প্রকাশিত হতে চলেছে রবীন্দ্রনাথের ‘শৈশবসংগীত’। নতুন বউঠান ছাড়া আর কাউকে উৎসর্গ করা যায় না এই বই। কিন্তু কী লিখবেন উৎসর্গলিপিতে? তীব্র তোড়ে ছুটে এল কবিতার স্রোত। কিন্তু সব আবেগ, সব সংকোচহীন প্রকাশ সরিয়ে রাখছেন তিনি। আকস্মিক মনে হল তাঁর, তাঁর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সরিয়ে রাখছে ওই লেখার টেবিল। টেবিলটা চাইছে শুধু দু’টি শব্দ– আর কিছু না। জানলা দিয়ে পূর্ণিমা এসে পড়েছে টেবিলটার শরীরে। তিনি তাকিয়ে সেই অলৌকিক উদ্ভাসের পানে। সেখানে ফুটে উঠল দু’টি শব্দ– ‘শৈশবসংগীত’-এর উৎসর্গ– ‘তোমাকেই দিলাম’।
৫.
সব ক’টি বই রবীন্দ্রনাথের সামনে। তাঁর লেখার টেবিলের ওপর। সব ক’টি বই, কী আশ্চর্য, তিনি উৎসর্গ করেছেন নতুন বউঠান কাদম্বরীকে! সব ক’টি বইয়ের উৎসর্গলিপি তাঁর সামনে খোলা। তিনি বারবার পড়ছেন। তিনি লিখেছেন? প্রতিটি উৎসর্গের ভাষা, ইঙ্গিত, ইশারা, আবেগ, কান্না ও আর্তি, এসব তাঁর? না কি অন্য কারওর?
রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, যে কাব্য তাঁর প্রথম উৎসর্গ নতুন বউঠান কাদম্বরীকে। লিখতেই পারতেন, নতুন বউঠানকে। কিন্তু লিখলেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছেন এই টেবিলে– কত বাক্য, কত শব্দ, কত প্রকাশ ও আড়াল আছড়ে পড়েছে তাঁর শরীর– মনের তোলপাড়ের ওপর। কিন্তু কোনওটাই তাঁর হস্তাক্ষরে ফুটে উঠল না কাগজে। মনে পড়ে তাঁর, এক রহস্যময় কম্পন ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর টেবিলের সারা অঙ্গ জুড়ে। আর কিছু না। কিছু বলতে চাওয়ার আর অনেক কিছু বলতে না পারার নীরব কম্পন। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন অবশেষে ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’-এর উৎসর্গে, ‘তোমাকে দিলাম।’
তরুণ, তাজা, বাঁধভাঙা রবীন্দ্রনাথ, ভাষার নিরন্তর ঈশ্বর, আর কিছুই লিখলেন না, প্রকাশ করলেন না আবেগ, প্রণয়, অন্তরের আলোড়ন, এমনকী লিখলেন না দু’-কলি কবিতা। শুধু ‘তোমাকে দিলাম’। কেননা, এই দু’টি শব্দ লেখার পরেই মনে হল তাঁর, টেবিলটা আর কাঁপছে না। যেন সব বলা হয়ে গেছে। বাকি নেই কিছুই।
প্রকাশিত হতে চলেছে রবীন্দ্রনাথের ‘শৈশবসংগীত’। নতুন বউঠান ছাড়া আর কাউকে উৎসর্গ করা যায় না এই বই। কিন্তু কী লিখবেন উৎসর্গলিপিতে? তীব্র তোড়ে ছুটে এল কবিতার স্রোত। কিন্তু সব আবেগ, সব সংকোচহীন প্রকাশ সরিয়ে রাখছেন তিনি। আকস্মিক মনে হল তাঁর, তাঁর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। সরিয়ে রাখছে ওই লেখার টেবিল। টেবিলটা চাইছে শুধু দু’টি শব্দ– আর কিছু না। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের, তিনি প্রার্থী ওই টেবিলটার কাছে। জানলা দিয়ে পূর্ণিমা এসে পড়েছে টেবিলটার শরীরে। তিনি তাকিয়ে সেই অলৌকিক উদ্ভাসের পানে। সেখানে ফুটে উঠল দু’টি শব্দ– ‘শৈশবসংগীত’-এর উৎসর্গ– ‘তোমাকেই দিলাম’। আর কোনও ইঙ্গিত, ইশারা, দ্যোতনা, ব্যঞ্জনা প্রয়োজনহীন। ‘তোমাকেই দিলাম’– বলা হয়ে গেল এক সমুদ্র। বলা হয়ে গেল এক আকাশ।
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী-র দিকে তাকান রবীন্দ্রনাথ। চাঁদের আলো ভিজিয়ে দিচ্ছে উৎসর্গের বাক্যগুলিকে: ‘ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাইতে তুমি আমাকে অনেকবার অনুরোধ করিয়াছিলে। তখন সে অনুরোধ পালন করি নাই। আজ ছাপাইয়াছি, আজ তুমি আর দেখিতে পাইলে না।’
রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে, বয়স তাঁর ১৬। নতুন বউঠানকে চমকে দিতে চান তিনি। অন্য যুগের কবিতা, ভিন্ন কবির নামে লিখে। সম্ভব? তা তিনি জানেন না। টেবিলের ওপর স্লেট আর খড়ি রেখে বসেছেন তিনি চেয়ারে। এক বুক আবেগ, প্রকাশের তাড়না, ফেটে পড়ছে যেন। দূরে শোনা যাচ্ছে নতুন বউঠানের নূপুরের আওয়াজ। এই ঘরের দিকেই কি আসছে সে? নতুন বউঠান ঘরে ঢোকার আগেই লিখে ফেলতে হবে অন্যযুগের অন্য কবির কবিতা, যে-কবি তারই মধ্যে আছে। হঠাৎ কিশোর রবি স্লেটের গায়ে লিখে ফেললেন:
গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে মৃদুল মধুর বংশি বাজে,
বিসরি ত্রাস লোকলাজে সজনি আও আও লো।
তারপর ১৬ বছরের রবি একটা ঘোরের মধ্যে। কখন যে নতুন বউঠান পিছনে এসে দাঁড়াল, কে জানে! কিন্তু লিখছে কে? রবি, অথচ রবি নয়। অন্য কেউ স্লেটের বুকে রবিরই হাতের লেখায় ফুটিয়ে তুলছে:
মন্দ মন্দ ভৃঙ্গ গুঞ্জে, অযুত কুসুম কুঞ্জে কুঞ্জে
ফুটল সজনি, পুঞ্জে পুঞ্জে বকুল যূথি জাতি রে।।
দেখ, লো সখি, শ্যামরায় নয়নে প্রেম উথলে যায়–
মধুর বদন অমৃতসদন চন্দ্রমায় নিন্দিছে।
আও আও সজনিবৃন্দ, হেরব সখি শ্রীগোবিন্দ–
শ্যামকো পদারবিন্দ ভানুসিংহ বন্দিছে।।
রবির ঘোর কাটে। পিছনে বিস্মিত নতুন বউঠান কাদম্বরী, নিথর।
–এ লেখা তোমার রবি? কম্পিত কণ্ঠে নতুন বউঠানের প্রশ্ন।
রবীন্দ্রনাথ এই প্রশ্নের কী উত্তর দিয়েছিলেন, তাঁর মনে নেই। তাঁর স্পষ্ট মনে আছে অন্য এক দুপুরবেলা।
নতুন বউঠানের সঙ্গে তরুণ রবীন্দ্রনাথ দিন কাটাচ্ছেন চন্দননগরের বাগানবাড়িতে। গঙ্গাতীরে বাগানবাড়ি। বাগানবাড়ির পিছনে বনজঙ্গলের মতো।
–কুল পাড়তে যাবে না ঠাকুরপো ওই বনজঙ্গলে?
স্পষ্ট মনে আছে রবীন্দ্রনাথের, কাদম্বরীর কুহকে কান পাতেননি তিনি।
–আজ দুপুরটা গানকেই দেব।
–তুমি তো কথায় কথায় গান বাঁধতে পার। সারা দুপুর লাগবে গান বাঁধতে?
এই প্রশ্নের পরেই নতুন বউঠানের ডাক ঘরের পাশেই ছাদ থেকে–
–ঠাকুরপো, একবার ছাদে এসো, দেখে যাও আকাশে কী কাণ্ড ঘটছে।
রবীন্দ্রনাথ বাইরে বেরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থমকে যান। বেশ বুঝতে পারেন, তিনি আর নিজের মধ্যে নেই। তিনি যেন অন্য কেউ। তাঁর লেখার টেবিলটা পশ্চিম আকাশের গায়ে, ঘন মেঘ গ্রাস করছে টেবিলটাকে।
–নতুন বউঠান, আমাকে গানটা লিখতেই হবে, সুরও বসাতে হবে, এই দুপুরবেলাটা বিদ্যাপতির।
–বিদ্যাপতির? আমার নয়?
–একটু একলা থাকি নতুন বউঠান। সন্ধেবেলাটা তোমার।
ছুটে ছাদ থেকে ঘরে ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ।
লেখার টেবিলটা যেখানে ছিল সেখানেই আছে। আকাশে মেঘের গায়ে তো উড়ে যায়নি। চেয়ারে বসে লেখার টেবিলটাকে আঁকড়ে ধরেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু গানটা কোথায় গেল। বুকের মধ্যে যে-গানটা ডালপালা মেলছিল। বিপুল বৃষ্টি নেমেছে ঘন মেঘের অন্ধকারে। টেবিলের সামনে বসে আছেন অসহায় রবীন্দ্রনাথ। একটি লাইনও লিখতে পারেননি তিনি। এমন তো কখনও হয় না। আজ হল। এই প্রথম। কোনও শব্দ, কোনও বাক্য নেই তাঁর কলমের মুখে।
–ঠাকুরপো, সারা দুপুর গেল, সারা বিকেল গেল, সবে সন্ধে হল, বাইরে অনন্ত বৃষ্টি, তোমার গান বাঁধা এখনও শেষ হয়নি?
–অনেকক্ষণ, অনেক যুগ আগে শেষ হয়ে গেছে। সুর বসালাম এইমাত্র নতুন বউঠান।
–তাহলে গেয়ে শোনাও। কেমন গান বাঁধলে শুনি, সারা দুপুর, সারা বিকেল ধরে।
রবীন্দ্রনাথ খালি গলায় গান ধরলেন:
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।
ঝঞ্ঝা ঘন গরজন্তি সন্ততি
ভূবন ভরি বরিখন্তিয়া
কন্ত পাহুন কাম দারুণ
সঘনে খর শর হন্তিয়া।
কুলিশ শত শত পাত মোদিত
ময়ূর নাচত মাতিয়া।
মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকি
ফাটি যায়তো ছাতিয়া।
তিমির দিগ ভরি ঘোর যামিনী
অথির বিজুরিক পাঁতিয়া
বিদ্যাপতি কহে কৈ সে গোঙায়বি
হরি বিনু দিন রাতিয়া।
–কী সুন্দর গান ঠাকুরপো! কী অসাধারণ গাইলে তুমি? তাহলে তুমি এখন ভানুসিংহ থেকে বিদ্যাপতি?
–না নতুন বউঠান। আমার সাধ্য নেই এমন গান বাঁধার। এ একেবারে বিশুদ্ধ বিদ্যাপতি।
–কোন যুগের কবি গো? এ কোন ভাষা? বোঝো তুমি?
–এই ভাষার নাম মৈথিলি। বল্লাল সেন বাংলাকে পাঁচভাগে ভাগ করেছিলেন। একটি ভাগের নাম মিথিলা। মিথিলার রাজদরবারের কবি ছিলেন বিদ্যাপতি। আমাদের কাল থেকে চারশো বছর ছাড়িয়ে বিদ্যাপতির কাল।
–আর এই সুর? এই সুরও চারশো বছরের পুরনো?
–না, নতুন বউঠান। এই সুর আজ দুপুরের। সারা দুপুর, সারা বিকেল একটি শব্দও লিখতে পারিনি আমি। কখনও এমন তো হয় না। আজ প্রথম হল। আমার লেখার টেবিলটা সম্পূর্ণ প্রাণহীন হয়ে গিয়েছিল। শত ডাকেও সাড়া দেয়নি।
–কে বললে সাড়া দেয়নি? ওই সুর, যে সুর এই বিদ্যাপতির এই গানটিকে বাঁচিয়ে রাখবে অনন্তকাল, সেই সুরটাকে টেবিলের দান বলে ভাবতে পার না? যে টেবিল দ্রৌপদীর শাড়ির মতো অন্তহীন কথা জুগিয়ে চলে, সেই টেবিল সুর জোগাতে পারে না?
রবীন্দ্রনাথ বিস্মিত হয়ে তাকান নতুন বউঠানের দিকে। তিনি বাক্যহীন।
–ঠাকুরপো, গানের সবটুকু যে বুঝতে পারিনি।
–যেমন?
–যেমন ‘বরিখন্তিয়া’। শুনতে কী ভালো! কিন্তু মানে কী?
–মানে খুব সহজ। বর্ষণ হয়েই চলেছে। থামবার নাম নেই। যেমন আজ।
–আর গরজন্তি সন্ততি মানে?
–সতত গর্জন করছে চারিধার। বৃষ্টির শব্দ, মেঘের শব্দ, ঝড়ের শব্দ আর মনের মধ্যে তোলপাড়ের শব্দ নতুন বউঠান।
নতুন বউঠান আর রবি, অনেকক্ষণ কথাহীন। তারপর হঠাৎ প্রশ্ন কাদম্বরীর– কন্ত পাহুন, সেটা কী-ঠাকুরপো?
–‘কন্ত’-কে ‘কান্ত’ করে নাও নতুন বউঠান। ‘কান্ত’ হল প্রিয়তম সুন্দরতম পুরুষ, যাকে তুমি ভালোবাসো। সেই পুরুষটি, আজকের ভাষায়, ‘পাহন’, অর্থাৎ নির্মম, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন। শব্দটি কিন্তু আজও বাংলা শব্দবন্ধে আছে নতুন বউঠান। আমরা বলি না, ‘পুরুষ পাহুন?’ অর্থাৎ ‘পাষাণ পুরুষ’। আর ‘কুলিশ’ মানে যে বজ্র তা নিশ্চয় তোমাকে বলে দিতে হবে না। বিদ্যাপতির কী অসাধারণ শব্দচয়ন, ভেবে দেখ নতুন বউঠান। কত বছর আগে এই কাণ্ডটি তিনি ঘটিয়ে গেছেন।
–আরও একটিবার ওই লাইনটা গাইবে ঠাকুরপো?
রবীন্দ্রনাথ উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠেন:
কুলিশ শত শত পাত মোদিত
ময়ূর নাচত মাতিয়া।
গান থামিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেন, কী আশ্চর্য রোম্যান্টিক কল্পনা বিদ্যাপতির, বাজ পড়ছে যেন চারিদিকে আনন্দ জাগাতে। আর সেই আনন্দে নাচছে ময়ূর। এই লাইনটাতে যখন সুর বসাচ্ছি আর বারবার গাইছি, হঠাৎ আমার লেখার টেবিল থেকে কয়েকটি জ্যোতির্ময় কথা উঠে এল আমার বুকের মধ্যে।
–তারপর?
–তারপর টেবিলটার দিকে অসহায়ভাবে চেয়ে বসে রইলাম। বাকি লাইনগুলো কিছুতেই দেখা দিল না। কত বছর অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে।
–অত বছর কি আমি থাকব ঠাকুরপো?
–থাকবে, থাকবে, চিরকাল থাকবে। চিরকাল থাকবে তুমি!
–ঠাকুরপো, বললে না তো, ‘কুলিশ শত শত পাত মোদিত’-তে সুর বসাতে গিয়ে কোন জ্যোতির্ময় কথাগুলো টেবিল থেকে উঠে এসে তোমার বুকের মধ্যে ঢুকে গেল?
শুধু চারটি শব্দ: ‘বজ্রে তোমার বাজে বাঁশি’। ব্যস, আর একটিও শব্দ নেই। টেবিলটা বড্ড কৃপণ নতুন বউঠান। কবে বাকি লাইনগুলো সে দান করবে এই ব্যাকুল প্রার্থীকে, কে জানে?
–টেবিলটা কৃপণ নয় ঠাকুরপো। অন্তত তোমার লেখার টেবিল অনুদার নয়। সে ব্যয়কুণ্ঠ হলে তোমাকে বিদ্যাপতির গানের সুরটি দান করত না। এই সুর বিদ্যাপতির গানটাকে লুঠ করে তোমাকে দিল। আজ থেকে এই গান যতখানি বিদ্যাপতির, তার চেয়ে অনেক বেশি তোমার।
নতুন বউঠানের এই কথাটা কোনওদিন কি ভুলতে পারবেন রবীন্দ্রনাথ?
রবীন্দ্রনাথ আবার গেয়ে ওঠেন, ‘মত্ত দাদুরী, ডাকে ডাহুকী, ফাটি যায়তো ছাতিয়া।’
–সব মানে বুঝতে পেরেছি, বলেন কাদম্বরী। ‘দাদুরী’ তো ব্যাঙ। বর্ষায় খেপে গেছে, আর ‘ডাহুকী’ তো ডাক পাখি। জলে থাকে, তাই না?
–সব বুঝেছ, অথচ কিছুই বোঝোনি বউঠান। দাদুরী মানে শুধু ব্যাঙ নয়। স্ত্রী ব্যাঙ। বর্ষায় বিরহিনী ব্যাং তার পুরুষটিকে মত্ত হয়ে ডাক দিচ্ছে। কিন্তু সেই পাষাণ পুরুষ সাড়া দিচ্ছে না। আবার ‘ডাহুকী’ ডাক দিচ্ছে তারও পুরুষকে। কিন্তু সেও কান্ত পাহুন। প্রিয়তম নিষ্ঠুরতম। কোথায় সে?
–একটা কথা ঠাকুরপো, চারধারে এমন বর্ষণ, তবু কেন বিদ্যাপতি বলছেন, তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে বুক?
– বর্ষার জল তেষ্টা নেভায় না, বাড়ায়। বললেন রবীন্দ্রনাথ।
– কীসের তেষ্টা ঠাকুরপো? রবীন্দ্রনাথের মনে পড়ে নতুন বউঠানের সেই হাসি।
ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীর ছ’ বছর পরে প্রকাশিত হতে চলেছে রবীন্দ্রনাথের ‘মানসী’। রবীন্দ্রনাথ টেবিলের সামনে অপেক্ষমাণ। উৎসর্গে যে কথাটি লিখতে চান, কিছুতেই সাহস হচ্ছে না লিখতে। মানসীও তিনি দিতে চান নতুন বউঠান কাদম্বরীকেই। কিন্তু যা লিখতে চান, সব আড়াল বজায় রেখে, লিখবেন কী করে? লেখার টেবিল কি তাঁকে দেখাবে পথ? দেবে সেই ভাষা? সেই প্রার্থিত মায়াবী আড়াল?
রবীন্দ্রনাথ কলম ধরলেন। নতুন বউঠান কাদম্বরীর উদ্দেশে ঢেলে দিলেন টেবিলের ওপর রাখা কাগজে দুই পংক্তির অনন্ত উৎসর্গ:
‘সেই আনন্দ মুহূর্তগুলি তব করে দিনু তুলি
সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ’।
ছাপার অক্ষরে ‘মানসী’-র এই উৎসর্গলিপি রবীন্দ্রনাথের চোখের সামনে, লেখার টেবিলে। কী দুর্বল, ক্লান্ত, পাংশু, মিথ্যাচারী তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণের প্রকাশ! মনে হল রবীন্দ্রনাথের। এখনও সাহস হল না সত্যি কথাটা বলার, জানানোর, মুখোশটা খুলে ফেলার? এখনও সংশয়? কুণ্ঠা? মরি একী হায় দুস্তর লজ্জা!
আরও পাঁচ বছর পরে নতুন বউঠানকেই দিলেন তাঁর ‘চৈতালী’ কাব্যগ্রন্থ। তাঁর লেখার টেবিল কি আকস্মিক সাহসে কিছুটা অন্তত উড়িয়ে দিল না কুণ্ঠা, লজ্জা, ভয়?
সুখাবেশে বসি লতামূলে
সারাবেলা অলস অঙ্গুলে
বৃথা কাজে যেন অন্য মনে
খেলাচ্ছলে লহ তুলি তুলি,
তব ওষ্ঠ দশন-দংশনে
টুটে যাক পূর্ণ ফলগুলি।
উৎসর্গের শেষ দু’টি লাইন একেবারে ভিত পর্যন্ত নড়িয়ে দিয়েছে ঠাকুরবাড়ির লোক দেখানো কৌলীন্য ও সৌজাত্যের। সত্যি স্বীকারোক্তি এবং আড়ালহীন হৃদয়কথার খুব কাছাকাছি গেছি, মনে হয় রবীন্দ্রনাথের। আরও একবার প্রার্থী হন তরুণ তুর্কি রবীন্দ্রনাথ বেপরোয়া সাহসে লেখার টেবিলের কাছেই। তাঁর কলম থেকে ঝরে পড়ে এই দুর্বার সত্য:
‘সেই গঙ্গার ধার মনে পড়ে? সেই নিস্তব্ধ নিশীথ? সেই জ্যোৎস্নালোক? সেই দুইজনে মিলিয়া কল্পনার রাজ্যে বিচরণ? সেই মৃদু গম্ভীর স্বরে গভীর আলোচনা? সেই দুজনে স্তব্ধ হইয়া নীরবে বসিয়া থাকা? সেই প্রভাতের বাতাস? সেই সন্ধ্যার ছায়া? একদিন সেই ঘনঘোর বর্ষার মেঘ, শ্রাবণের বর্ষণ, বিদ্যাপতির গান? তাহারা সব চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু আমার এই ভাবগুলির মধ্যে তাহাদের ইতিহাস লেখা রহিল। এক লেখা তুমি-আমি পড়িব, আর এক লেখা আর সকলে পড়িবে।’
রবীন্দ্রনাথের মনে হল, আর কোনও তেমন আড়াল নেই। পর্দা সরেছে। ভারতী-তে প্রকাশিত এই লেখা পড়ে রবীন্দ্রনাথকে চরম শাস্তি দিতে তৈরি হলেন দেবেন্দ্রনাথ। শাস্তি পেতে হবে বউমা কাদম্বরীকেও। তাঁকেও যশোরে যেতে হবে রবির বউ খুঁজতে। রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করতে বাধ্য হলেন ১৮৮৩-র ৯ ডিসেম্বর। তাঁর বয়েস ২৩। বিয়ে হল খুলনার ফুলতলির মেয়ে, সম্পূর্ণ অশিক্ষিত, দশ বছরের ভবতারিণীর সঙ্গে! (পরে নাম রাখা হল, মৃণালিনী)। রবীন্দ্রনাথের বিয়ের সাড়ে চার মাস পরে আত্মহত্যা করলেন ২৫ বছরের কাদম্বরী। নতুন বউঠানের এই আত্মহত্যার পরে সদ্য-বিবাহিত রবীন্দ্রনাথের কী অবস্থা রাতের পর রাত তাও লিখে গেছেন তিনি:
‘বাড়ির ছাদে একলা গভীর অন্ধকারে মৃত্যু রাজ্যের কোনও একটি চিহ্ন দেখিবার জন্য যেন সমস্ত রাত্রিটার উপর অন্ধের মতো হাত বুলাইয়া ফিরিতাম।’
কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ওপর চরম প্রতিশোধ নিতেও ছাড়েননি– তাঁর ওপর এই নির্মম অন্যায়ের প্রতিশোধ। তিনি তাঁর লেখার টেবিলে বসে লিখলেন তাঁর ‘আত্মহত্যার চিঠি’, যে চিঠি তাঁর কৌতুকী বিয়ের চিঠি বলেই পরিচিত:
এই পত্রের শীর্ষে মাইকেল মধুসূদনের অপ্রত্যাশিত উদ্ধৃতি। ‘আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়।’ তলায় বিয়ের এই আমন্ত্রণ পত্র:
‘আগামী রবিবার ২৪ শে অগ্রহায়ণ তারিখে শুভদিনে শুভলগ্নে আমার পরমাত্মীয় শ্রীমান্ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শুভবিবাহ হইবেক। আপনি তদুপলক্ষে বৈকালে উক্ত দিবসে ৬ নং জোড়াসাঁকোস্থ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভবনে উপস্থিত থাকিয়া বিবাহাদি সন্দর্শন করিয়া আমাকে এবং আত্মীয়বর্গকে বাধিত করিবেন।
ইতি অনুগত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’
…………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………..
এমন একইসঙ্গে বিয়ের এবং আত্মহননের চিঠি পৃথিবীতে আর কেউ কখনও লিখেছেন বলে আমার জানা নেই। তবে এই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল লেখককে দান করেছে উজাড় হাতে। এই চিঠির অক্ষরে অক্ষরে পুরে দেওয়া তীব্র শ্লেষ এবং ছুরির আঘাত আজও মহর্ষি দেবেন্দ্রকে ছিঁড়ছে, ঘটাচ্ছে তাঁর রক্তপাত!
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল