গাড়ির জানালার কাছে এসে অসম্ভব নাটকীয় ভঙ্গিতে সে যখন আবেদন পেশ করবে, তখন পকেটে হাত না ঢোকানোই হবে আশ্চর্যের। এখানে একটা মনস্তত্ত্বের খেলা আছে। ওই সময় ওই পথে যারা গাড়িতে করে যাচ্ছে তাদের আর্থিক ক্ষমতা সাধারণ পথচারীদের থেকে হয়তো বেশি। তারা কেউ ছুটছে কোর্টে, কেউ বা নতুন কাজের অর্ডার পেতে, কেউ বা পরীক্ষা দিতে, কেউ বা নিকটাত্মীয়ের অপারেশনের সময় উপস্থিত থাকতে, কেউ বা অফিসে ইনক্রিমেন্টের চিঠি পাওয়ার আশায়! অর্থাৎ, এইসব মানুষের মনের দুর্বলতার এক চমৎকার সুযোগ কাজে লাগানোই ওই খঞ্জ ভিক্ষুকের স্ট্রাটেজি।
১১.
স্থান: এসপ্লানেড, কলকাতা।
কাল: ৯টা থেকে বিকেল ৩টে।
পাত্র: এক হাতকাটা খঞ্জ ভিক্ষুক।
বিজ্ঞাপন, বিপণন বা কমিউনিকেশন বিজ্ঞানে ‘স্ট্রাটেজি’ বলে একটা বিষয় আছে। যে কোনও প্রোডাক্ট, সার্ভিস বা কনসেপ্ট বিক্রিতে যা খুব জরুরি। এই স্ট্রাটেজির প্রয়োগ কিন্তু আমাদের জীবনের সর্বত্র। ঘরে-বাইরে– সবসময়ই। আমাদের কাজকর্ম, চলনবলন সবই স্ট্রাটেজি নির্ভর। তাই যদি হয়, তাহলে ভিক্ষুকরাই বা কেন বাদ যাবে? ওদেরও ভিক্ষার স্থান-কাল-পাত্র ঠিক করতে হয় যাতে দু’-পয়সা বেশি আসে।
আজ বলতে চলেছি, আমারই দেখা এক খঞ্জ ভিক্ষুকের স্ট্রাটেজি জ্ঞান।
সকাল ৯টা থেকে ওই এসপ্লানেড– এস এন ব্যানার্জি রোড ক্রস করে দক্ষিণ থেকে উত্তরে অফিস পাড়া, কোর্ট কাছারি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক কাজে কত সহস্র গাড়ি যে ছুটছে, তার ইয়ত্তা করা অসম্ভব! আবার থামছেও। ট্রাফিক লাইটের লাল চোখ থেকে থেকে ওই বিশাল গাড়ির পালকে বেশ কয়েক মিনিটের জন্য থামিয়ে দিচ্ছে।
পড়ু্ন আরও ‘ব্যান্ড বাজাও’: সে যাত্রায় বন্দুকের নল থেকে রক্ষা করেছিলেন সুনীল গাভাসকর
এই গাড়ির পাল থমকে যাওয়ার মিনিটগুলো ওই ভিক্ষুকের কাছে সোনার খনি। এক হাতে ক্রাচে ভর দিয়ে, আর এক
আধকাটা হাতের অংশ কপালে ঠুকতে ঠুকতে তীব্র গতিতে এক পায়ে লাফাতে লাফাতে সে ওই সময়ের মধ্যে অন্তত ১০টা গাড়ি কভার করবে। ভিক্ষে চাওয়ার একটাই ক্যাপশন: ‘যে কাজে যাচ্ছো বাবা আমার/ মা আমার, তা শুভ হবেই। বাবা আমার রাজা হবে/ মা আমার রাজরানি হবেই। এ গরিবকে দশটা টাকা দাও গো।’
গাড়ির জানালার কাছে এসে অসম্ভব নাটকীয় ভঙ্গিতে সে যখন আবেদন পেশ করবে, তখন পকেটে হাত না ঢোকানোই হবে আশ্চর্যের। এখানে একটা মনস্তত্ত্বের খেলা আছে। ওই সময় ওই পথে যারা গাড়িতে করে যাচ্ছে তাদের আর্থিক ক্ষমতা সাধারণ পথচারীদের থেকে হয়তো বেশি। তারা কেউ ছুটছে কোর্টে, কেউ বা নতুন কাজের অর্ডার পেতে, কেউ বা পরীক্ষা দিতে, কেউ বা নিকটাত্মীয়ের অপারেশনের সময় উপস্থিত থাকতে, কেউ বা অফিসে ইনক্রিমেন্টের চিঠি পাওয়ার আশায়!
পড়ু্ন আরও ‘ব্যান্ড বাজাও’: মহাকাশচারীদের জন্য বানানো টুথপেস্টে এখন শিশু ও পোষ্যদের দাঁত মাজানো হয়
অর্থাৎ, এইসব মানুষের মনের দুর্বলতার এক চমৎকার সুযোগ কাজে লাগানোই ওই খঞ্জ ভিক্ষুকের স্ট্রাটেজি। এবং এটাও সত্যি যে ওই মুহূর্তে এক দুর্বল মনের কাছে এই খঞ্জ ভিক্ষুকের ঠিকঠাক শব্দ ব্যবহার করে কাতর আবেদন কঠিন হৃদয়কেও গলিয়ে দেবে। তখন আর ১০/ ২০/৫০-এর হিসেব থাকবে না। হাতে যা ওঠে, তাই হয়ে যাবে হাতবদল।
এবার ভাবুন ওই ৫/৬ ঘণ্টার ব্যস্ত সময়ে কত গাড়ি ছুটছে আর থামছে। ধরুন, কম করে পাঁচ হাজার গাড়ি থামছে। ওই দৃশ্যত ৬০ ছোঁয়া গতিশীল খঞ্জ ভিক্ষুক ওই ৫/৬ ঘণ্টায় কমপক্ষে ১০০ গাড়ির জানালায় পৌঁছে যাবে। অ্যাভারেজে যদি প্রতিটা গাড়ি থেকে ১০ টাকা করেও পায় তাহলে ওই ক’ঘণ্টায় কম করেও তাঁর আয় ১০০০ টাকা। মাসে ৩০০০০ টাকা! ভাবা যায়!
গল্পের শেষে ওই ভিক্ষুকের সঙ্গে আমার কথোপকথনের কথা একটু বলি। তখন আমার অফিস ছিল মিশন রো-তে। রোজ ওই পথেই আমার গন্তব্যস্থল। লক্ষ করতাম ওই ভিক্ষুকের গতিবিধি।
বিজ্ঞাপন জগতের লোক বলে আমাকে ওর ভিক্ষে করার টেকনিক আর মুভমেন্ট খুব আকর্ষণ করত। মাঝেমধ্যে ও আমার গাড়ির জানালায় চলে আসত। আমি গম্ভীর মুখে অ্যাভয়েড করতাম। একদিন এক বিশাল মিছিল ওই রাস্তা দিয়ে ক্রস করার জন্য একটা জ্যামে অনেকক্ষণ গাড়ি দাঁড়িয়ে রইল। সেই সুযোগে ওই খঞ্জ ভিক্ষুক আমার গাড়ির জানালায় এসে বলল, ‘বাবা গো, আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? তুমি কি ডাক্তার?’
পড়ু্ন আরও ‘ব্যান্ড বাজাও’: ‘ওরে ব্লোরীন লাগা’
আমার সাদা চুল, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা আর নকল গাম্ভীর্য দেখে অনেকেই আমাকে ডাক্তার ভাবেন। ওর আর দোষ কী!
‘কেন?’ প্রশ্ন করতে ও চোখের সমস্যার কথা জানাল, ওষুধও চাইল। আমি না হলেও, আমার বাড়িতে ডাক্তার রয়েছে। অনেক স্যাম্পল ওষুধ আসে। ডাক্তারের পরামর্শমতো একটা আইড্রপ পরের দিন ওকে দিলাম। এরপর থেকে ও আমার বন্ধু হয়ে গেল, আমি ডাক্তার।
মাঝে মাঝেই ওর ভিক্ষুক জীবনের অনেক গোপন তথ্য আমাকে গল্প করত অবশ্যই আমার ডাক্তারির বিনিময়ে। সেসব গল্প অবাক করার মতো। এই শহরের ভিক্ষুক কন্ট্রোলিং সিন্ডিকেটের সারা দিনের আয় শুনলে চোখ কপালে উঠবে!
হঠাৎ একদিন দেখা হতেই জানাল, ও ছুটিতে দেশে যাচ্ছে। ওর মতোই আর একজন ওর জায়গায় কাজ চালিয়ে যাবে। যাতে জায়গাটা ফাঁকা না থাকে। আমাকে একটু নজর রাখার অনুরোধ করে ভিক্ষুক বন্ধু চলে গেল।
আমি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম!