ভারত ছিল আমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা একটা দেশ। অচেনা-অজানা বিদেশবিভূঁই বলেই হয়তো ভারত আমার কাছে ভীষণ কৌতূহলের একটি জায়গা ছিল। এখনকার দিন হলে যেরকম ইন্টারনেট ঘেঁটে সব কিছু জেনে নিতে পারতাম, ’৯৯-এ প্রযুক্তির এত উন্নতি ঘটেনি। ইন্টারনেট ব্যবহারও এখনকার মতো ছিল না সেই সময়। তবুও কলকাতায় পা দেওয়ার আগে যেটুকু জানলাম, তা হল, মোহনবাগান ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাব।
২.
একজন ফুটবলারের জীবনে সাফল্যই শেষ কথা। কিন্তু সাফল্য কীভাবে আসবে? তা তো পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা নয়। যে পথে সাফল্য, সে পথ বন্ধুর। সে পথ পরীক্ষা নেয়। সে পরীক্ষায় মূল বিষয় দু’খানা– শৃঙ্খলা ও সংযম। যদিও সঙ্গে আরও অনেক বিষয়। আমি সেই শিক্ষা পেয়েছি। জীবনের নানা অভিজ্ঞতাই আমাকে পড়িয়েছে এই দুই বিষয়।
তবু, এখন বলতে দ্বিধা নেই, কেরিয়ারের শুরুর দিকে সাফল্যের খিদে থাকলেও, শৃঙ্খলাবোধ কিংবা সংযম– এই দু’য়ের সঙ্গে আমার তেমন কোনও যোগাযোগ ছিল না। গত পর্বে, আপনাদের তো জানিয়েইছি, ম্যাচের আগের দিন সতীর্থের সঙ্গে পানশালায় মদ্যপান আর নৈশপার্টি করায় ক্লাব থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল আমাদের। ভারতীয় ফুটবলের অনুরাগীরা, যাঁরা আমাকে এত ভালোবাসেন, তাঁরা হয়তো কোনও দিন বিশ্বাস করতে পারবেন না, আমার এই ফেলে আসা অন্ধকার জীবনকে। অথচ একটা সময় আমি এরকমই ছিলাম। আর আমার আফসোস সেটাই।
যদি আর একটু সিরিয়াস হতাম, তাহলে হয়তো ব্রাজিলের জাতীয় দলের জার্সিটা পরে ফেলতে পারতাম। অন্য উচ্চতায় পৌঁছত আমার ফুটবল কেরিয়ার। অবশ্য তাহলে কি আর ভারতে খেলতে আসা হত? জানি না।
যাই হোক, ক্লাব থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর গ্রেমিও-তে ফেরা ছাড়া আমার আর দ্বিতীয় কোনও উপায় ছিল না। তাই করলামও। গ্রেমিও-তে ফিরে এলাম। তার আগে ভাস্কোর একটি ক্লাবে খেলে ফেলেছি। মোহনবাগান জার্সিতে যাঁরা আমাকে স্ট্রাইকার হিসেবে খেলতে দেখেছেন, তাঁদের পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন যে, আমি তখনও পর্যন্ত কোনও দিন স্ট্রাইকারেই খেলিনি! খেলতাম উইঙ্গার পজিশনে। তখন ছিপছিপে চেহারা আমার। উইং থেকে উড়তাম ঠিক পাখির মতো।
গ্রেমিও-তে ফেরার পর নতুন একটা ঘটনা ঘটল। ব্রাজিলের একজন ফুটবল এজেন্ট, ভারতের এক ফুটবল এজেন্টের সঙ্গে কথাবার্তার পর আমাকে জানায়– ভারতের সবচেয়ে বড় ফুটবল ক্লাব একজন বিদেশি ফুটবলার চাইছে। সেই সূত্র ধরেই আমার এজেন্ট মোহনবাগান ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ধীরে ধীরে দু’পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়। তবে মোহনবাগানে যোগ দেওয়ার আগের পর্ব অনেক ঘটনাবহুল। আমার জীবন কীভাবে বদলে গেল, সেটা আমার ফ্যানদের জানা ভীষণই জরুরি। সেই নেপথ্য কাহিনি বলতেই এই ‘তোতাকাহিনি’-র কলম ধরা।
পোর্তো আলেগ্রে-তে তখন আমার জীবনে বান্ধবী হিসেবে এসেছে ভেরোনিকা। ভেরোনিকার সংস্পর্শে আসার পর জীবনটাই গেল পাল্টে। একেবারে এপিঠ-ওপিঠ। সেই উদ্দাম, সারারাত পার্টিতে মেতে থাকা ব্যারেটো উধাও। উধাও আমার অসংযমী, শৃঙ্খলাহীন উড়ে বেড়ানো। জীবনটা আরও বদলে গেল ক্যাথলিক থেকে প্রটেস্ট্যান্ট হওয়ার পর। প্রতিদিন নিয়ম করে বাইবেল পড়তে শুরু করলাম। কোনও সামুদ্রিক উদ্দাম ঢেউ নয়, নদীর নীরব স্রোতই হয়ে উঠল আমার জীবন। নাইট ক্লাব বন্ধ। বন্ধ মদ্যপান। জীবন তখন সমর্পিত যিশুর পায়ে। ঠিক এই সময়েই ভারতে ফুটবল খেলার প্রস্তাব এল। পুরো ঘটনাটা কীভাবে ঘটল, সেই কথায় আসি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এ-কথা, ও-কথায় মোহনবাগান কর্তারা সালগাঁওকরের প্র্যাকটিসে থাকা ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকারকে দেখিয়ে বলেছিলেন, এরকম একজন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড মোহনবাগানের জন্য সে এনে দিতে পারবে কি-না? এজেন্ট জানিয়েছিল, পারবে। আর তারপরেই ব্রাজিলে আমার এজেন্টের সঙ্গে তড়িঘড়ি যোগাযোগ করে সে। এরপর তল্পিতল্পা নিয়ে আমার ভারত-যাত্রা। মানে, কলকাতায় পদার্পণ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নাম স্পষ্ট মনে নেই, তবে আমার ভারতের আসার সময় গোয়ার সালগাঁওকরে একজন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার ছিল, যার খেলা মোহনবাগান কর্তাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল। ব্রাজিলে আমার এজেন্টের কাছ থেকে তেমনটাই শুনেছিলাম। এজেন্টের মুখেই শোনা, সেই সময় মোহনবাগান ডুরান্ড কাপ খেলতে দিল্লি গিয়েছিল। একদিন আম্বেদকর স্টেডিয়ামে, একই সময়ে মাঠের দুই দিকে মোহনবাগান আর সালগাঁওকরের প্র্যাকটিস চলছে। টিমের প্র্যাকটিস দেখতে গ্যালারিতে উপস্থিত তখন মোহনবাগান কর্তা অঞ্জন মিত্র আর দেবাশিস দত্ত। ওঁরা নিজেদের প্র্যাকটিস দেখার পাশাপাশি মাঠের উল্টোদিকে সালগাঁওকরের প্র্যাকটিসেও নজর রেখেছিলেন।
নজরটা আরও বেশি করে কেড়ে নিচ্ছিল সালগাঁওকরের প্র্যাকটিসে থাকা সেই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার। পায়ের জাদুতে পুরো প্র্যাকটিস একাই মাতিয়ে রেখেছিল। ওর টিমের প্লেয়াররা হিমশিম খাচ্ছিল ওকে সামলাতে। এককথায় প্রত্যেকেই ব্রাজিলিয়ান প্লেয়ারের স্কিল দেখে মন্ত্রমুগ্ধ! সেই ফুটবলারটির ব্রাজিলিয়ান এজেন্টও তখন হাজির ছিল আম্বেদকরের গ্যালারিতে। মোহনবাগান যে তখন বিদেশি ফুটবলার খুঁজছে, সেই কথা কানে গিয়েছিল ওই ফুটবল-এজেন্টেরও। কথায় কথায় তার সঙ্গে আলাপ জমে গিয়েছিল গ্যালারিতে থাকা অঞ্জন মিত্র আর দেবাশিস দত্তর সঙ্গে। এ-কথা, ও-কথায় মোহনবাগান কর্তারা সালগাঁওকরের প্র্যাকটিসে থাকা ব্রাজিলিয়ান স্ট্রাইকারকে দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এরকম একজন ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ড মোহনবাগানের জন্য এনে দিতে পারবে?’ এজেন্ট জানিয়েছিল, পারবে।
আর তারপরেই ব্রাজিলে আমার এজেন্টের সঙ্গে তড়িঘড়ি যোগাযোগ। তল্পিতল্পা-সহ আমার ভারত-যাত্রা। কলকাতায় পদার্পণ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আগে এশিয়া বলতে একমাত্র জাপানে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল। তার সঙ্গে ভারতের কোনও সম্পর্কই নেই! সে-দিক থেকে ভারত ছিল আমার কাছে সম্পূর্ণ অচেনা একটা দেশ। অচেনা-অজানা বিদেশবিভূঁই বলেই হয়তো ভারত আমার কাছে ভীষণ কৌতূহলের একটি জায়গা ছিল। এখনকার দিন হলে যেরকম ইন্টারনেট ঘেঁটে সব কিছু জেনে নিতে পারতাম, ’৯৯-এ প্রযুক্তির তো এত উন্নতি ঘটেনি। ইন্টারনেট ব্যবহারও এখনকার মতো ছিল না। তবুও কলকাতায় পা দেওয়ার আগে যেটুকু জানলাম, তা হল, মোহনবাগান ভারতীয় ফুটবলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাব। দেশের সেরা ফুটবলাররা মুখিয়ে থাকে মোহনবাগানের সবুজ-মেরুন জার্সি গায়ে চাপানোর জন্য। আর যে দলটায় খেলার জন্য যাচ্ছি, তা সেই মুহূর্তে জাতীয় লিগে বোধহয় লিগ টেবিলের পাঁচ নম্বরে রয়েছে।
শুরুতে জানতাম, কলকাতায় গিয়ে সরাসরি সই করব মোহনবাগানে। তারপর খেলা শুরু করে দেব। কিন্তু পরে জানতে পারলাম, মোহনবাগান কোচ আমাকে একবার ট্রায়ালে দেখে তবেই সই করাবেন! সেই সময় আমি জাস্ট উড়ছি। ভারতীয় ফুটবলে গিয়ে আমাকে ট্রায়াল দিয়ে জায়গা পেতে হবে– এই ভাবনা মাথাতেই ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটা যেহেতু আমার জন্য জাস্ট জলভাত পর্যায়ের, তাই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম ট্রায়াল দিতে। ভাবলাম, কোচ ট্রায়ালে দেখতে চেয়েছেন, তাতে সমস্যা কোথায়? যাব। মাঠে নামব। আর একদিনেই ট্রায়ালে কোচকে খুশি করে দেব। এজেন্টকে জানিয়ে দিলাম, মোহনবাগানের প্রস্তাবে আমি রাজি আমি।
পোর্তো আলেগ্রে থেকে সাও পাওলো। সাও পাওলো থেকে দুবাই। দুবাই থেকে কলকাতার ফ্লাইটে চেপে বসলাম। মনে তখন নতুন দেশ, নতুন স্বপ্ন। তখনও জানতাম না, ট্রায়ালের নামে আমার জন্য মোহনবাগানে কী অপেক্ষা করছে…।
(চলবে)
অনুলিখন: দুলাল দে