Robbar

পিতৃপিণ্ডে টমেটো সস

Published by: Robbar Digital
  • Posted:August 2, 2025 7:43 pm
  • Updated:August 3, 2025 7:34 pm  
swapnamoy chakraborty on a funny funeral story | Robbar

পুরোহিত মশাই মেম-পাত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন– ‘গো-গো রাউন্ড সেভেন সার্কেল। ওয়ান সার্কেল মিন্‌স ওয়ান গিঁট। মানে, দড়ির গিট্টা।’ মূকাভিনয়ে দড়ির গিট্টা বোঝাচ্ছিলেন পুরোহিত মশাই, নীল চোখের মেম চোখ পিটপিট করে বোঝার চেষ্টা করতে করতে, কী বুঝল কে জানে, হেসে বলল ‘ওহ্‌, নটি’। অন‌্য কোনও গূঢ় ইঙ্গিত বুঝে ‘নটি’ বলেছিল, নাকি গিঁট-এর ইংরিজি প্রতিশব্দ ‘নট’ ভেবে ‘নটি’ বলেছিল জানি না আজও। তবে এই পুরোহিত মশাই সহাস‌্য ‘নটি’ শব্দটি উপেক্ষা করে বলেছিলেন, ‘ইনডিয়ান ম‌্যারেজ ইজ গ্রেট। সেভেন পাক মিন্‌স একদম টাইট ব‌্যান্ডেজ ফর এভার। সেভেন পাক কমপ্লিট মিনস ইউ আর এমন টাইট যে নো-বডি ক‌্যান সেপারেট। সো রাউন্ড রাউন্ড। থ্রি পাক কমপ্লিট, নাও ফোর…।’

স্বপ্নময় চক্রবর্তী

২৪.

আমার এক বন্ধু খুব পিতৃভক্ত। তার বাবার মৃত‌্যুর পর পিতৃশ্রাদ্ধ চলছে। পিণ্ড প্রস্তুত। গোবিন্দভোগ চালের পিণ্ড, বেশ কিছুটা ঘি মাখানো, নিয়ম অনুযায়ী তিলও মেশানো হয়েছে পিণ্ডে। বন্ধুটি বলল, ‘তিলটা বাবার খুব প্রিয় খাবার। সিসম ব্রেড খেতে ভালোবাসতেন, বার্গারটপে সিসম থাকতে, তিলের বড়াও ভালোবাসতেন। তিন ইজ ওকে– তিল ঠিক আছে। তবে ভাতটা ঝুরঝুরে না হলে খুব রাগ করতেন।’ তারপর দু’ হাত জড়ো করে পুরোহিত মশাইকে বলেছিল: ‘একটা অনুরোধ করব ঠাকুরমশাই, পিন্ডির উপর একটু টমেটো সস ঢেলে দিতে অনুমতি করবেন? এরকম গলা ভাত, বাবা খাবেন কী করে?’

পুরোহিত মশাই গোল চশমার ফাঁক দিয়ে আমার বন্ধুটিকে এক অদ্ভুত কায়দায় অবলোকন করলেন। তাঁর মুখে কথা নেই, চোখ পিটপিট, নাক খুঁটলেন, তারপর চশমা খুলে গলা গাঢ় করে বললেন– ‘অসুবিধা কেন হইবে? পিণ্ডে যথেষ্ট ঘি দেওয়া আছে। গোবিন্দভোগ চালের সঙ্গে ঘৃত যথেষ্ট উপাদেয়।’

অলংকরণ: শান্তনু দে

বন্ধুটির আসল নাম চেপে যাচ্ছি।

অনেকের কাছেই নানা সামাজিক কাজের সুবাদে সে পরিচিত। ধরা যাক, ওর নাম সুবোধ। সুবোধ, অবোধ ছেলের মতো বলল– ‘ঘি দেওয়া আছে তো বুঝলাম। কিন্তু ভাত তো ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেই কখন ভাত সেদ্ধ হয়েছে, তারপর চটকে পিন্ডি করা হয়েছে, তারপর ঝাড়া একঘণ্টা ধরে মন্ত্র পড়ালেন। একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঠান্ডা ভাতে ঘি জমে? খাবার ব‌্যাপারে বাবা খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। একটু সস ঢেলে না দিলে বাবা গ্রহণ করবেন না।’ পুরোহিত মশাই পূর্ববঙ্গীয়, চেষ্টা করেন ‘বাঙাল ভাষা’ না বলতে, কিন্তু রাগে ও অনুরাগে কিংবা দুঃখে ও শোকে বাঙাল ভাষা বেরিয়ে যায় তাঁর। বললেন, ‘আজাইল‌্যা তর্ক কর ক‌্যান? আত্মার কি জিহ্বা আছে? জিহ্বা দিয়া কি এইসব সস-মস চাইট‌্যা খাইব নাকি তোমার পিতা?’

সুবোধ সরল প্রশ্ন করল– ‘আত্মার জিভ নেই বুঝি?’

পুরোহিত মশাই বোধহয় তার পুরো জীবনে এরকম প্রশ্নের মুখোমুখি হননি। প্রশ্নটা সহজ, এবং উত্তরও জানা। শুধু ‘না’ বলে দিলেই চলত। কিন্তু উনি বললেন– ‘দ‌্যাখেন, আপনি ইঞ্জিনিয়ার মানুষ, কলকব্জা বোঝেন ভালো, কিন্তু আধ‌্যাত্মিক জগৎটা বোধহয় বোঝেন না। বুঝলে পিতৃপিণ্ডে টমেটর সস ঢালার কথা বলতেন না। আত্মা হইল ব‌্যাটারি। ব‌্যাটারি শেষ, দেহযন্ত্র শেষ। ব‌্যাটারিতে যে আর পাওয়ার নাই, সেইটা কি ব‌্যাটারি দেইখা বুঝা যায়? যায় না। ব‌্যাটারির অন্তর্গত শক্তিটা হইল পাওয়ার। মানুষের ক্ষেত্রে সেইডাই আত্মা।’

এই পুরোহিত মশাইকেই একবার এক এন.আর.আই পাত্র আর মার্কিনি পাত্রীর বিয়ে দিতে দেখেছিলাম। মেম-পাত্রীর ভারতীয় কায়দায় ফুলের মুকুট পরে বিয়ে করার শখ হয়েছিল। এই পুরোহিত মশাই মেম-পাত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন– ‘গো-গো রাউন্ড সেভেন সার্কেল। ওয়ান সার্কেল মিন্‌স ওয়ান গিঁট। মানে, দড়ির গিট্টা।’ মূকাভিনয়ে দড়ির গিট্টা বোঝাচ্ছিলেন পুরোহিত মশাই, নীল চোখের মেম চোখ পিটপিট করে বোঝার চেষ্টা করতে করতে, কী বুঝল কে জানে, হেসে বলল ‘ওহ্‌, নটি’। অন‌্য কোনও গূঢ় ইঙ্গিত বুঝে ‘নটি’ বলেছিল, নাকি গিঁট-এর ইংরিজি প্রতিশব্দ ‘নট’ ভেবে ‘নটি’ বলেছিল জানি না আজও। তবে এই পুরোহিত মশাই সহাস‌্য ‘নটি’ শব্দটি উপেক্ষা করে বলেছিলেন, ‘ইনডিয়ান ম‌্যারেজ ইজ গ্রেট। সেভেন পাক মিন্‌স একদম টাইট ব‌্যান্ডেজ ফর এভার। সেভেন পাক কমপ্লিট মিনস ইউ আর এমন টাইট যে নো-বডি ক‌্যান সেপারেট। সো রাউন্ড রাউন্ড। থ্রি পাক কমপ্লিট, নাও ফোর…।’

এই পুরুতমশাই সুযোগ পেলেই একটু আধ‌্যাত্মিক জ্ঞান প্রদান করেন– সেটা আগেই দেখেছি। এখন বন্ধু সুবোধের সরল প্রশ্নের উত্তরে আত্মার তাত্ত্বিক ব‌্যাখ‌্যা করতে গিয়ে ফট করে গীতার শ্লোক বলে ফেললেন– ‘নৈনং ছিন্দতি শস্ত্রানি নৈনং দহতি পাবকঃ/ ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত‌্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ। মানে কোনও অস্ত্র দ্বারা আত্মাকে ছিন্ন করা যায় না, আগুনে দগ্ধ করা যায় না, জলে ভিজানো যায় না, বাতাসে শুকনা করা যায় না– বুঝলেন! আত্মা এমন জিনিস! টমেটু সস দিলেন বা না-দিলেন তাতে আপনার পিতার আত্মার কিচ্ছু যায় আসে না।’

সুবোধ বলল, “তাহলে এই ভাতের দলাটুকু না-দিলেও বাবার আত্মার কিচ্ছু যেত আসত না। এই যে তামার চামচটা দিয়ে ‘ইদম উদকং’ বলে জল দিচ্ছি, সেটাও তো না-দিলেই চলত। যে আত্মাকে কাটা যায় না, ছেঁড়া যায় না, পোড়ানো যায় না, সেই আত্মা তো খিদে-তেষ্টার বাইরে।”

পুরোহিত মশাই বললেন, ‘সেটা মিথ‌্যা নয়। তবে কী, শাস্ত্রে আছে মৃত‌্যুর পর জীবাত্মা কিছুকাল সূক্ষ্ম শরীরে অবস্থান করে। এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের পর তিনি তার সূক্ষ্ম শরীর থেকে উদ্ধার পাবেন এবং বায়বীয় আত্মাতে পরিণত হবেন। সূক্ষ্ম শরীরের ক্ষুধা-তৃষ্ণা আছে, আর সে কারণেই তো শ্রাদ্ধ-শান্তির বিধান।’ সুবোধ বলল, ‘সূক্ষ্ম শরীরটা কতটা সূক্ষ্ম? মানে, সাইজ কত?’ পুরোহিত মশাই এবার একটু রেগে গেলেন।

–কী অবোধ অর্বাচীনের মতো কথা কইতেছেন? আমি কি সূক্ষ্ম শরীর দেখেছি নাকি যে ছাই কমু? সূক্ষ্ম শরীর কি দেখা যায়?

সুবোধ বলল, “যদি দেখেননি তো পিণ্ডর সাইজ কী করে ঠিক করলেন? যখন পিণ্ডর সাইজটা বড় করলাম, আপনি বললেন, ‘এত বড় নয়, ছোট কর।’ সাইজ দেখিয়ে দিলেন।”

পুরোহিত মশাই বললেন, ‘বড় আজাইল‌্যা প‌্যাঁচাল করেন। এ তো মহা মুশকিল? আত্মা কি জুতা নাকি যে পায়ের সাইজে ঢুকে?’

সুবোধ পুরোহিতকে সংশোধন করে দেয়– ‘আত্মা নয় ঠাকুরমশাই, সূক্ষ্ম শরীর।’

–হ। প্রায় একই হইল। সূক্ষ্ম শরীরের কি মুখ আছে না দাঁত আছে যে, মুখে ঢুকাইয়া খাইবে? একবার দর্শনেই তার তৃপ্তি।
–দর্শন করতে গেলে তো চোখ থাকা দরকার। সূক্ষ্ম শরীরের তাহলে চোখ আছে। চোখ যদি থাকে তবে নাকও আছে। নাক যদি থাকে তো জিভও থাকতে পারে, যদিও সবই সূক্ষ্ম।

পুরোহিত মশাইকে বেশ নার্ভাস লাগছিল। চারিদিকে শূন‌্য দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন– ‘দ‌্যাখেন সুবোধবাবু, সবই আমাদের নিজেদের শান্তির জন‌্য। আত্মার কী শান্তি হয় সেটা জানা অসম্ভব।’ সুবোধ পুরোহিতের কথা কেড়ে নিয়ে বলল– ‘জানতে পারব যখন আমি আত্মা হব। তার আগে যেহেতু জানতে পারছি না, তাহলে নিজেদের মনের শান্তির জন‌্যই তো এসব, তাই তো?’

………………………..

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার.ইন

………………………..

পুরোহিত মশাই উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, ‘ধুত্তেরি, ভাল্লাগে না। পিণ্ডের উপর একটু টমেটুর সস দিবেন, এই তো? ঢালেন, বোতল আনেন।’

‘কোনও মন্ত্র আছে?’ শিশুর মতো প্রশ্ন করে সুবোধ।

কড়া জবাব– ‘না, নাই। আপনি ঢালেন।’

সত‌্যিই সাদা পিণ্ডর উপর টমেটোর সস ঢালে সুবোধ। তারপর বলে, ‘ধূপকাঠি তো জ্বলছে, দুটো সিগারেটও জ্বালিয়ে দিই। ভাত খাবার পর বাবার সিগারেট খাবার অভ‌্যেস ছিল। যেদিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন, তার আগের দিনও দুপুরে ভাত খাবার পর…’

পুরোহিত বললেন– ‘করেন, যা খুশি করেন!’

…পড়ুন ব্লটিং পেপার-এর অন্যান্য পর্ব…

২৩. হীনম্মন্য বাঙালি সমাজে শব্দের প্রমোশন হয় মূলত ইংরেজি বা হিন্দিতে

২২. গন্ধটা খুব সন্দেহজনক!

২১. বাঙালির বাজার সফর মানেই ঘ্রাণেন অর্ধভোজনম

২০. জাত গেল জাত গেল বলে পোলিও খাব না!

১৯: ধোঁয়া আর শব্দেই বুঝে গেছি আট-তিন-পাঁচ-দেড়-দেড়!

১৮: নামের আগেপিছে ঘুরি মিছেমিছে

১৭: টরে টক্কার শূন্য এবং ড্যাশের সমাহারে ব্যাঙের ‘গ্যাগর গ্যাং’ও অনুবাদ করে নিতে পারতাম

১৬: ছদ্মবেশী পাগলের ভিড়ে আসল পাগলরা হারিয়ে গেল

১৫. ধূমপান নিষেধের নিয়ম বদলান, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরকে বলেছিলেন ঋত্বিক ঘটক

১৪. এমএলএ, এমপি-র টিকিট ফ্রি, আর কবির বেলা?

১৩. ভারত কিন্তু আম-আদমির

১২. ‘গাঁধী ভগোয়ান’ নাকি ‘বিরসা ভগোয়ানের পহেলা অবতার’

১১. কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্টের চক্করে বাঙালি আর ভোরবেলা হোটেল থেকে রওনা দেয় না

১০. জনতা স্টোভ, জনতা বাসন

৯. রামেও আছি, রোস্টেও আছি!

৮. বাঘ ফিরেছে বাগবাজারে!

৭. রেডিওর যত ‘উশ্চারণ’ বিধি

৬.হৃদয়ে লেখো নাম

৫. তিনটে-ছ’টা-ন’টা মানেই সিঙ্গল স্ক্রিন, দশটা-পাঁচটা যেমন অফিসবাবু

৪. রাধার কাছে যেতে যে শরম লাগে কৃষ্ণের, তা তো রঙেরই জন্য

৩. ফেরিওয়ালা শব্দটা এসেছে ফার্সি শব্দ ‘ফির’ থেকে, কিন্তু কিছু ফেরিওয়ালা চিরতরে হারিয়ে গেল

২. নাইলন শাড়ি পাইলট পেন/ উত্তমের পকেটে সুচিত্রা সেন

১. যে গান ট্রেনের ভিখারি গায়কদের গলায় চলে আসে, বুঝতে হবে সেই গানই কালজয়ী