তখন সতেরো। অবচেতনে নিজের পাড়া, অন্য পাড়ার বিভিন্ন মেয়ের প্রেমে পড়ছি। দিনে থান-ইট হাতে বাইসেপ ফোলাচ্ছি। আর রাতে বা দুপুরে, মধ্যবিত্ত ঘেরাটোপে, একটু আড়াল পেলেই শরীর জাগছে। অথচ ধূমকেতুর মতো প্রেমপত্র এসে হাজির হল এক পুরুষ বন্ধুর কাছ থেকে। এই প্রথম নিজেকেই সন্দেহ হল, নিজের শরীরকে।
২৪.
প্রাপ্তবয়স্ক ‘পুরুষ’ মানেই যে রবীন্দ্রনাথের মতো দাড়ি গজাবে বা আশু মুখুজ্জের মতো তাগড়াই গোঁফ হবে, তা তো নয়। তারা মাকুন্দ হতেই পারে। এবং ‘মাকুন্দ’ মানেই যে ‘এফেমিনেট’, তার কোনও মানে নেই। অন্যদিকে গোঁফ-দাড়ি থাকলেও যে সবার গলায় কমল মিত্র বা ছবি বিশ্বাস ভর করবেন, সেই জেনেটিক সুবিধা পেয়ে অধিকাংশ পুরুষভূমিষ্ঠ হন না। অথচ চাঁচাছোলা মুখশ্রীর পুরুষ দেখলেই এককালে বন্ধুরা মিলে হ্যা-হ্যা করতাম। গোঁফ ও দাড়ি গজানো এবং কামানো পৌরুষের প্রথম শর্ত হিসেবে আমাদের কৈশোরকে নিয়ন্ত্রণ করত।
তখন সতেরো। অবচেতনে নিজের পাড়া, অন্য পাড়ার বিভিন্ন মেয়ের প্রেমে পড়ছি। দিনে থান-ইট হাতে বাইসেপ ফোলাচ্ছি। আর রাতে বা দুপুরে, মধ্যবিত্ত ঘেরাটোপে, একটু আড়াল পেলেই শরীর জাগছে। অথচ ধূমকেতুর মতো প্রেমপত্র এসে হাজির হল এক পুরুষ বন্ধুর কাছ থেকে। এই প্রথম নিজেকেই সন্দেহ হল, নিজের শরীরকে। পরদিন সকালে আয়নার সামনে দাঁড়াই, ভ্রু কুঁচকে। আয়না রাখ-ঢাক করে না। তার আধারে আমার কমনীয়তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। টিন এজের প্রান্তে এসেও আমার দাড়ি-গোঁফ, যাকে ‘পৌরুষ’ বলে জেনেছি এই সেদিন পর্যন্ত, পরবর্তী স্টেশনের আগে যেন হঠাৎ ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মেট্রো যেমন থমকে যায় কেউ লাইনে ঝাঁপ দিলে। মনে পড়ে গেল, ছোটবেলায় বাড়ির মেয়েরা যখন আলতা পরতেন, আমিও পরতাম। বহুবার শুনেছি পাড়ার বন্ধুদের ইয়ার্কি– আমি মেয়ে হয়ে জন্মালে নাকি নাগরের ঢল নামত আমার দালানে! তখন হেসেছি, কিন্তু এবার নিজের কাছে নিজেকে পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার তাগিদে আমি তৎপর হই। মনকে বোঝাই, গুরুতর কোনও ব্যাপার নয়, আমি স্রেফ মাকুন্দ। তাই না গজানো দাড়ি-গোঁফ কামানো শুরু হয়। তাতে নাকের নিচে এবং গালে ইতিউতি কয়েক ফোঁটা রক্ত ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ্যে আসে না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
যে রেকর্ডিং স্টুডিও-য় ফ্রিলান্স করি কলেজে কেটে, সেখানকার এক উদীয়মান পুরুষ এগজিকিউটিভ আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান। এবং অফিসে বসেই টেবিলের ওপার থেকে অবলীলায় প্রস্তাব দেন। আমার চেহারায় যে নারীত্ব উনি খুঁজে পেয়েছেন এক হাত দূর থেকে, তা তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে কয়েক বছর গায়ে গায়ে কাটিয়েও পাননি, তাঁর সেই উপলব্ধি আমায় অস্বস্তিতে ফেলে। সেদিন ময়দানে একা বসে থাকি কিছুক্ষণ, সন্ধে নামা পর্যন্ত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
ফার্স্ট ইয়ারে যেদিন দীপঙ্করের সঙ্গে আলাপ হয়, কলেজের লনের পাশে, সে বলে, ‘আরে! দূর থেকে ভেবেছিলাম তুমি ক্লিন শেভেন, এখন দেখছি কিছুই গজায়নি।’ সেই রাতে, না কি আরও কয়েক রাত পরে, স্বপ্ন দেখি। বৃদ্ধ আমি বাগানে বসে আর আমায় ঘিরে বন্ধুরা উদ্দাম নাচানাচি করছে। কারণ এতদিনে আমার মুখশ্রীর দারিদ্র ঘুচেছে। তবে সবই তো সাদা, তাই চমকে উঠি। সামান্য পৌরুষ, থুড়ি দাড়ি-গোঁফের জন্য বার্ধক্য অবধি অপেক্ষায় থাকতে হবে না কি? ঘুম ভাঙলে চিন্তা বাড়ে, বই কমে না। যে রেকর্ডিং স্টুডিও-য় ফ্রিলান্স করি কলেজে কেটে, সেখানকার এক উদীয়মান পুরুষ এগজিকিউটিভ আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে চান। এবং অফিসে বসেই টেবিলের ওপার থেকে অবলীলায় প্রস্তাব দেন। আমার চেহারায় যে নারীত্ব উনি খুঁজে পেয়েছেন এক হাত দূর থেকে, তা তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে কয়েক বছর গায়ে গায়ে কাটিয়েও পাননি, তাঁর সেই উপলব্ধি আমায় অস্বস্তিতে ফেলে। সেদিন ময়দানে একা বসে থাকি কিছুক্ষণ, সন্ধে নামা পর্যন্ত। অন্ধকার হলে অন্যের চোখে নিজেকে দেখার চাপ থাকে না। শুধু সমস্যা রয়ে যায় নিজেকে চেনার বিষয়টি নিয়ে। বিশেষ করে যৌন চেতনার অন্বেষণ, যা দাড়ি-গোঁফের আকাঙ্ক্ষায় অতি সরল একটি সমীকরণে পর্যবসিত হয়। কোন মুশকো জোয়ান যে একান্তে আমায় কামনা করতে পারে, সে চিন্তা আমায় রীতিমতো বিচলিত করে। রাতে ঘুম হয় না। কিন্তু ভবিষ্যতে যেদিন পাসপোর্টের ফোটোয় গোঁফ দেখা যাবে, সেদিন দু-হাত তুলে নৃত্য করব সেই শপথ নিলেও, তা রাখতে পেরেছি বলে মনে পড়ে না। হয়ত কয়েকটি প্রেম অথবা শরীর হারানোর দুঃখে।
যেহেতু ছোটবেলায় বাড়িতে ফুল সাইজ আয়না ছিল একটিই, তাও বাবা-মা’র ঘরে, তাই নিজেকে দেখতে হত লুকিয়ে, সময়ের ফাঁক গলে। এখন প্রাপ্তবয়স্ক পুত্রের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা চলাকালীন বুঝতে পারি তাদের জেনারেশন পারদের আয়নায় বিশ্বাস করে না। সোশ্যাল মিডিয়াই তাদের নিজস্ব দর্পণ। তার বন্ধুদের দেখি ইন্সটাগ্রামে সপাট পোস্ট করতে, নিজেদের ওরিয়েনটেশন নিয়ে। আমি, কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েই হয়তো জিজ্ঞেস করি, ‘তোর ওরিয়েনটেশন?’ সে উত্তরে বলে, তার মনে হয় সে ‘স্ট্রেইট’। কিন্তু একই সঙ্গে জানায় যে, এই প্রশ্ন অর্থহীন। কারণ এর প্রকৃত উত্তর শুধু সময় জানে। শরীর ও মনকে আলাদা করে দেখার তাগিদ তাদের নেই। সেই কারণেই হয়তো তার মা’কে সে অবলীলায় আশ্বাস দেয় এই বলে যে, পুরনো শাড়িগুলো, ন্যাপথালিনের গন্ধে বুঁদ হয়ে থাকা শাড়িগুলো সে নিজেই একদিন পরবে। আর এই কথা শুনে আমার মধ্যে, এক পুরুষ আলমারির কোণে অবহেলায় পড়ে থাকা, ধুলোমাখা একটি প্রতিবিম্ব সজোরে হেসে ওঠে।
…পাল্টি-র অন্যান্য পর্ব…
পাল্টি পর্ব ২৩: যে মানুষী জ্বলছিলেন দাউদাউ করে, তাঁর গায়ে বৃষ্টি পড়েনি
পাল্টি পর্ব ২২: বাংলা মদের মতো বাংলা ভাষার নেশাটাও যদি চিরস্থায়ী হত!
পাল্টি পর্ব ২১: সাদা কাঠির ডগায় লাল আলো
পাল্টি পর্ব ২০: যে কারণে বুলাদির মর্তে আগমন
পাল্টি পর্ব ১৯: আরে নামের সামনেই পেছন নিয়ে ঘুরছিস?
পাল্টি পর্ব ১৮: ‘আসল হিজড়ে’ কথাটা সোজা মাথায় আঘাত করে
পাল্টি পর্ব ১৭: গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে মাথা রেখে কোথায় চলেছেন অ্যাপ ক্যাবের ড্রাইভার?
পাল্টি পর্ব ১৬: কো-এড কলেজে পড়তে এসে বুঝি পিরিয়ড খুব একটা সুখের ক্লাস নয়
পাল্টি পর্ব ১৫: পচা ইলিশ ঝোলানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হত পাড়ার মেজরিটি পাবলিক
পাল্টি পর্ব ১৪: গুরু তুমি তো ফার্স্ট বেঞ্চ
পাল্টি পর্ব ১৩: আমের সিজন ফুরিয়ে গেলে ল্যাংড়া তার আসল অর্থ খুঁজে পায়
পাল্টি পর্ব ১২: টিবি হয়েছে বলে আড়ালে বন্ধুটির নাম দেওয়া হয় ‘কিশোর কবি’
পাল্টি পর্ব ১১: ডোমেরা জানে, আগুনের তর সয় না
পাল্টি পর্ব ১০: আমেরিকায় খুন হওয়ার থেকে স্বদেশি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ভাল
পাল্টি পর্ব ৯: মানুষ হয়ে জন্মেছি, ব্যাং কী করে জন্মায়, তা জেনে কী হবে?
পাল্টি পর্ব ৮: খোকাবাবু, ম্যাডাম স্যুইটে আছেন, এক ঘণ্টায় ৪০০ দেবেন বলছেন
পাল্টি পর্ব ৭: ও তো সন্ধে থেকেই গিরিশ ঘোষ
পাল্টি পর্ব ৬: যে দোকানের বেবিফুডে বেড়ে উঠলাম, সেখান থেকেই বীরদর্পে কন্ডোম কিনেছি
পাল্টি পর্ব ৫: প্রায়শ্চিত্ত রোল অ্যান্ড কর্নার
পাল্টি পর্ব ৪: দু’অক্ষর কথা, চার-অক্ষর কথা
পাল্টি পর্ব ৩: ‘টুকলি’ ঈশ্বরের দয়ার শরীর
পাল্টি পর্ব ২: পাগলি তোমার সঙ্গে
পাল্টি পর্ব ১: প্যান্টি যেন বদ্বীপ, লাজুকলতা নরম কাপড় জুড়ে যাবতীয় গোপনীয়তা