মুনমুন সেনের বসার ঘরটি প্রশস্ত, টানা সোফায় জড়সড় হয়ে বসলাম সবাই। মুনমুন সেন এলেন সাদা শার্ট আর জিন্স পরে। ‘রূপ’ শব্দটির ঘাড়ে যদি গনগনে বিশেষণ বসাতেই হয়, তবে তা বসল, এই ঘরেই, পায়ের ওপর পা’টি তুলে। আরও কেউ আসবে ঋতু? মুখে চাপা হাসি তাঁর।
৭.
যেহেতু ‘তারা’ নন-ফিকশন চ্যানেল, ফলে অভিনব কিছু অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করেছিল ঋতুদা। অপর্না সেনের একটা টক শো, নাম– অপর্নার অতিথি। গান এবং সেইসঙ্গে ক্যাফে কালচার নিয়ে অনুষ্ঠান, নাম– দিদি’জ ক্যাফে, হোস্ট করবেন ঊষা উত্থুপ। তেমনই মুনমুন সেনকে নিয়ে একটা ‘অ্যাগনি আন্ট’ শো প্ল্যান করা হয়েছিল। নামটা বেমালুম ভুলে গিয়েছি। প্রোগ্রামটার মধ্যে কিছুটা জেন্ডার অ্যাওয়ারনেস, সেক্স এডুকেশন থাকবে, এসবও ভাবা হয়েছিল। ঋতুদা মুনমুন সেনের বাড়িতে প্রায় একটা ব্যাটেলিয়ান নিয়ে মিটিং করতে গেল। আমি, চন্দ্রিল ছাড়া রয়েছে দেবিকা, অয়ন, মেহেলি। এখানেই শেষ নয়, আরও কয়েকজন ছিল। ঋতুদা লিফ্টে উঠেই বলল, এই যে বন্ধ দরজাটা দেখছিস, এর ভেতরেই কিন্তু সুচিত্রা সেন আছেন। এইসব নামগুলো শুনলেই বুকের ভেতর তখন ছলাৎ ঢেউ। দরজার দিকে চেয়ে রইলাম, যদি ‘খুল জা সিম সিম’ হয় হঠাৎ।
মুনমুন সেনের বসার ঘরটি প্রশস্ত, টানা সোফায় জড়সড় হয়ে বসলাম সবাই। মুনমুন সেন এলেন সাদা শার্ট আর জিন্স পরে। ‘রূপ’ শব্দটির ঘাড়ে যদি গনগনে বিশেষণ বসাতেই হয়, তবে তা বসল, এই ঘরেই, পায়ের ওপর পা’টি তুলে। আরও কেউ আসবে ঋতু? মুখে চাপা হাসি তাঁর। ঋতুদা আমল না দিয়ে গড়গড় করে কথা বলতে শুরু করে দিল। মুনমুন আর ঋতুপর্ণ– দু’জনেই দু’জনকে তুই তুই করে কথা বলেন। দু’জনেই কথা বলার সময় ভুলে যান, তাঁদের আশপাশে অন্য লোক আছে। আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি হয়ে বসে রইলাম এই উত্তেজিত কথোপকথনে। মাঝখানে একজন সুন্দর দেখতে মানুষ এসে বসলেন ওঁদের মাঝখানে। মুনমুনের ‘হাবি’ ডাক শুনে বুঝলাম, ইনিই সেই ‘মেরা ভরত মহান’ মানুষটি, যাঁকে পশ্চিমবঙ্গের তামাম যুবসমাজ ঈর্ষার চোখে দেখে। প্রায় মিনিট কুড়ি কথা বলার পর ঋতুদার মনে পড়ল, আমরাও সঙ্গে আছি। তখন সবার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দিল। মুনমুন সেনের সঙ্গে এটিই আমার প্রথম আলাপ নয়। ‘যুগান্তর’-এ যখন চাকরি করি, ক্লাব বা হোটেলে পার্টিতে যাওয়ার যখন সবে লাইসেন্স মিলছে, সেসময় একবার আলাপ হয়েছিল বটে। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন ‘স্টেটসম্যান’-এর এক প্রখ্যাত সাংবাদিক স্বপন মল্লিক। উত্তর কলকাতায় থাকার সুবাদে স্বপনদা খুব স্নেহও করতেন। ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্লাব’-এর সেই পার্টিতে মুনমুন পরেছিলেন একটি মিশকালো শিফন শাড়ি, রূপের ছটায় দাঁড়ানো যাচ্ছিল না সেখানে। কোনওমতে আমি বলেছিলাম, একটা যদি ইন্টারভিউ… মুনমুন পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছিলেন প্রস্তাব। অপ্রতিভ আমাকে ফের অপাঙ্গে মেপে বলেছিলেন, কিন্তু তুমি আমার বাড়িতে আসতে পারো, গল্প করব আমরা। সেই রাতে আমার আর ঘুম আসেনি। নিশ্চয়ই কী গল্প করব আমরা, সেই ভেবে।
ফ্ল্যাশব্যাক মরুক গে। আবার নতুন করে পরিচিত হলেই বা কী অসুবিধে! মুনমুনের অনুষ্ঠানে কী কী ঘটবে, তাই নিয়ে কথা শুরু হল। তার আগে তো ওপরা উইনফ্রে থেকে ওয়েনডি উইলিয়াম্স– অনেক নাম শোনা হয়ে গিয়েছে। ঋতুদা বলল, একটা এপিসোড হবে, ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স নিয়ে। থাকবে না-বলতে পারা মলেস্টেশনের ঘটনা। যাঁরা সত্যি ভিকটিম, তাঁরা এসে মুখ খুলবেন পর্দায়। একটা এপিসোড হবে সমকামিতা নিয়ে, সেম সেক্স ম্যারেজ নিয়েও কথা হবে। আজ সবাই যতটা মুখর ও সচেতন সামাজিক বৈষম্য নিয়ে, নয়ের দশকের শেষে সেই অভ্যুত্থানের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তবু সোশ্যাল ট্যাবুর খোলস ছেড়ে বেরচ্ছে না সব। ফলে সময়ের নিরিখে ঋতুদার ভাবনাটা খুবই এগিয়ে ছিল, তখনও অবধি বাংলা টিভিতে এমন অনুষ্ঠান কিছু হয়নি। আমরা সকলে তখন ‘মুনদি’ বলে কথা বলতে শুরু করে দিয়েছি। অয়ন, দেবিকা, মেহেলির দিকে তাকিয়ে অনেক কথাও বলছিলেন। আমার আর চন্দ্রিলের দিকে একটু কম তাকাচ্ছিলেন, মনে হয় দাড়ি ছিল বলে। তো মুনদি প্রস্তাব দিলেন, সোনাগাছি নিয়ে একটা এপিসোড করার। ঋতুদা হইহই করে উঠল, দারুণ হবে। ঠিক হল, যৌনকর্মীরা এসে তাঁদের সমস্যার কথা বলবেন এই ফোরাম-এ। ঋতুদা বলল, শুনতে তো ভাল লাগছে, কিন্তু ওঁদের কী আসতে দেবে?
মুনদি বললেন, ‘নিশ্চয়ই দেবে। আমার চেনা লোক আছে ওখানে, টাইগার, ও পাঠিয়ে দেবে।’
অয়ন বলল, ‘টাইগার কে মুনদি?’
–ও আমার বন্ধু।
এমন বাক্যে আমরা চমকিত। ভাবছি, মুনমুন সেনের কী চেনাজানার পরিধি, বাপ রে! ঋতুদা এর মধ্যে ‘দুর্বার মহিলা সমিতি’-কে ফোন করে জেনে নিয়েছে, যৌনকর্মীদের এমন অনুষ্ঠানে আসা বহু ঝক্কির ব্যাপার। এমন এপিসোড মাঠে মারা যাবে? মুনদি দমবার পাত্রী নন, ঋতুদাকে বললেন, এই তো, তোর এতগুলো মেয়ে আছে, ওরাই নাহয় মেকআপ করে বসে যাবে। সমস্যাগুলো আসল থাক, চরিত্রগুলো নকল।
দেবিকা, মেহেলিরা এমন একটা প্রস্তাবে হাসবে কি কাঁদবে ভেবে পেল না। বেশ কিছুক্ষণ এই নিয়ে আলোচনা চলল। সেসব শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে যাচ্ছে কখনওসখনও, কিন্তু মটকা মেরে আমি পড়ে রইলাম এককোণে। ফের সমস্যা পাকালেন মুনদি। সোনাগাছিকে কতটা হাতের তালুর মতো চেনে, সেই নিয়ে লাগাতার বলে চলেছেন– ‘সোনাগাছির ভেতর একটা বাড়ি আছে, একটু এলিট, মানে ওই জায়গাটায় এমনি লোক যায় না… আরে কী যেন বেশ নাম, কী একটা যেন…’
এইসব যখন মুনদি বলছেন, তখন আমার পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করে উঠল, উত্তর কলিকাতায় বড় হয়েছি, ওই নাম আমি বিলক্ষণ জানি। মুনদি দেখলাম মনে করতে না পেরে নিজের ওপরেই খুব রেগে যাচ্ছেন, কী যেন নাম, কী যেন…
একটা অলুক্ষুণে হাঁচির মতো আমি বললাম, ‘নীলকমল’।
ঘরে স্তব্ধতা নেমে এল। গোটা আলোচনায় এই একমাত্র আমার কনট্রিবিউশন। মুনদির চোখ ঘুরে গেল আমার দিকে, মুখে জ্বলজ্বল করছে লটারি পাওয়ার হাসি। মুনদি আঙুল তুলেছেন আমার দিকে, ‘এই তো ও জানে, ও যায়।’ একটা বসনতুবড়ি টাইপ হাসি ছড়িয়ে পড়ল সারা ঘরে। ‘ও জানে’ অবধি ঠিক ছিল, কিন্তু ‘ও যায়’-টা পুরো কবর দিয়ে দিল আমার বিকেল। প্রথম দেখায় একটা রাত গিয়েছিল, দ্বিতীয় দেখায় গেল বিকেল।
ফিরে আসার রাস্তাটা জুড়ে থাকল সেনবাড়ির নানা গল্পগাছা। মেহেলি বলল, রাইমাকে কিন্তু পুরো সুচিত্রা সেনের মতো দেখতে। ঋতুদা বলল, মোটেই না, ভরতের মুখ কেটে বসানো ওর মুখে। আমি আবার মুখ খুললাম, ভরতের মুখের সঙ্গেও যেন খুব চেনা কারওর একটা মুখের মিল আছে। ঋতুদা হাসতে হাসতে বলল, হ্যাঁ, মিল আছে তো। সুচিত্রা সেনের মুখের সঙ্গে।