কোম্পানির কর্মচারী এবং বলা চলে, তাদের প্রথম ইতিহাসবিদ, রবার্ট ওর্ম-এর লেখা হিস্ট্রি অফ দ্য মিলিটারি ট্র্যনসাকশনস অফ দ্য ব্রিটিশ নেশন ইন ইন্দোস্তান (১৭৭৮) এই ‘মারাঠা ডিচ’-এর কথা বেশ বিশদে লেখা হয় এবং পরবর্তীকালের গবেষকরা এই মতকে মোটামুটি প্রামাণ্য বলেই ধরে নেন। ওর্ম-এর বইতে বলা হয় যে ১৭৪২ সালে কলকাতার ভারতীয় বাসিন্দারা নিজেদের খরচায় এই খাল কাটতে শুরু করেন। ছয় মাসে তিন মাইল মতো এলাকা জুড়ে খাল কাটার কাজ এগোয় শহরের উত্তর এবং পূর্ব দিকে; মূল প্রস্তাব ছিল সাত মাইলের। কিন্তু ততদিনে বর্গির ভয় কমে আসে, তার ফলে বাকি কাজটা আর সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ।
২৬.
পৃথিবী-জুড়ে বন্দর-শহরের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, সেগুলি দেশের অভ্যন্তরের নগরগুলির থেকে অনেক বেশি বহির্মুখী। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে আঠারো শতকে ভারতের পূর্ব-পশ্চিম উপকূলে গড়ে উঠেছিল এরকমই কিছু শহর। সমুদ্র-বাণিজ্যের উপর নির্ভরশীল কোম্পানি দেশের ভিতরে বিশেষ যাওয়ার কথা চট করে ভাবত না। ভারতীয় নবাব-বাদশাহরাও নিজেদের এলাকায় এই ফিরিঙ্গি বণিকদের আনাগোনা প্রশ্রয় দিতেন না। তবে আমরা জানি যে, আঠারো শতকে রাজনৈতিক নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে ইংরেজ কোম্পানি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে নতুন বন্দর-শহরগুলিও ডালপালা মেলতে শুরু করে। নানা দেশের লোক জড়ো হয় এই শহরগুলিতে ভাগ্যান্বেষণে। ইংরেজ রীতিনীতি অনুযায়ী নগর প্রশাসন গড়ে ওঠে, আইন-আদালত তৈরি হয়। তবে শুধু যোগাযোগের ইতিহাসের মাধ্যমে বন্দর-শহরের রূপরেখা ধরতে গেলে অন্য আরেক গল্প হারিয়ে যায়–যা কোম্পানির সার্বভৌম ক্ষমতার স্থানিক বিন্যাসের পরিচায়ক ছিল, যেখানে কলকাতাকে বাকি অঞ্চল থেকে যেন আলাদা এক দ্বীপের মতো গড়ে তোলা হয়েছিল।
কলকাতা ইংরেজ কোম্পানির প্রধান কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি পায় ১৭৭৩ সালে, ব্রিটেনের পার্লামেন্টের ‘রেগুলেটিং আক্ট’-এর মাধ্যমে। বম্বে আর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির উপর স্থান পায় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি আর তার গভর্নর, যিনি এবার থেকে হয়ে গেলেন গোটা ভারতের গভর্নর-জেনারেল। ওয়ারেন হেস্টিংস এই পদোন্নতির ঠিক আগের বছরই মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন বাংলার রাজস্ব আদায়ের মূল কার্য্যালয়কে। কিন্তু এর অনেক আগে থেকেই কলকাতাকে কেন্দ্র করে ইংরেজ কোম্পানি নিজেদের একটা শক্তপোক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলার চেষ্টায় ছিল। কলকাতায় কেল্লা বা মেয়রস কোর্ট তৈরি হয় আঠারো শতকের প্রথমার্ধেই। ইংরেজ কোম্পানি নবাবের আক্রমণ ছাড়াও চিন্তিত ছিল ফরাসিদের সঙ্গে সংঘাত নিয়ে। এরই মধ্যে ১৭৪০-এর দশকে যোগ হয়েছিল মারাঠা বর্গিদের আচমকা হানার ভয়।
বর্গি আক্রমণের সম্ভাবনা কলকাতায় ইংরেজদের এক নতুন সুযোগ করে দিয়েছিল। কলকাতাকে নিজেদের এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করার ইচ্ছে কোম্পানির বহুদিনের। বাকি বাংলার থেকে আলাদা এক নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, যেখানে তাদের সার্বভৌম ক্ষমতা বহাল হবে, যেখানে ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রশাসনিক কাজকর্ম বা ধর্মীয় আচার-বিচারের উপর নবাবের নজরদারি থাকবে না। বর্গি হানা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করার জন্য কলকাতাকে ঘিরে এক বিশাল খাল কাটার কথা বলে শহরের দেশীয় কিছু বণিক। এই ভাবনা যদিও অনেক দিন আগে থেকেই কোম্পানির কর্তাব্যাক্তিদের মাথায় ঘোরাফেরা করছিল, কিন্তু সেই ভাবনা এর আগে কোনও নির্দিষ্ট দিশা পায়নি। তবে যে কোনও সীমানা তৈরির জন্মলগ্ন নিয়েই নানা ধোঁয়াশা থাকে। কলকাতার ‘মারাঠা ডিচ’ নিয়েও মতান্তর দেখা যায় ঐতিহাসিক দলিলপত্রে।
কোম্পানির কর্মচারী এবং বলা চলে, তাদের প্রথম ইতিহাসবিদ, রবার্ট ওর্ম-এর লেখা হিস্ট্রি অফ দ্য মিলিটারি ট্র্যনসাকশনস অফ দ্য ব্রিটিশ নেশন ইন ইন্দোস্তান (১৭৭৮) এই ‘মারাঠা ডিচ’-এর কথা বেশ বিশদে লেখা হয় এবং পরবর্তীকালের গবেষকরা এই মতকে মোটামুটি প্রামাণ্য বলেই ধরে নেন। ওর্ম-এর বইতে বলা হয় যে ১৭৪২ সালে কলকাতার ভারতীয় বাসিন্দারা নিজেদের খরচায় এই খাল কাটতে শুরু করেন। ছয় মাসে তিন মাইল মতো এলাকা জুড়ে খাল কাটার কাজ এগোয় শহরের উত্তর এবং পূর্ব দিকে; মূল প্রস্তাব ছিল সাত মাইলের। কিন্তু ততদিনে বর্গির ভয় কমে আসে, তার ফলে বাকি কাজটা আর সম্পূর্ণ করার প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ। এই ঘটনার সময়ে ওর্ম কলকাতায় ছিলেন না। অন্যদের বক্তব্য শুনে আর কিছু কাগজপত্র দেখে বোধহয় তিনি এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। কিন্তু কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের চিঠিপত্র, আলাপ-আলোচনা থেকে দেখা যায় খাল কাটার কাজ শুরু হয়েছিল ১৭৪৩ সালে আর অন্তত ১৭৪৮ সাল অবধি মারাঠা আক্রমণের আশঙ্কা তাঁদের ব্যস্ত রেখেছিল।
এই খাল এর পরের পঞ্চাশ বছরে কোম্পানির কলকাতা ‘নির্মাণের’ এক বিশেষ হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। সিরাজের কলকাতা আক্রমণ ও দখল, পরবর্তীকালে ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানির কলকাতা পুনরুদ্ধার, এবং পলাশির প্রান্তরে সিরাজের পরাজয়—এ সব ঘটনাই কলকাতাকে বাংলার প্রধান শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করে। ‘মারাঠা ডিচ’ যে কলকাতার সুরক্ষার বিশেষ উপযোগী নয়, তা সিরাজের বাহিনী প্রমাণ করে দিয়েছিল। কিন্তু এই খাল অন্য গুরুত্ব পেয়ে যায় পলাশি-পরবর্তী মীর জাফরের সঙ্গে কোম্পানির চুক্তির সময়ে। এতে কোম্পানিকে খালের ভিতরের সব জমি বিনা করে দান করা হল। এই সিদ্ধান্তে নবাবের বাংলার সঙ্গে কোম্পানির কলকাতার পার্থক্য তৈরি হল না শুধু; বরং মারাঠা ডিচ-কে কোম্পানির নিজস্ব এলাকার সীমানা হিসেবেও স্বীকৃতি দেওয়া হল। কোম্পানি যদিও এই সীমানার বাইরেও কলকাতার আশেপাশে অন্য জমিতে ভাগ বসিয়েছিল সেইসব এলাকার জমিদারদের হঠিয়ে দিয়ে। কিন্তু এই খাল যেন কলকাতা/কোম্পানি এবং নবাব/জমিদার/বাংলার মধ্যে এক নির্দিষ্ট সীমারেখা টেনে দিল এই পর্বে।
অসম্পূর্ণ মারাঠা ডিচ কলকাতার স্থানিক ধারণাকে এর পর নানা ভাবে পুষ্ট করেছে। ১৭৯৪ সালে যখন প্রথমবার কলকাতার এলাকা নির্ধারিত হয় সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুসারে, তখন এই খাল শহরের পূর্ব দিকের সীমানা হিসেবে গণ্য করা হয়। উনিশ শতকের গোড়ায় কোম্পানি অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল, ফলে আর তাদের সুরক্ষার জন্য শহরের চারপাশে খাল কেটে রাখার প্রয়োজন ছিল না। ১৭৯৯ সালে লর্ড ওয়েলেসলির নির্দেশে খাল বুজিয়ে পঞ্চাশ ফুট চওড়া সার্কুলার রোড তৈরি করা হয়। তবে এতে মারাঠা ডিচের স্মৃতি মুছে যায়নি। এই খাল শুধু এক সময়ের সুরক্ষার কথা ভেবে তৈরি করা কোনও নাগরিক পরিকাঠামো মাত্র ছিল না। বরং তা কোম্পানির শাসন ব্যবস্থার কিছু নির্দিষ্ট রূপ গেঁথে দিতে সাহায্য করেছিল। সেই সময়ে বাংলার আইনি কাঠামোয় এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কলকাতায় ছিল বিলিতি আইন, আর বাকি খালের ওপারে হিন্দু আর ইসলামীয় আইন। এর ফলে নানা জটিলতা প্রথম থেকেই লেগে ছিল কোম্পানির শাসনে। এই আইনি বহুত্ববাদের প্রসঙ্গে উনিশ শতকের তিনের দশকেও মারাঠা খালের নাম বারবার ঘুরেফিরে এসেছে কোম্পানির কর্তাব্যক্তিদের কথাবার্তায়।
প্রশাসনিক ব্যবহারের বাইরেও মারাঠা ডিচ এক নতুন পরিচয় লাভ করে সামাজিক পরিচিতি নির্মাণের ক্ষেত্রে। খালের পশ্চিমে কলকাতার লোকজন যেন বাকি প্রদেশের জনগণের থেকে বেশ আলাদা ও উন্নত– এই ধারণা ব্রিটিশ আর আংলো-ইন্ডিয়ান জগতে উনিশ শতক জুড়ে ছড়িয়ে ছিল। কলকাতার বাসিন্দাদের ‘ডিচার্স’ বলে অভিহিত করা হত বেশ কিছু লেখাপত্রে, বিশেষত যেসব লেখা ছাপা হত মফসসলে। ১৮৩৯ সালে এশিয়াটিক জার্নাল– এর এক প্রবন্ধে মফসসল আর কলকাতার বাসিন্দাদের এই চাপান-উতোর নিয়ে লেখা হল:
the Mofussillites and the Ditchers have agreed to hate each other with great cordiality. This dislike originated, in the first instance, in the arrogance and assumptions of the Ditchers, who despised the Mofussillites as barbarous and uncouth, living entirely out of the pale of civilized society; while, as the Mofussil widened, and its Anglo-Indian population increased, they, priding themselves upon their better acquaintance with the country, laughed at the Ditchers for their ignorance.
বিশ শতকেও যে এরকম ধারণা রয়ে গিয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় বেশ কিছু আত্মজীবনীতে। যেমন নীরদ চৌধুরী লিখেছেন, “the natives of Calcutta…were amazingly parochial. The world beyond the Hooghly River and the Mahratta Ditch was a wilderness to them.”
কলকাতাকে সুরক্ষিত করার জন্য বানানো এই খাল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কলকাতাকে বাকি প্রদেশ থেকে আলাদা করার এক প্রক্রিয়া হয়ে দাঁড়ায়। কোম্পানির রাজনৈতিক দাবি, তার সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকাশ, বা জটিল আইনি ব্যবস্থা– কলকাতার বেড়ে ওঠার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল ব্যতিক্রমী স্থান নির্মাণের নানা কৌশল। প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছাপিয়ে এর গভীর ছাপ পড়ে বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে, যেখানে কলকাতা আর বাকি বাংলার মধ্যে যেন মারাঠা ডিচের ব্যবধান এখনও ঘোচেনি।
ঋণস্বীকার: Joshua Ehrlich, ‘The Meanings of a Port City Boundary: Calcutta’s Maratha Ditch, c.1700-1950’, Past and Present, No 257 (November 2022).
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৫: কালো ভিক্টোরিয়া ও থমথমে কলকাতা
পর্ব ২৪: ঘোড়ার কলকাতা: ট্রাম থেকে রেসের মাঠ
পর্ব ২৩: গোলদীঘি গণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে জেগে উঠেছিল স্বদেশি সময়ে
পর্ব ২২: স্মৃতিদের এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র
পর্ব ২১: কলকাতার কেল্লা এবং ময়দানি মতবিরোধ
পর্ব ২০: সঙের গানে শতবর্ষের পুরনো কলকাতা
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট