আলুথালু ধাপ ভেঙে ছেলেটি স্নান করতে নামলেই, ‘পাহাড়ি সুড়ঙ্গে বাজনা বাজে/ গাছের জরায়ুকোণ থেকে/ অগ্নির রঙিন বিন্দু ছিটকে পড়েছে ঝরনায়।’ এই সেই ফিমেল গেজ, যা একটি পুরুষের স্নানরত সৌন্দর্যকে দ্যাখে। ‘আবিষ্ট যৌবনা জল উড়ে এসে/ ভেঙে দেয় তাকে।’ এই ‘আবিষ্ট যৌবনা’ কি শুধুই জল? না, কবির নারীসত্তাও? ‘সাদা পাথরের প্রাকৃতিক কারুকাজ/ ঘুমন্ত ঊরুর একখানি/ স্তব্ধ গর্ভে/ টেনে নিল দূর পাহাড়ের জন্মদেশ।’
স্নান হয় অনেক রকম। অবগাহন, ধারাস্নান, বর্ষাস্নান। কিন্তু কবিতার স্নান?
দেবারতি মিত্রর (Debarati Mitra) কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে একজন বলেছিলেন, তাঁর কবিতা পড়লে স্নানের অনুভূতি হয়। এখানে তিনি শুদ্ধতা, স্নিগ্ধতার কথাই বলতে চেয়েছিলেন। আমার কিন্তু দেবারতির কবিতা পড়তে গেলে ঠিক এমনটা মনে হয় না। তাঁর লেখার অপার স্নিগ্ধতার আড়ালে থাকে আধিদৈবিকতার, অলৌকিকতার চোরাগোপ্তা মার, যা এক এক সময় প্রবল অস্বস্তিসঞ্চারী। আর থাকে এক নিবিড় ফিমেল গেজ– যা দিয়ে তিনি পুরুষকে, পুরুষের সৌন্দর্যকে দেখেন।
‘যুবকের স্নান’ বইটি বেরিয়েছিল ১৯৭৮ সালে। তাঁর তৃতীয় বই। ততদিনে তাঁর নিজস্ব কবিতাভাষা তৈরি হয়ে গিয়েছে। বইটির নাম-কবিতাতেই শুধু নয়, আরও অনেক জায়গাতেই দেখছি জলের অনুষঙ্গ। প্রথম কবিতা ‘একটি বাজনা গাছ’। এ কবিতায় পাই–
‘লুপ্ত বালিকার মতো চুপ জল।
…
গোল ফোয়ারার মতো আকাশের নীচে
সে যেন আরম্ভ হল এইমাত্র।’
কে সেই বাজনা গাছ? সে কি কোনও পুরুষেরই প্রতিরূপ?
দ্বিতীয় কবিতা ‘নেই ফুল নেই গাছ’-এ দেখি–
‘পাশাপাশি দুটো মার্বেল পাথরের হ্রদে
সোনার মুকুট আর ১২ই এপ্রিলের দিন
ডুবিয়ে রাখলে
বরং কম জল উপচে
পড়ছে দ্বিতীয় থেকে–
ভেজো কি না ভেজো, এত দাম!’
কী ছিল এই ১২ এপ্রিলে? সে তো তাঁরই জন্মদিন! জন্মের আনন্দ, জন্মানোর রহস্য তাঁর কাছে কি পরতে পরতে খুলে দিচ্ছে এই জীবন ও জগৎকে?
পরের কবিতাই ‘যুবকের স্নান’। আলুথালু ধাপ ভেঙে ছেলেটি স্নান করতে নামলেই…
‘পাহাড়ি সুড়ঙ্গে বাজনা বাজে
গাছের জরায়ুকোণ থেকে
অগ্নির রঙিন বিন্দু ছিটকে পড়েছে ঝরনায়।’
এই সেই ফিমেল গেজ, যা একটি পুরুষের স্নানরত সৌন্দর্যকে দ্যাখে।
‘আবিষ্ট যৌবনা জল উড়ে এসে
ভেঙে দেয় তাকে।’
এই ‘আবিষ্ট যৌবনা’ কি শুধুই জল? না, কবির নারীসত্তাও?
‘সাদা পাথরের প্রাকৃতিক কারুকাজ
ঘুমন্ত ঊরুর একখানি
স্তব্ধ গর্ভে
টেনে নিল দূর পাহাড়ের জন্মদেশ।’
পুরুষকে ভালোবেসে, পুরুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে বারবার নিজের গর্ভের অন্ধকারে ডেকে নিয়েছেন তিনি বারবার। এখানে মনে পড়বে তাঁর অফলা, জরায়ুর শোকের কথা। আরও বেশি করে মনে পড়বে তাঁর জীবনের শেষ লেখাগুলির কথা, যেখানে যৌনতার বোধ লুপ্ত হয়ে প্রয়াত স্বামীকে তিনি বারবার ফিরিয়ে এনেছেন সন্তানকল্পে।
এই বইয়ে জল আসছে কতবার। ‘ঝরনা সহস্রধারা’-তে–
‘অদর্শন কিছু নয়,
তোমাকে দেখার ইচ্ছে শুধু আমারই কি?
বাঁশিটির তরুণ নিশ্বাস
ফুঁ দিয়ে সরায় জল, চলকানো রোদ’
বনময় যে শুয়ে থাকে, যে-ঘুমন্তের উজ্জ্বল ত্বকের মতো তার ঝরনাও হয়ে যায় সহস্রধারা। তারপর?
‘আর কি থাকছে বাকি?
অদর্শন কিছু নয়।’
বেড়াতে ভালোবাসতেন দেবারতি মিত্র। খুব দূর বিদেশে নয়, কিন্তু যেখানেই যখন গিয়েছেন, সেই নিসর্গ উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। বনজঙ্গল, নাম-না-জানা ফুল আর ঝরনাধারা। বাইরের জিনিস যেমন কবিতায় এসে যেন অবতল কাচের তলায় বেঁকেচুরে যায়, অবচেতন থেকে তুলে আনে স্মৃতি ও স্বপ্নের বীজ, তেমনিটাই দেখি দেবারতির কবিতায়–
‘আরোহীবিহীন কেন এসেছিলে চাঁদ?
কেন ঘুরছিল বিরাট ফোয়ারা
তরল বাগান ঢেকে?’
আবার জলের তারল্যে ভেসে যায় তাঁর বাগান, বিরাট ফোয়ারা থেকে ছিটকে পড়ে জল। কোন জল, আদিপৃথিবীর, না যৌথ অবচেতনের?
তখনও দেবাঞ্জলি আছেন, দেবারতি লিখলেন–
‘ভাইবোন পুকুরে নেমে
গা ডুবিয়ে একটি ডাকপাখি
ঘুমিয়েই পড়েছিল, ও আমার বোন?’
জঙ্গল অলীক হয়ে ওঠে যখন পড়ি:
‘বেপথু সবুজ নাকি এইখানে
খেলা করেছিল
…
কেন বা দেখালে কেন হল হাঁটু অবধি জল।’
আর জল নামে প্রেমেও। ‘বিবাহ’ কবিতায়–
‘দেবকমণ্ডলু থক্র কুলুকুলু নীল দুধ বয়ে আসে
হৃষীকেশ, কনখল, কেদারবদরিতে
…
এখানে ত্বকের শেষ আবরণও ভেসে যায়
স্নিগ্ধ গঙ্গাস্রোতে
…
ক্রমে তারা লুপ্তপ্রায়
মেয়েটির কাঁচা সিঁথি আলো করে
ফুটে ওঠে সন্ধিলগ্ন, জ্বলত সিঁদুর।’
কোজাগরী পূর্ণিমায় লক্ষ্মী যখন নেমে আসেন–
‘স্তনের নিবিড়ে তাঁর সে রকম ফিকে ভোর-আভা
স্নেহ দুধ মধু শরীরতা
মাথা রেখে ভেসে যাই
নদীজলে ভারি চুপচাপ
স্পষ্ট চিহ্ন আঁকা গোল ভরা ঘট
বিরল নিভৃতে’
কবিতার নাম ‘যুবকের স্নান’, কবিতার নাম ‘আদিম ভাসান’, কবিতার নাম ‘লক্ষ্মীডুবি দিঘি’। জলকে, স্নানকে কি অনায়াসে তুলে আনেন কবিতায়, আর রং পালটে পালটে, অপরধারা হয়ে তারা কোথায় যে ডুব দেয়, কোন অবচেতনার নিতল স্তরে!
‘হৃদয়ে, স্তব্ধ হয়ে যেতে পারো, তুমি মেধারই মতো
লুপ্তসংকেত জলজ ঝাঁজির
অসংখ্য নমনীয় ডালপালার মধ্যে মাত্র একটি।
বিষাদগাঢ় বিনুনির,
যতরকম সম্ভব প্রাকৃতিক নারীদের জন্মবীজ নিয়ে
যেমন সমুদ্রে খেলা করে পৌত্তলিক সূর্য।
…
ও ফোয়ারা,
এরোপ্লেনের চাকার মতো ঘুরছ কেন অত–
টেনে নাও আমাকে টেনে নাও।’
জল রয়েছে, ডুবে-যাওয়া রয়েছে, স্নান রয়েছে দেবারতি মিত্রর ‘যুবকের স্নান’ বইটিতে। তবু শেষ কবিতায় যেন অনুযোগের ছলেই বলেন:
‘মেঘের দল তোমার অযথা মন-কেমন-করা বলে
আমি দু’চক্ষে বৃষ্টি দেখতে পারি না’
আর শেষে বইটির সবচেয়ে যে আশ্চর্য পঙক্তিগুলি,
‘অলস ঘূর্ণিতে নির্ভার নৌকো
নৌকো
আরও নৌকো আরোহীবিহীন
কতদিন ধরে
এমনকী এখনও
সূর্য, আমি দেবারতি তোমাকে এভাবেই…’
পাঠক হিসেবে এই জলময় স্নানজগতের সামনে তখন মাথা নিচু হয়ে আসে।
আমাদের ছোট শহরে এবং তার আশপাশের গ্রামগঞ্জে গত এক দশকে যে পরিমাণে বট অশ্বত্থ জাতীয় বড় বড় গাছ কাটা পড়েছে, তার হিসাব নেই। দুঃখের বিষয় এই অঞ্চলের মানুষজনের এবং মিডিয়ার কোনও হেলদোল দেখা যায় না। যেমনটা হয়েছিল যশোর রোডের গাছ কাটার সময়।
রাষ্ট্রের চোখরাঙানি উপেক্ষা করেই জেল এবং বাইরের প্রিয়জনদের সেতু গড়তে থাকে। জামিনপ্রাপ্ত বন্দিরা জান কবুল করেন ভিতরে থাকা বন্ধুদের বার্তা তাঁর প্রিয়জনদের পৌঁছে দিতে। নজরদারিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চলতে থাকে চিঠি চালাচালি। প্রিয়জনদের কাছে যাওয়ার জন্য, ক্ষণিকের মুলাকাতের জন্য।
আমরা নিজেরাও আমাদের চারপাশের মানুষ সম্পর্কে একটা নির্দিষ্ট ধারণা গড়ে নিই। সেই ধারণাকে ঘিরে একটা বেড়া তৈরি করি। সেখান থেকে কেউ একটু এদিক-ওদিক হলেই মুশকিল! ঋতুদা, আমাদের ঋতুদা– সে সারাক্ষণ নানা বৌদ্ধিক আড্ডার শিরোমণি, তাকে সেটুকু দেখতেই আমি স্বচ্ছন্দ, হিসেবের বাইরে হলে, মেলাতে অসুবিধে। ঋতুদার যে একটা অন্য মন থাকতে পারে, ভেবেই দেখিনি কখনও।