Robbar

‘মৃত’ ঘোষণা চিকিৎসকের, কিন্তু অলৌকিক পুনর্জন্মে উস্তাদ আলি আকবর খান গেয়ে উঠেছিলেন গান

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 18, 2025 3:08 pm
  • Updated:June 18, 2025 3:40 pm  

রামপুর পাহাড়ে নীলকণ্ঠ মহারাজ নামে একজন বড় সন্ন্যাসী ছিলেন। গুরুবাবা তাঁর কাছে দীক্ষাও দিয়েছিলেন। তিনি দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তাঁর শিষ্যের হাত দিয়ে কিছু একটা পাঠিয়েছিলেন, গুরুবাবাকে বাঁচানোর জন্য। ফকির আফ্‌তাবউদ্দিন তখন মন্ত্র বলতে বলতে গুরুবাবার শরীরের চারপাশে ঘুরছেন। সাত-আট পাক ঘোরার পর গুরুবাবার বুকে পা রাখলেন। শোনা যায়, পা রাখার পরই তিনি উঠে বসে গান গাইতে শুরু করেন। মেঘ রাগ। যে গান তিনি শিখেছিলেন তাঁর বাবার কাছে। ‘চলত শ্রীলঙ্কা বনে শ্রীরামচন্দ্র’।

প্রচ্ছদের ছবি: রঘু রাই

অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

দেখতে দেখতে ‘স্বরসম্রাট’ উস্তাদ আলি আকবর খান সাহেবের মৃত্যুর ১৭ বছর কেটে গেল। তিনি আমার ‘গুরুবাবা’। তাঁর সঙ্গে আমার দীর্ঘ ৪২ বছর কেটেছে। এতগুলো বছরের সান্নিধ্য, নানা স্মৃতি। সেই স্মৃতিভার আমায় ভারাক্রান্ত করে, তাঁর অনুপস্থিতি আজও দুঃখ দেয়। সেইসব অমলিন স্মৃতির বেশিরভাগই ভাগ করে নিয়েছি বিভিন্ন লেখায় আর বক্তৃতায়। তবু তো কিছু থেকে যায়।

অনেক বেশি বয়স পর্যন্ত গুরুবাবার কঠোর শাসন ও নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে বড় হয়েছিলেন। তাই ওঁর স্বভাব ও ভাব– দুই-ই ছিল খুব অর্ন্তমুখী। বেশি কথা বলতেন না। বলতে চাইতেন না। একমাত্র শেখানোর সময়, কিংবা সংগীত নিয়ে আলোচনার সময় যেটুকু কথা। সেইসব কথোপকথন বেশিরভাগই সাক্ষাৎকারভিত্তিক। প্রচুর দৃষ্টান্ত দিয়ে, উদাহরণ দিয়ে সংগীতটাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন। এবং সেই নিদর্শনগুলো খুবই সহজাত ছিল। এতটাই যে, তার সরলতা অনেকটা রামকৃষ্ণদেবের কথামৃতের উদ্ধৃতির মতো।

আমার মনে হয়, এই সহজ করে বলার শিক্ষাটা উনি আলাউদ্দিন খান সাহেবের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন। তিনিও এইরকম উদাহরণ দিয়ে দিয়েই কথা বলতেন। ওঁর বিভিন্ন মুদ্রিত সাক্ষাৎকার পড়লেই সেটা বোঝা যায়। আরেকটা বিষয় হল, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কথা, গুরুবাবা প্রায় একদমই বলতেন না। কখনও-সখনও কোনও আলোচনায় প্রসঙ্গ উঠলে, বা কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে তখন হয়তো বলতেন, তবে কিছুটা দায়সারা ভাবে। উনি বিশ্বাস করতেন, এই ধরনের কথাবার্তা বললে নিজেকে ও নিজের পরিবারকে অন্যদের সামনে জাহির করে তুলে ধরা হয়। এই ব্যাপারটা ওঁর একেবারেই পছন্দ ছিল না। আজ ওঁর মৃত্যুদিনে ওঁর জীবনের একটি অলৌকিক ঘটনার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সারাজীবনে হয়তো একবার কি দু’বার এ ঘটনার কথা তিনি জনসমক্ষে বলেছেন। ব্যক্তিগত হলেও, এই ঘটনাটি গুরুবাবা আমাদের বলেছিলেন।

Ali Akbar Khan – Ali Akbar College of Music

গুরুবাবার জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামে। তিন মাস বয়সে পিতার কর্মস্থল মধ্যপ্রদেশের মাইহারে চলে যান। ওঁর মূল শিক্ষা সেখানেই, বাবার কাছে। এছাড়া কিছুদিন মেজ জ্যাঠামশাই কালীসাধক ফকির আফ্‌তাবউদ্দিন খান সাহেবের কাছে তবলা শিক্ষাও করেছিলেন।

গুরুবাবাকে খুবই চোখে চোখে রাখতেন আলাউদ্দিন খান। একমাত্র পুত্রসন্তান বলে যে সবসময় নজরে রাখতেন, তা কিন্তু নয়। আসলে খুব অল্প বয়সে খান সাহেবের একটা বড় দুর্ঘটনা ঘটে। তারপর থেকে তিনি আরও বেশি সাবধান হয়ে গিয়েছিলেন। গুরুবাবার যখন ৫-৬ বছর বয়স, সেই সময় আলাউদ্দিন খান সাহেবের শিষ্য যতীনবাবুর ছেলের পৈতে হয়। সেই অনুষ্ঠানে বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন গুরুবাবা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ফুলঝুরিজি। তিনিও তখন ছোট। এবং তিনি খুবই দুষ্টু ছিলেন।

বাবা আলাউদ্দিন, শিক্ষার্থী রবিশঙ্কর ও আলি আকবর খান

অনুষ্ঠান বাড়িতে গিয়ে গুরুবাবা আর ফুলঝুরিজি ছোটাছুটি করে খেলতে শুরু করেন। সেই বাড়িতে খানিকটা অংশ সিঁড়ি, তারপর খানিকটা চওড়া ফাঁকা– এরকম একটা জায়গা ছিল। ওঁরা দু’জন সেই সিঁড়িতে ওঠানামা করে খেলা করছিলেন। এইরকম খেলতে খেলতে গুরুবাবা সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে যান। মাথায় চোট লাগে; এবং তাঁর শরীরটা ওই চওড়া জায়গাটায় আটকে যায়। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ডাক্তার আসেন। তাঁর শরীর ততক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে। ডাক্তার তাঁকে পরীক্ষা করে দেখেন নাড়ি নেই। এবং তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

গুরুবাবাকে মাটিতে শুইয়ে রেখে সাদা কাপড় চাপা দিয়ে দেওয়া হয়। শোকাচ্ছন্ন আলাউদ্দিনজি বাজারে চলে যান দাফনের কাপড় কিনতে। আলাউদ্দিন খানের মেজদা ফকির আফ্‌তাবউদ্দিন খান সাহেবও তখন মাইহারে থাকতেন। প্রথমদিকে তিনি গুরুবাবাদের সঙ্গে এক বাড়িতেই থাকতেন। কিন্তু গুরুবাবাকে অতিরিক্ত শাসন করা নিয়ে একবার আলাউদ্দিন খান সাহেবের সঙ্গে তাঁর খুব ঝগড়া হয়; ফলে তিনি বাড়ি ছেড়ে স্থানীয় একটা দরগায় গিয়ে থাকতে শুরু করেন। এবং রামপুর পাহাড়ে তপস্যা করতেন। উনিও সেই মর্মান্তিক খবর পেয়ে চলে আসেন বাড়িতে।

Ali Akbar Khan (1922-2009): Sultan of strings - Frontline

মাইহারে অনেক পাহাড় আছে। তার মধ্যে রামপুর পাহাড়ে নীলকণ্ঠ মহারাজ নামে একজন বড় সন্ন্যাসী ছিলেন। গুরুবাবা তাঁর কাছে দীক্ষাও নিয়েছিলেন। তিনি খবর পেয়ে তাঁর শিষ্যের হাত দিয়ে কিছু একটা পাঠিয়েছিলেন, গুরুবাবাকে বাঁচানোর জন্য। ফকির আফ্‌তাবউদ্দিন তখন মন্ত্র বলতে বলতে গুরুবাবার শরীরের চারপাশে ঘুরছেন। সাত-আট পাক ঘোরার পর গুরুবাবার বুকে পা রাখলেন। শোনা যায়, পা রাখার পরই তিনি উঠে বসে গান গাইতে শুরু করেন। মেঘ রাগ। যে গান তিনি শিখেছিলেন তাঁর বাবার কাছে। ‘চলত শ্রীলঙ্কা বনে শ্রীরামচন্দ্র’। ইতোমধ্যে বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেবও হাজির দাফনের কাপড় হাতে। এরপর ধীরে ধীরে গুরুবাবা সুস্থ হয়ে ওঠেন।

আসলে তখন তো এখনকার মতো এত আধুনিক চিকিৎসা ব‌্যবস্থা ছিল না। তাই হয়তো যে ডাক্তার চিকিৎসা করতে এসেছিলেন তিনি বুঝতে পারেননি। যদিও অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শেষাবধি জবাব দিয়ে দেন। তবে এই ঘটনাটির অলৌকিকতা গুরুবাবাকে খুব স্পর্শ করেছিল। তিনি মনে মনে বিশ্বাস করতেন তাঁর ‘পুনর্জন্ম’ হয়েছে।

গুরুবাবা আলি আকবর খান সাহেবের সঙ্গে লেখক। ১৯৯৫। ছবি: রঘু রাই

আশ্চর্য হলেও, গুরুবাবার জন্মও হয়েছিল অলৌকিকভাবে। ওঁর জন্মের আগে ওঁর তিন দিদি– সরোজা, সরোজিনী ও জাহানারা জন্মগ্রহণ করেন। কোনও পুত্রসন্তান না হওয়ায় বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেবের মনে দুঃখ ছিল। রামপুরের এক মহাত্মা বা সাধুকে গিয়ে নিজের দুঃখের কথা বলেছিলেন তিনি। এবং শোনা যায়, সেই সাধুর দেওয়া এক ভস্ম স্ত্রীকে খাওয়ানোর পর পুত্র আলি আকবরের জন্ম হয়।

Ali Akbar Khan - Wikipedia

আলাউদ্দিন খান সাহেবের দীর্ঘ সংগীত জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় কেটেছে শিক্ষাগ্রহণে। বাকি জীবনের একটা বড় অংশই তিনি শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন। নিজের জীবনের এই আদর্শ তিনি পুত্রের চিন্তা-চেতনার মধ্যেও বুনে দিতে চেয়েছিলেন। তাই আলি আকবর খান সাহেবকে বলে গিয়েছিলেন, তিনি যেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শিখিয়ে যান। বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন তিনি। আমৃত্যু অনুসরণ করেছিলেন বাবা আলাউদ্দিনকে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে অবধি তিনি পুত্র আলম এবং আরও কয়েকজন ছাত্রছাত্রীকে রাগ দুর্গা ও কৌশিক কানাড়া শিখিয়েছিলেন। সংগীত ও সংগীত-শিক্ষার মধ্যে থাকতে থাকতেই তাঁর নশ্বর দেহ ছেড়ে পাড়ি দেন অমৃতলোকে।

…………………………….

ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল

…………………………….