১৯৪২-এর বোমাতঙ্কের পরেও কলকাতা শহর সুরক্ষিত করার বিশেষ কোনও ব্যবস্থা করেনি ঔপনিবেশিক সরকার। ‘ব্ল্যাক-আউট’ বা ভিক্টোরিয়া কালো রং করে শহরবাসীকে আশ্বস্ত করা সম্ভব হয়নি। জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা থাকলেও কলকাতা শহর তখন ধুঁকছে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত হতদরিদ্র মানুষগুলোকে নিয়ে। যুদ্ধ নিয়ে শঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় লোকজনের সুরক্ষা বা জীবন নিয়ে বিশেষ ভাবিত ছিল না। আর ’৪২-এর অগাস্ট আন্দোলন ঔপনিবেশিক সরকারকে ভারতীয়দের প্রতি আরও নির্মম করে তুলেছিল।
২৪.
১৯৪২-’৪৩ সালে কলকাতা থেকে পালানো, আবার কলকাতায় কোনওক্রমে চলে আসার এক করুণ ইতিহাস দেখতে পাই আমরা। পূর্ব এশিয়ায় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই মিত্র পক্ষের লড়াইয়ের এক প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে কলকাতা আর তার বন্দর। আমেরিকার সৈন্যরা কলকাতায় এসে উপস্থিত হয়, ময়দানে জঙ্গি বিমান ওঠানামার অস্থায়ী ব্যবস্থা করা হয়। এই যুদ্ধের আবহে ঔপনিবেশিক সরকার বাংলার উপর এক নির্মম আঘাত হানল। ব্রিটিশ সরকারের যুদ্ধ সামাল দেওয়া ও সেনাবাহিনীর রসদ জোগানোর নানা নীতির সরাসরি ফলাফল ছিল ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’। ১৯৪২ সালের ২০ ডিসেম্বরের রাতে প্রথম বার কলকাতায় বোমা ফেলে জাপানিরা। যত না ক্ষয়ক্ষতি হল তার থেকেও অনেক বেশি ভয় ঢুকল মানুষের মনে। আদৌ কি কলকাতা নিরাপদ? সরকারের ওপর কি আস্থা রাখা যায়? জাপানিরা কি অনেক বেশি শক্তিশালী নয়? এই সব নানা প্রশ্ন আর আশঙ্কা শহরবাসীকে বিপন্ন করে তুলল।
ব্রিটিশ সরকার অবশ্য এই জাপানি আক্রমণকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে রাজি ছিল না। ভারতের ভাইসরয়, লর্ড লিনলিথগো কলকাতার নাগরিকদের উদ্দেশে বাণী দিলেন, “Yours is the first capital city in India to suffer in this war a baptism of fire and her citizens have provided an admirable example of steadiness and fortitude. Well done Calcutta.” বিলিতি কাগজ স্টেটসম্যান বা জাতীয়তাবাদী অমৃত বাজার পত্রিকা-র বক্তব্যও মোটামুটি একই রকম ছিল। দুই কাগজেই লেখা হল যে, এ ছিল সামান্য এক ঘটনা, কলকাতার আমজনতা এতে মোটেই ঘাবড়ে যায়নি।
সাধারণ মানুষ যদিও এই আশ্বাসবাণীতে আস্থা রাখতে পারেনি। এক বিচিত্র ছবি দেখা গেল এরপর। সেই আঠারো শতক থেকে লোকে শুধু এসেই গেছে কলকাতায়– রুজি রোজগার, লেখাপড়া, বা আমোদ-প্রমোদের টানে। কিন্তু বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্কে প্রচুর মানুষ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়া বেশি নিরাপদ মনে করলেন। শহরের বিভিন্ন কাজকর্ম অপ্রত্যাশিতভাবে ধাক্কা খায় এর ফলে। সঠিক হিসেব পাওয়া যায় না, তবুও বিভিন্ন সরকারি নথি আর দৈনিক পত্রিকা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রায় দুই থেকে তিন লক্ষ মানুষ গাড়িতে, রেলে, বা পায়ে হেঁটে কলকাতা ত্যাগ করেছিলেন এই সময়ে। বন্দর এলাকার শ্রমিকরা দ্রুত কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন। শহরের জঞ্জাল পরিষ্কার করা বা রাস্তাঘাট সাফসুতরো রাখা সমস্যার হয়ে দাঁড়িয়েছিল কারণ এইসব কাজ করার লোকেরাও প্রাণভয়ে কলকাতা ছেড়েছিলেন। যাঁরা রয়ে যান তাঁরা কর্তৃপক্ষের কাছে বাড়তি পয়সা আর নিরাপত্তা দাবি করেন। কলকাতায় বোমা পড়ার পর শ্রমিক বিক্ষোভ আর স্ট্রাইক অনেকগুণ বেড়ে যায়। সবার মনে হচ্ছিল সরকার যথেষ্ট প্রস্তুতি নিচ্ছে না বা তাঁদের সুরক্ষার জন্য বিশেষ কিছুই করে উঠছে না।
৫ ডিসেম্বর, ১৯৪৩ ছিল রবিবার। সকাল ১১.১৫ নাগাদ হঠাৎ সাইরেন বেজে ওঠে। শহরবাসীকে সতর্ক করা হয়, আকাশপথে হানা দিতে পারে জাপানিরা। দিনদুপুরে বোমা পড়বে, এমনটা কেউই বিশ্বাস করতে চায়নি। কিন্তু মিনিট কয়েক পরে, ১১.২৭-এর সাইরেন জানায় ‘রেড অ্যালার্ট’, অর্থাৎ আক্রমণ নিশ্চিত। বিশ মিনিটের মধ্যেই কলকাতার আকাশ প্রায় ২৫০টি জাপানি বোমারু বিমান ছেয়ে ফেলে। ১১.৪৫-এ জাপানি বোমা পড়ল কলকাতার ডকে। এই বিমানগুলিকে বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না, ফলে তারা বেশ বেছে বেছে বোমা ফেলতে পেরেছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কলকাতা ডকের বেশ কিছু এলাকায় আগুন ধরে, ইলেক্ট্রিকের লাইন ছেঁড়ে, রেলের ওয়াগন আর লাইন ধ্বংস হয়। বন্দর এলাকার মধ্যেই ছিল হুগলি জুট মিল, তার উপর সাতটি বোমা পড়ে। ডকে যেসব জাহাজ ছিল মাল তোলা বা নামানোর জন্য, সেগুলিও রেহাই পায় না জাপানি বোমার হাত থেকে। ১১.৫৭-র মধ্যেই দেখা যায় অন্তত ১১টি বড় নৌকা জলের ওপর দাউদাউ করে জ্বলছে। দুপুর একটার সময় ‘অল-ক্লিয়ার’ সংকেত বেজে ওঠে। শতাধিক মানুষ আর পশু মারা যায় এই ঘণ্টা দেড়েকের অভিযানে। বন্দর এলাকার বাইরেও খিদিরপুর, ওয়াটগঞ্জ, আর গার্ডেন রিচের কিছু অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়; ভবানীপুর, আলিপুর, আর বউবাজারেও বিস্ফোরণ ঘটে।
বন্দর এলাকায় শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিশেষ কোনও ব্যবস্থাই করে উঠতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। আকাশপথে আক্রমণ হলে প্রাণ বাঁচানোর নির্দিষ্ট ছাউনি বা আশ্রয় ছিল না। যা কিছু অল্প মাথা গোঁজার জায়গা ছিল তাও শ্রমিক সংখ্যার তুলনায় ছিল নিতান্তই সামান্য। ফলে বোমার ভয়ে অনেকেই কাজ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। আর সরকারের মনোভাবও বিশেষ ভরসা জোগাতে পারেনি লোকজনকে। বিভিন্ন হিসেব অনুযায়ী দেখা যায় যে, ৫ তারিখ বোমা পড়ার পরপরই প্রায় ৭০০০ শ্রমিক গার্ডেন রিচ এলাকা থেকে সারি দিয়ে অনির্দিষ্ট গন্তব্যের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েন। জি. টি. রোডে দেখা যায়, সার দিয়ে গরুর গাড়ি– শহর থেকে লোকে গ্রামের দিকে যেতে শুরু করেছেন। বন্দর এলাকায় বার্ড অ্যান্ড কোম্পানির প্রায় দশ হাজার ঠিকাকর্মী বোমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কারখানা ছেড়ে প্রাণভয়ে পালিয়ে যান।
তবে সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে এই দিনের ঘটনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পরের দিন স্টেটসম্যান–এ সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী উল্লেখ করা হয় যে ‘কলকাতায় কয়েকটি বোমা পড়েছে’ কিন্তু ক্ষয়ক্ষতি ‘সামান্য’ [‘slight’] হয়েছে। সরকার দাবি করে যে আরও অনেক বেশি ক্ষতি হতে পারত কিন্তু তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জাপানি বিমানকে প্রতিহত করতে সফল হয়। এর বেশি কিছু আর বলা হয় না সেই রিপোর্টে। যুদ্ধ চলাকালীন খবরে কী প্রকাশ পাবে বা কতটা, ভাষা কী হবে– এই সবই সরকারি নীতি অনুযায়ী ঠিক হত। ১৯৪৩-এর এপ্রিলে যখন কলকাতায় বোমা পড়েছিল তখন সব প্রাদেশিক সরকারের কাছে এক নির্দিষ্ট ‘ডিফেন্স সার্কুলার’ পাঠানো হয় ভারত সরকারের তরফ থেকে। তাতে বলা হয় যে, আকাশপথে হানার রিপোর্টের শব্দ আর ভাষার ব্যবহার যেন অত্যন্ত সাবধানে করা হয়। নির্দেশ দেওয়া হয় যে বোমা পড়ার নির্দিষ্ট স্থানের নাম যেন উল্লেখ করা না হয়। উদাহরণ-স্বরূপ বলা হয় যে, ‘কলকাতার ডক’ না বলে ‘কলকাতা অঞ্চলে’ লিখতে হবে। ক্ষয়ক্ষতির উল্লেখ করতে হবে যতটা সম্ভব সাধারণ শব্দে, কোনও সংখ্যা বা তথ্য এড়িয়েঃ “where necessary to publish any mention of damage the general terms ‘slight’, ‘moderate’, and ‘heavy’ or synonyms of these will be used. These terms will have no relation to any specific numbers of casualties.”
সরকারি বিজ্ঞপ্তি যাই বলুক না কেন, যারা বন্দর এলাকায় ছিলেন তাদের মুখে মুখে বোমার বিবরণ শহরে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগেনি। সরকারের লুকোছাপা বরং উলটো প্রভাব ফেলেছিল। নানা গুজব শহরের আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছিল খুব দ্রুত। যুদ্ধ আর মন্বন্তরের ফলে বাংলার অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল চল্লিশের গোড়ায়। সেই সময়ে কলকাতাও ছাড় পায়নি। ১৯৪২-এর বোমাতঙ্কের পরেও কলকাতা শহর সুরক্ষিত করার বিশেষ কোনও ব্যবস্থা করেনি ঔপনিবেশিক সরকার। ‘ব্ল্যাক-আউট’ বা ভিক্টোরিয়া কালো রং করে শহরবাসীকে আশ্বস্ত করা সম্ভব হয়নি। জাপানি আক্রমণের আশঙ্কা থাকলেও কলকাতা শহর তখন ধুঁকছে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত হতদরিদ্র মানুষগুলোকে নিয়ে। যুদ্ধ নিয়ে শঙ্কিত ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় লোকজনের সুরক্ষা বা জীবন নিয়ে বিশেষ ভাবিত ছিল না। আর ’৪২-এর অগাস্ট আন্দোলন ঔপনিবেশিক সরকারকে ভারতীয়দের প্রতি আরও নির্মম করে তুলেছিল। গ্রাম বাংলার গরিব কৃষিজীবী লোকজনের মতোই কলকাতা শহর আর তার দরিদ্র খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষগুলো সরকারের উদাসীনতার শিকার হয়।
ইউরোপীয় শহরগুলির তুলনায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব কলকাতায় সামান্যই ছিল। কিন্তু জাপানি আক্রমণের ভয় আর আশঙ্কা কলকাতার মানুষদের সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। এই ভীতির দায় অনেকাংশেই ছিল ঔপনিবেশিক সরকারের নীতি আর ভুল পরিকল্পনার ফল।
ঋণস্বীকার:
Janam Mukherjee, Hungry Bengal: War, Famine, Riots and the End of Empire (2015)
David Lockwood, Calcutta under Fire: The Second World War Years (2019)
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৪: ঘোড়ার কলকাতা: ট্রাম থেকে রেসের মাঠ
পর্ব ২৩: গোলদীঘি গণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে জেগে উঠেছিল স্বদেশি সময়ে
পর্ব ২২: স্মৃতিদের এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র
পর্ব ২১: কলকাতার কেল্লা এবং ময়দানি মতবিরোধ
পর্ব ২০: সঙের গানে শতবর্ষের পুরনো কলকাতা
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট