সমস্ত বিশ্বের পাপ হৃদয়ে হৃদয়ে ঘরে ঘরে দেশে দেশে জমে উঠছে। সেই বিশ্বপাপের মার্জনার প্রার্থনাকে যদি সত্য করতে হয়, আগে আমার নিজের সমস্ত হৃদয়কে মার্জনার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। যে পিতা সমস্ত মানবসন্তানের দুঃখ গ্রহণ করে প্রেমের বেদনায় উদ্বেল হয়ে উঠেছেন, তাঁর সেই প্রেমের বেদনাকে সকলে মিলে গ্রহণ করার জন্য সকলকেই নিজের হৃদয়টিকে মার্জনার তপস্যা গ্রহণ করতে হবে।
১৮.
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চিন্তনে মননে অথবা যাপনে যদি আমরা ভুলেও থাকি, তবু পৃথিবীতে আজও যুদ্ধ চলছে প্রতিদিন। মানুষ হত্যা করছে মানুষকে। ঘরের থেকে হয়তো দুই পা দূরে। ঘরের পাশে নির্বাচনী হিংসার বলি হওয়া প্রাণেরা ক্রমাগত কেবল সংখ্যামাত্র হয়ে যাচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের উচ্চারণ গুঞ্জরিত হয়েই চলে– ‘আমরা প্রতিদিন সংবাদপত্রে টেলিগ্রাফে যে একটু-আধটু খবর পাই তার পশ্চাতে কী অসহ্য সব দুঃখ রয়েছে আমরা কি তা চিন্তা করে দেখি। যে হানাহানি হচ্ছে তার সমস্ত বেদনা কোনখানে গিয়ে লাগছে। ভেবে দেখো কত পিতামাতা তাদের একমাত্র ধনকে হারাচ্ছে, কত স্ত্রী স্বামীকে হারাচ্ছে, কত ভাই ভাইকে হারাচ্ছে। এই জন্যই তো পাপের আঘাত এত নিষ্ঠুর; কারণ, যেখানে বেদনাবোধ সব চেয়ে বেশি, যেখানে প্রীতি সব চেয়ে গভীর, পাপের আঘাত সেইখানেই যে গিয়ে বাজে। যার হৃদয় কঠিন সে তো বেদনা অনুভব করে না। কারণ, সে যদি বেদনা পেত তবে পাপ এমন নিদারুণ হতেই পারত না। যার হৃদয় কোমল, যার প্রেম গভীর, তাকেই সমস্ত বেদনা বইতে হবে। এইজন্য যুদ্ধক্ষেত্রে বীরের রক্তপাত কঠিন নয়, রাজনৈতিকদের দুশ্চিন্তা কঠিন নয়; কিন্তু ঘরের কোণে যে রমণী অশ্রুবিসর্জন করছে তারই আঘাত সব চেয়ে কঠিন।
সেইজন্য এক-এক সময় মন এই কথা জিজ্ঞাসা করে : যেখানে পাপ সেখানে কেন শাস্তি হয় না। সমস্ত বিশ্বে কেন পাপের বেদনা কম্পিত হয়ে ওঠে।’
রবীন্দ্রনাথের মনের এই জিজ্ঞাসা উপাসনাগৃহে যে অভিভাষণে, ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে তার শিরোনাম হল ‘পাপের মার্জনা’। জিজ্ঞাসার উত্তর বলছে, সমস্ত মানুষ যে এক, কোথাও যে বিচ্ছেদ নেই। অতীত থেকে ভবিষ্যতে, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হৃদয়ে হৃদয়ে মানুষ যে পরস্পরে গাঁথা হয়ে রয়েছে। সেইজন্য পিতার পাপ পুত্রকে বইতে হয়, বন্ধুর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় বন্ধুকে, প্রবলের উৎপীড়নের পাপ দুর্বলকে সইতে হয়, মানবসমাজে একজনের পাপের ফল ভাগ করে নিতে হয় সকলকেই।
……………………………………………………………………………………….
সত্যিই তো বিশ্বপিতার, বিশ্বপ্রকৃতির সৃষ্টিবিধানে ক্ষমার সুযোগ থাকবে কেমন করে! যেমন বীজ তেমন গাছ তেমনই ফল। নিমের বীজে নিমের গাছই হবে। কোনও ক্ষমার মন্ত্রে আম হবে না। বিশ্বপিতা মানুষের পাপ ক্ষমা করতে পারেন না, মার্জনাই করতে পারেন। বিশ্বপাপ মার্জনা করতেই পারেন। পৃথিবীর পাপ স্তুপাকার হতে হতে একদিন তার মার্জনার দিন আসে।
……………………………………………………………………………………….
মনে পড়ে যায়, ‘আফ্রিকা’ কবিতায় সভ্য মানুষকে কবি পাশবিক বর্বরতার জন্য মানহারা মানবীর দ্বারে ক্ষমাপ্রার্থনা করতে বলেছেন। বলেছেন, সভ্যতার শেষ পুণ্যবাণী হোক ‘ক্ষমা করো’। এই অভিভাষণে তাঁর উপলব্ধি বলছে, “আমরা তাঁর কাছে এ প্রার্থনা করতে পারি না ‘আমার পাপ ক্ষমা করো’; কারণ তিনি ক্ষমা করেন না, তিনি সহ্য করেন না। তাঁর কাছে এই প্রার্থনাই সত্য প্রার্থনা : তুমি মার্জনা করো।”
সত্যিই তো বিশ্বপিতার, বিশ্বপ্রকৃতির সৃষ্টিবিধানে ক্ষমার সুযোগ থাকবে কেমন করে! যেমন বীজ তেমন গাছ তেমনই ফল। নিমের বীজে নিমের গাছই হবে। কোনও ক্ষমার মন্ত্রে আম হবে না। বিশ্বপিতা মানুষের পাপ ক্ষমা করতে পারেন না, মার্জনাই করতে পারেন। বিশ্বপাপ মার্জনা করতেই পারেন। পৃথিবীর পাপ স্তুপাকার হতে হতে একদিন তার মার্জনার দিন আসে। রক্তস্রোতের বন্যাতেই হয়তো পুঞ্জীভূত পাপকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বারবার রক্তস্রোতের দ্বারা অগ্নিবৃষ্টির দ্বারা যতকিছু অকল্যাণের পাপ তিনি মার্জনা করেন।
মানবসমাজের সমস্ত পাপের ফল আমাদের সকলকেই ভোগ করতেই হবে। প্রত্যেক মানুষ যে অবিচ্ছিন্ন। মানুষের এই ঐক্যবোধের গৌরবের জন্যই আমাদের সকলকে দুঃখভোগের জন্য প্রস্তুত হতে হবে, না হলে প্রায়শ্চিত্ত যে হয় না। যে হৃদয় প্রীতিতে কোমল, দুঃখের আগুন তাকেই আগে দগ্ধ করবে। চোখের ঘুম তারই হারাবে আগে। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করছেন, সমস্ত মানুষের সুখদুঃখকে এক করে একটি পরম বেদনা, পরম প্রেম আছে। ধনী-দরিদ্র জ্ঞানী-অজ্ঞানী সকলকে নিয়ে সেই এক প্রেম চিরজাগ্রত থাকে বলেই এক জায়গার বেদনা সব জায়গায় কম্পিত হয়। তাঁর উপদেশ, “তাই এ কথা আজ বলবার কথা নয় যে ‘অন্যের কর্মের ফল আমি কেন ভোগ করব’। ‘হাঁ, আমিই ভোগ করব– আমি নিজে একাকী ভোগ করব’ এই কথা বলে প্রস্তুত হও। নিজের জীবনকে শুচি করো। তোমাকে যে নিজের পাপের সঙ্গে ভীষণ যুদ্ধ করতে হবে, নিজের রক্তপাত করতে হবে, দুঃখে দগ্ধ হয়ে হয়তো মরতে হবে। কারণ, তোমার নিজের জীবনকে যদি পরিপূর্ণরূপে উৎসর্গ না কর তবে পৃথিবীর জীবনের ধারা নির্মল থাকবে কেমন করে, প্রাণবান হয়ে উঠবে কেমন করে।”
……………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………
সমস্ত বিশ্বের পাপ হৃদয়ে হৃদয়ে ঘরে ঘরে দেশে দেশে জমে উঠছে। সেই বিশ্বপাপের মার্জনার প্রার্থনাকে যদি সত্য করতে হয়, আগে আমার নিজের সমস্ত হৃদয়কে মার্জনার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। যে পিতা সমস্ত মানবসন্তানের দুঃখ গ্রহণ করে প্রেমের বেদনায় উদ্বেল হয়ে উঠেছেন, তাঁর সেই প্রেমের বেদনাকে সকলে মিলে গ্রহণ করার জন্য সকলকেই নিজের হৃদয়টিকে মার্জনার তপস্যা গ্রহণ করতে হবে।
(চলবে)
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১৭। সাধনায় সাফল্যের আভাস মিললে সেই পথচলা সহজ হয়
পর্ব ১৬। প্রকৃতি ব্যক্তিবিশেষ মানে না, তার কাছে সকলে সমান
পর্ব ১৫। যিনি অসীম তিনি সীমার আকর হয়ে উঠেছেন ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা
পর্ব ১৪। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া
পর্ব ১৩। জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতা খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব