সাইকেল-চাকার রিমের সঙ্গে দড়ি বাঁধা। চাকা ঘুরলে দড়িতে টান পড়ে, আবার আলগা হয়। ফলে টানা পাখায় টান পড়ে। লোকটার বাঁ হাত প্যাডেল ঘোরাচ্ছে। আর ডান হাতে বই। নিবিষ্ট পাঠক। একইসঙ্গে প্রযুক্তিবিদ এবং পুস্তকপ্রেমী মানুষটিকে দেখে লোকটার প্রতি খুব শ্রদ্ধা হল। আমি দাঁড়িয়ে লোকটিকে দেখতে থাকি। লোকটির বোধ হয় এবার ঝিমুনি এসেছে। লোকটা সামনের একটা জলচৌকির উপর বইটি উল্টে রেখে ঝিমোতে লাগল। বইটির মলাট দেখলাম। ‘গরম বৌদির নরম মন’।
২৫.
চুপচাপ বসে থাকলে, অনেক সময় দেখি আকাশ থেকে প্যারাসুটে চেপে স্মৃতি নেমে আসে, আমি তখন চোখ বুজি। চোখ খোলা রাখলে তখন দেখতে পাই না, চোখ বুজে দেখি কখনও টিনের বাক্স কাঁধে ঘুগনিওলা, ব্রতচারী শেখানো কান্তিকাকু, যাত্রার ডায়লগ-বলা সত্যপাগলা, মড়া পোড়ানোই হবি যাঁর– সেই ভোলাদা, জিলিপির কারিগর সিধু কাকু– যে নাকি অন্ধ, সাপ খেলা দেখানো বেদে বেদিনী…। সাপের খেলা দেখানোর আগে ওরা ছোট পুতুলের নাচ দেখোতে। হাতপুতুল। পুতুলের ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে হাতের আঙুলের খেলায় পুতুল নাচ। ‘রসের বিনো দিয়ে খেদি নাচবি ভালো…’। ওই পুতুলনাচের প্রসঙ্গেই মনে পড়ল বারুইপুরের এক আদালত এবং জজ সাহেব।
তখন আমার বয়স কত হবে! ২৩-২৪…। বেদে-বেদিনীদের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম ওরা বারুইপুরে থাকে। এবং এরা ঠিক যাযাবর গোত্রের নয়। জমিতে থিতু। লোকের বাড়িতে সাপের সন্ধান পেলে সাপ ধরতে যায়, কাউকে বিছে কামড়ালে ‘বিষপাথর’ দিয়ে ‘বিষ টেনে নেয়’, আবার দাঁতের ‘পোকা’ও বের করে। গঙ্গার ধারেও কিছু বানজারা দেখতাম, ওরাও বেদে গোত্রেরই, তবে ওরা বেশিদিন এক জায়গায় থাকত না। আমি তখন সদ্য বিনয় ঘোষ, আব্দুল জাব্বার, দিব্যজ্যোতি মজুমদার পড়ছি। একবার ইচ্ছে হল বারুইপুরের বেদেদের দেখে আসি– যাকে বলা যায় ‘ক্ষেত্র সমীক্ষা’। যদি সম্ভব হয়, লিটল ম্যাগাজিনে একটা গল্প নামিয়ে দেব। আর দেখেছি, প্রান্তিক নিয়ে লিখলে কিছু পাবলিক ‘বাহবা বাহবা বেশ’ বলে। তো, আমি সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম বারুইপুর। শীতকাল। আর শীতকালেই এইসব ইচ্ছেগুলো বেশি বেশি হয়।
বেদেদের সঙ্গে দেখা হল কি না, কী কথা হল, সেটা এখন থাক। ওসব বলতে গেলে আর সেই জজ সাহেবের কথা বলা হবে না। কোর্ট চত্বরের ছবি গত ৫০ বছরে তেমন পাল্টায়নি। দু’টো বটগাছ, চারটে চায়ের দোকান, ঘুগনি-আলুরদম-ডিমভাজা-সেঁকারুটি।
মামলা জেতার মাদুলি-কবচ-পাথর দেওয়া একটা জ্যোতিষী, টিনের শেডের তলায় টাইপ রাইটার নিয়ে বসা কয়েকটা লোক খটাখট করে যাচ্ছে। পাশে ঝুঁকে থাকা লোক, টুলে বসা। পুরীর পান্ডাদের মতো পাকড়াও করার লোক, পরনে কালো কোট, উকিল ওরা, এবং দালালগণ কানের কাছে ফিসফিস– এফিডেবিট? পার্টিশন? সম্পত্তি? স্বামী নেয় না? ছাড়ান কেস? অ্যাটেস্টেশন? ল্যাম্পপোস্টগুলোর গায়ে একইরকম পানের পিক।
কোর্ট চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে হাজির হলাম আদালত কক্ষে। বিচার চলছে। হাকিমের টেবিলটা লাল শালুতে মোড়া। হাকিমের টেবিলের দু’পাশে দুটো কাঠের পাটাতন, ওটা সাক্ষীদের জন্য। সামনে একটা ছোট টেবিলে বোধ হয় পেশকারবাবু বসেন। আর দেখলাম, ছাদ থেকে বেশ চওড়া একটা মাদুর একবার এধারে যাচ্ছে, একবার ওধারে যাচ্ছে। মাদুরটা তক্তার গায়ে লাগানো, আর তক্তার দু’পাশে দড়ি। টানা-পাখার কথা শুনেছিলাম, দেখলাম প্রথম। তখন বারুইপুরে বিদ্যুৎ ছিল, ওই ঘরেও দিনের বেলায় আলো জ্বলছিল। কেন ফ্যানের বদলে ওরকম মাদুর পাখা ছিল, তার কারণ জানি না। হতে পারে কানুনের গেরো। একটা পাঙ্খাপুলার পোস্ট ছিল, পুলারও ছিল যেহেতু, ওকে ব্যবহার করতে হবে। আর ওই কারণেই হয়তো ইলেকট্রিক ফ্যান ‘স্যাংশন’ হয়নি।
যে দড়ি টানছে, তাকে আদালত কক্ষে দেখা যাচ্ছিল না। পাশের বারান্দায় ওকে দেখা গেল। ও বাঁ-হাত দিয়ে একটা সাইকেলের প্যাডেল ঘোরাচ্ছে, সাইকেলটা এমন করে রাখা আছে যাতে একটা চাকাই ঘুরে যায়। সাইকেল-চাকার রিমের সঙ্গে দড়ি বাঁধা। চাকা ঘুরলে দড়িতে টান পড়ে, আবার আলগা হয়। ফলে টানা পাখায় টান পড়ে। লোকটার বাঁ-হাত প্যাডেল ঘোরাচ্ছে। আর ডান হাতে বই। নিবিষ্ট পাঠক। একইসঙ্গে প্রযুক্তিবিদ এবং পুস্তকপ্রেমী মানুষটিকে দেখে লোকটার প্রতি খুব শ্রদ্ধা হল। আমি দাঁড়িয়ে লোকটিকে দেখতে থাকি। লোকটির বোধ হয় এবার ঝিমুনি এসেছে। লোকটা সামনের একটা জলচৌকির ওপর বইটি উল্টে রেখে ঝিমোতে লাগল। বইটির মলাট দেখলাম। ‘গরম বৌদির নরম মন’।
লোকটি ঝিমোচ্ছে, কিন্তু বাঁ হাতের কাজ চলছে। সাইকেলের চাকা ঘুরছে। মানে টানা পাখা চলছে। পাশের ঘরে শুনানি শুরু হয়ে গেছে। একজন রোগা লিকলিকে উকিল, কোটটা বেশ ঢিলে, গালে দাড়ি-গোঁফ কামানো। একদিকে শার্ট-পাজামা পরা একজন লোক, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, কাঁধে গামছা। উকিল মশাই বলছেন ‘ধর্মাবতার, ফুল যদি তার রঙিন পাপড়ি মেলে ডাকে, বলে আয় আয়– ভ্রমর, প্রজাপতি সে দিকেই যায়। অগ্নি যখন জ্বলে, তার শিখাটি ছড়ায়, বাতাস ধাবিত হয়ে সেদিকেই যায়। সমুদ্র নিচে থাকে স্যর, নদীকে ডাকে আয়, নদী ওদিকেই ধায়। আমার মক্কেল নির্দোষ স্যর। ওর ভিতর থেকে, অন্তর থেকে কোনও তাড়না ছিল না। কিন্তু বেপর্দা নারী শ্রীমতি কুসুমবালা গাইন তাঁর যৌবনকুসুম বিকশিত করে, সৌন্দর্যের জাল রচনা করে, ছলাকলা করে আমার মক্কেলকে আহ্বান করেছে। কুসুমবালা একজন বেপর্দা মক্ষীরানি ধর্মাবতার, সে তাঁর পক্ববিম্বাধর, চকিত হরিণী-চক্ষুর ইশারায় বহু পতঙ্গকে জালে ফেলেছে। আপনার অনুমতি পেলে আমি কুসুমবালাকে জেরা করতে চাই।’
আমি এবার ‘কুসুমবালা গাইন হাজির…’ এই আহ্বান শুনতে পাই। আমি উন্মুখ হয়ে থাকি কখন সেই পক্ববিম্বঅধরা, মক্ষীরানি, যৌবনের আগুন-ঝরানো নারী আসবেন। জজসাহেব বেশ কিছুক্ষণ ধরেই উসখুস করছিলেন। জজসাহেব বেশ মোটা সোটা গোলগাল চেহারা, স্থূলমধ্য, নিতম্বিনী (পুং) বলা যায়। আমি ভাবছিলাম উকিলবাবুর কবিতা-শরে বিদ্ধ হয়ে এমন করছেন বুঝি। জজসাহেব এবার হাঁক পাড়লেন– ‘কতবার বলেছি চেয়ারে কেরোসিন দিয়ে ঝেড়ে রাখবে। বসতে পারছি না। যজ্ঞেশ্বর…’।
সেই পাঙ্খাপুলারটি এলে। হাতজোড় করে বলল, ‘স্যর, এজলাসের আগে তো একবার ঝেড়ে দিয়েছিলাম। আবার দিচ্ছি।’ ও এসে বিচারকের চেয়ারটা আছড়াতে লাগলে। আর চেয়ার থেকে পড়তে লাগল দু’-চারটে করে ছারপোকা। পাঙ্খাপুলার-মুহুরি মিলে ছারপোকাগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে খুন করতে লাগল। ছারপোকাদের জন্য ৩২৬ ধারা, ৩২৭ ধারা নেই।
………………………..
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন
………………………..
যখন ছাড়পোকা জেনোসাইড চলছে, তখন হাজির হলেন কুসুমবালা। বলল ‘এসি গিইচি, এট্টু দোক্তা কিনতি গেইলাম তো…’। দেখি ঠোঁট থেকে বেরিয়ে আছে দু’টো দাঁত, একটা চোখ ছোট, গালে মেচেতা… এই সেই বেপর্দা সুন্দরী। তখনও দমাদ্দম চেয়ার আছড়ানো চলছে।
উকিলবাবু বলেছিলেন ‘স্যর, একটা কাজ করুন। যদি আপনার দেহের রক্ত বলে আয় আয়, বেচারা ছারপোকাগুলো তো সেদিকেই যায়। এজন্যই দরকার পর্দা।’
উকিল মশাই কোত্থেকে একটা চট এনে চার ভাঁজ করে চেয়ারের উপর বসিয়ে দিল, মুহুরি মশাই ওটা ঢেকে দিল লাল শালুতে। এবার কোর্ট চালু হবে।
…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…
২৩. হীনম্মন্য বাঙালি সমাজে শব্দের প্রমোশন হয় মূলত ইংরেজি বা হিন্দিতে
২১. বাঙালির বাজার সফর মানেই ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম
২০. জাত গেল জাত গেল বলে পোলিও খাব না!
১৯: ধোঁয়া আর শব্দেই বুঝে গেছি আট-তিন-পাঁচ-দেড়-দেড়!
১৮: নামের আগেপিছে ঘুরি মিছেমিছে
১৭: টরে টক্কার শূন্য এবং ড্যাশের সমাহারে ব্যাঙের ‘গ্যাগর গ্যাং’ও অনুবাদ করে নিতে পারতাম
১৬: ছদ্মবেশী পাগলের ভিড়ে আসল পাগলরা হারিয়ে গেল
১৫. ধূমপান নিষেধের নিয়ম বদলান, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরকে বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক
১৪. এমএলএ, এমপি-র টিকিট ফ্রি, আর কবির বেলা?
১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’
১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না
৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু
৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য
৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল
২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন
১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী