ক্লাস এইটে পড়ার সময়েই বাবা রবি ট্যান্ডনের সিনেমায় অ্যাসিস্ট করতে শুরু করেছিলেন রবিনা। যদিও, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যেহেতু, ‘ডিরেক্টর সাব কি বেটি’, তাই ইউনিটের কেউ-না-কেউ দৌড়ে এসে, তাঁর হয়ে কাজটা করে দিতেন। স্কুল ফাইনালের পর, শুরু করলেন মডেলিং। তারপর, ঢুকলেন অ্যাড-ম্যান প্রহ্লাদ কক্করের ‘জেনেসিস’-এ। সেখানে, অফিসের নানা কাজ ছাড়াও, স্টুডিওর ফ্লোর পরিষ্কারের দায়িত্ব ছিল তাঁর। স্টুডিও ঝকঝকে রাখতে গিয়ে, লোকজনের বমিও সাফ করেছেন তিনি।
নয়ের দশক। ‘ফিল্মওয়ালা’ সুব্রত সেন তখনও সিনেমার আঙিনায় আসেননি। ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে, সাংবাদিকতা করছেন তিনি। পোস্টিং, দিল্লিতে। একদিন, একটা কাজে, ঢুকছেন মেরিডিয়ান হোটেলে। লবিতে দেখলেন, উল্টোদিক থেকে হেঁটে আসছেন এক মধুস্নাতা তরুণী। খুব চেনা-চেনা; কিন্তু, নাম মনে পড়ছে না কিছুতেই। একটু হাসলেন সুব্রত। তরুণীর ঠোঁটেও ফিরতি-হাসি। সাহস পেয়ে, সাংবাদিক-সুলভ কৌতূহলে, সুব্রত বলে ফেললেন, ‘ইউ লুক সো ফ্যামিলিয়ার! কোথায় দেখেছি, বলুন তো?’ আরেকটু চওড়া হল তরুণীর হাসি; যেতে যেতে, ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘ইন ইয়োর ড্রিমস…’।
গাড়িতে উঠে, চলে গেলেন তিনি। সুব্রত হতভম্ব, কী অ্যাটিটিউড রে বাবা! নিজের কাজে মন বসাতে বসাতে, মাথায় আচমকা ইউরেকা! আরে, ইনি তো রবিনা ট্যান্ডন!
‘দমন’-এর শুটিংয়ে, কল্পনা লাজমি ডেকে পাঠালেন এক বাঙালি যুবককে, অ্যাসিস্ট করতে। সে যুবক সবেমাত্র একটা ডকুমেন্টারি বানিয়ে, ভাবছেন এবার ফিকশন ফিচারে হাত দেবেন। কিন্তু, যে ধরনের কাজ করতে চান, সেখানে ঠিকঠাক অ্যাক্টরদের সাপোর্ট খুব দরকার; তাঁদের বন্ধুতা দরকার। কল্পনার ডাক পেয়ে, বুঝলেন এই সুযোগ! ফিল্মমেকিং-টা হাতে-কলমে শেখার পাশাপাশি, যদি সঞ্জয় সুরি, সায়াজি সিন্ধে, রাইমা সেন, রবিনা ট্যান্ডনকে ইমপ্রেস করা যায়!
পড়ুন আরও ‘ফ্ল্যাশব্যাক’: অমিতাভ বচ্চনকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি যে হোটেলে
ডিসেম্বর, ১৯৯৯। যুবক পৌঁছলেন গৌহাটি। ওখানে, এক প্রত্যন্ত গ্রামে, আউটডোরের শিডিউল। কাছাকাছি কোনও হোটেল নেই। নিতান্ত সাদামাটা ব্যবস্থায়, হোমস্টে-তে থাকছেন টিমের সবাই। প্রথম দিন থেকেই, প্রাণ ঢেলে, তিনি প্রমাণ করতে চাইলেন নিজেকে। বাকি ক্রু-মেম্বারদের কাছে যেটা ‘জব’, সেটাই তো তাঁর ‘ইন্সটিটিউট’।
কল্পনার চোখ তীক্ষ্ণ; যুবকের প্যাশন দেখে, কোরিওগ্রাফির দায়িত্বও দিলেন তাঁকে। ব্যাস, ড্যান্সাররা তাঁর পা ছুঁয়ে ‘মাস্টারজি’ বলতে শুরু করলেন। যুবক বিড়ম্বনায়; তবুও, নার্ভাস না হয়ে, কাজকম্ম সামলাতে থাকলেন। পরদিন, রবিনার ড্যান্স সিকোয়েন্স। যুবক তাঁকে শট-টা বুঝিয়ে, হাঁকলেন, ‘মিউজিক… রোল ক্যামেরা… অ্যাকশন!’ রবিনা অবাক, ‘এ কী! গিভ মি দ্য কাউন্ট, ওয়ান-টু-থ্রি-ফোর… প্রোফেশনাল কোরিওগ্রাফিতে যেরকম হয়…’
পড়ুন আরও ‘ফ্ল্যাশব্যাক’: বর্ষা এনেছিল দেব আনন্দের ‘গাইড’
যুবকের সেসব মাথামুণ্ডু কোনও আইডিয়াই নেই। তবুও, চেষ্টা করলেন। বুঝতে পারলেন, হয়নি। আবার চেষ্টা করলেন, আবার… আবার…। ক্রমশ বাড়তে থাকল রবিনার বিরক্তি। দু’দিন ধরে চলতে থাকল এরকম। শেষমেশ, হা-ক্লান্ত যুবক সিদ্ধান্ত নিলেন, পরিচালককে জানিয়ে, ফিরে যাবেন। সে রাতে ঘুম এল না তাঁর। স্বপ্নের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে, নিজেকে ব্যর্থ দেখলেন তিনি।
সকাল ফুটতেই, কল্পনাকে বললেন, চলে যাবেন তিনি, হবে না তাঁর দ্বারা। পরিচালক বুঝলেন, মন একবার ভাঙলে, ঘুরে দাঁড়ানো যায় না আর; বললেন, ‘আজ দিনটা থেকে যাও…’। শুটিংয়ের শেষে সেদিন, রবিনা ডাকলেন যুবককে, ‘আমার সঙ্গে ডিনার করবে, প্লিজ?’
পড়ুন আরও ‘ফ্ল্যাশব্যাক’: ভারতের প্রথম অভিনেতা যিনি সেক্রেটারি রেখেছিলেন
ডিনারে, রবিনা বললেন তাঁকে, ‘তুমি সেটে থাকলে আমার খুব ভাল্লাগে, জানো! তোমার সঙ্গে যেভাবে কানেক্ট করতে পারি, সেভাবে সকলের সঙ্গে পারি না… তাই, তোমায় একটু রাগ দেখাই…!’
উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরিবিলি শীতার্ত রাতেও ঘাম দিল যুবকের। দুই নতুন বন্ধু, তখুনি, নাম রাখলেন একে অপরের। যুবকের কাছে রবিনা হলেন, ‘র্যাবস’; আর, সেই যুবক, অনির, ‘বোন’। দু’দশক পেরিয়েছে; অনির আরও কাজ করেছেন, অনেক খ্যাতি পেয়েছেন; তবু, সেই বন্ধুতা মনে পড়লে, এখনও আর্দ্র হয়ে ওঠেন।
ক্লাস এইটে পড়ার সময়েই বাবা রবি ট্যান্ডনের সিনেমায় অ্যাসিস্ট করতে শুরু করেছিলেন রবিনা। যদিও, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। যেহেতু, ‘ডিরেক্টর সাব কি বেটি’, তাই ইউনিটের কেউ-না-কেউ দৌড়ে এসে, তাঁর হয়ে কাজটা করে দিতেন। স্কুল ফাইনালের পর, শুরু করলেন মডেলিং। তারপর, ঢুকলেন অ্যাড-ম্যান প্রহ্লাদ কক্করের ‘জেনেসিস’-এ। সেখানে, অফিসের নানা কাজ ছাড়াও, স্টুডিওর ফ্লোর পরিষ্কারের দায়িত্ব ছিল তাঁর। স্টুডিও ঝকঝকে রাখতে গিয়ে, লোকজনের বমিও সাফ করেছেন তিনি।
গ্ল্যামার আর স্টারডমের বোঝা ভেবে, ‘শূল’-এ তাঁকে নিতে গররাজি রাম গোপাল বর্মা; বললেন, “তোমার ছবি দেখলে, আমার শুধু ‘আঁখিয়োঁ সে গোলি মারে…’ মনে হয়!” লুক টেস্টে চমকে দিলেন রবিনা; দেখে, রামু থ!
আসলে, সমস্যাটা ইন্ডাস্ট্রির। একটা হিট ইমেজ ভাঙা সহজ হয় না কারও, কখনও। সেই ঝক্কি ছিল রবিনারও। যে স্ক্রিপ্টেই সাইন করতেন, কোনও-না-কোনও রেফারেন্সে চলে আসত ‘টিপ টিপ বরসা পানি…’। ‘কিমত’-এও তাই হল। প্রেমের দৃশ্যে এসে পড়ল, ‘দে দিয়া দিল পিয়া…’। সেই একইরকম অঝোর-ধারায় রেন-পাইপ, একইরকম নিরালা বিল্ডিং। তফাৎ শুধু শাড়ির রঙে, হলুদের বদলে এখানে সফেন সাদা।
গানটার শুটিং দেখতে এসেছিল ১১-১২ বছরের একটা ছেলে। তার কাছে তখন গোটা দুনিয়াই আশ্চর্য ফিল্মি। দু’চোখে তীব্র কৈশোর নিয়ে, বুভুক্ষুর মতো দেখছিল নায়িকার বিভঙ্গ। রবিনা অপ্রস্তুত হলেন, কাজ করতে অসুবিধে হচ্ছিল তাঁর। ইউনিটের একজনকে জানাতেই, তিনি এসে, ছেলেটার হাত হিড়হিড় টেনে, বের করে দিলেন স্টুডিওর বাইরে।
ছেলেটা সেদিন কাঁদছিল। বুঝতে পারছিল না, কী এমন অন্যায় করে ফেলেছে সে। এই ঘটনার প্রায় ১২-১৩ বছর পর, একদিন, আমরা পোস্টারে দেখতে পেলাম সেই নাছোড় বালককে; নাম, রণবীর সিং।
২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পেলেন কোরিয়ান সাহিত্যিক হান কাং। অস্তিত্বের অতীন্দ্রিয় অস্বস্তি ধরা পড়ে তাঁর লেখায়। উত্তরাধুনিক সমাজে আমাদের প্রত্যেকেরই বুকের ভিতর রক্তক্ষরণ চলছে অবিরত। আমরা চেপে যাচ্ছি রোজ। লোকলজ্জার ভয়ে, মানহানির ভয়, গড্ডলিকা প্রবাহের বিপরীতে একা হওয়ার ভয়ে। কাং সেসব টেনে খুলে ফেলেন।