মাড আইল্যান্ডে সন্ধে নামছে, দূরের স্কাইলাইনে আসতে আসতে ফুটে উঠছে ফুলের মতো আলোগুলো, আকাশ থমথমে। এখানে এসে খুব একটা ঘোরাঘুরি করিনি আমরা। ধী-এর ছুটির দিনগুলো ছাড়া বেরনোর ইচ্ছেও করেনি। নতুন কোনও শহরে আমার খুব ভয় ভয় লাগে। কলকাতার ভিড় আমি চিনি, জানি। তবুও আমার এখনও থিয়েটার রোড আর পার্ক স্ট্রিট গুলিয়ে যায়, আর এ তো সম্পূর্ণ অচেনা এক অঞ্চল, বিরাট একটা শহর ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে।
৮.
অঙ্কটা পরিষ্কার ছিল, ওরা আমাকে হাতে যে টাকাটা দিয়েছিল, তার থেকে আমার দলের মিউজিশিয়ানদের ভাগ দেওয়ার পরও আমার কাছে যে টাকাটা থাকত, সেটা প্রায় আমার এক বছরের উপার্জনের থেকেও কিছুটা বেশিই হবে। একে আমি বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার পর আমার কিছু কিছু কলিগের মনোভাব একটু পাল্টে গেছিল, অবশ্য সেটা শুধুমাত্র সহকর্মীদের ক্ষেত্রেই শুধু হয়েছিল, তা বলব না। বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেও একটা অকারণে অদ্ভুত দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছিল। আগে আমার গ্রামে ঢুকলে, আমার গেয়ো বন্ধুদের কাছে খবর চলে যেত বাতাসের মতো। বাস স্টপে নামতে হত শুধু, আমরা জড়ো হয়ে যেতাম, তাদের সঙ্গে, তাদের খামারে, তাদের বাড়িতে, বাগানে, পুকুরঘাটে। গ্রামের প্রায় সব বন্ধুরাই মাছ ধরতে পারত পটাপট। লেই দিয়ে, কেঁচো গেঁথে ছিপে ওরা ধরে ফেলত পুঁটি বা একটা-দুটো চারাপোনা বা বাটা। আমার ধৈর্যে কোলাত না। ফাতনা তাক করে বসে থাক, কখন মাছ ঠুকরে খাবে কেঁচো, আর আমি মারব টান? আর তাতে ধরা পড়বে মাছ? সে ছিপে শালুক ফুল। একবার তো এমন হয়েছিল আমার টানের চোটে বঁড়শি এসে পড়ল আমারই মাথায়। সে এক রক্তারক্তি কেস। নিজেকে কালীদাস মনে হয়েছিল। চন্দ্রশেখর, দীমু, অচিন্ত্য, গৌতম, লাল্টু, ডাম্বল, দীপক, সোনা, লক্ষ্মণ, মঙ্গলা, আমরা চলে যেতাম গ্রামের পেছনের হাঁটু জলা নদীর পাড়ে জাম পাড়তে। কাউকে ডাকতে হত না, কিন্তু বিখ্যাত হওয়ার পর গ্রামে গিয়ে দেখলাম তাদের ডাকতে হচ্ছে। একে তো সেই শৈশবে বন্ধুত্বের সময় লণ্ঠন ছিল ভরসা। সবার হাতে টর্চও থাকত না। আর এখন আমাদের ছেলে-মেয়েদের খবর রাখতে হয় ইনস্টা স্টোরিতে। আমরা আমাদের ফোনেই ঢুকে গেছি। এখন আমাদের মোবাইলই আলো ছড়িয়ে দিয়ে পথ দেখিয়ে দেয়। আর সেই টর্চের আলোতেই খুঁজে বেড়াতে হয় তাদের।
কাউকে কাউকে দেখে মনে হয় তারা আমাকে আগের মতো ভাবতে পারে না। বিখ্যাত হলেই লোকে ভুলে যায় সব, এমনকী শৈশবও। এটাই তাদের মনে হয় প্রাথমিকভাবে। কিন্তু সে দূরত্ব কমে যায় খানিকটা সময় খরচা করলেই, কিন্তু কলিগ আর বন্ধু তো আর সবসময় এক হয় না। হতে পারে না। কিছু কিছু সহকর্মী বন্ধু হতেই পারে। আমার জীবনেও হয়েছে, পেয়েছি, সব থেকে বড় ঝঞ্ঝাটটা হল, বন্ধুদের অকারণেও ঝেলা যায়, কখনও কখনও একটু স্পেস নেওয়া যায়। কিন্তু বসের মুখ তো ছুটির দিন ছাড়া রোজ ঝেলতে হয় কাকা।
আমার সিনিয়রদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে অবিশ্বাস করতে শুরু করল, যখন থেকে অফিসে কে একজন কমপ্লেন করল আমার নামে, বসকে আমি নাকি ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হয়েছে– এই মিথ্যে বলে ছুটি নিয়ে, অফিস কামাই করে শো করতে গেছি। সেদিন থেকে আমার সারাক্ষণ ভীষণ অশান্তি শুরু হল, সেটা আরও বাড়তে লাগল যখন দেখলাম আমি প্রায় নন্দ ঘোষ হয়ে যাচ্ছি, তখন আমি একটু ঘেঁটেই গেছিলাম। একদিকে হঠাৎ একটা খ্যাতির খোঁচা, তার সঙ্গে একটা অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ অফিসের একটা কাজের দায়িত্ব– এই দুইয়ের চাপে আমাকে ডাক্তার দেখাতে হয়েছিল। হ্যাঁ, নিউরোসাইক্রিয়াট্রিস্ট কনসাল্ট করে তাঁর চিকিৎসাধীন ছিলাম কয়েক মাস। সে অন্য কথা, কিন্তু এর সঙ্গে একবছরের উপার্জনের নিশ্চয়তা এক দিনেই পাওয়ার এ পরিস্থিতি আমাকে কাগজ ফেলার কাজটা সহজ করে দিয়েছিল। মনে হয়েছিল এক বছর সময় পেলে কি আমি আমার এই গান তৈরি আর বেচার খেলাটা শিখে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারব না?
এক বছরের সংসার চালাতে পারলে দেখ লেঙ্গে বাকিটা। সেই ভেবেই জীবনে প্রথম এয়ারপোর্টে পৌঁছেছিলাম। মুম্বই তো নয়, বম্বে তখন। আমার সঙ্গে সেই সময় ইলেকট্রনিক ড্রামস বাজাতেন ভোলাদা, ভোলাদার গাইডেন্সে আমি প্লেন থেকে উঠলাম-নামলাম। এয়ারপোর্টে দেখা হয়েছিল সেই সময়ের বম্বের বাঘ, কুমার শানুর সঙ্গে। সে গল্প যদি আসে আসবে, আরও কিছু সত্যি, কিছু ঘটনা চলে আসবে, যা গল্পের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু আমি ভাবছি রোববারের জন্য লেখাটা লিখতে লিখতে– মুম্বইতে আমার সাতটা দিন কেটে গেল হুশ করে।
মাড আইল্যান্ডে সন্ধে নামছে, দূরের স্কাইলাইনে আসতে আসতে ফুটে উঠছে ফুলের মতো আলোগুলো, আকাশ থমথমে। এখানে এসে খুব একটা ঘোরাঘুরি করিনি আমরা। ধী-এর ছুটির দিনগুলো ছাড়া বেরনোর ইচ্ছেও করেনি। নতুন কোনও শহরে আমার খুব ভয় ভয় লাগে। কলকাতার ভিড় আমি চিনি, জানি। তবুও আমার এখনও থিয়েটার রোড আর পার্ক স্ট্রিট গুলিয়ে যায়, আর এ তো সম্পূর্ণ অচেনা এক অঞ্চল, বিরাট একটা শহর ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে, হাজার হাজার ট্রেন এসে দাঁড়াচ্ছে প্ল্যাটফর্মে। আবার ছেড়ে চলে যাচ্ছে কোথায় না কোথায়। ক্যাবে করে গেলে সাংঘাতিক কনজেশনে আটকে থাকার যন্ত্রণা, কী নিদারুণ ট্র্যাফিক। একা বেরতে ভয় ভয় লাগছিল। দু’চারজন মিউজিশিয়ান, ভক্ত, বন্ধু খোঁজ পেয়ে চলে আসছে তাদের শিলুদার সঙ্গে দেখা করতে, বাইরে বেরচ্ছি কম। গতকাল একটু বেরিয়েছিলাম ছেলের বন্ধু রোহিত ফাঁকা ছিল বলে, আমাকে এসকর্ট করেছিল সে। এই সুবিধেটুকু পাওয়াতে টুক করে এক মিউজিক ডিরেক্টর (এখন নাম বলব না)-এর স্টুডিওতে গিয়ে হঠাৎ করেই দুটো গানও রেকর্ড করে ফেললাম। রাতে দেরি হয়ে গেছিল আড্ডা-গানে, ডিরেক্টর ব্যাটা আমাকে একটু জেটি পর্যন্ত এগিয়ে দেবে বলেছিল। এক গায়ক-ভক্ত (এরও নাম বলব না) আমাকে জেটি পার করিয়ে দেবে ভাবছিল বোধহয়, এই বুড়ো মালকে একা মুম্বইয়ের রাস্তায় ছাড়তে একটু দুশ্চিন্তাই করছিল সে। কিন্তু আমি মনে মনে ভাবলাম, ‘হে শিলাজিৎ, যে দুর্ধর্ষ দুঃসাহস নিয়ে তুমি বাংলা গানের বাজারে, বীভৎস প্রতিভাবান গায়কদের, শৈশব থেকে সুর-তাল-রাগের পাণ্ডিত্যের আঁচে নিজেদের সেঁকে একটু একটু করে তুলে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেদের ইতিহাসের পাতায়, তাদের ভিড়েও যখন তুমি হারিয়ে যাওনি, এ বান্দ্রা, বোরিভেলি, লোখান্ডওয়ালার ভিড় কি তোমাকে হারাতে দেবে? বাংলা বাজারের ‘পারাবার পার হয়ে এসে শেষে ডুবিব কি’ মাড-এর ‘গোস্পদ’-এ।
এক এক করে নানা রঙের নানা রকম কাজ ফেরতা মানুষ, জেটিতে এসে ফেরিতে ওঠার অপেক্ষায় এসে দাঁড়াচ্ছে, রাত্রি পৌনে একটা বাজে। জানি না এ চিলতে নদীর কী নাম। অন্ধকারে তার জলের ওপর ঢেউয়ের মাথায় চকচক করছে দূরে জ্বলা আলোর ছটা। আমি মোবাইল ক্যামেরায় সেই কালো জলকেলি ছবি তুলছি, আর তু্লতে তুলতে মনে মনে একটা ডায়লগ দিয়ে ফেললাম, ‘শিলাজিৎ মুম্বইতে কী হারাবে পাগলা, মুম্বই হারিয়ে ফেলতে পারে শিলাজিৎকে, মুম্বই খুঁজে নেবে ঠিক শিলাজিৎকে দরকার পড়লে।
এই দেখো, নার্সিসিস্ট হয়ে পড়ছিলাম। বম্বের সেই বৃষ্টি আমার জীবনে কী দুর্দশা বয়ে এনেছিল, সেটা বলতেই ভুলে গেলাম। পরের কিস্তিতে না হয় লেখা যাবে, টাট্টু।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved