অন্যরকম সম্পর্ক কি অফিসে হত না? প্রেম, ভালোবাসা, ভালোলাগা? মনে রাখা দরকার, দেশভাগের আগে বিভিন্ন দপ্তরে বাঙালি মেয়েদের উপস্থিতি ছিল হাতে গোনা। দেশভাগের পর সে ছবি পাল্টাল। মেয়েদের পাশে বসে কাজ করার অভিজ্ঞতা হল ছেলেদের, বেশিরভাগের কাছেই তা এক অভিনব অভিজ্ঞতা। মেয়েদের কাছেও এই সান্নিধ্য ছিল নতুন। এই নতুনত্বের মধ্যে নিশ্চয়ই এক ধরনের রোমাঞ্চ ছিল। নরেন মিত্র তো লিখেইছেন, ক্লাইভ রো’র স্ত্রীভূমিকাবর্জিত সদাগরি অফিসে প্রথম চাকুরিরতার আগমনে কীভাবে ‘সমস্ত অফিসটা মুহূর্তের মধ্যে চঞ্চল, চক্ষুময় হয়ে উঠল। চক্ষু ঠিক চঞ্চল নয়, হৃদয় চঞ্চল, চক্ষুস্থির।’ বা মনে করে দেখুন মৃণাল সেনের ছবি ‘পুনশ্চ’-এর কথা। স্টেনোটাইপিস্ট বাসন্তীর প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর অফিসের বড়কর্তা।
১৭.
তখন মায়ার বয়স ২৫–২৬ হবে। সদ্য তিনি চাকরি পেয়েছেন প্রতিরক্ষা বিভাগে। একদিন তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসার তাঁকে ডেকে বললেন, ‘মায়া, এই ফাইলগুলো দেখো তো’। মায়া তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন, “আপনি আমাকে ‘মিস ঘোষ’ বলবেন, আর ‘আপনি’ করে বলবেন।’’ ‘তুমি’ বলা আর নাম ধরে ডাকার মধ্যে যে অন্তরঙ্গতা ছিল, তা মায়ার পছন্দ হয়নি। অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে যে দূরত্ব রাখতে মায়া অভ্যস্ত, তার সীমানা লঙ্ঘন করেছিলেন ভদ্রলোক। বলা বাহুল্য, মায়ার আচরণে সেই অফিসার খুশি হননি। নানা সময়ে আকারে ইঙ্গিতে, ক্ষমতা খাটিয়ে সে কথা মায়াকে বুঝিয়েও দিতেন তিনি। যেমন একবার অনেক ফাইল দিয়ে বলেছিলেন, কাজ শেষ না করে মায়া যেন বাড়ি না যান। সেইবার মায়া ভয় পেয়েছিলেন। বেশি রাতে একা বাড়ি ফেরা নিয়ে একটি মেয়ের উদ্বেগ হওয়াই স্বাভাবিক। এই একটি নির্দেশের মধ্যে দিয়েই যেন সেই অফিসার তাঁর ক্ষমতা জাহির করতে পেরেছিলেন– সেই ক্ষমতা শুধু অধস্তনের উপর ঊর্ধ্বতনের ক্ষমতা নয়, একজন মহিলাকে বিপন্ন করার চেষ্টাও বটে।
খানিকটা একইরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল জ্যোৎস্না সিনহারও। খুব অল্পবয়সে জ্যোৎস্নার স্বামী মারা যান। ছেলে ছোট। এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে রিসেপশনিস্টের চাকরি নেন জ্যোৎস্না। সংসার সামলে, ছেলেকে স্কুলে দেওয়া নেওয়া করে মাঝে–মধ্যে দেরি হয়ে যেত তাঁর অফিস পৌঁছতে। আজও ৮৩ বছরের জ্যোৎস্নার মনে আছে একদিন তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসার কেমন ধমক দিয়েছিলেন তাঁকে। বলেছিলেন কাজে ঠিক সময়ে না আসতে পারলে ছেলেকে হস্টেলে পাঠিয়ে দিতে। খুব অপমানিত বোধ করেছিলেন জ্যোৎস্না সেইদিন। সেটাই স্বাভাবিক। কোনও পুরুষ দেরি করে এলে এমন কথা তাঁকে নিশ্চয়ই শুনতে হত না। মা হওয়া আর রিসেপশনিস্ট হওয়ার মধ্যে যেন কোথাও বিরোধ আছে; বেছে নিতে হবে একটা– এমনটাই ইঙ্গিত করেছিলেন জ্যোৎস্নার অফিসার। মনে করিয়ে দিয়েছিলেন মহিলা হিসাবে, বিধবা হিসাবে, মা হিসাবে তাঁর অসহায়তাকে।
সাদা শাড়ি পরে অফিস যেতেন জ্যোৎস্না। পোশাকেই প্রমাণিত হত তাঁর বৈধব্য। তাঁর এই পোশাক নিয়েও ছিল অফিসের নানা লোকের নানা আপত্তি। রঙিন শাড়ি পরার আদেশ উপদেশ দিতেন অনেকেই। সামাজিক ধারণায় রিসেপশনিস্ট মাত্রই সেজেগুজে থাকা, সুশ্রী, নম্র মহিলা। সেই ধারণার সঙ্গে খাপ খেতেন না বিধবা জ্যোৎস্না। তাই বোধহয় তাঁকে শুনতে হত এত কথা। অস্বস্তি হত বইকি তাঁর। অস্বস্তির আরেক রকম গল্প শুনি আমরা মায়া ঘোষের (বিয়ের পর আচার্য) কাছে। ৯৫ বছরে পৌঁছেও তাঁর মনে আছে সহকর্মী বনলতার কথা। বনলতাকে দেখলেই তাঁদের এক পুরুষ সহকর্মী গুনগুন করে গেয়ে উঠতেন, ‘নাম রেখেছি বনলতা…’। প্রবল অস্বস্তি হত বনলতার; অন্যদিকে সেই শখের গায়কের কাছে এ ছিল নিছক মজা।
মায়া বা জ্যোৎস্নার অফিসের সব স্মৃতিই অবশ্য অস্বস্তি বা বিরক্তির নয়। বন্ধুত্ব, আনন্দ, পুরুষ–মহিলা নির্বিশেষে একসঙ্গে সুন্দর সময় কাটানো– এসব নিয়েও গড়ে উঠেছিল পাঁচ ও ছয়ের দশকে মেয়েদের অফিস জীবন। মায়ার যেমন মনে আছে, যেদিন তাঁকে অফিসার কাজ শেষ করে বাড়ি যেতে বলেছিলেন, সেদিনই অন্য এক পুরুষ সহকর্মী তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘দিদিমণি, আপনাকে ট্রামে তুলে বাড়ি যাব। চিন্তা নেই।’ ‘ভাই–বোনের মতোই মিশতাম আমরা’, মায়ার মনে পড়ে।
এলাহাবাদ ব্যাঙ্কে যখন প্রথম মেয়েরা চাকরি পেলেন, তাঁদের একজন ছিলেন গীতিকা মিত্র। গীতিকার মনে পড়ে প্রথম প্রথম পুরুষ-গ্রাহকরা মহিলা-কর্মীদের নিয়ে একটু সন্দিহান ছিলেন; ঠিক যেন ভরসা করতে পারতেন না। গীতিকাদের পুরুষ সহকর্মীরা তখন সেই গ্রাহকদের বারবার বলতেন ব্যাঙ্কের মহিলা কর্মীরা কাজে কতটা পারদর্শী। ঠিক তেমনই নানা মধুর অভিজ্ঞতায় ভরপুর আলপনা ঘোষের চাকরি জীবন। বাংলা সাংবাদিকতার জগতে প্রথম মহিলাদের একজন ছিলেন আলপনা। তাঁর সাক্ষাৎকারে আমরা শুনি অজিত চক্রবর্তী, কুমুদ দাশগুপ্তর মতো বয়োঃজ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা কীভাবে তাঁকে আগলে রাখতেন অফিসের ভিতরে, অফিসের বাইরে। ‘আগলে রাখা’, ‘স্নেহ করা’, ‘ভাই–বোনের মতো’, এই শব্দবন্ধগুলো বারবার উঠে এসেছে সে যুগের চাকুরিরতাদের সঙ্গে আলাপচারিতায়। সমানে–সমানে নিছক বন্ধুত্ব বোধহয় ভাবতে বা বলতে অস্বস্তি হত অনেক মেয়েরই। পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে নারী–পুরুষ সম্পর্ককে ফেলতে পারলে স্বস্তি পেতেন তাঁরা। এই আচরণ হয়তো স্বাভাবিক। সদ্য তখন মেয়েরা ঘরের বাইরে বেরিয়ে অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে পাশাপাশি বসে, আলাপ–আলোচনা করে কাজ করছেন; কাজের সূত্রে দিনের বড় অংশ কাটাচ্ছেন একে অপরের সঙ্গে– এই নতুন অভিজ্ঞতাকে চেনা মাপকাঠি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করা তো স্বাভাবিক।
তবে অন্যরকম সম্পর্ক কি অফিসে হত না? প্রেম, ভালোবাসা, ভালোলাগা? মনে রাখা দরকার, দেশভাগের আগে বিভিন্ন দপ্তরে বাঙালি মেয়েদের উপস্থিতি ছিল হাতে-গোনা। দেশভাগের পর সে ছবি পাল্টাল। মেয়েদের পাশে বসে কাজ করার অভিজ্ঞতা হল ছেলেদের, বেশিরভাগের কাছেই তা এক অভিনব অভিজ্ঞতা। মেয়েদের কাছেও এই সান্নিধ্য ছিল নতুন। এই নতুনত্বের মধ্যে নিশ্চয়ই এক ধরনের রোমাঞ্চ ছিল। নরেন মিত্র তো লিখেইছেন, ক্লাইভ রো’র স্ত্রীভূমিকাবর্জিত সদাগরি অফিসে প্রথম চাকুরিরতার আগমনে কীভাবে ‘সমস্ত অফিসটা মুহূর্তের মধ্যে চঞ্চল, চক্ষুময় হয়ে উঠল। চক্ষু ঠিক চঞ্চল নয়, হৃদয় চঞ্চল, চক্ষুস্থির।’ বা মনে করে দেখুন মৃণাল সেনের ছবি ‘পুনশ্চ’-এর কথা। স্টেনোটাইপিস্ট বাসন্তীর প্রেমে পড়েছিলেন তাঁর অফিসের বড়কর্তা। সেই ভালোবাসা অবশ্য পূর্ণতা পায়নি। তবে অনেকের কাছেই শুনেছি আমরা সে যুগের প্রেম ভালোবাসার মিলনান্তক গল্প। গীতিকা যেমন বলেছেন তাঁর দু’–তিনজন সহকর্মিণী-র কথা, যাঁরা ব্যাঙ্কের সহকর্মীদেরই বিয়ে করেছিলেন। তেমনি টেলিফোন অফিসেই চাকরি সূত্রে আলাপ হয় দেবাশিস দত্তগুপ্ত ও শিপ্রার। সংসার বাঁধেন তাঁরাও।
তেমনই, ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র সাংবাদিক, ঝকঝকে ব্যক্তিত্ব, বয়সে ২৫ বছরের বড় শংকর ঘোষের প্রেমে পড়েছিলেন আলপনা ঘোষ। প্রেস কনফারেন্সে দেখতেন সামনের সারিতে বসা এক ভদ্রলোক চোখা চোখা প্রশ্ন করছেন দুঁদে রাজনীতিকদের। সঙ্গীদের প্রশ্ন করে আলপনা জানতে পারেন ভদ্রলোকের নাম। একবার শান্তিনিকেতনের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে দল বেঁধে যান সাংবাদিকেরা। সেই দলে ছিলেন শংকর আর আলপনাও। হোটেলে এখনকার মতো সুবন্দোবস্ত ছিল না। খাবার ঢাকা থাকত, নিজেদের বেড়ে নিতে হত। গৃহকাজে অনভ্যস্ত আলপনার সেদিন মনে হল মেয়ে হিসাবে তাঁরই কর্তব্য সবাইকে খাবার বেড়ে দেওয়া। ভাত বাড়তে গিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একশা কাণ্ড হল! এগিয়ে এলেন শংকর। বললেন, ‘বুঝেছি তুমি কত কাজের। এখন সরো দেখি, আমিই বেড়ে দিই সবাইকে।’
অকৃতদার শংকর ভাবেননি কোনও দিন সংসার করবেন। আলপনার অনুভূতির কথা জেনে আকাশ থেকে পড়লেন। বয়সের এত তফাতে সম্পর্ক হয় ভাবতেই পারছিলেন না তিনি। তারপর অনেক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে মজবুত হতে থাকে দু’জনের বন্ধুত্ব। এরপর বিয়ে, সংসার, ছেলের জন্ম, ভারি আনন্দে কাটে আলপনার বিবাহিত জীবন।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে সাংবাদিকতার চাকরি ছেড়ে সাউথ পয়েন্ট স্কুলে চাকরি নেন আলপনা। রান্নাঘরে ঢুকলে বিরক্ত হতেন স্বামী, বলতেন, ‘এই কাজে সময় নষ্ট কোরো না।’ মজার কথা, সেই আলপনাই পরে লিখে ফেলেন একাধিক রান্নার বই। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও চলে তাঁর। আমৃত্যু তাঁর সব কাজে উৎসাহ দিয়েছেন শংকর। শেষ জীবনে স্মৃতি হারিয়ে ফেলেন, অসম্ভব নির্ভরতা তৈরি হয় আলপনার ওপরে। সে সময়ে আলপনার পিসি এক দিন দেখতে আসেন শংকরকে। এই পিসি নিজেও খুব কৃতী, লেখাপড়ায় তুখড়, চাকরি করতেন। আলপনার এই অসমবয়সি সম্পর্কে ভারি আপত্তি ছিল তাঁর। রোগশয্যায় শংকরের পাশে আলপনাকে দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তিনি। আলপনাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আই ওয়াজ রং’। আজ আমাদের সেই গল্প বলতে বলতে গলা ধরে আসে ৮০-র আলপনার।
… পড়ুন চৌকাঠ পেরিয়ে কলামের অন্যান্য পর্ব …
পর্ব ১৬: ট্রামের স্বস্তি না বাসের গতি, মেয়েদের কোন যান ছিল পছন্দসই?
পর্ব ১৫: অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শই শুধু নয়, চৌকাঠ পেরনো মেয়েরা পেয়েছিল বন্ধুত্বের আশাতীত নৈকট্যও
পর্ব ১৪: লীলা মজুমদারও লেডিজ সিট তুলে দেওয়ার পক্ষে ছিলেন!
পর্ব ১৩: অল্পবয়সি উদ্বাস্তু মহিলারা দেহব্যবসায় নেমে কলোনির নাম ডোবাচ্ছে, বলতেন উদ্বাস্তু যুবকরা
পর্ব ১২: মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’ ছবির মিঠুর মতো অনেকে উদ্বাস্তু মেয়েই চাকরি পেয়েছিল দুধের ডিপোতে
পর্ব ১১: প্রথম মহিলা ব্যাঙ্ককর্মীর চাকরির শতবর্ষে ব্যাঙ্কের শ্রমবিভাজন কি বদলে গিয়েছে?
পর্ব ১০: সেলসগার্লের চাকরিতে মেয়েরা কীভাবে সাজবে, কতটা সাজবে, তা বহু ক্ষেত্রেই ঠিক করত মালিকপক্ষ
পর্ব ৯: স্বল্পখ্যাত কিংবা পারিবারিক পত্রিকা ছাড়া মহিলা সাংবাদিকরা ব্রাত্য ছিলেন দীর্ঘকাল
পর্ব ৮: অভিভাবকহীন উদ্বাস্তু মেয়েদের ‘চিরকালীন বোঝা’র তকমা দিয়েছিল সরকার
পর্ব ৭: মেয়েদের স্কুলের চাকরি প্রতিযোগিতা বেড়েছিল উদ্বাস্তুরা এদেশে আসার পর
পর্ব ৬: স্বাধীনতার পর মহিলা পুলিশকে কেরানি হিসাবেই দেখা হত, সেই পরিস্থিতি কি আজ বদলেছে?
পর্ব ৫: প্রেম-বিবাহের গড়পড়তা কল্পকাহিনি নয়, বাস্তবের লেডি ডাক্তাররা স্বাধীনতার নিজস্ব ছন্দ পেয়েছিলেন
পর্ব ৪ : নার্সের ছদ্মবেশে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কেও যৌন হেনস্তার কবলে পড়তে হয়েছিল
পর্ব ৩ : উদ্বাস্তু মেয়েদের রোজগারের সুযোগ মিলেছিল টাইপ-শর্টহ্যান্ডের কাজে
পর্ব ২ : পিতৃতন্ত্রের কাঠামোয় কিছু ফাটল নিশ্চয়ই ধরিয়েছিলেন সে যুগের মহিলা টেলিফোন অপারেটররা
পর্ব ১ : দেশভাগের পর ‘চঞ্চল চক্ষুময়’ অফিসে চাকুরিরত মেয়েরা কীভাবে মানিয়ে নিলেন?
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved