সত্যি, রোজ চান করে কী তীরটাই মারছি আমরা? ক’টা যুদ্ধ, অতিমারী বা ভোটের কেত্তন থামাতে পেরেছি দু’বেলা শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে? আরে বাবা, চান না করলে হবেটা কী? চানপার্টি বলেন, সর্বনাশ হবে। যেমন কিছুদিন পরেই গা থেকে দুর্গন্ধ বেরতে পারে। আমি বলি, সে গন্ধ নিজের নাকে সয়ে যাবে। আর চান করলেও তো ডিওডোরেন্ট বা পারফিউম মাখে পাবলিক। তার চেয়ে গন্ধ থাকুক গায়ে, তাহলে কিছু উটকো জনতা কেটে পড়বে পাশ থেকে।
প্রচ্ছদের কার্টুন সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়
চান করব না গা ধোব? আমেরিকার ডাক্তার জেমস হ্যাম্বলিন দাবি করেছেন– এর কোনওটারই প্রয়োজন নেই। চানের সঙ্গে হাইজিনের ভাইজান টাইপের কোনও সম্পর্ক আছে কি না, সেটি জানার জন্য উনি বছর পাঁচেক চান না করে ছিলেন। কয়েক বছর আগে একেবারে নিশ্চিত হয়ে জানিয়েছেন যে, আমাদের মনের গভীরে গায়ের চামড়া জল দিয়ে নিত্য ধুয়ে ফেলার যে ব্যাকরণ– সেই বাল্যকাল থেকে ঠুসে দেওয়া হয়েছে, তার কোনও ভিত্তিই নেই! গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো উনি আরও যোগ করেছেন যে– সাবান, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার ইত্যাদি সুগন্ধি ফেনিল বস্তু কোনও উপকার তো করেই না বরং ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোকে গলা টিপে মেরে তারা আদতে ত্বকের সর্বনাশ করে!
জেমস ডাক্তারের বক্তব্য পড়ে ছোটবেলার ডাক্তারমামাকে মনে পড়ে গেল। নিজের মামা নন, কিন্তু পাড়ায় আমার বয়সি প্রায় সবারই ডাক্তারমামা। বিধান সরণি আর বিবেকানন্দ রোডের ক্রসিং-এর কাছেই ওঁর ল্যাবরেটরিতে উনি দিনের (এবং কখনও রাতেরও) বেশিরভাগ সময় কাটাতেন। টিমটিমে আলো জ্বলা স্টাডি, প্রাচীন টেবিল, চেয়ার, বইয়ের আলমারি। বাইরে খাঁচায় কিছু সাদা ইঁদুর আর খরগোশ রাখা থাকত। যেহেতু সারা বছরই জ্বরজ্বালা লেগে থাকত তাই ওঁর চেম্বারে ওই ইঁদুর আর খরগোশদের মতোই দাপট ছিল আমার। ডাক্তারমামা বছরভর ধুতি আর পাঞ্জাবি, ঘিয়ে রঙের। শীতকালে গায়ে শাল জড়ানো। যে আত্মীয়ই নিয়ে যেতেন আমায়, বিভিন্ন অনুযোগ উগরে দিতেন আমার নামে। এই খাই না, সেই খাই না ইত্যাদি। মা অবিশ্যি আরও একটি যোগ করতেন– কিছুতেই ভালো করে চান করতে চায় না এই ছেলে। ডাক্তারমামা চোখ আধবন্ধ রেখে বলতেন, হুমম…। একবার সাঁতারে ভর্তি করলে শরীর সারবে কি না, জিজ্ঞেস করতে উনি প্রায় আর্তনাদ করে উঠেছিলেন, কোনও দরকার নেই অত জল ঘাঁটার!
একটু বড় হয়ে জানলাম আসলে ওঁর নিজেরই চানে প্রবল অনীহা। আর সাঁতার শিখতে গেলে আগে চান, তারপর জলকেলি, আবার চান। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এই জটিলতায় উনি আমার মতো অপাপবিদ্ধ শিশুকে জড়াতে চাননি– সেটা বোঝার পর থেকে ওঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। চান না করলেও ওঁর গা থেকে কোনও দুর্গন্ধ পাইনি কোনও দিন। বেশ একটা ধূপ-ধুনো গন্ধ ভেসে বেড়াত মাকড়সার জাল ঢাকা বন্ধ জানলার স্টাডিতে। অথবা, হয়তো নিজের আর ওঁর গায়ের গন্ধ হাতে হাত মিলিয়ে আমার নাককে বোকা বানিয়েছে বছরের পর বছর।
শুধু ডাক্তাররাই নন। এই না-চানের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন আরও অনেক তালেবর। মূলত বিদেশে। পৃথিবীবিখ্যাত পাঠশালা, আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গ্র্যাজুয়েট, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ডেভ হুইটলক পাক্কা ১২ বছর চান না করে যুক্তি দিয়েছেন যে, চান করার সুফল জানার জন্য যখন কোনও ক্লিনিকাল ট্রায়াল হয়নি, তখন চান করলে শরীর সুস্থ থাকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া নিতান্ত বালখিল্যপনা। মাঝখান থেকে এক কাঁড়ি জল নষ্ট, ভালো ব্যাকটেরিয়ার বিনাশ, চামড়াকে অকারণ উত্তেজিত করা। সত্যি, রোজ চান করে কী তীরটাই মারছি আমরা? ক’টা যুদ্ধ, অতিমারী বা ভোটের কেত্তন থামাতে পেরেছি দু’বেলা শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে? আরে বাবা, চান না করলে হবেটা কী? চানপার্টি বলেন, সর্বনাশ হবে। যেমন কিছুদিন পরেই গা থেকে দুর্গন্ধ বেরতে পারে। আমি বলি, সে গন্ধ নিজের নাকে সয়ে যাবে। আর চান করলেও তো ডিওডোরেন্ট বা পারফিউম মাখে পাবলিক। তার চেয়ে গন্ধ থাকুক গায়ে, তাহলে কিছু উটকো জনতা কেটে পড়বে পাশ থেকে।
কেবল সাচ্চা প্রেম যদি হয় সে গায়ের আসল গন্ধের টানেই আসবে। সেইদিনের অপেক্ষায় থাকো। নিন্দুকরা উত্তেজিত হয়ে বলেন, আরে বাবা, এরপর চামড়া খসখসে হয়ে যাবে। চামড়ার ওপর আরেক পরত চামড়া তৈরি হবে। আরে! সে তো একপক্ষে ভালোই। নিখরচায় মোটা চামড়া হয়ে যাব। যে কোনও রাজনৈতিক দল লুফে নেবে। এরপর যদি খোসপাঁচড়া হয়? আর ননস্টপ খুজলি? তাতে আর কী হবে? কেউ না কেউ তো না চাইতেই নিত্যদিন চুলকে দিচ্ছে রাস্তাঘাটে। সে অফিস হোক বা শেয়ার বাজার, স্কুল-কলেজ, রাজনৈতিক দল বা প্রশাসন। তার চেয়ে নিজের গায়ে খুজলি থাকলে নিজেই চুলকোব। একটা ক্রিয়েটিভ প্রসেসের মধ্যে থাকা যাবে সারাক্ষণ। আর তার ফলে দীর্ঘ আয়ু হবে নিশ্চিত। এই যেমন ইরানের এক প্রত্যন্ত গ্রামের জনৈক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। বছর তিনেক আগে মারা যাওয়ার পর খবর হয়েছিলেন। উনি একটানা ৬০ বছর চান না করে পৃথিবীর সবচেয়ে নোংরা লোক হিসেবে স্বীকৃতি পান। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪। গ্রামের লোকজন ওঁকে খাবার-দাবার দিয়ে সাহায্য করতেন। যতই হোক উনি তো একজন ‘সেলেব্রিটি’। গা চুলকে চুলকে রক্ত বের করে ফেলছেন, কিন্তু চান করাতে গেলেই ভয়ে কাঁপছেন। শেষে যখন পুঁজ-রক্ত শরীরে মেখে গেল, গ্রামবাসীরা আর সে দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না। তাঁরা জোর করে চান করিয়ে দিলেন। ওই চানের কয়েক মাসের মধ্যেই ওই নোংরা ভদ্রলোকের মৃত্যু হয়।
…………………………………….
একবার লং উইকেন্ডে এরকম একটি ঠেকে গিয়েছি। শুক্রবার দুপুরে প্রবেশ। কথায় কথায় বেলা হয়ে রবিবার রাত। খেতে যাব। এক বন্ধু তার ফ্ল্যাটমেট-কে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আমি শেষ কবে চান করেছি মনে আছে তোমার? তার ফ্ল্যাটমেট কড়ি গুনতে শুরু করল কিন্তু কোনও সদুত্তর দিতে পারল না। আমি মিনমিন করে জিজ্ঞেস করি, ভাই, চান না করে তোমার কোনও অসুবিধা হয় না? যে দীর্ঘ বক্তৃতা শুনি সেই রাতে, চানের সম্পর্কে আমার ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে। আমি মিনমিন করে বলতে যাই চান ব্যাপারটা না থাকলে কিন্তু ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’-এর জিনাত আমন বা ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’র শ্রীদেবী বা ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’-র মন্দাকিনীর ওই দৃশ্যায়নগুলো সম্ভব হত না।
…………………………………….
যে ক’টা শীত আমেরিকায় কাটিয়েছি, চান এক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল। আসলে ছোটবেলার অভ্যেস। যা শেখানো হয়েছে। সাহেবরা নাকি চান করে না। আর যেহেতু বাহ্যি করে কাগজ ব্যবহার করে তাহলে বুঝতেই পারছ পিছনদিকেও কী অবস্থা। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের খাঁজে খাঁজে জলের ব্যবহার আমাদের গর্বের অভ্যাস। এই খেলায় সাহেবদের আমরা দু’তিন গোল দিতে পারি– সেই শিক্ষা নিয়ে বিদেশ গেছি। কিন্তু রোমে গেলে রোমান হতেই হবে। আর তার ওপর বসন্তকালেও যা ঠান্ডা ইস্ট কোস্টে! দিনের বেলা গায়ে জল ঢালার ইচ্ছেই হয় না। সপ্তাহের কাজের দিনগুলোতে রাতের দিকে একটু উষ্ণ জলের ছিটেমাত্র। সপ্তাহান্তে কোনও না কোনও বন্ধুর বাড়িতে ঠেক। কথার পিঠে কথা, সংস্কৃতির বন্যা। ওই ঘোলা বানের জলে চানের প্রশ্নই ওঠে না। একবার লং উইকেন্ডে এরকম একটি ঠেকে গিয়েছি। শুক্রবার দুপুরে প্রবেশ। কথায় কথায় বেলা হয়ে রবিবার রাত। খেতে যাব। এক বন্ধু তার ফ্ল্যাটমেট-কে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, আমি শেষ কবে চান করেছি মনে আছে তোমার? তার ফ্ল্যাটমেট কড়ি গুনতে শুরু করল কিন্তু কোনও সদুত্তর দিতে পারল না। আমি মিনমিন করে জিজ্ঞেস করি, ভাই, চান না করে তোমার কোনও অসুবিধা হয় না? যে দীর্ঘ বক্তৃতা শুনি সেই রাতে, চানের সম্পর্কে আমার ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে। আমি মিনমিন করে বলতে যাই চান ব্যাপারটা না থাকলে কিন্তু ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’-এর জিনাত আমন বা ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’র শ্রীদেবী বা ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’-র মন্দাকিনীর ওই দৃশ্যায়নগুলো সম্ভব হত না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ভয়ংকর পুরুষতান্ত্রিক কামতাড়িত কথা বলে ফেলছি ভেবে সেটা গিলে নিই। অন্য কেউ চান করল কি না করল, তাতে আমার কী? আমি চান করি বা না করি তাতে তোমার কী? এই হল প্রকৃত সাম্যবাদ। কবিগুরুও কিন্তু নবধারাজলে চান করতে বলেছেন। যতক্ষণ না নতুন জল পাচ্ছি কলে, চান করার কোনও মানেই হয় না।
কোভিডের বাজারে কবিদের কথা যদিও কেউ মনে রাখেনি। যখন তখন ঢেলে চান করার নির্দেশিকা এমন বদভ্যাস ধরিয়েছে পাবলিকের যে, এখনও একটু ‘ভাইরাস ভাইরাস’ হাওয়া উঠলেই লোকে সকাল, সন্ধে কিংবা মাঝরাতে হুসহাস নাইতে নামছে। এর চেয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ জল খেয়ে কায়িক শ্রম করে ঘাম ঝরানো ভালো। যেমন করেন প্রাজ্ঞ রিকশাওয়ালা, মুটে বা ঠেলাওলারা। ওই রিসাইকেল্ড জলেই তো ওঁরা চান করে আসছেন এতদিন। গায়ের ময়লার কেয়ার করেন না, চামড়ার নিচের ময়লা ঘামের সঙ্গে বেরিয়ে আসে আর তাদের পটাং করে মেরে ফেলে ভালো ব্যাকটেরিয়ার দল। অথবা ওই ইরানি বৃদ্ধের মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে। ফুটপাথের ধারে, রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের সিঁড়ির কোণে সংসার পেতে ফেলো। জট পড়া চুল, খসখসে চামড়া, চুলকে দ্গদগে ঘা করে ফেলা বুক-হাত-পেট-কুঁচকি-পা। জনতা ‘পাগল’ বলে দাগিয়ে দেবে। তাতে কোনও আসুবিধে নেই। কবীর সুমন শিখিয়েছেন, এই না-চান চেহারার মানুষই বিধাতার সঙ্গে সাপ-লুডো খেলতে পারে বিন্দাস। সেই খেলায় কোনও নোংরামি নেই।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে যে মন্ত্রিত্বই তাঁর হাতে থাক, বুদ্ধদেব ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে অতি নির্ভরযোগ্য এক সেনাপতির মতো। ‘আপনারা বুদ্ধর কাছে যান, বুদ্ধ ওসব কালচার-ফালচার বোঝে’– জ্যোতিবাবুর এই উক্তি যথার্থ কি না জানি না, কিন্তু কথাটা মিথ্যে ছিল না।
বিশ শতকের বাংলা পত্রিকার ইতিহাসে ‘প্রবাসী’ এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে আর এই পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে বাংলা প্রকাশনার একটা মানদণ্ডও তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু দণ্ড মিললেও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মতো দণ্ডধারী মেলা খুবই কঠিন ছিল। কথাটা সে-যুগের মতো এ-যুগেও সত্যি।
প্রীতীশদা বলতেন, আমি এই ‘লাভ’ (love) শব্দটাকে একেবারে পছন্দ করি না। আই লাইক ‘হেট’ অর ‘রেসপেক্ট’– এখন বুঝি, এটা বজায় রাখার জন্যই প্রীতীশদার এত পাগলামি! ‘এক্সট্রিমিস্ট’ যাকে বলে আর কী! ওঁর বিশ্বাস, পৃথিবী কালকেই শেষ হয়ে যাবে, যা করার আজকেই করতে হবে এবং তা হবে জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ।