বড়দা শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে প্রথম যখন যোগাযোগ করেন তখন তিনি পুনাতেই থাকেন। পুনাতে তাঁর বাসভবনের নাম ছিল ‘মিথিলা’। দাদা শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে চিঠিতেই যোগাযোগ করেছিলেন। তবে আমাদের নতুন প্রকাশনা জেনেও তিনি বই দিতে পিছপা হননি। তখনকার লেখকেরা যেমন পেশাদার ছিলেন, তেমনই নিজেদের লেখা বই নিয়ে আত্মবিশ্বাসীও ছিলেন এবং তা হওয়ার কারণও ছিল। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকেরা বই দেওয়ার আগেই সমস্ত চুক্তি ও আর্থিক বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তবেই বই দিতেন। আমাদের সঙ্গেও তা-ই হয়েছিল। আমরা তাঁর প্রথম যে বইটা করলাম সেটা আগে ছিল একটি চিত্রনাট্য।
১৮.
দীর্ঘদিন ‘দে বুক স্টোর’-এর দায়িত্ব সামলানোয় আমার দুই দাদাও বইয়ের জগতের নাড়ি-নক্ষত্রের খবর রাখতেন। বাবার মতোই বড়দা এবং মেজদা– দু’-জনেই নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রথম দিকে আমাকে পরামর্শ দিতেন আমাদের কী ধরনের বই ছাপা উচিত। কাউন্টারে দীর্ঘদিন বসার সুবাদে দুই দাদারই পরিচিতি ছিল বিশাল। বাবার কথা বাদ দিলে বই-ব্যবসায় দাদারাই আমার পথপ্রদর্শক। প্রথম যে-চারটি বই নিয়ে দে’জ পাবলিশিং-এর পথচলা শুরু, তা হঠাৎ কোনও তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে হয়নি। বাবা এবং আমরা তিন ভাই তার আগে দীর্ঘ আলোচনা করেছি কীভাবে কোন বই করলে পাঠকের কাছে পৌঁছনো যাবে। যে-কোনও প্রকাশনার শুরুতে এমন বই বাছাই করা প্রয়োজন যাতে অভিনবত্ব থাকবে, আবার সেই সঙ্গে জনপ্রিয় লেখকের ভালো বইও থাকা দরকার। এই ভারসাম্যটাই প্রকাশনাকে পরিচিতি এনে দেয়। যে-চারটি বই নিয়ে দে’জ পাবলিশিং-এর আত্মপ্রকাশ– তাঁর মধ্যে বেদুইনের ‘মহানায়ক লেনিন’, আশাপূর্ণা দেবীর ‘মনের মুখ’, প্রতিভা বসুর ‘সমুদ্র হৃদয়’ ছাড়া চতুর্থ বইটি ছিল শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কুমারসম্ভবের কবি’।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় তখন বাংলা সাহিত্যের জীবিত লেখকদের মধ্যে যেমন বয়োজ্যেষ্ঠ, তেমনই তুমুল জনপ্রিয়। আমার বিশ্বাস তাঁর সেই জনপ্রিয়তায় আজও ভাটা পড়েনি। বিশেষ করে, সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর কাহিনি এবং অতুলনীয় সব ঐতিহাসিক গল্প-উপন্যাসের পাঠক এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে বেড়েই চলেছে। আমরা যখন প্রকাশনার কথা ভাবছি তখন বড়দা একদিন শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে যোগাযোগের একটা সূত্র বের করলেন।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে কলকাতা তথা বাংলার বাইরে। যদিও তাঁদের আদি বাড়ি ছিল বরানগরে, কিন্তু শরদিন্দুর জন্ম-কর্মের বেশিরভাগটাই বাংলার বাইরে। তাঁর বাবা তারাভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বিহারের মুঙ্গেরে একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী। সেসময় বিহারের পূর্ণিয়া, মুঙ্গের এবং ভাগলপুরে প্রচুর বাঙালি বাস করতেন এবং তাঁদের একটা বড় অংশ আইন ব্যবসায় পারঙ্গম ছিলেন। পূর্ণিয়ায় যেমন ছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ীর বাবা ইন্দুভূষণ ভাদুড়ী। মুঙ্গেরেই শরদিন্দুর স্কুলজীবন কাটে, কিন্তু কলেজে পড়ার সময় তিনি কলকাতায় এসে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। বিদ্যাসাগর কলেজের ক্লাসে তিনি অধ্যাপক হিসেবে পেয়েছিলেন নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীকে। শিশিরকুমারের সংস্পর্শে আসার জন্যই শরদিন্দুর নাটকের প্রতি আকর্ষণ কি না বলতে পারব না, তবে পরবর্তীকালে শরদিন্দুও বেশ কিছু নাটক ও চিত্রনাট্য লিখেছেন। বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর তিনি আবার বিহারে চলে যান। সেখানে গিয়ে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন পাশ করে বাবার দেখানো পথে আইন ব্যবসায় প্রবেশ করেন। কিন্তু খুব বেশিদিন তিনি আইনজীবী হয়ে কাটাননি। বেশ অল্প বয়সেই পুরো সময়ের জন্য সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। এরই মধ্যে হিমাংশু রায় এবং দেবিকা রানী প্রতিষ্ঠিত ‘বম্বে টকিজ’-এ চিত্রনাট্য লেখার কাজ পেয়ে তিনি মুম্বই চলে যান। ১৯৪০ সালে হিমাংশু রায়ের মৃত্যুর পর ‘বম্বে টকিজ’ ছেড়ে আচারিয়া আর্ট প্রোডাকশনেও কিছু দিন কাজ করেন। তারপর থেকে তিনি একেবারেই স্বাধীনভাবে লেখালিখি করে গেছেন। গত শতাব্দীর তিনের দশক থেকেই তাঁর বিখ্যাত লেখাগুলো প্রকাশিত হতে শুরু করে। সিনেমার কাজের সঙ্গে-সঙ্গে সাহিত্য রচনায় কখনও ছেদ পড়েনি। তবে এক সময় সিনেমার সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করলেও শরদিন্দু কিন্তু বাংলায় ফিরে আসেননি। তিনি মহারাষ্ট্রের পুনা শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।
বড়দা শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে প্রথম যখন যোগাযোগ করেন তখন তিনি পুনাতেই থাকেন। পুনাতে তাঁর বাসভবনের নাম ছিল ‘মিথিলা’। দাদা শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে চিঠিতেই যোগাযোগ করেছিলেন। তবে আমাদের নতুন প্রকাশনা জেনেও তিনি বই দিতে পিছপা হননি। তখনকার লেখকেরা যেমন পেশাদার ছিলেন, তেমনই নিজেদের লেখা বই নিয়ে আত্মবিশ্বাসীও ছিলেন এবং তা হওয়ার কারণও ছিল। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো লেখকেরা বই দেওয়ার আগেই সমস্ত চুক্তি ও আর্থিক বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তবেই বই দিতেন। আমাদের সঙ্গেও তা-ই হয়েছিল। আমরা তাঁর প্রথম যে বইটা করলাম সেটা আগে ছিল একটি চিত্রনাট্য। গ্রন্থকার আমাদের বইয়ের শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন– ‘এই কাহিনী পূর্বে “কালিদাস” নামে চিত্রনাট্যের আকারে প্রচলিত ছিল, এখন ইহা “কুমারসম্ভবের কবি” নামে উপন্যাসের আঙ্গিকে পুনর্লিখিত হয়ে প্রচারিত হইল। “কালিদাস” আর ছাপা হইবে না।’ ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে আমরা বইটা ছাপি, মলাট করে দিয়েছিলেন অজিত গুপ্ত। প্রথম বইটা প্রকাশের আগে নিজের প্যাডে তারিখবিহীন একটি চিঠিতে শরদিন্দু বড়দাকে লিখেছেন–
‘সবিনয় নিবেদন,
আপনার ২৭ মে’র চিঠি পেলাম। নিম্নোক্ত শর্তে উক্ত বইখানির ১১০০ কপি ছাপার অনুমতি দিতে পারি– ১। ছয় শত (৬০০ ) টাকা রয়াল্টি অগ্রিম দিতে হবে।
২। দুই বছরের মধ্যে সংস্করণ শেষ না হলে আমি অন্যত্র বই ছাপতে পারব।
৩। ১০ কপি বই আমাকে উপহারের জন্য দিতে হবে।
আপনি সম্মতি ও টাকা পাঠালে পাকা চুক্তিপত্র তৈরি হবে।
বিনীত
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়’
সেই আমলে ‘কুমারসম্ভবের কবি’র মতো স্বল্পায়তন বইয়ের জন্য ৬০০ টাকা কিন্তু খুব কম অঙ্কের টাকা নয়। তবে একেবারে আনকোরা প্রকাশকের ঘরে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই থাকাটাও সম্মানের ব্যাপার ছিল। চিঠিটির নীচে দেখছি লেখা আছে জুলাই মাসের ৯ তারিখে শরদিন্দুবাবুর প্রস্তাব মতো তাঁকে ইউকো ব্যাঙ্কের কর্নওয়ালিস স্ট্রিট ব্রাঞ্চের একটি চেকে পুরো টাকাটাই পাঠানো হয়েছে।
প্রথম বইটি প্রকাশের পরও বড়দার সঙ্গে তাঁর চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। আমি কখনও তাঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করিনি। সবটাই হয়েছে বড়দার মারফত। ২৬ জুলাই একটি চিঠিতে তিনি লিখেছেন আমাদের পাঠানো চুক্তিপত্র তিনি পেয়েছেন, সেই সঙ্গে জানান, ‘উল্টোরথের উপন্যাসটা সম্বন্ধে এখন কিছু বলতে পারছি না।’ আমার যতদূর মনে পড়ছে সেসময় ‘উল্টোরথ’ পত্রিকায় বেরুনো শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অভিজাতক’ উপন্যাসটা আমরা বই করতে চাইছিলাম। বাড়িতে এ নিয়ে আলোচনাও চলছিল। শরদিন্দুবাবু শুরুতেই আমাদের কিছু না জানালেও ৩০ অগাস্ট মুম্বইয়ের আন্ধেরির লক্ষ্মী এস্টেট থেকে একটি ইনল্যান্ড লেটারে বড়দাকে লিখলেন–
‘আপনার ২৪/৮ তারিখের চিঠি পেলাম। আমার অসুখ গুরুতরই হয়েছিল, এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নয়, তাই চিঠি dictate করছি।
নতুন ‘কুমারসম্ভবের কবি’ এখনও আসেনি। উল্টোরথে প্রকাশিত “অভিজাতক” আপনাকে ২২০০ কপি ছাপার অনুমতি দিতে পারি। অনুপাতে এর জন্যে আমাকে ১২০০ টাকা অগ্রিম পাঠাতে হবে। বম্বের কোনো ব্যাংকের ওপর draft পাঠালে আমি এই খানেই টাকাটা নিজের ব্যাঙ্কে জমা করব।
প্রসাদের রচনাটা পরিপূর্ণ উপন্যাস নয়। ৩০/৪০ পাতার গল্প। তাই ওটা
এখন কাউকে দিতে চাইনা। ওটা সম্বন্ধে পরে ব্যবস্থা করব।…’
এই চিঠিতেও দেখছি কিছুদিনের মধ্যেই শরদিন্দুবাবুকে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার কলেজ স্ট্রিট শাখা থেকে ডিমান্ড ড্রাফটের মাধ্যমে ১২০০ টাকা পাঠানো হয়েছে। এই চিঠিতে একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, বড়দা তখন শরদিন্দুবাবুর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে ছিলেন। কারণ ‘প্রসাদ’ পত্রিকার যে-লেখাটির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন সেটি তখনও প্রকাশিতব্য ছিল। সে বছর ‘প্রসাদ’-এর পুজোসংখ্যায় গল্পটি প্রকাশিত হয়। সম্ভবত পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পটির নাম ছিল ‘শৈল-ভবন’। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ১৬ সেপ্টেম্বর একটি চিঠিতে লিখেছেন,
‘শ্রী হিমাংশু শেখর দে সমীপেষু
বিনীত নিবেদন, আপনার ৯/৯ তারিখের চিঠি ও ১২০০ টাকার draft পাইয়াছি। টাকার রসিদ অত্রসহ দিলাম। আপনি লিখিয়াছেন যে “অভিজাতক” ৬/৭ ফর্মার মতো হইবে। পুস্তক আকারে ছোট হইবে। আমাকে বড় করিয়া দিতে লিখিয়াছেন। আমার বর্তমান স্বাস্থ্য বিধায় কোনো রূপ সাহিত্য কর্ম করা আমার পক্ষে অসম্ভব। আপনি অভিজাতক প্রকাশিত হইবার পর বই এর আকার দেখিয়া বই লিতে চাহিয়াছিলেন, এখন আর হ্রস্ব-দীর্ঘ লিয়া আলোচনা নিষ্ফল হই। আমি ২০% হিসেবে রয়ালটি লইয়া থাকি। আপনি যখন “কুমারসম্ভবের কবি” ক্রয় করেন তখন উক্ত বইয়ের দাম ছিল ৩ টাকা। আমি সেই বিবেচনাতেই আপনার নিকট হইতে একহাজার কপির জন্য ৬০০ টাকা দাবী করিয়াছিলাম।… কিন্তু “অভিজাতক” নূতন বই, উহার জন্য ২০% রয়ালটি লইব। তবে বই ছোট হইলে অসুবিধা হইবে। এইজন্য একটি নূতন প্রস্তাব করিতেছি। পূজা সংখ্যা “প্রসাদে” আমার একটি ৩০/৪০ পাতার বড় গল্প বাহির হইবে। আমি সেটিকে ৪০০ টাকায় আপনাকে দিতে পারি। ও দুটি গল্প একসঙ্গে লইলে ৪ টাকা দাম রাখা চলিবে। যদি এই প্রস্তাব আপনার মনোমত হয়। টাকা (৪০০ ) পাঠাইয়া দিবেন, তারপর আমি অনুমতি পত্র দিব। এই পত্রকে “অভিজাতকের” অনুমতিপত্র বলইয়া মনে করিতে পারেন। পরে আপনি সম্মত থাকিলে দুটি গল্পের অনুমতি পত্র একসঙ্গে দিব।
আমার শরীর অতি ধীরে ধীরে সারার মুখে চলিয়াছে। এখনও নিজের হাতে লিখিতে পারি না, কেবল কোনো মতে দস্খৎ করিলাম।…’
দে’জ পাবলিশিং-এর জন্য বড়দাকে লেখা শরদিন্দুবাবুর এটিই শেষ চিঠি। চিঠিতে তিনি ‘প্রসাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিতব্য যে গল্পটির কথা বলেছেন, সেটি আগের চিঠিতেই কোনও প্রকাশককে সেসময় দিতে চাননি। কিন্তু এবার সরাসরি সেটি আমাদের দিতে চাইলেন। আমরা অবশ্য আগে থেকেই গল্পটা চাইছিলাম। কেননা ‘অভিজাতক’ কম্পোজ করার পর আমরা বুঝতে পারছিলাম বইটা মেরেকেটে চার-সাড়ে চার ফর্মা দাঁড়াবে। এত ছোট উপন্যাস বিক্রি করা বেশ মুশকিল। তাই আমাদের ইচ্ছে ছিল যদি ‘প্রসাদ’-এর গল্পটা এর সঙ্গে দেওয়া যায় তাহলে বইটার আয়তন খানিক বাড়বে। শেষ চিঠিতে সেরে ওঠার কথা বললেও চিঠিটি লেখার ঠিক ছ’-দিনের মাথায়, ১৯৭০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তিনি আকস্মিকভাবে প্রয়াত হন। এর পর থেকে বড়দার সঙ্গে শরদিন্দুবাবুর স্ত্রী পারুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। আমরা শরদিন্দুর দ্বিতীয় বই ‘শৈল-ভবন’ প্রকাশ করি লেখকের মৃত্যুর পর, ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে। এই বইটির মলাটও আঁকেন অজিত গুপ্ত। বইটি ছেপেছিলাম বিডন রো-তে মোহনচন্দ্র পালের লক্ষ্মীনারায়ণ প্রিন্টার্স থেকে। তবে এতদিন পরে এই লেখার সময় বইটা উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না কোথায় ‘অভিজাতক’ শেষ হয়ে ‘শৈল-ভবন’ গল্পটা শুরু হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ পাতা ওলটানোর পর বুঝলাম ছাপাখানার ভূত এই বইয়ের প্রথম সংস্করণে ভর করেছিল ! দ্বিতীয় গল্পটির শুরুতে শিরোনামটিই বসেনি।
দাদাদের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ল, বড়দার মতো মেজদার মাধ্যমেও একজন লেখক আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন– তিনি চিত্রা দেব। সেটা অবশ্য আরও কিছুদিন পরে। চিত্রা দেব আমাদের দোকান থেকে নিয়মিত বই কিনতেন। কখনও খবর পাঠিয়ে বা চিঠি লিখেও বই কিনতেন আমাদের দোকান থেকে। আমার মেজদার সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল।
চিত্রা দেবেরও ছোটবেলা কাটে বিহারে। তাঁর জন্ম ১৯৪৩ সালের ২৪ নভেম্বর, পূর্ণিয়ায়। স্কুলের পড়াশোনা বিহারেই, উচ্চশিক্ষা কলকাতায়। তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ, পিএইচডি ছিলেন। চিত্রাদি একক বা যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন– ‘কবিচন্দ্রের মহাভারত’, ‘বিষ্ণুপুরী রামায়ণ’, ‘কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল’, ‘ময়ূরভট্টের ধর্মমঙ্গল’ ইত্যাদি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সব বই। কর্মজীবনে তিনি ‘আনন্দবাজার’ সংস্থার গ্রন্থাগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ এবং ‘ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল’ বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিকের সম্মান পেয়েছে।
সেসময় মাঝে মাঝেই ‘আনন্দবাজার’-এর দপ্তরে যেতাম। তখন চিত্রাদির সঙ্গে পরিচয় হওয়ায় আমি তাঁর একটি বই করতে চেয়েছিলাম। তখনকার পত্রপত্রিকায় তাঁর দুর্দান্ত সব গদ্য পড়ে আমার মনে হয়েছিল তাঁর একটা বই করতে পারলে পাঠককে ভালো বই উপহার দেওয়া যাবে। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮ সালে টালিগঞ্জের রানীকুঠির কাছে রিজেন্ট এস্টেটের আবাসন থেকে মেজদাকে একটি চিঠিতে চিত্রাদি লেখেন–
‘মাননীয় পরেশবাবু,
কিছুদিন আগে আপনাদের একটি বই (‘ব্রহ্মলোকে’– শঙ্কু মহারাজ লিখিত) কিনি। নানা কারণে বইটি পড়া হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি পড়তে গিয়ে পাতা ও ফর্মার গোলমালে (পৃ. ১৮৪, পৃ. ২০১ দ্র.) পড়া গেল না। বইটি পাঠলাম। যদি বদল করে ভাল বই দেন তাহলে উপকৃত হব। বইয়ে কোনো দাগ দিইনি। এখন আমি তিনটি বই কিনতে চাই। বইগুলির নাম– ১) স্মৃতির সংলাপ– মণীন্দ্র রায় (– এ. মুখার্জি) ২) এই পুলিশ জীবন– উপানন্দ মুখোপাধ্যায় (– বিভা) ৩) পূর্বজন্মের রাস্তা ধরে– সমীর দাশগুপ্ত (– এম. সি. সরকার) আপনি এবং সুধাংশুবাবু ইতিপূর্বে আমাকে বলেছিলেন আপনাদের ১টা বই দেবার জন্য। নানা কারণে এতদিন তা হয়ে ওঠেনি। সম্প্রতি ভারতীয় নারীর সাজসজ্জার বিবর্তন ও ভারত ভাস্কর্যে নারীজীবন বিষয়ে একটি বইয়ের পরিকল্পনা করেছি। ‘সুকন্যা’ ও ‘দেশ’ পত্রিকায় রচনাগুলি ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ে তার আয়তনবৃদ্ধি ঘটবে। ফর্মা দশ/এগারোর হবে। কিছু আলোকচিত্র থাকা প্রয়োজন।
যদি এই বইটিতে আগ্রহী হন তাহলে ভেবেচিন্তে সুধাংশুবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে আমাকে যথাশীঘ্র সম্ভব জানাবেন। তাহলে আমার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হয়।
নমস্কারান্তে–
চিত্রা দেব’
চিত্রাদির চিঠি পেয়ে উত্তরটা আমিই লিখি, ‘আপনার চিঠি যথাসময়েই পেয়েছি। যে লেখাগুলির কথা উল্লেখ করেছেন তার কপি এ পাড়ায় কোনোদিন এলে সঙ্গে করে নিয়ে আসলে ভালো হয়। অথবা জানালে আনন্দবাজার দপ্তর থেকেও খবর পাঠালে কাউকে পাঠিয়ে সংগ্রহ করে নেব। অথবা, আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসব।’
এই বইটি দে’জ থেকে প্রকাশিত হয় পরের বছর জুলাই মাসে। দু’টি ছবি ব্যবহার করে ক্রাউন সাইজের বই ‘আবরণে আভরণে ভারতীয় নারী’র মলাট তৈরি করেছিলেন বিপুল গুহ। সামনের মলাটে ছিল: প্রমদাসুন্দরী– জনপ্রিয় পটচিত্রের নায়িকা, আর পিছনের মলাটে: অভিজাত হিন্দু নারীর সাজ– উত্তর ভারত’।
বইটির পরিচিতিতে লেখা হয়েছিল, ‘নারীর রূপরচনার ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে, ভারতীয় নারীর সাজে যত বৈচিত্র্য আছে পৃথিবীর অপর কোন দেশের নারীর পোশাকে তা নেই। প্রাচীনকাল থেকে এদেশের নারী আপন রূপরচনার ক্ষেত্রে এমন অসামান্য নজির স্থাপন করেছিলেন যার সঙ্গে প্যারিসের প্রখ্যাত ডিজাইনার ডিয়রের কোন মতপার্থক্য নেই। এ এক আশ্চর্য ঘটনা। ভারতের সব নারীই কমবেশি সৌন্দর্য সচেতন। তাঁদের সৌন্দর্যপ্রিয়তাই গৃহকে করে তুলেছে মন্দির, গৃহস্থালির প্রতিটি প্রয়োজনীয় সামগ্রীকে করেছে দৃষ্টিনন্দন। আবরণে-আভরণে নিজেকে সুন্দর করে তোলাও তারই অঙ্গ।
দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন অনেকসময় নারীদের জীবনে নিয়ে এসেছে সঙ্কট ও অনিশ্চয়তা। তার প্রভাব পড়েছে তাঁদের পোশাক ও প্রসাধনে, অলঙ্কার ও অবগুণ্ঠনে।’
ভারতীয় নারীর সাজসজ্জার বিবর্তনের ইতিহাসই ছিল বইটির বিষয়, লেখকের ইচ্ছানুযায়ী আট পাতা জুড়ে বিভিন্ন সময়ের সুসজ্জিতা নারীর অনেকগুলি সাদা-কালো ছবিও দেওয়া হয়েছিল। বইটি ছেপেছিলাম ২ গণেন্দ্র মিত্র লেনে শিবনাথ পালের প্রিণ্টেক থেকে।
এরপর ১৯৯৬ সালের বইমেলার সময় প্রকাশ করেছিলাম চিত্রাদির কিশোর উপন্যাস ‘রূপমতীর মালা’, বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন দেবাশিস রায়। আর ২০০২-এর বইমেলায় প্রকাশিত হয় ‘রাজকীয় প্রেমকথা’। অমিতাভ চন্দ্রের প্রচ্ছদে নির্মিত বইটি সম্পর্কে চিত্রাদি নিজেই লিখেছেন, ‘ইতিহাসের সাল তারিখ কণ্টকিত ঘটনার মধ্যে প্রেমের স্থান একেবারেই নেই অথচ ইতিহাসের কয়েকটি চরিত্র তাঁদের প্রণয় কাহিনীর জন্য কিংবদন্তির নায়ক বা নায়িকা হয়ে উঠেছেন। কেউ অতি পরিচিত আবার কেউ স্থানীয় পরিবেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অধিকাংশক্ষেত্রে তথ্যের অভাবে ইতিহাসকে থমকে দাঁড়াতে হয়েছে, গল্প থেমে থাকেনি। ইতিহাসের পাতা থেকে রাজ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত সতেরোটি কাহিনী প্রথম পর্যায়ে শোনাচ্ছি। সময় দিয়ে প্রেমকথাকে ধরা যায় না বলে কয়েকটি অতি পরিচিতের সঙ্গে কয়েকটি প্রায় অপরিচিত গল্প এই খণ্ডে পরিবেশন করা হল’। তাঁর ইচ্ছে ছিল এই সিরিজে আরও বই করার কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। জীবনের শেষ কয়েক বছর তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২০১৭-য় তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান।
চিত্রাদির কথা বলতে গিয়ে একটা ব্যক্তিগত কথা না বললেই নয়। আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ১ বৈশাখ ১৩৯৩ সালে প্রকাশিত চিত্রাদির ‘বিবাহবাসরের কাব্যকথা’ বইয়ের নাম-প্রবন্ধে তিনি বুদ্ধদেব বসুর লেখা একটি বিয়ের কবিতার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন কবিতাটি ‘এক প্রকাশকের বিয়েতে লেখা’। এতদিন পরে আজ জানিয়েই দিই, সেই প্রকাশক আসলে আমি। ১৯৭৩ সালের ২৭ মে আমার আর রীতাঞ্জলির বিয়ে উপলক্ষে আত্মীয়-বন্ধুদের দেওয়ার জন্য ‘শুভাশীর্বাদ’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিলাম। তাতে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন,
‘দেবতা শুধু নিষ্ঠুর নন
দেবতা শুধু বজ্রের নন
দেবতা কেবল মৃত্যুর নন:
দেবতা উৎসবের
দেবতা বসন্তের
দেবতা চুম্বনের।
বজ্রের যিনি দেবতা তাঁকে প্রণাম করি
তিনি ভয়ঙ্কর।
চুম্বনের যিনি দেবতা তাঁকে ভালবাসি
তিনি অপরূপ।
দেবতা শুধু মৃত্যুর নন, দেবতা উৎসবের
দেবতা শুধু বজ্রের নন, দেবতা চুম্বনের।’
আমাদের বিয়ের পুস্তিকায় আমার বাবা-মা ছাড়াও লিখেছিলেন অলোক রায়, আশাপূর্ণা দেবী, আশুতোষ ভট্টাচার্য, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, কল্হন, গৌরকিশোর ঘোষ, জ্যোতির্ময় বসুরায়, তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী, দীপ্তি ত্রিপাঠী, নিমাই ভট্টাচার্য, পূর্ণেন্দু পত্রী, প্রতিভা বসু, প্রফুল্ল রায়, প্রবোধবন্ধু অধিকারী, ফণিভূষণ আচার্য, রবি বসু, রমাপদ চৌধুরী, শংকর, বিমল মিত্র, বুদ্ধদেব গুহ, বুদ্ধদেব বসু, বিমল কর, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কু মহারাজ, শঙ্খ ঘোষ, শান্তনু দাস, সনৎকুমার মিত্র, সন্তোষকুমার ঘোষ, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় এবং হরিপদ পাত্র। ‘শুভাশীর্বাদ’ পুস্তিকাটির অলংকরণ করেছিলেন গৌতম রায়। মডার্ন প্রসেস থেকে ব্লক বানিয়ে ইম্প্রেসন হাউসে পুস্তিকাটি ছেপেছিলাম।
আজও সেই ‘শুভাশীর্বাদ’ আমাদের জীবনের সত্যিকারের আশীর্বাদ বলেই আমরা মনে করি। মজাদার সব ছড়া লিখেছিলেন বিভিন্ন লেখক। রমাপদ চৌধুরী লিখেছিলেন–
‘ফালতু যত বই ছাপিয়ে
ভাবতে তাদের গীতাঞ্জলি
তবুও পেলে নোবেল প্রাইজ
নাম নাকি তার রীতাঞ্জলি’।
বুদ্ধদেব গুহ লেখেন, ‘এতদিন শুধু প্রকাশক ছিলে; এখন প্রকাশিত হলে। অনেক সংস্করণের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি’। সন্তোষকুমার ঘোষ লেখেন,
‘কবে যেন কবে, কবে, কবে ?
জ্যৈষ্ঠ মাস, তবু, তবু, তবু
সুধাংশু আর একটু স্নিগ্ধ হবে!…’
তবে যে-ছড়াটা আমাদের বাড়ির সবার মুখে মুখে ঘোরে, সেটি লিখেছিলেন আমার অত্যন্ত কাছের মানুষ প্রবোধবন্ধু অধিকারী। প্রবোধদা লেখেন,
‘ইন্দিরা নিকসন
মুজিব কি চৌ
তার চেয়ে ভালো নাকি
যার যার বৌ ?’
লিখন শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়
……………………ইতি কলেজ স্ট্রিট-এর অন্যান্য পর্ব……………………
পর্ব ১৭: পূর্ণেন্দু পত্রীর বাদ পড়া প্রচ্ছদ ও দিনেশ দাসের কবিতার শ্রেষ্ঠ দিনগুলি
পর্ব ১৬: সব প্রকাশনার যাবতীয় বইয়ের হদিশ পাওয়া যেত ‘সম্মিলিত গ্রন্থপঞ্জী’তে
পর্ব ১৫: নিছকই একটা পত্রিকা নয়, ‘কলেজ স্ট্রীট’ আমাদের আবেগ
পর্ব ১৪: খুদে পাঠকদের জন্য মিনিবই তৈরির কথা প্রথম ভেবেছিলেন অভয়দা
পর্ব ১৩: কয়েকটি প্রেসের গল্প
পর্ব ১২: দীর্ঘায়ু বই ও আইয়ুব পরিবার
পর্ব ১১: প্রেমের নয়, অপ্রেমের গল্প সংকলনের সম্পাদনা করেছিলেন সুনীল জানা
পর্ব ১০: ছোট্ট অপুকে দেখেই রঙিন ছবিতে ভরা টানটান গল্পের বই করার ইচ্ছে জেগেছিল
পর্ব ৯: চানঘরে গান-এ সত্যজিৎ রায়ের চিঠি থাকায় ব্যাপারটা গড়িয়েছিল কোর্ট কেস পর্যন্ত
পর্ব ৮: প্রকাশক-লেখকের কেজো সম্পর্কে বুদ্ধদেব গুহর বিশ্বাস ছিল না
পর্ব ৭: পুজো সংখ্যায় না-বেরনো উপন্যাস বই আকারে সুপারহিট
পর্ব ৬: মানবদার বিপুল অনুবাদের কাজ দেখেই শিশির দাশ তাঁর নাম দিয়েছিলেন– ‘অনুবাদেন্দ্র’
পর্ব ৫: সাতবার প্রুফ দেখার পর বুদ্ধদেব বসু রাজি হয়েছিলেন বই ছাপানোয়!
পর্ব ৪: লেখকদের বেঁচে থাকার জন্য অনেক কিছুই লিখতে হয়, প্রফুল্ল রায়কে বলেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র
পর্ব ৩: পয়লা বৈশাখের খাতায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মজাচ্ছলে লিখেছিলেন, ‘সুধাংশুরা রাজা হোক’
পর্ব ২: বাংলা মাসের সাত তারিখকে বলা হত ‘গ্রন্থতিথি’, বিজ্ঞাপনেও বিখ্যাত ছিল ‘৭-ই’
পর্ব ১: সত্তরের উথাল-পাথাল রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমি প্রকাশনার স্বপ্ন দেখছিলাম