মোহনবাগানে যখন আমার সব কিছু সেট হয়ে গিয়েছে, তখন হঠাৎ করে ক্লাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে গেল। টুটু বোস, অঞ্জন মিত্র, টুম্পাই, দেবাশিসরা সরে গিয়ে ক্ষমতায় এলেন বলরাম চৌধুরি। দেবাশিস, টুম্পাইদের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকার জন্য একটা বন্ডিং তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি কিছু না বললেও আমার মুখ দেখে ওরা বুঝে যেত কী চাইছি। ওরাও কী চায় আমি বুঝে যেতাম। পারস্পরিক সম্পর্কটাই এরকম হয়ে গিয়েছিল। ফলে মোহনবাগান ছাড়ার কথা কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু হঠাৎ-ই সব বদলে গেল।
১৩.
অনেক দিন পর ফের কলকাতায় এলাম। সেটাও মাত্র একদিনের জন্য। হাতে অল্প সময়। তার মধ্যে একটা অনুষ্ঠানে যাওয়া নিয়ে এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, আলাদা করে কারও সঙ্গে আর দেখা করার সুযোগ পাইনি। কলকাতায় এসেছি শুনে শিলটন ছুটে এসেছিল। আর ডগলাস তো ছিলই।
মাত্র একদিনের সফর। পরের দিন সন্ধেবেলা যখন মুম্বই যাওয়ার জন্য কলকাতা ছাড়ছি, মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। প্রত্যেকবারই এমনটা হয়। কলকাতা থেকে যতই দূরে থাকি না কেন, এই শহর ভীষণভাবে আমারও। তাই যাওয়ার সময় মন খারাপ লাগে। এবার যাওয়ার সময় কলকাতা বিমানবন্দরে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। প্রতিবার হয় না। কিন্তু এবার হল।
মুম্বই যাওয়ার কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস নিয়ে নিয়েছি। তারপর সিকিউরিটি চেক ইন করে দেখলাম, বোর্ডিং হতে হাতে আরও মিনিট তিরিশ সময় আছে। একটা কোণে চেয়ারে কফি নিয়ে চুপ করে বসেছিলাম। মনে পড়ছিল পুরনো দিনের কথা। একটা দিন এই কলকাতা ছেড়ে কী ভয়ে ভয়েই না চলে গিয়েছিলাম। তখন অবশ্য এতটা ঝাঁ-চকচকে ছিল না কলকাতা বিমানবন্দর। কেউ যাতে ঘুণাক্ষরে টের না পায়, তাই চুপিসারে মধ্যরাতে শহর ছেড়েছিলাম। সেদিনও কলকাতা ছাড়ার আগে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।
মোহনবাগানে যখন আমার সব কিছু সেট হয়ে গিয়েছে, তখন হঠাৎ করে ক্লাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে গেল। টুটু বোস, অঞ্জন মিত্র, টুম্পাই, দেবাশিসরা সরে গিয়ে ক্ষমতায় এলেন বলরাম চৌধুরি। দেবাশিস, টুম্পাইদের সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকার জন্য একটা বন্ডিং তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি কিছু না বললেও আমার মুখ দেখে ওরা বুঝে যেত কী চাইছি। ওরাও কী চায় আমি বুঝতে পারতাম। পারস্পরিক সম্পর্কটা এরকম হয়ে গিয়েছিল। ফলে মোহনবাগান ছাড়ার কথা কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু হঠাৎ-ই সব বদলে গেল। তখন কোচ ছিল অলোক মুখার্জি। সত্য (সত্যজিৎ চট্টোপাধ্যায়) সম্ভবত সহকারী কোচ। অলোক ভালো মানুষ। কিন্তু সেই সময়ের ক্লাবের বা টিমের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার মতো জায়গায় ছিল না।
বলরাম চৌধুরি যখন ফুটবল টিম চালাতে শুরু করলেন, বিশ্বাস করুন, আমার কোনও সমস্যা ছিল না। আমি এভাবেই দেখতাম, ক্লাবে এখন নতুন অফিশিয়াল। আর আমি একজন চুক্তিবদ্ধ পেশাদার ফুটবলার। সেই সময় আমাদের সঙ্গে আরেক ব্রাজিলিয়ান মার্কোসও ছিল। আমরা তখন থাকতাম কসবার নীলাচল কমপ্লেক্সে। ডগলাস তখন ছিল ইস্টবেঙ্গলে। আইলিগের কোনও একটা ম্যাচে খেলতে গিয়ে পা ভেঙে যায়। ডগলাসও সেই সময় থাকত নীলাচল কমপ্লেক্সে। সেই সময় ঠিক কী হয়েছিল, তা নিয়ে পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে চাই না। তবুও আমার চলে যাওয়া নিয়ে দু’চার কথা না বললেই নয়।
…………………………………………..
মার্কোসের স্ত্রী তখন সন্তান-সম্ভবা। সেই অবস্থায় মার্কোসের বেতন আটকে দেওয়া হয়। তারপর হঠাৎ করেই একদিন মার্কোসকে বাদ দিয়ে বলে দেওয়া হয়েছিল, নীলাচলের ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে বেতনহীন একজন মানুষ বিদেশ-বিভুঁইয়ে কোথায় যাবে? ব্যাপারটা রীতিমতো আহত করল আমাকে। প্রতিবাদ করলাম। এরপর শুরু হল আমার সঙ্গে সমস্যা। ঠিকভাবে বেতন পাচ্ছিলাম না।
…………………………………………..
পালাবদলের পর হঠাৎ করেই দলের মধ্যে কেমন একটা গা-ছাড়া মনোভাব দেখা দিল। কেউ যেন কাউকে মানছে না। মাঠের বাইরে ছেড়ে দিন। মাঠের মধ্যেও সেভাবে ঐক্য় ছিল না। এই সময় আরও একটি ঘটনা ঘটল, যা ভীষণভাবে আমাকে আহত করে। মার্কোসের স্ত্রী তখন সন্তান-সম্ভবা। সেই অবস্থায় মার্কোসের বেতন আটকে দেওয়া হয়। তারপর হঠাৎ করেই একদিন মার্কোসকে বাদ দিয়ে বলে দেওয়া হয়েছিল, নীলাচলের ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে বেতনহীন একজন মানুষ বিদেশ-বিভুঁইয়ে কোথায় যাবে? ব্যাপারটা রীতিমতো আহত করল আমাকে। প্রতিবাদ করলাম। এরপর শুরু হল আমার সঙ্গে সমস্যা। ঠিকভাবে বেতন পাচ্ছিলাম না। অথচ প্রেসের কাছে জানানো হচ্ছিল, ক্লাব আমার জন্য চেক নিয়ে বসে আছে। আমি চাইলেই নিতে পারি। অথচ বারবার চেয়েও সেই চেক আর পাচ্ছিলাম না। ক্লাবকর্তাদের এই দ্বিচারিতা মেনে নিতে পারছিলাম না। দেবাশিসদের সময়ে কতবার এরকম হয়েছে, কোনও অগ্রিম অর্থ নিইনি। তাও কথা দিয়ে গিয়েছি, মোহনবাগানে খেলব। ক্লাবের ক্ষমতা বদলের পরও সেরকমটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখলাম, আমাকে একরকম বলা হচ্ছে। প্রেসের কাছে আরেকরকম। তার ওপর মার্কোসের সঙ্গে ঘটনাটা। সব মিলিয়ে মানসিকভাবে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম।
এর মধ্যেই গোয়াতে খেলতে গেলাম আমরা। এখন ঠিক মনে নেই গোয়ায় ঠিক ক’টা ম্যাচ ছিল। তবে একদম ভালো খেলতে পারিনি। দল হিসেবে ভীষণই খারাপ খেলেছিলাম আমরা। আসলে দলের মধ্যে সেই বোঝাপড়াটাই ছিল না। কেউ কাউকে মানত না। ম্যাচ চলাকালীন একজন জুনিয়র স্ট্রাইকারের কাছে পাস চেয়েছি। দেখলাম, অত্যন্ত বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট করল। ভাবতেই পারিনি, মোহনবাগানে কোনও জুনিয়র ফুটবলার এভাবে আমার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে! পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ক্লাবকর্তারাই আমার বিরুদ্ধে সেই প্লেয়ারটিকে বাজে ব্যবহার করার জন্য উসকে ছিলেন।
………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………….
একদিকে দলের ভালো রেজাল্ট নেই। নিজেও খোলামনে খেলতে পারছিলাম না। উপরন্তু মার্কোস ও তার সন্তান-সম্ভবা স্ত্রীর সঙ্গে কর্তারা যে ব্যবহার করেছিলেন, সেই অপমানও আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব ছিল না। দিনের পর দিন আমার বেতনও আটকে রেখেছিলেন কর্তারা। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছিল। এরকম মানসিক অবস্থায়, ভাঙা-মন নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছিলাম।
(চলবে)
অনুলিখন: দুলাল দে
…তোতাকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১২। ‘মোহনবাগান দিবস’ একজন ভারতীয় ফুটবলারের কাছে যতটা আবেগের, আমার কাছেও তাই
পর্ব ১১। ডার্বির আগের দিন ইস্টবেঙ্গল টিম হোটেলে আড্ডায় বসে গেলাম বাইচুংয়ের সঙ্গে
পর্ব ১০। ইংরেজি শেখাতে বাড়িতে আসতেন এক মোহনবাগান সমর্থক
পর্ব ৯। বারপুজোয় সমর্থকদের ভালোবাসার হাত থেকে বাঁচতে দৌড় লাগিয়েছিলাম টেন্টের দিকে
পর্ব ৮। মাঠে তো বটেই, ইয়াকুবু বাথরুমে গেলেও ফলো করবে স্যালিউ
পর্ব ৭। আর একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল জাতীয় লিগ জয়
পর্ব ৬। জাতীয় লিগের প্রথম ম্যাচেই বেঞ্চে বসে রইলাম
পর্ব ৫। আশিয়ানের আগে সুভাষ ভৌমিক প্রায়ই ফোন করত আমাকে, বোঝাত ইস্টবেঙ্গলে সই করার জন্য
পর্ব ৪। আর একটু হলেই সই করে ফেলছিলাম ইস্টবেঙ্গলে!
পর্ব ৩। মোহনবাগানের ট্রায়ালে সুব্রত আমায় রাখত দ্বিতীয় দলে
পর্ব ২। কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
পর্ব ১। ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব