Robbar

আমাদের দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছে নাটোরের জুকারবার্গ

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 14, 2025 7:25 pm
  • Updated:March 14, 2025 7:25 pm  

নীল রঙে আমাদের ঘুম ভাঙে। আর লালে ঘুম পায়। বৈজ্ঞানিকেরা বলেন, এগুলো সবই বিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। সকালের আলোয় নীল বেশি। হাজার হাজার বছর ধরে গুহা থেকে বেরিয়েই আকাশের দিকে তাকালেই একরাশ নীল আলো এসে রেটিনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। শরীরের কলকবজা তাতে নড়তে শুরু করে। আড়ষ্টতা কাটে। আড়মোড়া ভেঙে মানুষ হেঁটে যায় জলের দিকে। রাতে গুহার সামনেই আগুন জ্বলে। সেই আগুনে অনেক লাল এবং ইনফ্রারেড (অর্থাৎ লালের ওপারে)। সেই আলো দেখে মানুষের চোখ জুড়িয়ে আসে, অন্য মানুষের কাঁধে হাত রাখতে ইচ্ছা করে, তার আরাম হয়। তার মন চলে যায় ঘর, বাচ্চা, সঙ্গীর দিকে। শিকারের কথা তখন সে ভাবে না।

ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী

এই যেদিন প্রথম জানতে পারলাম, ভিজিবল স্পেক্ট্রাম আসলে সমস্ত তরঙ্গের লম্বা বারান্দায় দুটো থামের মাঝখানের একটা ছোট্ট অংশ, সেদিন থেকেই শৈশব শেষ হয়ে গেল। শৈশব শেষ হওয়া মানে বিশ্বাস হারানো। যা আমার আশপাশের নিশ্চিন্ত পৃথিবী তার প্রতি সন্দেহের চোখে তাকানোর অভ্যাসের শুরু।

তার মানে আসলে কিছুই কিছু নয়। যা দেখছি তার বাইরে বহু বহু রং আছে, যা শুনছি তার বাইরে বহু বহু শব্দ আছে। এমনকী, কোনও কিছুরই কোনও রং নাকি নেই। একটা জিনিস লাল বা সবুজ এই কারণেই লাগছে, কারণ তার পিগমেন্টগুলো বাকি সমস্ত কিছু শুষে নিয়ে শুধু ওইটুকুই আমাদের চোখে ফিরিয়ে দিচ্ছে। একে চন্দ্রবিন্দুর ভাষায় চোখে ‘ঝিলমিল লাগা’ বা একটু জ্ঞানগম্ভীর গলায় ‘জ্ঞানচক্ষুর উন্মীলন’ও বলা যেতে পারে।

This may contain: the starry night painting is shown in this image
নীলচে রাত। শিল্পী: ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ

তারপর থেকেই শুরু হয় সারাক্ষণ হিসাব মিলাতে পারা বা না-পারার গল্প। যেমন সব মায়া, আবার মায়াও নয় ঠিক। আসলেই যদি কোনও বস্তুর কোনও রং না থাকে, তাহলে রং আমাদের শরীরের এত ওতপ্রোত অংশ কেন? আরেকটু বড় হয়ে পড়লাম ডায়ারনাল সাইকেল বা সার্কেডিয়ান রিদম অথবা দিন রাতের বায়োলজিক্যাল ঘড়ি যা নাকি আমাদের সবার শরীরে বিদ্যমান। এই ঘড়ি চোখে দেখা যায় না, ব্যাটারিতে চলে নাকি দম দিতে হয় তাও জানা নেই। কাঁটাগুলো কীভাবে ঘোরে তাও দেখা যায় না । কিন্তু ঘড়ির বাস্তব শারীরিক চাক্ষুষ প্রমাণ সর্বত্র। এই যে পাখিগুলো ঠিক রাত্রি তিনটে চল্লিশ মিনিট থেকে কিচিরমিচির শুরু করে, পোষা কুকুর চারটে বাজার ঠিক এক মিনিট আগে মুখে বকলেস নিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে থাকে– এগুলো সবই নাকি বায়োলজিক্যাল ক্লক বা জৈবিক ঘড়ি। এই ঘড়ি নাকি চালিত হয় আলো দিয়ে। আসলে রং দিয়ে। যেটুকু শরীর নিতে পারে জৈবিক ঘড়ি, ঠিক ততটুকুই পড়তে পারে। বাম প্রান্তে ভায়োলেটের একটা স্তর থেকে ডান-প্রান্তে লালের আরেকটা স্তর অবধিই তার যাতায়াত।

Planet Earth Rotates In Space 2019999 Stock Video at Vecteezy
নীল রঙের গ্রহ

তাই নীল রঙে আমাদের ঘুম ভাঙে। আর লালে ঘুম পায়। বৈজ্ঞানিকেরা বলেন, এগুলো সবই বিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। সকালের আলোয় নীল বেশি। হাজার হাজার বছর ধরে গুহা থেকে বেরিয়েই আকাশের দিকে তাকালেই একরাশ নীল আলো এসে রেটিনায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। শরীরের কলকবজা তাতে নড়তে শুরু করে। আড়ষ্টতা কাটে। আড়মোড়া ভেঙে মানুষ হেঁটে যায় জলের দিকে। রাতে গুহার সামনেই আগুন জ্বলে। সেই আগুনে অনেক লাল এবং ইনফ্রারেড (অর্থাৎ লালের ওপারে)। সেই আলো দেখে মানুষের চোখ জুড়িয়ে আসে, অন্য মানুষের কাঁধে হাত রাখতে ইচ্ছা করে, তার আরাম হয়। তার মন চলে যায় ঘর, বাচ্চা, সঙ্গীর দিকে। শিকারের কথা তখন সে ভাবে না। ঝগড়া করতে ইচ্ছা করে না। সে ঘুমিয়ে পড়ে। অর্থাৎ সবই মায়া, কিন্তু সেই মায়াটি কায়ার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। এটাকে দ্বন্দ্ব ভাবলে দ্বন্দ্ব, দ্বৈততা ভাবলে তাই।

Story pin image
ছবিটি প্রতীকী

আরেকটু বড় হয়ে রাস্তাঘাটে ঘুরতে ঘুরতে মানুষ দেখতে দেখতে এই বোধে পৌঁছেছি যে, এই দ্বন্দ্ব ও দ্বৈততারও একটা নিজস্ব সংঘাত আছে। তা পেন্ডুলামের মতো এপাশ-ওপাশ করতে থাকে নিরন্তর। স্বাভাবিক বিবর্তনের মানসিকতায় দ্বন্দ্ব আমরা বুঝি ভালো। জঙ্গলের ওপারে যে থাকে সে স্বাভাবিকভাবেই শত্রু। আমার মতো যে নয়, সে আমার বৈরি তো বটেই। কিন্তু আমার মতো যে নয়, সে আলাদা হয়েও আবার আমারই মতো– এইটা  বিবর্তন-বিরোধী বোধ। এই বোধ সভ্যতার অংশ। এর যাত্রাপথ ভঙ্গুর, উচ্চাবচ। একটু এগিয়ে অনেকটা পিছিয়ে আবার জিরোতে থাকে। ভয়ে ভয়ে দু’হাত দিয়ে চোখ ঢেকে ফেলে। আঙুলের অল্প ফাঁক দিয়ে দেখে দূরে একটা পাহাড়ের মাথায় কমলা চুলঅলা ফ্যাটফেটে সাদা একটা লোক প্রবল চিল্লাছে। সবাইকে শত্রু বলে উড়িয়ে দেওয়ার হুংকার দিচ্ছে। সে জানে কমলা রং মিথ্যে। কিন্তু লোকটা মিথ্যে নয়। তার নাম নাকি ডোনাল্ড ট্রাম্প। সে একবার ডোনাল্ড ডাকের কথা ভাবে একবার ভাবে ট্রাম্পেটের কথা। তার কার্টুন আর বাস্তবতা গুলিয়ে যায়। কিন্তু লোকটা মিথ্যে নয় আর তার আশপাশে হলদে-সবুজ ওরাংওটাং-এর মতো নানা লোকজন যে ‘হাউডি হাউডি’ করছে তারাও ঘোর বাস্তব। তাদের সত্যিকারের বুলডোজার সত্যিকারের ঘরবাড়ি ভেঙে চুরমার করে দেয়।

How bulldozers became a vehicle of injustice in India
সাম্প্রতিক ভারতে যে বাহনের ব্যবহার বেড়েছে

ভাং না-খেয়েই এলোমেলো বাজে বকছি দোলের দুপুরে। পেন্ডুলামটা হাতে ধরে একটু থামিয়ে পয়েন্টে ফেরার চেষ্টা করি।

রং অবাস্তব কিন্তু তার দৈনন্দিন ডিসিপ্লিনটি ভয়ানক শারীরিক। এবং মানসিকও বটে। লক্ষ হাজার বছর ধরে এই নিয়ম মানতে মানতে তারপর হঠাৎ করে আধুনিক হয়ে গিয়ে আমাদের হয়েছে মহা গন্ডগোল! আমাদের নীল রং ঢুকে গেছে রাতে, আর লাল রং হয়ে দাঁড়িয়েছে ষাঁড়ের সামনে উড়ন্ত কাপড়। নীল শিকারের রং। তা দিয়ে মানুষ আড়মোড়া ভাঙে, দল বেঁধে বল্লম-ছুরি নিয়ে হইহই করতে করতে হরিণের পিছনে ছোটার শক্তি পায়। যেদিন থেকে বাড়িতে টিউবলাইট ঢুকে এল, সেই দিন আমাদের রাতের চরিত্রগুলো পাল্টাতে শুরু করল। তারপর টেলিভিশন, কম্পিউটার ঘুরে হাতের তালুতে ছোট্ট মোবাইলের ভেতরে ঘুরপাক খেতে খেতে নীল রং এখন আমাদের ভীষণ প্রিয়। আমাদের রাত এখন নীল। রাত নীল হয়ে গেলে ডাক্তাররা চিন্তিত হয়ে পড়েন। চোখের বাজার ব্লু কাটিং গ্লাস তৈরি করে। রাতের বেলায় নীল রং আমাদের কী কী সর্বনাশ করে ইন্টারনেট খুললেই তার হাজারো রিল চোখে ভাসতে থাকে। কিন্তু ডাক্তাররা শুধু তো শরীরের কথা বলেই ক্ষান্ত। এত নীল রং রাতের বেলা আমাদের হান্টার গ্যাদারার মনকেই বা ছেড়ে দেবে কেন? কিন্তু রাতের বেলা বল্লমই বা কোথায় আর হরিণই বা পাই কই? কংক্রিটের আলো ঠিকরানো টাওয়ারগুলোকে জঙ্গল ভাবতেও মন সায় দেয় না।

ছবিটি প্রতীকী। ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

কিন্তু রেটিনায় এত নীল রং নিয়ে চুপচাপ শান্তভাবে সঙ্গিনীকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোই কী করে?

সভ্যতার এই ভয়ানক মানসিক সংকটে আমাদের দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছে নাটোরের জুকারবার্গ।

টুপ করে আমাদের স্ক্রিনে ভাসিয়ে দিয়েছে একটা নীল রঙের ফেসবুক।

এবার আর সমস্যা হচ্ছে না। বল্লম, হরিণ, জঙ্গল– সব হাতের কাছে চলে আসছে এক লহমায়। রাত হলেই লাখো লাখো হান্টার গ্যাদারার বেরিয়ে পড়ছে নীল রঙের তাড়নায়। একে দেশছাড়া করছে, তাকে ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে, বাকি সবাইকে বলছে গদ্দার।

masjid mosques covered plastic sheets holi procession uttar pradesh
দোলের রং থেকে বাঁচতে উত্তরপ্রদেশের এক মসজিদ ঢেকে দেওয়া হয়েছে কাপড়ে

তাঁদের হাতে অনেক রং। একটু আগে ওই নীল রঙের ফেসবুকেই দেখলাম তারা মসজিদের কাপড় সরিয়ে মহা উল্লাসে রং মাখাচ্ছে। তারা হান্টার গ্যাদারার। হরিণ শাবক পেলেই খুশি।

আর পাহাড়ের মাথায় ওই যে কমলা রঙের ট্রাম্পের আশপাশে হলদে সবুজ ওরাংওটাংগুলি, যাদের দোস্তি ‘অনন্তকাল বনি রহেগি’– তাদের চোখে নেমে আসছে শান্তি স্বস্তির রাত্রিকালীন ঘুম। বড় মায়াময় নিশ্চিন্ত পৃথিবী তাদের।

এই নীল রং তাদের সত্যিই ভীষণ প্রিয়।