১৯০৪ সালে, চার্লস রাসেল, প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক, সহকারী ডিপিআই হিসেবে শহরের ৩৩টি ছাত্রদের মেস ঘুরে একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। বলা বাহুল্য, সেই প্রতিবেদনে মেস-বাড়িগুলির ভয়াবহ চেহারা ফুটে উঠেছিল। তবে এতে হিতে বিপরীত হয়। বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার প্রাক্কালে সরকার-বিরোধী যে আবহাওয়া ছিল, সেই পালেই হাওয়া লাগে। বাঙালি ছাত্রদের সরকার ইচ্ছে করেই বদনাম করছে বলে অভিযোগ করা হয়।
২৯.
কলকাতা শহরে মেস-বাড়ি এখনও বহাল তবিয়তে টিকে আছে। মফস্সল থেকে শহরে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় সংখ্যা এই মেসের ওপর নির্ভরশীল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেলে স্থান পাওয়া অনেক সময়ই কঠিন হয়। এই সমস্যা উনিশ শতক থেকেই, যখন উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতা শহরে আসার চল শুরু হয়। সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে ঔপনিবেশিক কলকাতার গুরুত্ব বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে চাকুরিজীবী একলা পুরুষদের ঠিকানাও হয়ে ওঠে মেসবাড়ি। গোটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে পরিবার-সহ কলকাতায় থাকা বেশিরভাগ মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল না, তাই অনেকের কাছেই মেস-ই ছিল একমাত্র সম্বল। এবং এর সূত্র ধরে এক পুরুষ-কেন্দ্রিক নাগরিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। আমাদের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে, স্মৃতিচারণায়, গল্পে-উপন্যাসে এই মেস-জীবনের নানা কথা, নানা আবেগ, নানা ভালোলাগার অম্ল-মধুর ছবি পাওয়া যায়। শহরের সঙ্গে পরিচয়ের প্রথম ধাপ হয়ে ওঠে মেস; তাই মেসের বাসিন্দাদের চোখ দিয়ে দেখলে কলকাতার এক অন্য রূপ দেখতে পাওয়া যায়, যেখানে নিহিত থাকে শহরতলি আর মফস্সলের সঙ্গে বড় শহরের টানাপোড়েন, যা সেই উনিশ শতক থেকেই শুরু হয়েছে।
বিপিনচন্দ্র পালের আত্মজীবনীতে ১৮৭০-এর দশকের মেসবাড়ি নিয়ে চমৎকার তথ্যবহুল দৈনন্দিন জীবনচর্যার ধারণা পাওয়া যায়। শ্রীহট্ট থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনোর জন্য এসে তিনি উঠেছিলেন ১৫ নম্বর নিমু খানসামা লেনের সিলেট মেসে। জেলাওয়াড়ি মেস বাড়ি তখন ছিল কলকাতার এক বিশেষ বৈশিষ্ট। তখনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কোনও ছাত্রাবাস ছিল না। ফলে শহরের বাইরে থেকে পড়তে আসা ছাত্রদের নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরই করে নিতে হত। এভাবে একই অঞ্চলের লোকজন এক একটা মেস তৈরি করে নিয়েছিলেন। একদিকে যেমন ছিল সিলেট, ত্রিপুরার মেস, তেমনই খানিক বড় এলাকা হিসেবে ঢাকার মেস ছিল দু’টি, কারণ বেশি সংখ্যক ছাত্র ঢাকা থেকে কলকাতায় আসত লেখাপড়ার জন্য। তবে এক জেলার মেসে একেবারেই অন্য কেউ ঠাঁই পেত না, তা নয়।
এই মেসবাড়ির বন্দোবস্ত নিয়ে বিপিন পাল লিখছেন,
সেকালে কলিকাতার ছাত্রাবাসগুলি এক একটি ক্ষুদ্র জন-রাজ্য বা Republic ছিল। যে বাড়ীতে কতকগুলি ছাত্র মিলিয়া বাস করিতেন, সে বাড়ীর সমুদয় কাজকর্ম্ম তাহাদের অধিকাংশের মতে নির্ব্বাহ হইত। প্রতি মাসে সকলে বসিয়া মাসিক খরচের একটা বরাদ্দ করিয়া দিতেন। প্রত্যেক ঘরের কোন্ সীটের কত ভাড়া সকলে মিলিয়া ঠিক করিতেন। তারপর যার যে ঘর বা যে সীট পছন্দ হয়, তিনি তাহা বাছিয়া লইতেন; এই লইয়া কখনও কোন বিবাদ বিসম্বাদ হইতে দেখি নাই।
এরপর ঠিক হত অন্য মূল বিষয়টা– খাবারদাবারের দায়িত্ব কে পাবে, আর তাঁর কী কী কাজ। এই ‘ম্যানেজার’ পদটি যে বিশেষ আরামের ছিল না, তার খানিক আভাস পাওয়া যায় বিপিন চন্দ্রের লেখায়:
তারপর মোটামুটি প্রতি মাসের একটা বাজেট (budget) ঠিক হইত এবং একজন কর্ম্মকর্ত্তা নির্ব্বাচিত হইতেন। এই বাজেট মত যতটা সম্ভব তিনি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করিতেন। ম্যানেজার সচরাচর এক মাসের জন্যই নির্ব্বাচিত হইতেন। তাঁহাকে বাসার খাই-খরচের হিসাব রাখিতে হইত। চাল, ডাল, ঘি, তেল প্রভৃতি নিজে যাইয়া কিনিয়া আনিতে হইত। ভাল জিনিষ না আনিলে বা আনিতে না পারিলে তাঁহার উপর রীতিমত সাধারণ সভাতে সেন্সার (censure) আনা হইত। মাসিক বাজেটের বেশী খরচ হইলে কর্ম্মকর্ত্তা তাহার অক্ষমতা বা অনবধানতার জন্য নিন্দার ভাগী হইতেন এবং সভ্যেরা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ করিতেন। এই নিন্দার ভয়ে কখনো কখনো কোন মাসের কর্ম্মকর্ত্তা তাঁহার নিজের তহবিল হইতে বাজেটের অতিবিক্ত ব্যয় পূরণ করিয়া দিতেন। কখনো কোন মাসে কর্ম্মকর্ত্তার কৃতিত্বে বাজেটের টাকা উদ্বৃত্ত হইলে, মাসের শেষ দিকে যথাযোগ্য সমারোহ সহকারে সভ্যদের বিশেষ ভোজের ব্যবস্থা হইত।
ঝগড়া-ঝামেলায় মেসের সভ্যরাই আলোচনা সভা বসিয়ে নিদান দিতেন। কোনও গুরুতর অপরাধ সাব্যস্ত হলে সেই সভ্যকে মেস ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ পর্যন্ত দেওয়া হত বলে বিপিন পাল জানিয়েছেন।
মেসের সভ্যদের সাধারণ সভাতেই পরস্পরের ঝগড়া-বিবাদেরও বিচার এবং মীমাংসা হইত। এই উপলক্ষে রাত্রে আহারান্তে আমাদের সাধারণ আদালত বসিত। বাদী প্রতিবাদীকে এই আদালতে নিজেদের বক্তব্য বিবৃত করিতে হইত এবং প্রয়োজন হইলে সাক্ষী-সাবুদও এই আদালতের সমক্ষেই উপস্থিত করিতে হইত।… সময় সময় আমাদের এই সাধারণ আদালতে অতি গুরুতর বিষয়েরও বিচার নিষ্পত্তি হইত। কোন সভ্য কোন গর্হিত আচরণে দোষী হইলে তাহাকে মেস ছাড়িয়া যাইতে হইত। ইহাই আমাদের ‘জনরাজ্যের’ নির্বাসন-দণ্ড ছিল। এই নির্বাসন-দণ্ডকে সকলে অত্যন্ত ভয় করিতেন। কোন বন্ধুর উপরে একবার এই দণ্ড বিহিত হইয়াছিল। আমাদের বাসা হইতে চলিয়া যাইবার পাঁচ ছয় দিন পরে তাঁহার সঙ্গে পথে দেখা হয়। দেখিয়া মনে হইল যেন তিনি ছয় মাসের রোগশয্যা হইতে উঠিয়া আসিয়াছেন।
মেসের খাবার নিয়ে সবারই চিরকাল আপত্তি থাকে, বিপিন পালের লেখাতেও সেই কথা পাওয়া যায়। তাই সকলেই বাইরে অন্যান্য খাবারের দিকেও নজর দিত। ধার্মিক ব্যক্তিরা এতে বিশেষ সুবিধে করে উঠতে পারতেন না; তবে বিপিন চন্দ্র নিজে সে ব্যাপারে খুব একটা পরোয়া করেননি। সিলেটে থাকাকালীনই তাঁর ‘হিন্দুয়ানির বন্ধন আলগা’ হয়ে গিয়েছিল, আর কলকাতায় এসে তা থেকে তিনি পুরোপুরি মুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন বলে মন্তব্য করেছেন। মুরগির মাংস খেতে বা ইংরেজ রেস্তোরাঁয় যেতে তিনি বেশ পছন্দ করতেন। এই অল্প কথায় এটাও বোঝা যায় যে, অভিভাবক-হীন বড় শহরে যুবদের বসবাস করার এক অন্য দিকও ছিল, যা অনেকের কাছেই আদর্শ ছাত্র-জীবন হিসেবে গণ্য হত না।
এই নিয়ে চিন্তা বা আশঙ্কা সরকারেরও ছিল। ল্যান্ডসডাউন সাহেব ১৮৯২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন ভাষণে বলেন যে, প্রতি বছর ১৭-২৯ বছর বয়সি প্রায় ৬ থেকে ৭ হাজার ছাত্র মফস্সল থেকে কলকাতায় পড়তে আসে। এরা শহরের নানাবিধ বিপদ আর হাতছানির শিকার হয়। তাদের মধ্যে শিষ্টাচার থাকে না, নিয়মকানুন মেনে চলার ব্যাপারেও তারা বেপরোয়া হয়। অন্যদিকে, হিন্দু উচ্চবিত্ত ও উচ্চবর্ণের অভিভাবকদের বিশেষ চিন্তা ছিল জাত-ধর্ম নিয়ে, তাঁদের ছেলেরা যে সেসব খুইয়ে বসছে শহরে, এ ব্যাপারে অনেকেই নিশ্চিত ছিলেন। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলির নিজেদের ছাত্রাবাস চালু করা দরকার, সেটা অনেকেই মনে করতেন। কলেজ স্ট্রিট, শিয়ালদা, মেছুয়া, কলুটোলা ঘিরে কলকাতা শহরের তৎকালীন যে মূল শিক্ষা চত্বর, তার আশেপাশেই ছিল ‘অখাদ্য-কুখাদ্য’ খাওয়ার নামী দোকানপত্তর, আর নানা ‘বেপাড়া’, যুবা ছেলেদের বিপথগামী করার জন্য। এইসব দেখে শুনে ১৮৭৯ সালে ছোটলাট ইডেনের মনে হয়েছিল যে কলকাতায় অতি অবশ্যই ছাত্রাবাস খোলা প্রয়োজন, যেখানে বাইরে থেকে আসা ছাত্ররা নির্দিষ্ট নিয়মবিধির মধ্যে থেকে পড়াশুনো করতে পারবে। এই চিন্তা-ভাবনা রূপায়িত হতে আরও এক দশক লেগে যায়, মূলত টাকার অভাবে। শেষে, মফসসলের বিভিন্ন জমিদার আর সরকারের টাকায় ‘ইডেন হিন্দু হোস্টেল’ চালু করা সম্ভব হয় উনিশ শতকের শেষ লগ্নে।
এই একই সময়ে সরকার ঠিক করে যে শহরের বিভিন্ন মেস-বাড়িগুলি পরিদর্শন করা জরুরি, এবং প্রয়োজনমতো সেগুলির সংস্কার। ১৯০৪ সালে, চার্লস রাসেল, প্রেসিডেন্সি কলেজের দর্শনের অধ্যাপক, সহকারী ডিপিআই হিসেবে শহরের ৩৩টি ছাত্রদের মেস ঘুরে একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। বলা বাহুল্য, সেই প্রতিবেদনে মেস-বাড়িগুলির ভয়াবহ চেহারা ফুটে উঠেছিল। তবে এতে হিতে বিপরীত হয়। বঙ্গভঙ্গ ঘোষণার প্রাক্কালে সরকার-বিরোধী যে আবহাওয়া ছিল, সেই পালেই হাওয়া লাগে। বাঙালি ছাত্রদের সরকার ইচ্ছে করেই বদনাম করছে বলে অভিযোগ করা হয়।
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………
এর পরবর্তী কয়েক দশকে এই ছাত্র-সমাজ বাংলার জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মুখ্য চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে, সরকার-বিরোধী নানা কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা নেবে। এঁদের আশ্রয় দিতে তাই কলকাতার বুকে মেস-বাড়িও থেকে যায়, হয়ে ওঠে বাঙালির সাংস্কৃতিক-সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিসর।
…কলিকথা–র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৮: কলকাতার রাস্তা নিয়ন্ত্রণ সহজ নয়, দেখিয়ে দিয়েছিল পালকি-বেহারাদের ধর্মঘট
পর্ব ২৭: কোনটা কলকাতা, কোনটা নয়!
পর্ব ২৬: দ্বীপের মতো করেই যেন গড়ে তোলা হয়েছিল কলকাতাকে
পর্ব ২৫: কালো ভিক্টোরিয়া ও থমথমে কলকাতা
পর্ব ২৪: ঘোড়ার কলকাতা: ট্রাম থেকে রেসের মাঠ
পর্ব ২৩: গোলদীঘি গণ আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে জেগে উঠেছিল স্বদেশি সময়ে
পর্ব ২২: স্মৃতিদের এক বিশাল সমাধিক্ষেত্র
পর্ব ২১: কলকাতার কেল্লা এবং ময়দানি মতবিরোধ
পর্ব ২০: সঙের গানে শতবর্ষের পুরনো কলকাতা
পর্ব ১৯: দেশভাগ ও উদ্বাস্তু মানুষদের শিয়ালদা স্টেশন
পর্ব ১৮: কলের গাড়ি ও কলকাতার নিত্যযাত্রীরা
পর্ব ১৭: বাবুদের শহর যেভাবে বদলে গেল আবেগের শহরে
পর্ব ১৬: ঘর-বন্দি হয়েও নাগরিক কলকাতার স্বাদ
পর্ব ১৫: গৃহভৃত্যর বেশিরভাগই ছিলেন পুরুষ, দু’দশকে বদলে যায় পরিস্থিতি
পর্ব ১৪: স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা সিনেমায় চাকরির ইন্টারভিউয়ের দৃশ্য সেই সময়ের আয়না
পর্ব ১৩: দাঙ্গা ও দেশভাগ বদলে দিয়েছে কলকাতার পাড়া-বেপাড়ার ধারণা
পর্ব ১২: প্রাচীন কলকাতার বোর্ডিং হাউস
পর্ব ১১: সারা বিশ্বে শ্রমিক পাঠানোর ডিপো ছিল এই কলকাতায়
পর্ব ১০: কলকাতার যানবাহনের ভোলবদল ও অবুঝ পথচারী
পর্ব ৯: বৃষ্টি নিয়ে জুয়া খেলা আইন করে বন্ধ করতে হয়েছিল উনিশ শতকের কলকাতায়
পর্ব ৮: ধর্মতলা নয়, ময়দানই ছিল নিউ মার্কেট গড়ে তোলার প্রথম পছন্দ
পর্ব ৭: সেকালের কলকাতায় বাঙালি বড়মানুষের ঠাঁটবাটের নিদর্শন ছিল নিজের নামে বাজার প্রতিষ্ঠা করা
পর্ব ৬: কলকাতার বহিরঙ্গ একুশ শতকের, কিন্তু উনিশ-বিশ শতকের অসহিষ্ণুতা আমরা কি এড়াতে পেরেছি?
পর্ব ৫: কলকাতা শহর পরিকল্পনাহীনভাবে বেড়ে উঠেছে, একথার কোনও বিশেষ ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই
পর্ব ৪: ঔপনিবেশিক নগর পরিকল্পনার বিরুদ্ধ মত প্রকাশ পেয়েছিল যখন প্লেগ ছড়াচ্ছিল কলকাতায়
পর্ব ৩: ঔপনিবেশিক কলকাতায় হোয়াইট টাউন-ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে কোনও অলঙ্ঘনীয় সীমানা
পর্ব ২: ‘জল’ যেভাবে ‘জমি’ হল এ কলকাতায়
পর্ব ১: চেনা কলকাতাকে না পাল্টেই বদল সম্ভব, পথ দেখাতে পারে একটি বাতিল রিপোর্ট