জানতে পারলাম অঞ্জন একটা ছবি করছে এবং মৃণাল সেন নিয়ে, আমি খুব এক্সাইটেড হলাম। ছবিটা অনেকদিন ধরে দেখব দেখব করেও দেখা হয়ে উঠছিল না। কিন্তু ফাইনালি যখন দেখলাম, মনে হল ‘ইন্টারেস্টিং’! মৃণাল সেনের ভূমিকায় অঞ্জন দত্তকে দারুণ লাগল এই ছবিতে। মৃণালদার চেনা মুদ্রাদোষ, শরীরী ভাষা, কথা বলার ভঙ্গি, এইসব দেখতে পেলাম। মৃণালদার মতো করেই তো এই ছবি। ওঁর কাজের ঘরানাকে মাথায় রেখেই।
১৯.
আমার সঙ্গে অঞ্জন দত্তর প্রায়শই দেখা হওয়া শুরু হল ২০০৩ নাগাদ। আমরা দু’জনেই তখন ব্ল্যাক ম্যাজিক স্টুডিওতে কাজ করছি। আমি আমার বিজ্ঞাপনের কাজ আর অঞ্জন ওর ছবি ‘বো ব্যারাকস’ (২০০৪)-এর কাজে। অঞ্জনের সেই ছবিটা যথেষ্ট জনপ্রিয়, তাও বলছি সেই ছবিতে ছিল ভিক্টর ব্যানার্জী, লিলিথ দুবে, মুনমুন সেন, সব্যসাচী চক্রবর্তী এবং আরও অনেকে। ছবিটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের নিয়ে, প্রায় দু’ঘণ্টার ছবি।
দিনে অফিস আর রাতে এডিট, এই ছিল আমার তখনকার ডেইলি রুটিন। সেসময় অঞ্জন অনুরোধ করে আমি যদি ছোট একটা ডাবিং করে দিই। বিশদে জানাল, চরিত্রটা একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের, যে লন্ডনে থাকে। ফলে লন্ডনের ককনি উচ্চারণ ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের উচ্চারণ মিলিয়ে-মিশিয়ে ডাবিং করতে হবে। করেছিলাম এই কাজটা।
অঞ্জনের গান, যা দিয়ে মানুষ ওঁকে চেনে, সে গান লাইভ শুনেছি একবারই। ম্যাডক্স স্কোয়ারের একটা শো-তে। অঞ্জনের ছেলে নীল দত্ত, অঞ্জন এবং আমার আড্ডা হয়েছে অনেকবারই। কথা হয়েছে আমার তোলা ছবি নিয়েও। নীল আমার ওয়েবসাইট থেকে ছবি দেখে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল একবার। প্রস্তাব দিয়েছিল একটা এগজিবিশন কিউরেট করার, ওদেরই এগজিবিশন। অনেকরকম নিয়ম-কানন, বুদ্ধি-টুদ্ধি খরচের পর আমি রাজিও হয়েছিলাম। আমি নীলের বন্ধুদের সঙ্গে বসে, আলোচনা করে, ছবি দেখে ঠিক করেছিলাম যে, কী হবে সেই প্রদর্শনীতে। অনেক দিন লেগে গিয়েছিল এই করতে গিয়ে! এই প্রদর্শনীতে ছিল বিজ্ঞাপনের লোক, ছিল ডাক্তার, মিউজিশিয়ানরাও। প্রদর্শনীর নাম ছিল: #মর্নিংলাইট। ২০১৬ সালের এই প্রদর্শনীতে অনেকগুলো ছবিই শো চলতে চলতেই বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ছবিগুলো প্রিন্ট করিয়েছিলেন বিভাস ভট্টাচার্য। সেই সময়কার কলকাতার বিখ্যাত ফোটো প্রিন্টার।
‘ফাইনালি ভালোবাসা’ (২০১৯) ছবিতে অঞ্জন বলা চলে আমাকে প্রায় ধরে-বেঁধে নিয়ে গিয়েছিল একটা সিন করাতে। সেই সিনে ছিলাম শুধু অঞ্জন আর আমি। আমার প্রথম বড়পর্দা যদিও ‘পাতালঘর’ (২০০৩)। ছোট্ট একটা রোল। ছোটদের জন্য ছবি এবং এখনও অত্যন্ত জনপ্রিয়। বানিয়েছিল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু অভিজিৎ। তাই স্ক্রিপ্ট থেকে প্রিমিয়ার অবধি জড়িয়ে ছিলাম এই ছবির সঙ্গে।
অঞ্জনের বহু ছবি দেখেছি। তার মধ্যে রয়েছে গৃহযুদ্ধ (১৯৮২), খারিজ (১৯৮২), মহাপৃথিবী (১৯৯১), যুগান্তর (১৯৯৫), অন্তরীণ (১৯৯০)। অঞ্জনের দারুণ অভিনয় ছড়িয়ে আছে এই সমস্ত ছবিতে। অঞ্জনের পরিচালিত ছবি বং কানেকশন (২০০৬), রঞ্জনা আমি আর আসব না (২০১১), চলো লেটস গো (২০০৮) দেখেছি। অঞ্জন অনেক ছবিই করেছে। একদিন জানতে পারলাম অঞ্জন একটা ছবি করছে এবং মৃণাল সেন নিয়ে, আমি খুব এক্সাইটেড হলাম। ছবিটা অনেকদিন ধরে দেখব দেখব করেও দেখা হয়ে উঠছিল না। কিন্তু ফাইনালি যখন দেখলাম, মনে হল ‘ইন্টারেস্টিং’!
মৃণাল সেনের ভূমিকায় অঞ্জন দত্তকে দারুণ লাগল এই ছবিতে। মৃণালদার চেনা মুদ্রাদোষ, শরীরী ভাষা, কথা বলার ভঙ্গি, এইসব দেখতে পেলাম। মৃণালদার মতো করেই তো এই ছবি। ওঁর কাজের ঘরানাকে মাথায় রেখেই। অঞ্জন চমৎকার একটা গান দিয়ে শেষ করেছে ‘চালচিত্র এখন’। সেই গান: on the streets/ where people make love/ make a living on the/ streets as well/ You’ll have for yourself a/ world of corruption/ of compromise and disdain/ so all I have for you is/ just another movie/ by a maverick Sen Sen Sen. এককথায়, ইটস আ বিউটিফুল টাচি ফিল্ম।
কিন্তু আমার এখনও অঞ্জন দত্তর প্রিয় ছবি ‘বো ব্যারাকস’।
…পড়ুন ফ্রেমকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৮। ১৭টা রাজ্য ঘুরে ১০৫৫টা পুরনো সিনেমা হলের ছবি তুলেছে হেমন্ত
পর্ব ১৭। এক বাঙালি বাড়ি আসবে বলে দু’রকমের মাছ রেঁধেছিলেন নানা পাটেকর
পর্ব ১৬। সুব্রত মিত্র ও সৌম্যেন্দু রায়ের মধ্যে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না
পর্ব ১৫। ১০ বছর বয়সেই ব্রাউনি ক্যামেরায় ছবি তোলা শুরু করেছিল রিনামাসি
পর্ব ১৪। তাল ও সুর দিয়ে তৈরি এক গ্রহে থাকতেন উস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ
পর্ব ১৩। মৃণাল সেনকে এক ডলারেই গল্পের স্বত্ব বিক্রি করবেন, বলেছিলেন মার্কেস
পর্ব ১২: পুরনো বাড়ির বারান্দায় মগ্ন এক শিল্পী
পর্ব ১১। প্রায় নির্বাক গণেশ পাইন আড্ডা মারতেন বসন্ত কেবিনে
পর্ব ১০। আজাদ হিন্দ হোটেল আর সুব্রত মিত্রর বাড়ির মধ্যে মিল কোথায়?
পর্ব ৯। শান্তিনিকেতনের রাস্তায় রিকশা চালাতেন শর্বরী রায়চৌধুরী
পর্ব ৮। পুরনো বইয়ের খোঁজে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিলেন ইন্দ্রনাথ মজুমদার
পর্ব ৭। কলকাতার জন্মদিনে উত্তম-সুচিত্রার ছবি আঁকতে দেখেছি মকবুলকে
পর্ব ৬। বিয়ের দিন রঞ্জা আর স্যমন্তককে দেখে মনে হচ্ছিল উনিশ শতকের পেইন্টিং করা পোর্ট্রেট
পর্ব ৫। আলো ক্রমে আসিতেছে ও আমার ছবি তোলার শুরু
পর্ব ৪। মুম্বইয়ের অলৌকিক ভোর ও সাদাটে শার্ট পরা হুমা কুরেশির বন্ধুত্ব
পর্ব ৩। রণেন আয়ন দত্তর বাড়ি থেকে রাত দুটোয় ছবি নিয়ে বেপাত্তা হয়েছিলেন বসন্ত চৌধুরী
পর্ব ২। ইশকুল পার হইনি, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত একটা ছোট্ট রামের পেগ তুলে দিয়েছিল হাতে
পর্ব ১। ঋতুর ভেতর সবসময় একজন শিল্প-নির্দেশক সজাগ ছিল