পর্দায় দেব আনন্দকে দেখে প্রেমিকা তখন মোহিত। প্রেমিকটি খানিক দোলাচলে, সরাসরি বিবাহ প্রস্তাব দেবে? না কি কয়েক দিন আগে দেখা সেই ‘তিন ভুবনের পারে’-র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে সাহস তার হৃদয়ে জুগিয়েছে, তার ওপর ভর করে নেহাতই প্রেমনিবেদন করবে ও পাণিপ্রার্থী হবে রোমান্সের ঢেউ খেলিয়ে? হাত ধরা কি সমীচীন হবে? না কি আপাতত থাক?
৪.
সময়যানে এক ঝাঁপ দিয়ে বেশ অনেকটা এগিয়ে আসতে হল। সাতের দশকে ফেরার জন্যই কিছুটা এগিয়ে আসা। ২০০৭ সাল। মার্চ মাস। রাজ্যে তখন রাজনৈতিক টালমাটাল। সদ্য ঘটে যাওয়া সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আঁচ পোহাচ্ছে বাঙালি। থমথমে চারপাশ। এরকমই এক সময়ে অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হওয়ার অবসরে একটি ছেলে বাড়িতে বসে টিভি স্ক্রিনে যে ছবিটি দেখছিল, সে জানতই না, ৩৭ বছর আগে ছবিটা নিয়ে ‘মিনার’ সিনেমা হলে কী কাণ্ড হয়ে গিয়েছে!
‘জনি মেরা নাম’ নামের সেই সিনেমার নায়কের নাম দেব আনন্দ। দেব আনন্দ নামটার সঙ্গে কোন প্রজন্মের প্রজন্মের পরিচয়, সেটা একটু বোঝা প্রয়োজন আগে। সেই স্বাধীনতার আগে থেকে যাঁর অভিনয়ের যাত্রা শুরু, সেই দেব আনন্দ কিন্তু নবীন নায়ক ছিলেন পাঁচ-ছয়ের দশকে। ফলে, স্বাধীনতার পর যাদের সিনেমা দেখা শুরু, তাদের নায়ক দেব আনন্দ সত্তরে এসে বেশ বুড়ো। ফলে, ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘প্রেম পূজারী’ (যা তাঁর নিজেরই নির্দেশনা) বা ‘জনি মেরা নাম’ বা ‘গ্যাম্বলার’ আদতে তাঁর বিগত-যৌবনের ছবি। সেই দেব আনন্দ, যাঁকে কিনা ‘ম্যাকেনাস গোল্ড’ বা আলফ্রেড হিচককের ‘স্পেলবাউন্ড’ ছবির গ্রেগরি পেকের সঙ্গে তুলনা করা হত, বা বলা ভাল, বলা হত গ্রেগরি পেকের ভারতীয় সংস্করণ, সেই দেব আনন্দ তাঁর যৌবন পেরিয়ে এসে যে যে ছবি করছেন, সেখানে তিনি কি আর সেই হার্টথ্রব? ততদিনে বলিউড পেয়ে গিয়েছে এক সদ্য-রোমান্টিক নায়ককে, যাঁর ঘাড় ঘোরানোর ম্যানারিজম বুঁদ করে রাখছে দেশকে। রাজেশ খান্নার নাম তখন আকাশে-বাতাসে ভাসছে বসন্তের উসকানিমূলক কোকিল-ডাকের মতো। তেমন সময় কি দেব আনন্দের রোম্যান্টিক আবেদন আর আগের মতো অটুট?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বেশ কিছুটা রাগই হচ্ছে তখন দেব আনন্দের ওপর। সেই কোন সুদূরের নায়ক, তাও বেশ কিছুটা আধবুড়ো, সে কিনা এতটাই ব্যস্ত রেখেছে তার সঙ্গিনীকে, পর্দার ওপার থেকেই, যে এই মোটামুটি ফাঁকা হল-এ (সন্ধের হাতিবাগান গোলমালের কারণে এড়িয়ে যেতে চেয়েই অনেকে আসেনি, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে) সে কিছুতেই হাতের ওপর হাত রাখার সহজ ভঙ্গিটুকু অবলম্বন করতে পারছে না?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ঐতিহাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক নিরিখে এই কাটাছেঁড়া করা যেতে পারে, তার আগে বরং গল্পে ফেরা যাক। রাজনৈতিক চাপানউতোরের ওই বছরে, ২০০৭ সালে, এক থমথমে দুপুরে কিঞ্চিৎ থ্রিলারধর্মী ওই ছবি দেখে বিশেষ মজেনি সেই কিশোর। কিন্তু সেদিনই বিকেল পড়ে আসা সন্ধেবেলা তার বাবার থেকে শোনা গল্পটুকু অনেকটা বদলে দিয়েছিল তার ভাবনার গতিপথ। আরেক উত্তাল রাজনীতির সময়, ১৯৭০-এর এক হালকা হেমন্তে উত্তর কলকাতার ব্যস্তসমস্ত, আবার নকশাল অভ্যুত্থানের আবহে, সেসময় ওই এলাকায় সিপিএম-নকশাল সংঘর্ষের উত্তাপে কিছুটা ত্রস্ত ও তপ্ত সন্ধের আলোয়ান জড়িয়ে এক যুগল ঢুকেছিল ‘মিনার’-এ, যে হল এখন সিঙ্গল স্ক্রিন থেকে সিনেপ্লেক্স হয়ে উঠেছে। এই যুগলের প্রেমিকপ্রবর কিশোরটির বাবার যেমন পরিচিত, কিশোরটিরও পরিচিত। এই পাড়াতেই তার বাস। নিষ্ঠাবান পার্টিকর্মী এবং বেশ গুরুগম্ভীর, নীতিবাগীশ সেই লোকটি সাড়ে তিন দশকেরও বেশি আগের হেমন্তের হিমমাখা সন্ধেয় ঢুকছে সিনেমা হলে, এই দৃশ্যকল্পই কিশোরটির বিস্ময় জাগাতে যথেষ্ট ছিল। তারপরের গল্প আরও চমৎকার।
পর্দায় দেব আনন্দকে দেখে প্রেমিকা তখন মোহিত। প্রেমিকটি খানিক দোলাচলে, সরাসরি বিবাহ প্রস্তাব দেবে? না কি কয়েক দিন আগে দেখা সেই ‘তিন ভুবনের পারে’-র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে সাহস তার হৃদয়ে জুগিয়েছে, তার ওপর ভর করে নেহাতই প্রেমনিবেদন করবে ও পাণিপ্রার্থী হবে রোমান্সের ঢেউ খেলিয়ে? হাত ধরা কি সমীচীন হবে? না কি আপাতত থাক?
বেশ কিছুটা রাগই হচ্ছে তখন দেব আনন্দের ওপর। সেই কোন সুদূরের নায়ক, তাও বেশ কিছুটা আধবুড়ো, সে কিনা এতটাই ব্যস্ত রেখেছে তার সঙ্গিনীকে, পর্দার ওপার থেকেই, যে এই মোটামুটি ফাঁকা হল-এ (সন্ধের হাতিবাগান গোলমালের কারণে এড়িয়ে যেতে চেয়েই অনেকে আসেনি, তা বেশ বোঝা যাচ্ছে) সে কিছুতেই হাতের ওপর হাত রাখার সহজ ভঙ্গিটুকু অবলম্বন করতে পারছে না?
পর্দায় ততক্ষণে চোরের ছদ্মবেশে থাকা সিআইডি অফিসার সোহন অর্থাৎ দেব আনন্দ পাহাড়ের ওপর মারপিটে ব্যস্ত! আচমকাই দুড়ুম করে একটি আওয়াজে যেন কেঁপে উঠল হলের মাটি।
এতক্ষণের কঠিন কাজ সহজ হল নিমেষেই।
হাত ধরে ফেলল মেয়েটি, ছেলেটির। তুঙ্গ ক্লাইম্যাক্সের দেব আনন্দ তখন তাঁর চরিত্রের পারিবারিক ইতিহাসে ঘাই মারবেন। পলাতক দাদা, বিধবা মা, পিতৃহত্যার প্রতিশোধের চেনা বলিউডি মানচিত্রে ঢুকে পড়ছে ছবি। ছায়ার মতো যুগল ওই হল-ভরা আলো-অন্ধকারে যেতে যেতে দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে। কিঞ্চিৎ দ্বিধায় মেয়েটি জিজ্ঞেস করে ফেলল ছেলেটিকে, ‘এবার?’
ছেলেটি গলা খাঁকরে বলল, ‘এবার… এবার কী?’
মেয়েটি আলতো চোখ নামিয়ে বলে, ‘বাড়ি ফিরব কী করে?’
কে ফেলেছিল বোমাটা, নকশাল না সিপিএম– বলা মুশকিল। ছেলেটি, যে পরবর্তীতে চাকুরিজীবী ও আদর্শবান গাম্ভীর্যে ঢাকা বামপন্থী হবে, এবং তাকে দেখলেই পাড়ার ছেলেমেয়েরা ভয়ে ছাড়িয়ে নেবে হাত, সে সেদিন বেশ কিছুটা আতান্তরেই পড়েছিল। আজ নাহয় বাড়ি ফেরা হল, এরপর বারবার হবে তো?
‘এই কি তবে ঠিক হলো যে দশ আঙুলের সুতোয় তুমি
ঝুলিয়ে নেবে আমায়
আর আমাকে গাইতে হবে হুকুমমতো গান?
এই কি তবে ঠিক হলো যে বৃষ্টিভেজা রথের মেলায়
সবার সামনে বলবে ডেকে, ‘এসো
মরণকূপে ঝাঁপাও’?’
এই সময়ের আশপাশেই ‘আদিম লতাগুল্মময়’-এর এই কবিতা লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। হাতের ওপর হাত রাখা সহজ হয়েছিল সেদিন, সারাজীবন বইতে পারাও সহজ হোক, এই কামনাতেই দেব আনন্দ বিদায় নিয়েছিলেন বোধহয় পর্দা থেকে। আর তার মাসখানেক বাদেই ওই ‘মিনার’-এই, ‘প্রথম কদম ফুল’ দেখতে এসে, লাইব্রেরিতে সৌমিত্র-তনুজার প্রেমের কুসুম প্রস্ফুটিত হওয়ার সময় বিস্ফোরণের ইন্ধন ছাড়াই মেয়েটি হাত ধরেছিল ছেলেটির। পাড়ার কিছু কাছের বন্ধুকে সেই গল্প বেশ লাজুক ভাবেই করেছিল ছেলেটি।
চরিত্ররা বা আখ্যান কাল্পনিক নয়, একথা মৃদু স্বরে বললেও, জোর গলায় বলার এই, এই গল্পের ভূগোল একেবারে সত্যি। ‘মিনার’ নামের এলডোরাডোরা এভাবেই ধরে রেখে দিয়েছে ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস, গোয়েন্দা হয়ে দেব আনন্দের বারবার পর্দায় যাতায়াতের রহস্যের মাঝেই রাজেশ খান্নার ততোধিক স্পষ্ট প্রেমের আবেশে হৃদয়ের কুরসিটুকু দখল করে নেওয়া, উত্তমকুমারের চরিত্রাভিনেতা হয়ে ওঠার ফাঁকে বাঙালি পুরুষের প্রেমিক সত্তার নতুন প্রতিনিধি হয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পর্দায় আসা; আর এমন অজস্র হাত ধরা ও না-ধরার গল্প, একাকিত্বের কিসসা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অজান্তে পাকানো বিস্ফারের সলতে।
এই সিনেমা হলরা দিনের শেষে চেয়েছিলই, সবার ভালো হোক।
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved