
বাংলার অনেক জনজাতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভৌতিক আলপনার প্রসঙ্গটি। ভূত চতুর্দশী উপলক্ষে হাওড়ার শ্যামপুর থানা অঞ্চলের উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থদের কেউ কেউ সেদিন বাড়িতে ভূতের আলপনা আঁকেন। চোদ্দশাকের ধোয়া জল আতপচাল বাটায় মিশিয়ে চতুর্দশীর বিকেলে আলপনা দেন গিন্নিরা। ভূতের পালকির ভেতর নারী-পুরুষের দু’টি প্রতীকী ভৌতিক মূর্তি। নারী-ভূতের সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়ার নিয়ম। ভূতের পালকি বহন করে আরেক জোড়া প্রতীকী ভূত। প্রতিপদের দিন ভূতের পালকির আলপনা গিন্নিরা গোবরজল দিয়ে মুছে দেন।
৮.
সত্তর দশকের উত্তাল বাংলা। নকশাল আন্দোলন, জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা, রাজনৈতিক অপশাসনে বিধ্বস্ত বাংলা। গ্রামবাংলায় প্রকাশ্যে চাষির মরাই ভেঙে ধান লুঠ, কিংবা গরিবগুর্বো মানুষের ওপর নিদারুণ অত্যাচারের ভয়াবহ মর্মন্তুদ চিত্রনাট্য অনেকের মনে থাকার কথা।
এরই মাঝে গভীর নিশীথে বাড়ির সদর দরজায় এক অলৌকিক ফেরিওয়ালার ডাক সেদিনের লোকজীবনকে বড়ই আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছিল।
সদর দরজায় কড়া নাড়ার সঙ্গে ধ্বনিত হত– ‘দই নেবে গো! মাছ নেবে গো!’
সেই ডাকে সাড়া দিলে সমূহ বিপদ! যে সাড়া দিয়েছে তারই বিরাট ক্ষতি। কত সোমত্থ বউ গেছে কর্পূরের মতো উবে; কত খড়ের পালুইয়ে লেগেছে আগুন। সেইসব গল্প আজও কান পাতলে শোনা যায়। রাত নামে আর পাল্লা দিয়ে দাবানলের মতো গাঁ-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে সেই ডাকের আতঙ্ক।

লোকে ভয়ে জড়সড়। শিক্ষিত লোকে বলাবলি করে– শহুরে নকশালদের তৈরি করা গুজব! কিন্তু অধিকাংশ লোকের বিশ্বাস ছিল– ওসব কিচ্ছুটি না। ভৌতিক কাণ্ড!
প্রতিকারও বেরিয়ে পড়ল চটজলদি। দরজার দু’পাশে যদি মেল-ফিমেল গোবরের পুতুল নির্মাণ দাও– নিশীথ রাতের ভূতুড়ে ফেরিওয়ালার ডাক যাবে থেমে।
আশা করি অনেকেরই মনে আছে এ ঘটনা।
২০০০ সালের ভয়াবহ বন্যার দগদগে ক্ষত তখনও টাটকা। হঠাৎ গ্রামে গ্রামে আবার এক বিচিত্র ভূতের আমদানি হল।
তার নাম লাইটভূত।
লোক রাতবিরেতে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। এমন সময় একটা অদ্ভুত আলোকরশ্মি নিদ্রিত মানুষের চোখেমুখে ঘুরপাক খায়। দু’ চোখ খুললে সেই রশ্মি ভয়াবহ আলোর দৈত্যের আকার ধারণ করে মানুষের জীবনকে সর্বৈব বিপর্যস্ত করে তোলে!
লাইটভূত ধরার জন্য গ্রামে-গঞ্জে রাতপাহাড়া বসে গেল। সন্দেহের বশে সেসময় কত যে পাগল, কাজ করতে আসা ভিনদেশি মুনিশ বেদম মার খেয়েছে তার হিসেব নেই।

এগুলি সবই যে পরিকল্পিত গুজব– সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কিন্তু এর প্রেক্ষিতে রয়েছে গ্রাম্য মানুষের যুগ-যুগান্তরের ভৌতিক বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসের ভিত্তিভূমিতে গুজবগুলো তৈরি করে উদ্দেশ্য-প্রণোদিতভাবে ছাড়া হয়। কেননা উক্ত উদাহরণ দু’টির সঙ্গে চমৎকার মিলিয়ে নেওয়া চলে লৌকিক মেছোভূত কিংবা লাইটভূত সম্পর্কে মনের অন্দরে পুষে রাখা প্রাগৈতিহাসিক ধারণাকে।
গ্রাম্য বিশ্বাস– লোকে অপঘাতে মারা গেলে ভূত হয়। ভূতের নামকরণেও সেই অপঘাতের চিহ্ন লেগে থাকে। যেমন বাঘের শিকার হলে ‘বাঘুতভূত’। সুন্দরবন অঞ্চলের বনজীবী মানুষের মুখ থেকে বাঘুতভূতের প্রচুর গল্প শুনতে পাওয়া যায়।
সাপে কেটে মারা গেলে ‘নাগিয়াভূত’; তালগাছ থেকে পড়ে মারা গেলে ‘তালভূত’; কিংবা বজ্রপাতে মারা গেলে সে তখন লাইটভূত। এ বিশ্বাস শুধু বাংলার নয়, উত্তর ভারতেও এদের নাম একইরকমের। পার্থক্য শুধু ‘ভূত’-এর স্থানে ‘বীর’ শব্দটিতে। তাদের কাছে লাইটভূত হল ‘বিজলিবীর’।
লোকায়তিক জীবনচর্যার বৃহৎ অংশ জুড়ে ভৌতিক সংস্কৃতির দাপাদাপি। ‘প্রেত’ শব্দটির মূলে আছে প্রয়াত বা মৃতজন। হিন্দু ধর্মানুসারে মানুষ ‘প্রয়াত’ হলে সে প্রেত। প্রেত আবার ভূতবিশেষও।
প্রেতকৃত্য আসলে প্রেতের উদ্দেশে সংঘটিত কর্তব্য; দাহাদি ও সপিণ্ডনাদি কর্ম। গয়াকর্মেও প্রেতশিলার ভূমিকা আছে। লোকবিশ্বাস অনুসারে, মানুষ মারা গেলে মৃতের প্রেত তার নিজের বাড়িঘরে ঢোকবার মরিয়া চেষ্টা করে।

গ্রামাঞ্চলে মৃতের শ্রাদ্ধের সময় দেখেছি, গৃহকর্তা এক থালা খাবার সাজিয়ে বাড়ির ছাঁচতলায় রাখেন। ইদানীং ছবিটা একটু পালটেছে। প্রয়াত ব্যক্তির জীবিত অবস্থার ছবি চেয়ারে রেখে, মালা পরিয়ে, সামনে খাবার পাত্রটি রাখা থাকে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ছাঁচতলায় খাবার দেওয়ার প্রথাটি অল্পবিস্তর আজও টিকে আছে।
‘ছাঁচ’ শব্দটি মান্ধাতা আমলের। ভদ্র-বাংলায় ‘ছঞ্চা’। পূর্বে মাটির বাড়ির খড়ের চাল ছিল ৯০ শতাংশ। চাল নিঃসৃত জল যেখান দিয়ে ঝরে মাটিতে পড়ে, তার নাম ‘ছঞ্চা’ বা ‘ছাঁচতলা’।
স্থানটি লৌকিক সংস্কৃতিতে বহু তাৎপর্যময়। ছাঁচতলায় দাঁড়ানো নিষেধ। আবার গর্ভবতী মহিলারা ছাঁচতলায় কাজ করেন না। ছাঁচতলার ভদ্র-বাংলা ‘প্রেত্য’ অর্থাৎ লোকান্তর বিশেষ। সাধারণ মানুষের কথায়, ছাঁচতলা ‘ভূমণ্ডলের বাইরে’। এবং জাদুবিশ্বাস রয়েছে যে ছাঁচতলা বাড়ির রক্ষারেখা। এখানে খাবার রাখার অর্থ হল, প্রেত এই লাইন পেরিয়ে ঘরে ঢুকতে পারবে না।
বাংলার অনেক জনজাতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভৌতিক আলপনার প্রসঙ্গটি। ভৌতিক আলপনা বিচিত্র ও অনালোচিত বিষয়। ভূত চতুর্দশী উপলক্ষে হাওড়ার শ্যামপুর থানা অঞ্চলের উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থদের কেউ কেউ সেদিন বাড়িতে ভূতের আলপনা আঁকেন। চোদ্দশাকের ধোয়া জল আতপচাল বাটায় মিশিয়ে চতুর্দশীর বিকেলে আলপনা দেন গিন্নিরা।
বাড়ির দরজায়-দরজায় জোড়া আলপনা আঁকার নিয়ম। আলপনার বিষয় ভূতের পালকির ভেতর নারী-পুরুষের দু’টি প্রতীকী ভৌতিক মূর্তি। নারী-ভূতের সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়ার নিয়ম। ভূতের পালকি বহন করে আরেক জোড়া প্রতীকী ভূত। প্রতিপদের দিন ভূতের পালকির আলপনা গিন্নিরা গোবরজল দিয়ে মুছে দেন। সংশ্লিষ্ট মিথটিও শুনতে বেশ চমকদার– ভূত চতুর্দশীতে চোদ্দপুরুষের কর্তাগিন্নীরা ভূতলোক থেকে নেমে আসেন তাঁদের ভিটেমাটি দেখার জন্য।

জৈন ধর্মগ্রন্থ ‘নিশীথ’ সূত্রে লেখা হয়েছে, প্রাচীন ভারতবর্ষে সবচেয়ে জনপ্রিয় লোক উৎসব অর্থাৎ ‘মহামহ’ পরব ছিল চারটি– ইন্দ্রমহ, স্কন্দমহ, যক্ষমহ এবং ভূতমহ। প্রাকৃত ‘মহ’ শব্দ থেকে একালের ‘মেলা’ কথাটি এসেছে। ভূতমহ পালিত হত চৈত্র পূর্ণিমায়। ভূতমহের অর্থ হল ভূতপুজো এবং মেলা-উৎসব ইত্যাদি জমজমাট লোকানুষ্ঠান। ভূতমহ লুপ্ত হলেও, এখনও ভূত বা রাক্ষস-রাক্ষসীর পুজো হয় বাংলার বিভিন্ন স্থানে।
ভূত নিয়ে কত প্রবাদ, বাগধারা। এই যে কথায়-কথায় বলি, ‘বারো ভূতের সংসার’। ‘বারোভূত’ কারা? এ সম্পর্কে অবশ্য মতান্তর রয়েছে। তবে যাদবপুরের শ্রীকলোনি অঞ্চলে বারোভূতের পুজো হয়। বারোভূতের আদি পুজো হারিয়ে গেছে। বর্তমানে বারোভূতের নামে বনদুর্গা আর দ্বাদশ অবতারের পুজো হয়।
নদিয়া জেলার শান্তিপুরের ফুলিয়াতে আজও পয়লা বৈশাখ অনুষ্ঠিত হয় ভূতপুজো এবং ভূতের মেলা। সেই পুজো ‘নিশিকান্ত’ বা ‘কবন্ধ’ পুজো নামে বিখ্যাত। নিশিকান্ত অদ্ভুত দীর্ঘাকার মূর্তি, মেলার মাঠের মাঝখানে মাটি দিয়ে তৈরি কিম্ভূত কিমাকার রূপ। গলাকাটা। ছিন্ন গলার নিচে দু’টি দীর্ঘায়ত চক্ষু। উদ্ধত নাক, স্ফীত নাসারন্ধ্র। কালীঠাকুরের মতো টকটকে লাল জিভ বেরিয়ে আছে। মুখের দু’পাশে রাক্ষসের মতো দু’টি দাঁত। হাত-পা বিকটাকার। নিশিকান্ত যেন চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। দু’টি পা প্রসারিত। একটি হাত নিচের দিকে। অন্য হাতটি বরদা মুদ্রায় ঊর্ধ্বমুখী। বর্তমানে লাল শালুর খাটো পোশাক থাকলেও, অতীতে নাকি নিশিকান্ত নগ্ন থাকতেন। ঘোর কালো রঙের তাঁর দেহবর্ণ।

এ পুজোর উৎস সম্ভবত ‘রামায়ণ’। কেননা রামায়ণে ‘কবন্ধ আলেখ্য’ রয়েছে। বাল্মীকি রামায়ণের অরণ্যকাণ্ডের ৬৯-৭৩ সর্গ জুড়ে কবন্ধ কাহিনির রোমাঞ্চকর বর্ণনা। রাম-লক্ষ্মণ, সীতার অনুসন্ধানে বেরিয়ে জটায়ু পক্ষীর প্রেতকৃত্য সমাপ্ত করে, ক্রৌঞ্চারণ্য থেকে তিন ক্রোশ দূরে অবস্থিত মতঙ্গাশ্রমে আসেন। প্রথমে তাঁরা অয়োমুখী রাক্ষসী এবং তারপরে কবন্ধ রাক্ষসের মুখোমুখি হন। বিকটাকার রাক্ষস। মুণ্ডগ্রীবাহীন কবন্ধের উদরে মুখ। একটিমাত্র চক্ষু– অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে। যোজনপ্রমাণ দীর্ঘ হাত দিয়ে বনের পশুপাখি অনবরত খেয়ে চলেছে।
রামায়ণে কবন্ধ রাক্ষস তাঁর পূর্ববৃত্তান্ত জানিয়েছিলেন রামচন্দ্রকে। তিনি শ্রী নামক দানবের পুত্র, দনু। পূর্বে তাঁর রূপসৌন্দর্য ছিল চন্দ্র, সূর্য এবং ইন্দ্রের ন্যায় প্রসিদ্ধ। সেই অহংকারে স্ফীত হয়ে বনের ঋষিদের ভয় দেখাতেন। বিদ্রুপ করতেন। একবার মৃগশিরা নামক ঋষিকে ভয় দেখাতে গিয়ে অভিশাপগ্রস্থ হন এবং কুৎসিত বিকটাকার হয়ে ওঠেন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে কাহিনির কিঞ্চিৎ হেরফের আছে। সেখানে কবন্ধ রাক্ষস গলাকাটা। পেটের ভিতর দেখা যাচ্ছে নাক-কান-চোখ-মাথা। দু’ হাত দীর্ঘ। কৃত্তিবাস লিখেছেন,
পেটের ভিতর নাক কান চক্ষু মাথা।
শতেক যোজন দীর্ঘ, অপূর্ব সে কথা।।
রাম লক্ষ্মণেরে দেখি করিয়া তর্জন।
দুই হাত প্রসারিয়া রাখে দুই জন।।
ফুলিয়ার নিশিকান্তের পুজো বড় অদ্ভুত, পুজো করেন বালা মশাই। পুজোর আকর্ষণ নানা ধরনের নাচ। সে নাচের মুদ্রায় ফুটে ওঠে পশুবলির ছবি। বলির রক্তাক্ত ছিন্নশির থেকে টাটকা রক্ত দেওয়া হয় নিশিকান্তের শায়িত দেহে।

যারা ভূতগ্রস্ত, তাদের ভূত ছাড়ানোও পুজোর অন্যতম অঙ্গ। ভক্তদের বিশ্বাস, ভূতে পাওয়া রোগীদের নিশিকান্তের কাছে আনতে পারলে ভূত বাপ-বাপ করে ছেড়ে পালায়। নিশিকান্তের পুজোয় মানতের দ্রব্য পড়ে বিস্তর। পুজো উপলক্ষে জমজমাট মেলা বসে। শুধু নদিয়া জেলা নয়, বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লোকজন ভূতের মেলা দেখতে আসেন।
ভূতের মতো রাক্ষসী, বিশেষ করে পুতনা রাক্ষসীর পুজো হয় বাংলার অনেক স্থানে। চন্দননগরের অধিকারী বাড়িতে প্রতিবছর দুর্গাপুজোর সময় পুতনা রাক্ষসীর পুজো হয়। এ বাড়িটি ‘রাক্ষুসী বাড়ি’ নামে পরিচিত। পুতনার কোলে থাকেন শিশু কৃষ্ণ। চার পুরুষ ধরে এই পুজো চলে আসছে।
নীচুপট্টি অধিকারী বাড়ির মন্দিরে ঢুকলেই চোখে পড়বে রাক্ষসী-মূর্তি। মনে হবে, তার চোখ দুটো জ্বলছে। বড় বড় দুটি দাঁত বেরিয়ে রয়েছে। নিত্যপুজো হয় তিন বেলা, সঙ্গে ভোগ। ঝাড়গ্রাম জেলার বাঁশপাহাড়ি অঞ্চলে কোচবিহারের মদনমোহনের রাস উপলক্ষে পুতনার মূর্তি প্রদর্শন বা পুজো চলে।

রাঢ় বাংলার ‘নবান্ন’ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ রাক্ষস-রাক্ষসীর প্রতিমা। এটি প্রায় সব গ্রামের পাড়ায়-পাড়ায় দেখা যায়। অধিকাংশ মূর্তি ছেলেপুলেরা নিজেরাই তৈরি করে। ভয়ংকর কালো লোমশ শরীর। সামনের দু’টি দাঁত মুলোর মতো। চোখগুলি রক্তিম। এক-একটা গ্রামে এমন মূর্তি অন্তত দশটি দেখা যায়। তবে রাক্ষস বা রাক্ষসীর কোনও পুজো হয় না।
বাংলায় শিবের গাজনের অন্যতম আকর্ষণ রাক্ষসী নৃত্য। মুখোশ ও পোশাক পরে, ঢাকের বাজনার তালে তালে রাক্ষসী নৃত্য উত্তর রাঢ়ের শৈবগাজনের অন্যতম দর্শনীয় লোকনৃত্য।
বাংলায় ভূতেরও জাতিবিভাগ আছে। সাধারণত ভূত ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র পর্যায়ে পড়ে। চেহারায় তালগাছের মতো লম্বা, পাতলা এবং ঘোর কৃষ্ণবর্ণের। এমনই লোকবিশ্বাস। গাছে-বনে-পুকুরে-মাঠেঘাটে থাকে। কিন্তু ব্রহ্মদৈত্য ব্রাহ্মণ ভূত। ধবধবে ফর্সা। কাঁধে এক গোছা পৈতে। তিনি খড়ম পায়ে হাঁটেন। ক্ষতি করেন না। বড় গাছ, বিশেষত নিম কিংবা বটগাছে থাকেন।
বর্ধমান, বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ জেলার অনেক গ্রামে দেখতে পাবেন বড় ঝাঁকুমাকু গাছ। ডালপালা কাটা দূরে থাকুক, গাছতলা থেকে কুটোটা পর্যন্ত কেউ নেবে না। গাছের গোড়ায় মস্ত ত্রিশূল পোঁতা। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে লাল-কালো মাটির ঘোড়া, গাঁজার কলকে। গাছের ডালে-ডালে দুলছে ছোট-বড় চাঁদমালা। কোনও কোনও গাছের গোড়ায় ছালের কাপড় জড়ানো। এর নাম ‘বেহ্মদত্যিতলা’। সন্ধেবেলায় এসব গাছের কাছে যেতে কারও সাহস হয় না।

ব্রহ্মদৈত্যের বাৎসরিক পুজোকে কেন্দ্র করে পয়লা মাঘ জমজমাট মেলা বসে। ব্রহ্মদৈত্য প্রসন্ন হলে বন্ধ্যা নারী সন্তান লাভ করেন। অসুখবিসুখ ভালো হয়। বীরভূমের টেকাগ্রাম, সিউরির নগরীগ্রাম, পাড়ুইগ্রামে ব্রহ্মদৈত্যতলার মেলা বহুকাল আগে থেকেই হয়ে আসছে।
একইভাবে যখাযখি ভূতের থানও বাংলায় কম নেই। কেতুগ্রাম অঞ্চলের হলদি শ্রীপুরের মাঝমাঠে আছে যখাযখির থান। এখন আর মেলা না বসলেও, অনেকেই পুজো দিয়ে আসেন ভক্তিভরে। যখাযখির কৃপায় অনেকে গুপ্তধন পান বলে লোকবিশ্বাস। পূর্ব বর্ধমানের এরুয়ার গ্রামের প্রত্নস্থানটির নাম যখের ডাঙা। যাখিন চণ্ডীকে খুঁজে পাওয়া যাবে মুর্শিদাবাদের গ্রামে।
পশ্চিমের হ্যালোউইন নিয়ে আজ আমরা এত মাতামাতি করি, কিন্তু আমাদের চারপাশে এত দেশীয় ভূতপুজো, এতরকম ভূতের মেলা, উৎসব, তিথি ও স্থানিক ঐতিহ্য– এর কতটুকু আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করি?
………………..পড়ুন ঠাকুরদার ঝুলির অন্যান্য পর্ব………………..
পর্ব ৭: প্রেত মানেই ভূত বা অতীত, কিন্তু সকল প্রেতই ভূত নয়!
পর্ব ৬: কেবল কালী নন, লৌকিক লক্ষ্মী ঠাকরুনও দাঁড়ান স্বামী নারায়ণের বুকে পা রেখেই
পর্ব ৫: মহিষাসুরমর্দিনী নন, কৃষিপ্রধান বাংলায় আদিপূজিতা ছিলেন শস্যদেবী নবপত্রিকা
পর্ব ৪: পুকুরের দেবতা পুকুরের ভূত
পর্ব ৩: পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে লোককথা আর লোকবিশ্বাস
পর্ব ২: পৌরাণিক হিন্দু ও বৌদ্ধ সাহিত্যে দেবতা অথবা মানুষের বন্ধু হিসেবেই স্থান পেয়েছে কুকুর
পর্ব ১: সেকালের ডাকাতির গপ্প
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved