ্বত্থ ‘বার’। তার উপর মালিকানা বদলেছে মাঝে। পুরাতন কর্মচারীদের কেউ অবসরে, কেউ বা মরণের পারে। বলার বিশেষ লোক পাওয়া যায় না আর। অধুনা যাঁরা মালিকপক্ষ, তাঁদের আইনি উপদেষ্টা অরিন্দম ঘোষ দুঃখ করে বলছিলেন, ‘পুরনো দিনের কাকে পাবেন বলুন? কে দেবে এত উত্তর? তৃপ্তি কি আজকের মশাই? সেই ১৯৩৫। নয়-নয় করে নব্বই হয়ে গেল!’ অতএব, সে আয়নার উপকারিতা বা প্রয়োজনীয়তা, অধরা মাধুরীই থেকে গেল, অ্যাদ্দিন ছিল যেমন। তবু কেন অমন দর্পণ? আত্মসমীক্ষার চাহিদায় কি? প্রতি পলকে খরিদ্দারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে, ওহে আম-ইনসান, তোমার এ সাময়িক বাবুগিরি আদতে নিছক প্রহেলিকা মাত্র! ফুটপাথের যদুবাবুর বাজারে বাসন-কোসন-ফলের দোকানে দরাদরিই তোমার প্রকৃত দিনলিপি। পঁচাত্তর টাকার ডিম পকোড়া আর ড্রাফট বিয়ার সহযোগে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে রাখো, নিজ সত্তাকে জেনে রাখো?
শায়েদ! হবে হয়তো!
সেই পৃথিবীতে বিকেলের রং হেমন্ত হলুদ
সেই পৃথিবীতে পাশের বাড়ির কান্না শোনা যায়…
পাশের বাড়ির কান্না শোনা না গেলেও, প্রস্তর যুগের সিঁড়ির পাকদণ্ডি বেয়ে উঠলে, ফুটফুটে এক ‘মার্জার সরণি’ আবিষ্কার করা যায়! যেথা ফুল-ফুল, নকশি-কাঁথা বনেদি মেঝেয় বিরাজ করেন মা ষষ্ঠীর বাহনকুল! এক-আধজন নয় ভায়া, মোট চারজনের নিবাস হেথা! যারা ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি ফুলিয়ে অবাধে যাতায়াত করে। যত্র-তত্র-সর্বত্র। হেঁশেলে কড়া নজর রাখে। ক’পিস মাছ-মাংস শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে কাস্টমার নামক কুলাঙ্গার-গোষ্ঠীর উদরস্থ হল, দিন শেষে হিসেব খাতায় বোধহয় লিখেও নেয়! আরে বাবা, যথা সময়ে পাওনা-গণ্ডা বুঝে নিতে হবে তো! তৃপ্তির আইনি উপদেষ্টা মহোদয় স্মিত হাস্যে বলছিলেন, ‘ওরা ভালোই জানে, কোন খরিদ্দারের কাছে গেলে কলাটা-মুলোটা বাগানো যাবে! কেউ কিছু বলে না ওদের। বরং খাবার-দাবার দিয়ে তুষ্ট রাখে।’
সেকথা শোনামাত্র, বিকেলের রং কেমন হেমন্ত হলুদ হয়ে যায়। আপনাআপনি। অলক্ষ্যে। অগোচরে। এ বাংলার ক’টা পানশালায় বেড়াল-তপস্যা চলে, জানা নেই। বরং অধুনা রেস্টো-পাব সংস্কৃতির জমানায় মদিরালয়ে বেড়াল-সারমেয় ঢুকে পড়লে, ‘ইউউউ’ বলে তিন লাফে সরে যাওয়াই দস্তুর! কিন্তু তৃপ্তি বার কাম রেস্তোরাঁর আইন আলাদা, কানুন আলাদা। এখানে মার্জারকুল পান-বিলাসী মানুষের পাশে গ্যাঁট হয়ে বসে নির্বিচারে ‘অধিকার’ আদায় করে নেয়। কলকাতায় একমাত্র প্রেস ক্লাবে এ জিনিস দেখেছি। কোলে বেড়ালছানা নিয়ে সুরাপানও করেছি। কিন্তু আদ্যোপান্ত ঘরোয়া প্রেস ক্লাবের বাইরেও যে এ শহরে এমন একখানা মনের মতো ‘বাসা’ থাকতে পারে, পূর্বে জানতাম না। অবশ্য ঠিকই আছে। যে পানশালায় খসা পলেস্তারার গোলাপি দেওয়াল অটুট রেখে দেওয়া হয় অতীত স্মৃতি-কুম্ভ সংরক্ষণে, যে পানশালায় বছরের পর বছর খাবার-দাবার-পানীয়ের মূল্যবৃদ্ধি হয় না সাধারণ মানুষের কথা ভেবে– (৭৫ টাকায় ডিম পকোড়া লিখেছিলাম আগে। ওটা তো বটেই। সঙ্গে ১৭০ টাকার চিজ-চেরি-পাইনাপলটাও খেয়ে দেখবেন পারলে। অমৃত, স্রেফ অমৃত) সেখানে মনুষ্য ও মনুষ্য-উত্তম (ইতর লেখাটা ঘোর অন্যায়) প্রাণীর সাম্যবাদ রক্ষিত যে হবে, তাতে আর আশ্চর্য কী!
মজার হল, সাম্যবাদের আরও এক প্রতিচ্ছবি আছে এখানে। ভবানীপুরের তৃপ্তিতে কিন্তু পকেটে রেস্তওয়ালা মানুষজনও আসেন! শুধুই কলেজ-পড়ুয়া বা নিম্ন মধ্যবিত্ত-পূর্ণ মধ্যবিত্তের সুরা-নিবাস এ নয়। সন্ধের দিকে তৃপ্তির এসি ঘরে ঢুকলে এঁদের দর্শনও পাওয়া যায়। সুস্নাত চৌধুরীর ‘শুঁড়ির সাক্ষী’ বই পড়ে ‘দাঁড়াভোগ’ নামক এক ‘বস্তুর’ বিষয়ে জেনেছি। পড়েছি, ব্রিটিশ কলকাতার ‘বাবু’ গোত্রীয়রা নাকি মাস শেষে ট্যাঁকে টান পড়লে শস্তার পানশালায় ঢুকে পড়তেন। আলোয়ান মুড়ি দিয়ে। পাছে কেউ দেখে ফেলে। এবং দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে চোঁ-চাঁ দু’পাত্তর মেরে দিতেন। তাই নামকরণ হয় ‘দাঁড়াভোগ’! তৃপ্তিতে আলোয়ান চাপিয়ে ‘বাবু’ শ্রেণিরা কেউ আসেন না। দাঁড়িয়ে নয়, সোজা টেবিল হাতিয়ে বসে পড়েন। তবে আসেন, পার্ক স্ট্রিট ‘রেগুলার’-রা নিয়মিতই আসেন। তা সে ট্যাঁকের মায়াতেই হোক কিংবা ‘ভোগের’ টানে! আগেও লিখেছি, আবার লিখছি। তৃপ্তির যা খাবার, অহো! ডিমের পকোড়া বলুন, মেটে চচ্চড়ি বলুন, চাখলেই স্বর্গ। ‘ভোগ’, মদ্যপায়ীদের যথাযথ আনুষাঙ্গিক ‘ভোগ’। ফিশ ফিঙ্গারে একখানি কামড় দিলে দেখবেন, জিভের সঙ্গে চোখেও জল চলে আসছে।
আশ্লেষে। আমেজে। আনন্দে।
জানলা আমার সকালবেলায় শোনায় ভৈরবী
আর সন্ধেবেলায় শোনায় জন কোল্ড রিং…
ভৈরবী-পূরবী-কোল্ড রিং যা-ই হোক, তৃপ্তির জানলা কিছু না কিছু শোনায়, দিন-রাত্তির আলবাত শোনায়। না হলে কীসের অমোঘ টানে সকাল এগারোটায় প্রতিনিয়ত উপস্থিত হন এক বছর চুরাশির ভদ্রলোক, খুটখুট কড়া নাড়েন বার-দুয়ারে, তার ঘুম জড়ানো সময়ে? কেনই তিন পুরুষ ধরে এক আটপৌরে বারের মোহ কাটাতে পারে না এক বাঙালি পরিবার? গল্পগাছা শুনলাম যা, তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। অরিন্দম বাবুই বলছিলেন যে, কথায়-কথায় একবার এক যুবক তাঁকে বলে ফেলেছিলেন তৃপ্তির প্রতি তাঁদের তিন পুরুষের আনুগত্য। ঠাকুর্দা খোঁজ পান সর্বপ্রথম। তারপর কলেজ লাইফে পিতা। সর্বশেষে তিনি, পুত্র স্বয়ং!
আসলে তৃপ্তির একখানা ভৌগলিক অ্যাডভান্টেজ চিরকাল ছিল। অতএব, এ সুরা-নিকেতনের আদি প্রতিষ্ঠাতা আশুতোষ কলেজের অধ্যাপক রাবণ দত্ত মহাশয়, বুঝেশুনে মাস্টারস্ট্রোকই দিয়েছিলেন বলা যায়। ইদানীং দক্ষিণের পয়সাওয়ালাদের ‘উইকএন্ড’ মজলিশির দাবিদাওয়ায় লেকের ধারে চায়ের দোকানের মতো অগুনতি ‘রুফটপ বার’ খুলেছে বটে। কিন্তু পুরাতন সময়ে দক্ষিণ কলকাতা আর পার্ক স্ট্রিটের মাঝে ‘বার’ একটাই ছিল– তৃপ্তি! গড়িয়ার তখনও এত বাড়বাড়ন্ত হয়নি। বরং সামান্য অভ্যন্তরে প্রহর পিছু খ্যাঁক শেয়ালের হাঁক শ্রবণ নিত্য ছিল। মাস পয়লায় একটু গলা ভেজাতে হলে দৌড়তে হত পার্ক স্ট্রিট। তাই তৃপ্তির অচিরেই পান-পেয়ারিদের ম্যাডক্স স্কোয়্যার অথবা কফিহাউস হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় লাগেনি। লোকজন ঘুরত-ফিরত। শেষে তৃপ্তিতে এসে সদলবলে বসে পড়ত। পানাহার সহযোগে যেখানে দেদার আড্ডাই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।
‘শুনেছি, একবার নাকি উত্তমকুমারও এসেছিলেন’, নাকতলার অফিসে লিকার চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বললেন অরিন্দমবাবু। শুনলাম, রাবণ দত্তের পরিবার থেকে তৃপ্তির মালিকানা হাত বদলায় ২০০৪ সালে। পুরনো টলিপাড়ার অভিনেতাগণ দলে-দলে আসতেন এক কালে। নৃপতি চট্টোপাধ্যায়। বসন্ত চৌধুরী। অনিল চট্টোপাধ্যায়। ছবি বিশ্বাসকেও নাকি দেখা যেত মাঝে-সাঝে। আর আসতেন ঋত্বিক ঘটক। কলকাতায় থাকলে, প্রায়ই। পেল্লায় জানলার পাশে চেয়ার টেনে বসতেন ওঁরা। পানশালাকে ঐতিহ্যের পূণ্যভূমিতে রূপান্তর করে।
‘আকর্ষণের একটা কারণ বলতে পারেন দাম। আজও যা আমরা সেভাবে বাড়াইনি। তা ছাড়া পুরনো কিছু খাবার অটুট রেখে দিয়েছি। আলু চাট, ডিমের পকোড়া, এ সমস্ত কিন্তু তৃপ্তির আদিকালেও পাওয়া যেত। চিজ-চেরি-পাইনাপল আবার হারিয়ে যাচ্ছিল শহর থেকে। আমরা ফিরিয়ে এনেছি’। গড়গড়িয়ে বলে যান অরিন্দম বাবু। শেষে মৃদু অহং-মিশ্রিত হাসি দিয়ে বলেন, ‘একটা কথা আমরা বেশ জানি। যাঁরা একবার এখানে আসবেন, তাঁরা তৃপ্তির মায়া কাটিয়ে কখনও বেরোতে পারবেন না।’
লাখ টাকার এক কথা। মায়া! ঠিকই। ওই যদুবাবুর বাজারের ঘিঞ্জি দোরে, ওই প্যাঁচালো সিঁড়ি-খোলা জানালা-লাল মেঝে-খসা পলেস্তারার অবুঝ আদরে, এই একটা বস্তুই যে রয়েছে আবহমানকাল ধরে। সেই ১৯৩৫ থেকে। মায়া, অপার মায়া। অবিকল যা বেলা বোস, রঞ্জনা, মেরি অ্যানদের মতো। ছুঁয়েও ছোঁয়া যায় না যা, মিলিয়ে যায় মেঘের মতো। তবু ফিরে-ফিরে আসতে হয় তার টানে। বারবার। কী করা যাবে, পানশালা হোক বা প্রেমিকা, পৃথিবীর যে কোনও মায়ার নিয়মই যে তাই। তার মাধুকরী সংগ্রহে কাঙাল হওয়াই অমোঘ নিয়তি, একমাত্র পরিণতি!
চিত্রগ্রাহক: কৌশিক দত্ত
… পড়ুন বারবেলা-র অন্যান্য পর্ব…
৪. একসময় কুকুর আর ভারতীয়দের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল নিউ ক্যাথে রেস্তোরাঁ-কাম-বারে
৩. ‘চাংওয়া’-র কেবিনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাসরঘর!
২. মহীনের ঘোড়াগুলির প্রথম ‘আস্তাবল’ ডিউক
১. তেতাল্লিশের মন্বন্তরে ‘বার’ থেকে ‘রেশন সেন্টার’ হয়ে উঠেছিল ব্রডওয়ে