Robbar

যিনি অসীম তিনি সীমার আকর হয়ে উঠেছেন ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 21, 2024 7:32 pm
  • Updated:May 21, 2024 7:32 pm  

সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর মানুষকে নিজের থেকে পৃথক করেছেন মানুষকে স্বাতন্ত্র্য দান করে। প্রকৃতি থেকেও তেমনই নিজেকে তিনি পৃথক করেছেন, নিয়ম দিয়ে। নিয়ম দিয়ে নিজেকে প্রকৃতির থেকে পৃথক করে না রাখলে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকলে, প্রকৃতির ওপর তিনি নিজের ইচ্ছাকে প্রয়োগ করতে পারতেন না।

অভীক ঘোষ

১৫.

কিছুদিন আগে আন্তর্জাতিক দাবাখেলার জগতে একজন তরুণ ভারতীয়র সাফল্যের কথা জানার পরে মনে করার চেষ্টা করছিলাম রবীন্দ্রনাথ উপাসনাগৃহের কোনও একটি অভিভাষণে দাবাখেলার প্রসঙ্গ এনেছিলেন উদাহরণ হিসেবে। খুঁজে পেলাম অভিভাষণটি, শিরোনাম ‘পার্থক্য’।

এই অভিভাষণে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর মানুষকে নিজের থেকে পৃথক করেছেন মানুষকে স্বাতন্ত্র্য দান করে। প্রকৃতি থেকেও তেমনই নিজেকে তিনি পৃথক করেছেন, নিয়ম দিয়ে। নিয়ম দিয়ে নিজেকে প্রকৃতির থেকে পৃথক করে না রাখলে, প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে থাকলে, প্রকৃতির ওপর তিনি নিজের ইচ্ছাকে প্রয়োগ করতে পারতেন না। ঈশ্বর আর প্রকৃতির এই পার্থক্যের রূপটি স্পষ্ট করতে রবীন্দ্রনাথ দাবাখেলার উল্লেখ করেছেন। বলছেন, ‘যে লোক দাবাবড়ে খেলায় নিজের ইচ্ছাকে প্রয়োগ করতে চায় সে প্রথমে নিজের ইচ্ছাকে বাধা দেয়। কেমন করে? নিয়ম রচনা করে। প্রত্যেক ঘুঁটিকে সে নিয়মে বন্ধ করে দেয়। এই যে নিয়ম, এ বস্তুত ঘুঁটির মধ্যে নেই– যে খেলবে তারই ইচ্ছার মধ্যে। ইচ্ছা নিজেই নিয়ম স্থাপন করে সেই নিয়মের উপরে নিজেকে প্রয়োগ করতে থাকে তবেই খেলা সম্ভব হয়।’

দাবাখেলার সমস্ত নিয়ম যেমন মানুষ নিজেই আরোপ করেছে, ঈশ্বরও তেমনই যেন বিশ্বজগতে জলের নিয়ম, স্থলের নিয়ম, বাতাসের নিয়ম, আলোর নিয়ম, মনের নিয়ম, এরকম নানান নিয়ম বিস্তার করে দিয়েছেন। এই নিয়মের সীমা না থাকলে তাঁর ইচ্ছা তো বেকার হয়ে যেত, কোনও কাজ পেত না। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, যিনি অসীম তিনিই সীমার আকর হয়ে উঠেছেন– কেবলমাত্র ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা। অরূপ আনন্দরূপের ইচ্ছাই আপনাকে সীমায় বেঁধেছে, রূপে বেঁধেছে।

Rabindranath Tagore birthday: On Rabindranath Tagore's birth anniversary, a reading list to remember the legend

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

প্রকৃতির সঙ্গে ঈশ্বর নিজের পার্থক্য গড়েছেন নিয়মে, মানুষের থেকে পৃথক হয়েছেন মানুষকে তার স্বাতন্ত্র্য দান করে। বয়ঃপ্রাপ্ত ছেলেকে বাপ যেমন আলাদা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘স্বতন্ত্র তহবিল’) খুলে দেন, সেরকম স্নেহের প্রকাশ এই পার্থক্যে। প্রকৃতি নিজের পার্থক্যের কথা জানে না, কিন্তু মানুষ জানে সে স্বতন্ত্র। এই মহাগৌরবের অধিকারটি সে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে।

………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….

এই চিরন্তন পার্থক্যকে যা চিরকাল অতিক্রম করে চলেছে, তা হল শক্তি। শক্তি একটি যোগ। নিয়ম-সীমার পার্থক্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে ‘তাঁর শক্তি দেশের সঙ্গে দেশান্তরের, রূপের সঙ্গে রূপান্তরের, কালের সঙ্গে কালান্তরের বহুবিচিত্র সংযোগ স্থাপন করে এক অপূর্ব বিশ্বকাব্য সৃজন করে চলেছে।’ ঠিক যেমন দাবাখেলায় সমস্ত ঘুঁটির আলাদা আলাদা নিয়মের মধ্য দিয়ে একজন খেলোয়াড়ের শক্তি খেলাটিকে একই তাৎপর্যে পরিণতি দেয়। ‘এমনি করে যিনি অসীম তিনি সীমার দ্বারাই নিজেকে ব্যক্ত করছেন, যিনি অকাল-স্বরূপ খণ্ডকালের দ্বারা তাঁর প্রকাশ চলেছে। এই পরমাশ্চর্য রহস্যকেই বিজ্ঞানশাস্ত্রে বলে পরিণামবাদ। যিনি আপনাতেই আপনি পর্যাপ্ত তিনি ক্রমের ভিতর দিয়ে নিজের ইচ্ছাকে বিচিত্ররূপে মূর্তিমান করছেন জগৎ-রচনায় করছেন, মানবসমাজের ইতিহাসে করছেন।’

প্রকৃতির সঙ্গে ঈশ্বর নিজের পার্থক্য গড়েছেন নিয়মে, মানুষের থেকে পৃথক হয়েছেন মানুষকে তার স্বাতন্ত্র্য দান করে। বয়ঃপ্রাপ্ত ছেলেকে বাপ যেমন আলাদা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘স্বতন্ত্র তহবিল’) খুলে দেন, সেরকম স্নেহের প্রকাশ এই পার্থক্যে। প্রকৃতি নিজের পার্থক্যের কথা জানে না, কিন্তু মানুষ জানে সে স্বতন্ত্র। এই মহাগৌরবের অধিকারটি সে নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে। এই স্বাতন্ত্র্য-গৌরবের অধিকার তার অহংকার। এই অহংকারের সীমা অতিক্রম করতে পারে প্রেম। প্রকৃতির মধ্যে নিয়মের সীমা যেমন পার্থক্য, আমাদের মধ্যে অহংকারের সীমাই তেমন পার্থক্য। এই সীমা স্থাপন না করলে তাঁর প্রেমের লীলা সম্ভব হত কেমন করে? তাঁর আনন্দের যে আর কোনও কাজই থাকত না।

রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘তাঁর শক্তির ক্ষেত্র হচ্ছে নিয়মবন্ধ প্রকৃতি আর তাঁর প্রেমের ক্ষেত্র হচ্ছে অহংকারবদ্ধ জীবাত্মা।’ আমাদের প্রেম সমস্ত আত্মাকে আত্মীয় করবার পথে এগোয় যখন, তখনই স্বাতন্ত্র্যের যথার্থ সার্থকতা। যিনি পরিপূর্ণ আনন্দ, অপূর্ণের দ্বারাই তিনি আপনার আনন্দলীলা বিকশিত করে তুলছেন বলেই কত দুঃখ, বেদনা, মান, অভিমান, স্বার্থ, সম্মানবোধের বন্ধুর পথ অতিক্রম করে জীব আর প্রেমের নদী প্রেমসমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। ‘প্রেমের শতদল পদ্ম অহংকারের বৃত্ত আশ্রয় করে আত্ম হত গৃহে, গৃহ হতে সমাজে, সমাজ হতে দেশে, দেশ হতে মানবে, মানব হতে বিশ্বাত্মায় ও বিশ্বাত্মা হতে পরমাত্মায় একটি একটি করে পাপড়ি খুলে দিয়ে বিকাশের লীলা সমাধান করছে।’

(চলবে)

…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ১৪। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া

পর্ব ১৩। জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতা খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

পর্ব ১২। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ

পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ

পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়

পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো

পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়

পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ

পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি

পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না

পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ

পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল

পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই

পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব