শান্তিনিকেতনে পলাশ-শিমুলের আগুন লেগেছে ডালে ডালে, তখন শক্তিদা আমাদের প্রথম ক্লাসটা নিয়েছিলেন
Published by: Robbar Digital
Posted on: March 22, 2025 4:54 pm
Updated: March 23, 2025 1:41 pm
১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, যখন শান্তিনিকেতনে পলাশ-শিমুলের আগুন লেগেছে ডালে ডালে; তখন, মনে আছে শক্তিদা আমাদের প্রথম ক্লাসটা নিয়েছিলেন। সেই মিডিয়াবিরল যুগেও ঘটনাটা রীতিমতো আলোড়ন ফেলেছিল! শক্তি চট্টোপাধ্যায়; বাউন্ডুলে, বোহেমিয়ান, ‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল’ করা শক্তি চাটুজ্যে করবেন ‘অধ্যাপনা’! তাও কিনা রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে! লিখছেন অধ্যাপক শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ক্লাসের ছাত্র– বিশ্বভারতী বাংলা বিভাগের বর্তমান বিভাগীয় প্রধান।
প্রচ্ছদ: দীপঙ্কর ভৌমিক
মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
শোনা যায় শুরুটা হয়েছিল এইভাবে:
বিশ্বভারতীর উপাচার্যের সরকারি আবাসন ‘পূর্বিতা’ থেকে উপাচার্য সব্যসাচী ভট্টাচার্য চলেছেন মর্নিংওয়াকে। পূর্বপল্লি অতিথি-নিবাসের দোতলার জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁকে লক্ষ করে বলে উঠলেন:
–ওহে, সব্যসাচী, আপনি কি আমাকে এখানে পদ্য পড়াতে দেবেন?
ট্র্যাকস্যুট পরিহিত সব্যসাচীদার হাতে ছিল একখানা ছড়ি। অনেক সময় দু’কাঁধের ওপর ছড়িটাকে ভারসাম্যে রেখে হেলেদুলে হাঁটতে দেখা যেত তাঁকে। সেই ছড়িটার উপর ভর দিয়ে ঈষৎ ঝুঁকে জানালা আন্দাজ করে রসিক উপাচার্য তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তরে বললেন:
–সে ব্যবস্থা তো করাই যায় শক্তিবাবু। কিন্তু মুশকিল হল অন্য জায়গায়। ‘পদ্য’-এর সঙ্গে সহজ মিলে যে শব্দটা আসে সেইটি আবার ছেলেরা শিখে যাবে না তো!
হলফ করেই বলতে পারি, ‘পদ্য’-এর সহজ মিলের বাংলা শব্দটা শক্তিদা আমাদের শেখাননি কোনও দিন। বরং আশ্চর্যরকম; বলা যায় অপ্রত্যাশিত সিরিয়াস ছন্দচর্চাই করেছিলেন, নিয়তির ফেরে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সময়ের বাংলা বিভাগের ‘অতিথি-অধ্যাপক’ শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সব্যসাচীদার সঙ্গের ওই গল্পটা হয়তো নিতান্তই জনশ্রুতি। এর মধ্যে তথ্য বলতে শুধু এইটুকু যে, ১৯৯৪ সালে উপাচার্য অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্যের উদ্যোগেই বিশ্বভারতী বাংলা বিভাগে অতিথি-অধ্যাপক হিসেবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের নিযুক্তির অনুমোদন জুটেছিল। ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি, যখন শান্তিনিকেতনে পলাশ-শিমুলের আগুন লেগেছে ডালে ডালে; তখন, মনে আছে শক্তিদা আমাদের প্রথম ক্লাসটা নিয়েছিলেন। সেই মিডিয়াবিরল যুগেও ঘটনাটা রীতিমতো আলোড়ন ফেলেছিল! শক্তি চট্টোপাধ্যায়; বাউন্ডুলে, বোহেমিয়ান, ‘পা থেকে মাথা পর্যন্ত টলমল’ করা শক্তি চাটুজ্যে করবেন ‘অধ্যাপনা’! তাও কিনা রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনে!
মিডিয়া বলতে তখন ছিল কয়েকটা খবরের কাগজ। ‘আনন্দবাজার’-এ তখন শান্তিনিকেতনের প্রতিবেদন লিখতেন, যতদূর স্মরণে আসে অরুণ মুখোপাধ্যায় এবং পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়। আর ‘আজকাল’-এ পূর্ণানন্দদা (লেবুদা)-র ভাই দেবীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়(আলুদা)। আলুদা দৈনন্দিন ক্লাস রিপোর্টিংয়ের কাজটা দিয়েছিলেন আমাকেই। সেই সুযোগে শাশ্বতী, মৌশেলী, মৌ, মঞ্জরিতা, রুমা, বীণা প্রমুখ আমার বিখ্যাত বান্ধবীকুলের ক্লাস-প্রতিক্রিয়া ছেপে প্রতিদানে ফাল্গুনীদার ক্যান্টিনে এগটোস্ট সাঁটিয়েছি বিস্তর! শক্তিদা তখন রীতিমতো ‘মিথ’। তিনি যেখানে স্বয়ং অধিষ্ঠিত, সেখানে কি আর নিউজের অভাব হয়?
শক্তিদা প্রথমেই একটা মস্ত বড় বোমা ফাটালেন আমাদের অগোচরেই। পরদিন প্রথম শ্রেণির দৈনিকে প্রথম পাতায় বড় বড় হরফে ছাপা হল সে খবর। তার শিরোনাম ছিল অনেকটা এইরকম: ‘শান্তিনিকেতন কবিতা লেখার জায়গাই নয়: শক্তি’। তা দেখে অভিমানে আমাদের ঠোঁট ফুলে উঠছে। দিন দুইবাদে বিভাগীয় প্রধানের ঘরে শক্তিদাকে একান্তে পেয়ে কথাটা একবার যাচাই করে নিলাম। ঠোঁটে মৃদু একটু হাসি ঝুলিয়ে শক্তিদা বললেন, খবরের কাগজের শিরোনাম অমন চটকদারই হয়। তিনি নাকি বলতে চেয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনের জীবন বড্ড বেশি পেলব, সংঘাতহীন। এই শান্তি হৃদ্রোগীর পক্ষে ভাল কিন্তু কবিতার কারবারির চাই একরকমের সংঘাত, অশান্তি। এই জন্যই শান্তিনিকেতন কবিতা লেখার আদর্শ জায়গা হতেই পারে না। কবিতার জন্য প্রয়োজন নিরন্তর রক্তক্ষরণ।
সত্যি বলতে আমাদের একটু অভিমানই হয়েছিল তাঁর এই কথায়। রবীন্দ্রনাথ কী করে এখানে কবিতা লিখে গেলেন এত বছর; কিংবা রামকিঙ্কর করে গেলেন শিল্পচর্চা? সে প্রশ্ন তুললেনও কেউ কেউ। কবিতা রচনার রসায়ন নিয়ে বেশ একটা আধাতাত্ত্বিক বিসংবাদে কয়েকদিন জড়িয়ে পড়া গেল। কিন্তু কবিতা নিয়ে এই যে শক্তির একটা তত্ত্ব বা অবস্থান সেদিকটা ঊহ্য হয়ে কয়েক দিন কাগজের পাতায় তাই নিয়ে চাপান-উতোরই চলল বিস্তর। তত্ত্বপ্রস্থানগত সম্ভাবনা তেমন উদ্ভাসিত হল না কোনও পক্ষ থেকেই। বরং এই হুজ্জুতির মধ্যে চাপা পড়ে গেল সেই কথাটাও যেটা শুরুর ক্লাসেই বলেছিলেন শক্তিদা। বলেছিলেন, যাদের জীবনের বনেদে জমে আছে গ্রামজীবনের ধুলোমাটি তারা ঈর্ষণীয়ভাবে সৌভাগ্যবান। আমার মতো গ্রাম থেকে পড়তে আসা ছেলেমেয়েদের কাছে এই কথাটা কী সাংঘাতিক প্রণোদনাময় হয়ে উঠেছিল তখন তা বুঝিয়ে বলা দুষ্কর আজও। কিন্তু কথার ফেরে সে সময়ের মিডিয়া এই কথাটা তেমন তুলেই ধরল না। তার বদলে আরেকপ্রস্থ তর্ক উঠল ওই ‘পদ্য শেখানো’ কথাটা নিয়ে। শক্তিদা বিনয় করে কবিতাকে বলতেন ‘পদ্য’। শুধু বিনয়ও নয়, কথাটার মধ্যে একটা চাপা প্রতিবাদও ছিল। একসময় বাংলা সাময়িকপত্রে গদ্যের পদপ্রান্তে ঠাঁই মিলত কবিতার। ‘পদ্য’ কথাটা প্রয়োগের মধ্যে সেই আহত অভিমানও লুকিয়ে ছিল বইকি! তো সেই কবিতা লেখা কি কাউকে শেখানো যায়? শত বিতর্কেও নির্বিকার শক্তিদা কিন্তু আমাদের বলেই চলেছেন: আমি তোমাদের পদ্যলেখা শেখাব।
সেই তর্কে খানিকটা অংশ নিতে হল আমাকেও। জিজ্ঞাসু মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলতে হল, ক্রিয়েটিভ রাইটিং এখন বিদেশে রীতিমতো একটা ডিসিপ্লিন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। শক্তিদা আসলে বলতে চাইছেন সেই ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের কথা। যার মধ্যে কবিত্ব নেই, শুধু পরীক্ষা বৈতরণি পারের পারানি-স্বরূপ নোট তৈরির মাধুকরী আছে, তাদের ধরে ধরে কবিতা লেখা শেখানোর কথা উনি আদৌ বলেননি। ক্লাস আরও কিছুটা এগোলে শক্তিদার কথাটার সারবত্তা অনুধাবন করেছিলাম নানাভাবে।
তখন উনি আমাদের লেখা কবিতার ছন্দ পরখ করতেন ক্লাসে। ক্লাসটা হত পাঠভবনের সামনে আমাদের সেসময়ের বাংলা বিভাগের শিমুলতলা বাড়ির এমএ ফাইন্যাল ইয়ারের ঘরে। শতরঞ্চিতে বসতাম আমরা, আর শক্তিদা একটা চেয়ার-টেবিলে। আমি একটা সদ্যলেখা কবিতা এগিয়ে দিলাম শক্তিদার দিকে। তার প্রথম দুটো লাইন ছিল: ‘চিত্রগতি মর্মকথা এই তো আমার বলার ছিল/ ধুলায় ধূসর পাণ্ডুলিপি দ্বিপ্রহরে পণ্ড হল।’ আর শেষ লাইন দুটো এইরকম: ‘এবার আমি এই চুপছি এবার আমি স্পিকটি নট/ সংগুপ্ত আপন কথা নিজের মাঝেই ফাটুক ফট।’ শক্তিদা আমার ওই ‘একান্ত নিজস্ব দুঃখ’ কবিতাটার প্রশংসা করেও ‘চুপছি’ শব্দটা নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়লেন। জিগ্যেস করলেন, এই ক্রিয়াপদটার এমন ব্যবহার কি প্রচলিত? উত্তরে বললাম, আমাদের গ্রামের দেশে এমন ব্যবহার হয়েই থাকে। তবু যেন শক্তিদার মন ঠিক সায় দিচ্ছে না। বললেন, ছন্দ বজায় রেখে এর একটা প্রতিশব্দ ব্যবহার করলে কেমন হয়? আমি তৎক্ষণাৎ কলমটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘চুপছি’র বদলে তাহলে ‘থেমেছি’ বা ‘থামছি’ করে দেন যদি! উনি সায় দিলেন, কিন্তু বললেন, ‘সংশোধনটা নিজের হাতেই করো’।
‘কুড়ি বছরে কুড়িটি’ বইয়ের পিছনের পাতায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ছবি
সময় আরেকটু এগিয়েছে। আরেকটু সহজ হয়েছে সম্পর্ক। বিভাগীয় প্রধান তখন অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য, আমাদের অমিতদা। তাঁর নির্দেশমতো শক্তিদার ছত্রধারী হয়ে পূর্বপল্লি অতিথি নিবাসের ১৯ নম্বর ঘর থেকে বিকেল তিনটের ক্লাসে শক্তিদাকে শিমুলতলার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল আমার উপর। আমি তখন থাকতাম পাশেই পূর্বপল্লি সিনিয়র বয়েজ হস্টেলে। শেষ বসন্তের বিকেলে আমাদের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা হত। বুঝতে চাইতাম, শক্তিদা কেন এত লৌকিক বা ছড়ার ছন্দ নিয়ে কথা বলছেন ক্লাসে! কেন তাঁর কাছে ছন্দ এত গুরুত্ব পায়? ক্লাসে হাঁটুতে তাল দিয়ে দিয়ে শক্তিদা বুঝিয়ে দিতেন ছন্দ ব্যাপারটা আসলে কানের মামলা। কিন্তু আমরা যে ভেবেছিলাম আধুনিক কবিতায় মিল ও ছন্দের মুক্তি নিয়েই তিনি কথা বলবেন বেশি! কেন শক্তিদার কবিতাতেই-বা এত ছন্দ, এত মিলের কারিকুরি? ‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি/ এমন ছিলো না আষাঢ় শেষের বেলা/ উদ্যানে ছি্লো বরষা-পীড়িত ফুল/ আনন্দ ভৈরবী।’ এ তো অতি চমৎকার ছন্দ-মিলের কবিতা। আর ওই ‘এলায়ে’ শব্দটার মধ্যে কবির সযত্নরচিত কাব্যগন্ধ থাকলেও এলিয়ে পড়া ভাবটার ছবি আর কীভাবেই-বা শব্দে অমন জ্যান্ত আঁকা যেত? শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামের সেই এতোল-বেতোল করে দেওয়া মিথমানুষটির সঙ্গে যেন মিলছে না কোথায়! মিলছে না তাঁর জীবন আর কাব্যপ্রকরণে! যেন যাঁকে চন্দ্রাহত পাগল বলে ধরে নিয়ে এলাম, জ্যোৎস্নার গাঢ় সংরাগে জানা গেল সে ব্যক্তি সন্তসাধক! সুতরাং, মিলছে না। মিলছে না তাঁর পরিপাটি ক্লাস নেওয়ার অধ্যাপকীয় সিরিয়াসনেস!
আমাদের তখন বেড়াভাঙার বয়স। মনের মধ্যে ঘনিয়ে উঠছিল এইসব নিয়েই নানা প্রগলভ তর্ক। অসম্ভব ছন্দ-আনুগত্যও কি নয় একরকম নিয়মতান্ত্রিকতার বশংবদতা? উত্তর অবশ্য মিলেছিল ক্লাসেই। ‘প্রতিষ্ঠান ভাঙা, মানে নিজেকে কুঠার করে তোলা’– লিখেছিলেন যে কবি, তিনিই বললেন একদিন: ভাঙতে হয় অনেক কিছুই, ভাঙাটা জরুরিও বটে। তবে ভাঙারও একটা ব্যাকরণ আছে। যেমন-তেমন করে ভাঙা যায় না কিছুই। মনে পড়ে গেল তাঁরই কবিতার দুটো ছিন্ন পঙ্ক্তি: ‘ভেঙে দেবো… সবাই যেভাবে ভাঙে, সেভাবেও নয়/ পরম আদরে ভাঙবো, যত্নে ভাঙবো, নেবো কোলে তুলে…।’ আজও যাঁরা নানাভাবে ভাঙন-প্রস্তাব শোনান, তাঁদের চোখেমুখে খুঁজি আমি ভাঙার সেই মরমি ব্যাকরণ, যাতে লেখা থাকবে: ‘পরম আদরে ভাঙবো, যত্নে ভাঙবো, নেবো কোলে তুলে…।’
অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতায় আমাদের প্রলম্বিত কৈশোরের সেই দিনগুলো জারিত হচ্ছিল তখন। একটা ঘোরের মধ্যে তখন আমাদের সমূহ কবিতা-যাপন চলছে। বিশ্বভারতী ক্যান্টিনে বিক্রম(সিং খাঙ্গুরা), মৌ, বীণা আর আমি হয়তো আমাদের নতুন কোনও কবিতা পড়ছি। অবাক হয়ে খেয়াল করছি আমাদের কবিতা পড়ার ধরন যাচ্ছে বদলে! শক্তিদা যেমন তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিতে পাঠ করতেন, ‘তীরে কি প্রচণ্ড কলরব/ জলে ভেসে যায় কার শব / কোথা ছিলো বাড়ি/ রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়/ আমি স্বেচ্ছাচারী’। কিংবা ‘অবনী, বাড়ি আছ?’… অনেকটা তেমন নাটকীয়, ঈষৎ সানুনাসিক অথচ একরকম আভিজাত্যময় টানটোন যেন মিশে যাচ্ছে আমাদের কবিতাতেও। কোনও কোনও শব্দ লিখে ফেলে এখন মনে হচ্ছে, শব্দ যে ব্রহ্ম; কবিতায় শব্দের প্রয়োগ যে অমোঘ পাশুপত অস্ত্রের মতো– সে বোধহয় এই প্রথম ধরা দিল আমাদের অকিঞ্চন হাতে! আমরা একরকম মেতে আছি শক্তিদাকে নিয়ে। তখন আমরা পরম ‘শাক্ত’। একসময় কবি বুদ্ধদেব আর বিষ্ণু দের ভক্তরা নিজেদের বলতেন ‘বৌদ্ধ’ আর ‘বৈষ্ণব’। সেই আদলে আমাদের গোষ্ঠীটার নামকরণ করেছিলাম ‘শাক্ত’ আর ‘শাঙ্খ্য’। আমরা শক্তি আর শঙ্খ ঘোষের কবিতার চেলা! আমার এই নামকরণ মনে ধরেছিল বন্ধুদেরও।
কোনও সন্ধ্যায় সুতপাদি (অধ্যাপক সুতপা ভট্টাচার্য)-র ‘বন্ধুসভা’য় শক্তিদা কবিতা পড়বেন। লোডশেডিংয়ে আলো ধরেছি পিছনে। আধো-অন্ধকারে গমকে গমকে জলপ্রপাতের মতো উৎসারিত হচ্ছে কবিতা। আমরা তাতে স্নান করছি। কবিতার জলরেণু লেগে থাকছে আমাদের শরীরে ও মনে। চিনি ছাড়া চা খাবেন শক্তিদা। সামনে সাজানো ল্যাংচা সহযোগে চিনিছাড়া চায়ে চুমুক দিচ্ছেন শক্তি। আর এই কৌতুককর ‘অনৌচিত্য’ নিয়ে প্রশ্ন করলে শিশুর মতো হেসে উঠছেন বাংলা কবিতার শব্দের জাদুকর! মাঝে শক্তি কয়েক দিনের জন্য যাবেন ব্যাঙ্গালোর। কবিতা পড়বেন সেখানে। সেই প্রবাসবিরহটুকুও বড় দীর্ঘ মনে হচ্ছে তখন আমাদের। মার্চের মাঝামাঝি শান্তিনিকেতনে বসন্তোৎসব। পূর্বপল্লির ঘরে কলকাতার কবি ও কবি-যশোপ্রার্থীদের ভিড় ঠেলে দরজায় একটু উঁকি দিয়েছি মাত্র, ভিতর থেকে রবীন্দ্রসংগীতরত শক্তিদা সহসা আদেশ করলেন: ‘এসো মানব’। তারপর সমবেত সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বীরভূমের এক পত্রিকা-সম্পাদক আমারই মারফত একটা কবিতার আবদার করেছিলেন শক্তিদার কাছে। কিন্তু পত্রিকাটির নাম পছন্দ না হওয়াই তৎক্ষণাৎ সে আবেদন খারিজ করে দিলেন সেই মুহূর্তে ‘রক্তকরবী’র বিশুর ‘চোখের জলের লাগল জোয়ার’ গানের ঘোরে থাকা, আপাদ টলমল করা শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
২০ মার্চ আমাকে যেতে হল দেশের বাড়ি– এপিক কার্ডে্র ছবি তুলতে। ফিরে এসে শুনি সেদিনই শক্তিদাকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্রের শ্যুটিং হয়ে গেছে শান্তিনিকেতনে। ইংরেজি বিভাগের বন্ধু, ছড়াকার নীলাঞ্জন (বন্দ্যোপাধ্যায়) আর আমার নাম ধরে নাকি খোঁজাখুঁজি করেছিলেন শক্তিদা। বিক্রম ছিল শুটিংয়ে। সেই আপশোসের সীমা ছিল না আমার। ২১ তারিখ সন্ধ্যায় সুবর্ণরেখায় শক্তিদার সঙ্গে আবার দেখা। আপশোস গোপন রইল না। সে কথা জ্ঞাপনের পর বললাম, ২২ তারিখ মুর্শিদাবাদ যাচ্ছি আমরা আউটিংয়ে। আপনিও চলুন সঙ্গে। শক্তিদা বললেন, ইন্দ্র (প্রকাশনা জগতের প্রবাদপ্রতিম ইন্দ্রনাথ মজুমদার)-র বাড়িতে আমার বাইশে নেমন্তন্ন। তোমরা শরৎ (শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়)-কে নিয়ে যাও। হাতের সিগারেটটা তখন পুড়তে পুড়তে আঙুল ছুঁয়েছে বোধহয়। একটা জীবনই যেন পুড়তে পুড়তে শেষ সীমানায় এসে ঠেকেছে। তেইশে সকালেই মৌ আর বীণা হস্টেলে এসে ঘুম ভাঙিয়ে জানিয়ে গেল সে তুমুল বিষাদ সমাচার…!
সবই তো চোখের সামনে চলচ্ছবির মতো ভাসে এখনও। হাঁটুতে তাল ঠুকে ঠুকে কবিতা পড়ছেন শক্তিদা; আর তার ছন্দের দোলাটা কানের ভিতর দিয়ে চারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মনোকোষে-কোষে। বসন্তের শান্তিনিকেতন। শিমুলতলার ক্লাসরুমের জানালার ওপারে বৈকালিক আলো মেখে ফুটে আছে একগাছ রুদ্রপলাশ। শক্তিদা সেদিকে তাকিয়ে আবার হাঁটুতে তাল দিচ্ছেন:
ভাবতে অবাক লাগে শক্তিদাকে সেদিন পুষ্পশোভিত কোনও উপযুক্ত শকটে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়নি। প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের ব্যবস্থাপনায় চন্দন-চর্চিত, চিরনিদ্রায় শায়িত শক্তি চট্টোপাধ্যায় মহানগরে ফিরেছিলেন ট্রেনবাহনে! বুকের উপর শোভা পাচ্ছিল একটি টুকটুকে রক্তগোলাপ। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তা নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন তাঁর কাগজে। প্রতিবেদন পড়ে মনে হল, সেই লাল টুকটুকে গোলাপফুলটাও পথিমধ্যে কোথাও খসে পড়েছিল নিঃশব্দে।
২৩ মার্চ শক্তিদার দেহ শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে তুলে দিয়ে মন্থর পায়ে যখন হস্টেলে ফিরছি তখন নজরে পড়ল আর একটা রুদ্রপলাশ গাছ। চৈত্রের দুপুরে রিক্ত, বিধ্বস্ত। তার ডালপাতার ভিতর থেকে ডানা ঝাপটে চলে গেল একটা পাখি। বাসা-ভাঙা ছন্নছন্দ কোনও একলা-পাখি বোধহয়!
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
যথাসম্ভব নো মেকআপ লুক নিয়ে ফ্লোরে গিয়ে বসলাম আমার নির্দিষ্ট জায়গায়। তরুণ চক্রবর্তী ঢুকল। অন্যান্য দিন কুশল বিনিময় হয়, আজ কেবল স্তব্ধতা। শুরু করলাম অধিবেশন, চিরাচরিত হাসিটি আজ মুখে নেই। তারপরেই তরুণের মুখে উচ্চারিত হল প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার সংবাদ। ঘোষিত হল রাষ্ট্রীয় শোক।