জ্যোৎস্নার মতো ধবল গাত্র বর্ণ, দক্ষিণ হস্তে ছোট এক ছুরি, বাম হস্তে রুধির পাত্র, মুখে স্মিতহাস্য, পদতলে কালভৈরব ও বিরূপাক্ষ, দেবীর বাম পদ সেই বিরূপাক্ষের মাথার ওপর, আর দক্ষিণ পদ কালভৈরবের বক্ষ স্পর্শ করা। রাজা সদানন্দ আনন্দে আত্মহারা হলেন। দেবী তাঁকে আদেশ করলেন তাঁর মূর্তি গড়ে, মন্দির বানিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে। ইনিই দেবী রাজবল্লভী, রাজবলহাটের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
১৬.
ভুরশুট পরগনায় ছিল একসময় ছিল এক বাগদি রাজা, অত্যাচারী ও লুঠেরা। তাঁর রাজকোষ পূর্ণ হত লুঠের অর্থে, তাই আর রাজস্ব আদায়ের বালাই ছিল না। তবে সে ছিল কালীভক্ত। প্রতি রাতেই দেবীকে পুজো দিয়ে সে বের হত ডাকাতি করতে। প্রতি অমাবস্যার রাতে দেবীর সামনে নরবলি দিতেই হবে, এই ছিল তার নীতি। আশপাশের গ্রাম থেকে ধরে আনত কিশোর বালক, বলি দিত নিজের হাতে। এভাবেই একসময় ধরা পড়ে এক ব্রাহ্মণ-তনয়, অতি সুলক্ষণযুক্ত। সেই রাজা, শনি ভাঙড়, তাই ভারী খুশি, দেবী তৃপ্ত হবেন সুলক্ষণ কিশোরের অপাপবিদ্ধ শোণিতে, পূরণ করবেন অভীষ্ট। শনি ভাঙড়ের গুরুদেব কিন্তু ছেলেটিকে দেখেই অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ হয়ে পড়েন, এমন সুলক্ষণযুক্ত, কপালে তার রাজটীকা স্পষ্ট, তাকে কি না বলি দেওয়া হবে, বেঁকে বসলেন তিনি, শনিকে নিষেধ করলেন। গুরুর আদেশ মানতেই হল। কিশোর রক্ষা পেল, আর গুরু তাকে আপন আশ্রয়ে নিয়ে অস্ত্র, শাস্ত্র আরও নানা বিদ্যায় শিক্ষিত করে তুললেন। শনি ভাঙড়কে স্থানীয়েরা আদৌ পছন্দ করত না, তারা সবাই মিলে ষড়যন্ত্র করে এক রাতে দেবীর কাছে গুরুদেবের নির্দেশে বলি দিয়ে দিল। রাজা হলেন সেই ধরে আনা কিশোর, যার নাম ছিল চতুরানন। তত দিনে সে সাবালক এবং রাজকার্যে সুদক্ষ। ক্রমে সে তার রাজধানী স্থাপন করে অধুনা হাওড়া জেলার ভবানীপুরে। গোটা রাজধানী পরিখা বা গড় দিয়ে ঘিরে ফেলায় এলাকার নাম হয়ে যায় গড়ভবানীপুর।
১৯৪০ সালে পূর্ববঙ্গ রেলপথ কর্তৃপক্ষ ‘বাংলায় ভ্রমণ’ নামে এক অসাধারণ সংকলন প্রকাশ করেছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে জুড়ে থাকা রেলপথের ধারে ধারে যে ইতিহাস, তা রয়েছে ওই সংকলনে। হাওড়া-আমতা ও হাওড়া-শিয়াখালা লাইট রেলওয়ে অংশে রয়েছে ভুরশুট পরগনার কথা। সেই বিবরণ অনুযায়ী, হাওড়ার ঘাট থেকে ১৯ মাইল দূরে মুন্সিরহাট, এককালের বিখ্যাত বাণিজ্যকেন্দ্র। তার থেকে আবার ৫ মাইল দূরে পেঁড়োবাব পাণ্ডুয়া। ‘আদিশূর বংশীয় যামিনী শূর যখন অপার মন্দারের (বর্তমান গড়মন্দারণ) রাজা, তখন ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের কায়স্থ রাজা পাণ্ডুদাস তাঁহার সামন্ত নৃপতি ছিলেন। তাঁর নাম থেকেই পাণ্ডুয়া হয়’। আরও লেখা আছে, ‘তৎকালে ভুরিশ্রেষ্ঠ রাজ্য হাওড়া, হুগলী ও মেদিনীপুর জেলার কিয়দংশ লইয়া গঠিত ছিল, এবং বহু শাস্ত্রজ্ঞ, পণ্ডিত ও ধনী বণিক বা শ্রেষ্ঠীর আবাসস্থল ছিল। ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠীদিগের বাসস্থান বলিয়া ইহার নাম ভুরিশ্রেষ্ঠ হয়। বর্ত্তমানে ইহা ভুরশুট বা ভুরশো নামে পরিচিত’।
রাজা পাণ্ডুদাস সম্পর্কেও বেশ কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য জানা যায়, যেমন তিনি ছিলেন ধার্মিক ও বিদ্যোৎসাহী। দশম শতাব্দীতে চান্দোলরাজ যশোবর্মা মিথিলা ও গৌড় জয় করেন। তাঁর সভাকবি কৃষ্ণ মিশ্র লিখেছিলেন প্রবোধচন্দ্রোয় নাটক, সেই নাটকে তিনি ভুরশুট পরগনার অনেক সুখ্যাতি করেন। এই পাণ্ডুদাসের উত্তর পুরুষের দুর্বলতার সুযোগেই শনি ভাঙড় সেই রাজ্য অধিকার করে নেন। তাঁর রাজধানীর নামটি কিন্তু খুবই আকর্ষণীয় ছিল, ‘দিল আকাশ’।
………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………..
এরপরের ইতিহাস ইতিমধ্যেই বলা হয়ে গেছে। বলার বিশেষ কথা চতুরাননই ভুরশুট পরগনায় ব্রাহ্মণ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জামাই সদানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। সদানন্দের বসত ছিল নদীয়া জেলায় ফুলিয়া গ্রামে, যে গ্রাম বাংলায় রামায়ণের রচয়িতা কৃত্তিবাস ওঝার জন্য বিখ্যাত। বস্তুত, সদানন্দ ওই বংশেরই সন্তান। দীর্ঘদিন সদানন্দের বংশ পাণ্ডুয়া এবং গড়ভবানীপুরে রাজত্ব করেছে। শেষে মুর্শিদকুলি খাঁয়ের সময়ে বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্র গড়ভবানীপুর থেকে ওই বংশীয় রাজা লক্ষ্মীনারায়ণকে তাড়িয়ে রাজা হয়ে বসেন। আর পাণ্ডুয়া বা পেঁড়োর শেষ রাজা নরেন্দ্রনারায়ণেরই ছেলে বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর। বহু চেষ্টা করেও তিনি বর্ধমানের রাজাদের কবল থেকে পিতৃপুরুষের হৃত সম্পত্তি উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়ে, প্রথমে চন্দননগরের বিখ্যাত ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, তারপরে কৃষ্ণনগরের রাজা মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি হিসেবে জীবন ধারণ করেন।
সদানন্দের কথায় ফেরা যাক। সদানন্দ একদা শিকারে গেলেন, সারাদিন প্রচুর পরিমাণে হরিণ, বুনো শুয়োর শিকার করে, নানা আমোদে পাত্রমিত্র নিয়ে রাতে ফিরে এলেন। কিন্ত সেই রাতে হঠাৎই তাঁর মনে তীব্র অনুশোচনা জন্মাল, ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে পাশবিক বৃত্তির শিকার হয়ে এত রক্তপাত ঘটিয়ে ফেলেছেন, ব্রাহ্মণের আদর্শ ক্ষমা, হিতসাধন, সেই ধর্ম থেকে তিনি বিচ্যুত হয়েছেন! মনস্তাপে জর্জরিত হয়ে রাজপাট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে গুরু আদেশ প্রার্থনা করতে গেলেন। শিষ্যের মনের ব্যথা বুঝলেন গুরু রামরাঘব ভট্টচার্য। তিনি তাঁর মানসিক শান্তির জন্য দীক্ষা দানের ব্যবস্থা করলেন, তান্ত্রিক মতে শক্তি মন্ত্রে দীক্ষা দিলেন, শিখিয়ে দিলেন সাধন পদ্ধতি। আর আদেশ করলেন প্রজাহিতকর কর্মে রাজ্য শাসন করতে। যুগপৎ চলতে লাগল রাজার ধর্ম ও কর্ম সাধনা। অবশেষে শব সাধনায় সিদ্ধ হলেন রাজা, দেবী দর্শন দিলেন তাঁর সকাশে। অপূর্ব সে মূর্তি। জ্যোৎস্নার মতো ধবল গাত্র বর্ণ, দক্ষিণ হস্তে ছোট এক ছুরি, বাম হস্তে রুধির পাত্র, মুখে স্মিতহাস্য, পদতলে কালভৈরব ও বিরূপাক্ষ, দেবীর বাম পদ সেই বিরূপাক্ষের মাথার ওপর, আর দক্ষিণ পদ কালভৈরবের বক্ষ স্পর্শ করা। সদানন্দ আনন্দে আত্মহারা হলেন। দেবী তাঁকে আদেশ করলেন তাঁর মূর্তি গড়ে, মন্দির বানিয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে। ইনিই দেবী রাজবল্লভী, রাজবলহাটের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সরস্বতী নদী দিয়ে যেতে যেতে এক বণিকের পণ্য বোঝাই নৌকাখানি হঠাৎ ডুবে যায়। বণিক আকুল হয়ে উদ্ধারের জন্য ইষ্টদেবীকে স্মরণ করলে দেবী রাজবল্লভী ওই বিশেষ মূর্তিতে দর্শন দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করেন। নৌকাখানি ভেসে ওঠে, পণ্যের কোনও ক্ষতি হয়নি। সেই বণিকই নাকি দেবীর মন্দির বানিয়ে ওই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গঙ্গামাটি দিয়ে তৈরি ওই মূর্তিখানি ১২-১৪ বছর পরপর নতুন করে বানানো হয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে দেবীর আবির্ভাব ও মূর্তি তথা মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে আরেকটি কাহিনিও প্রচলিত। সরস্বতী নদী দিয়ে যেতে যেতে এক বণিকের পণ্য বোঝাই নৌকাখানি হঠাৎ ডুবে যায়। বণিক আকুল হয়ে উদ্ধারের জন্য ইষ্টদেবীকে স্মরণ করলে দেবী রাজবল্লভী ওই বিশেষ মূর্তিতে দর্শন দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করেন। নৌকাখানি ভেসে ওঠে, পণ্যের কোনও ক্ষতি হয়নি। সেই বণিকই নাকি দেবীর মন্দির বানিয়ে ওই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। গঙ্গামাটি দিয়ে তৈরি ওই মূর্তিখানি ১২-১৪ বছর পরপর নতুন করে বানানো হয়। দেবীর কাছে নিত্য অসংখ্য ভক্ত দূরদূরান্ত থেকে নানা প্রার্থনা নিয়ে ছুটে আসেন, রয়েছে প্রশস্ত নাটমন্দির। এখানে দেবীর ধ্যানমন্ত্রখানি গোপনীয়, পুরোহিত ভিন্ন কেউ তা শোনার অধিকারী নয়, যদিও কলকাতার শোভাবাজার গঙ্গার ঘাটের কাছে অনুরূপ এক শ্বেতকালী প্রতিষ্ঠিত আছেন। তাঁর ধ্যানমন্ত্র প্রকাশ্যে উচ্চারিত হয়। আদিতে সেই মূর্তির পূজা নাকি ডাকাতের দল করত, পরে ক্রমে ডাকাতের দল চলে গেলেও দেবীমূর্তি রয়ে গেছে এবং আজও তিনি পূজিতা। মন্দিরের মাথার দিকে লিপিতে লেখা ‘শ্রী শ্রী রাজবল্লভী মাতা। স্থাপিত: ১১৩৫ সাল। পুনঃসংকার। অবিনাশ দত্ত। তস্য পুত্র পশুপতিনাথ দত্ত। সেবায়েত অক্ষয় কুমার বন্দোপাধ্যায়’ ইত্যাদি।
রাজবলহাটে দেবী পুজোর নির্ঘণ্ট মানা হয় জলঘড়ির সাহায্যে। ওই মন্দিরের কর্মী জানিয়েছিলেন, সন্ধিপূজার সময় গাছে গাছে মশালজ্বেলে সংকেত দেওয়া হত দূরদূরান্ত পর্যন্ত। মন্দিরের সামনের দিকে এক বিশাল দিঘি, সেই দিঘিতে প্রতিদিন মাছ ধরা হয়ে থাকে, আর দেবীর ভোগে সেই মাছ দিতেই হয়। ভক্তেরা ভাতের সঙ্গে মাছের তরকারি প্রসাদ হিসেবে পেয়ে থাকেন। মাতৃমন্দিরে ভক্তেরা তাঁদের নিজেদের বাগানের শাকসবজি নিয়ে পুজো দিয়ে থাকেন, এছাড়া, এক সময় ভক্তের আনা সামান্য চালের বিনিময়েও তাদের প্রসাদ দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পাশাপাশি সামান্য অর্থের বিনিময়েও প্রত্যেকদিন অসংখ্য ভক্ত মায়ের প্রসাদ পেয়ে থাকেন।
কালী সম্পর্কে বলা হয়, তিনি কালকে কলন করেন, মহাকাল তাই তাঁর পদতলে, সেই কারণেই তিনি কৃষ্ণবর্ণা। কিন্তু সেই কালী আবার স্বত্ত্বগুণের প্রকাশিকা, তখন তিনি শ্বেতবরণ। মনে পড়ে যায়, কমলাকান্তের সেই বিখ্যাত গান, ‘(শ্যামা) কখনো শ্বেত, কখনো পীত, কখনো নীল লোহিত রে, শ্যামা মা কি আমার কালো রে’। সত্যিই তাই, দেবীর কত কত রূপ যে সাধকেরা দেখেছেন, কল্পনা করেছেন তার সন্ধান শুধু তাঁরাই করতে পারেন। প্রতিদিন কত আর্তি, প্রার্থনা দেবদেবীদের মন্দিরে মন্দিরে নিয়ে যারা আসেন, তাদের নয়ন ধন্য হয় অনন্তরূপধারীদের রূপবৈচিত্র দর্শন করে।
(চলবে)
…পড়ুন তীর্থের ঝাঁক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৫। যে দেবীর পুজোর নির্ঘণ্ট ঠিক করা হয় জলঘড়ির সাহায্যে
পর্ব ১৪। সারা বছর দেবী থাকেন জলের তলায়, পুজো পান কেবল বৈশাখের সংক্রান্তিতে
পর্ব ১৩। দ্বিধাগ্রস্ত বিবেকানন্দকে পথ দেখিয়েছিল যে কন্যাকুমারী
পর্ব ১২। রানি অহল্যাবাইয়ের উদ্যোগে পুনর্নির্মাণ ঘটে বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরের
পর্ব ১১। বৈজু গোয়ালা যেভাবে পেয়েছিল শিবের দর্শন
পর্ব ১০। নবদ্বীপ বরাবর সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র, সেই সমাহার আজও বর্তমান
পর্ব ৯। দেবী কামাখ্যার পুজোর নেপথ্যে রয়েছে আদিবাসীদের কৃষিকাজের উৎসব
পর্ব ৮। শতবর্ষ আগে বাংলার প্রথম সত্যাগ্রহ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তারকেশ্বর মন্দিরকে ঘিরে
পর্ব ৭। বামাক্ষ্যাপার টানে তারাপীঠে এসেছিলেন বিবেকানন্দ, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ
পর্ব ৬। তান্ত্রিক, কাপালিক এবং ডাকাতদের থেকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কালীঘাটে পুজো দিতেন যাত্রীরা
পর্ব ৫। কপিলমুনির আশ্রম খুঁজে না পেয়ে ‘শতমুখী’ হয়েছিল গঙ্গা
পর্ব ৪। কোন উপায়ে লুপ্ত বৃন্দাবনকে ভরিয়ে তুললেন রূপ-সনাতন?
পর্ব ৩। পুত্র রাম-লক্ষ্মণ বিদ্যমান থাকতেও পুত্রবধূ সীতা দশরথের পিণ্ডদান করেছিলেন গয়ায়
পর্ব ২। এককালে শবররা ছিল ওড়িশার রাজা, তাদের নিয়ন্ত্রণেই পুজো পেতেন জগন্নাথদেব
পর্ব ১। ছোটবেলায় ছবি দেখেই কাশীধামে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন ম্যাক্সমুলার সাহেব