Robbar

অপু-দুর্গার বৃষ্টিস্নান স্বপ্ন আর বিপর্যয়ের নিখুঁত বুনন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:June 11, 2025 5:30 pm
  • Updated:June 13, 2025 1:12 pm  
An article about the rain bath of Durga in Satyajit Ray's Pather Panchali

এই জুন মাসেই ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির ৭০ বছর পূর্ণ হল। মনে পড়ে যায়, দুর্গাকে ওর মা দু’বার পিছু ডেকেছিল, ততক্ষণে সে অপুর সঙ্গে মাঠ পেরিয়ে কালো মেঘ তাড়া করে অনেক দূর চলে গেছে। বৃষ্টিতে তৃপ্তি করে ভিজতে-ভিজতে ভাইয়ের সঙ্গে খুনসুটি করে, আবার কাক-ভিজে চুপ্পস হয়ে বসে থাকে দু’জনে। এর পরিণতি সম্পর্কে আমরা অবগত। এই দ্বৈততা সত্যজিৎ রায়ের ছবির শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি– যেখানে স্বপ্ন ও বিপর্যয়ের নিখুঁত বুনন থাকে। দুর্গার স্বপ্নের রূপরেখা যখন দর্শক বুঝে ফেলে, তখনই শুরু হয় সেই বৃষ্টি। আর দুর্গার এই আনন্দ-স্নানই হবে ওর মৃত্যুর কারণ।

সুদেষ্ণা গোস্বামী

দুর্গার বৃষ্টিস্নান– এক জীবনের রূপক, স্বপ্নের ব্যঞ্জনা, আর মৃত্যুর পূর্বতন আত্মরতির এক অনুপম শিল্পরূপ।

এক দুপুরে দিগন্ত বিস্তৃত কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে ‘পথের পাঁচালী’ ছবিতে। দুর্গা মেঘ আর বৃষ্টি দেখতে যাবে তার ভাই অপুকে নিয়ে। ভরা গ্রীষ্ম তখন। দুপুর-শেষে কালবৈশাখীর মেঘ যতই ঘন হয়ে আসুক, সব ফেলে চট করে দুর্গার বাড়ি থেকে বেরনোর জো নেই। তার আগে তাকে দ্রুত পুণ্যি-পুকুর ব্রত সেরে নিতে হবে বাড়ির উঠোনে। আঙিনার মাটিতে ছোট্ট এক চারকোনা গর্ত কেটেছে দুর্গা। সেটাই পুকুর, ‘পুণ্যি-পুকুর’। বেলগাছের পাতাসুদ্ধ সরু একটা ডাল পোঁতা পুকুরের মাঝখানে। মন্ত্র আওড়ে সেই গর্তে ঘটি থেকে জল ঢালতে হবে তিনবার। তবে দুর্গার ছুটি। ওদিকে মেঘ এখন আরও ঘন, আরও গাঢ়। ওদিকে দিদির অপেক্ষায় একাই মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে অপু। দুর্গা এদিকে মন্ত্র বলছে, ‘পুণ্যি-পুকুর পুষ্পমালা/ কে পূজে রে দুপুরবেলা?/ আমি সতী লীলাবতী/ ভাইয়ের বোন-পুত্রবতী।’

পথের পাঁচালী-র পুণ্যি-পুকুর ব্রতর দৃশ্য

এ-রকম আরও পদ আউড়ে, নিজেরই কাটা ‘পুণ্যি-পুকুর’-এ কাঁসার ঘটি থেকে জল ঢালল দুর্গা। তারপর গড় হয়ে পুকুরকে প্রণাম করেই দৌড়। মাঠে পৌঁছনোর আগে আর থামা নেই!

দুর্গার মৃত্যুতে খুব কম মানুষ আছে যার হৃদয় মুচড়ে কান্না পায়নি। দুর্গা যখন গলায় আঁচল দিয়ে ওই খুদে পুকুরের পাশে মাথা নোয়াচ্ছে, তখন অধিকাংশ দর্শকের চোখ জলে ভরে যায়। কারণ, এটি প্রকৃত অর্থে দুর্গার স্বপ্নভঙ্গের পূর্বক্ষণ। এই-যে দুর্গা আকাশ-ভাঙা মেঘ-বৃষ্টি দেখতে মাঠে বেরবে, সেটাই হবে ওর শেষ বেরনো। তারপর ওর জ্বর আসবে বৃষ্টিতে ভিজে। আর সে জ্বর সারবে না কোনওদিনও। পুণ্যি-পুকুর মন্ত্র শুনতে-শুনতেই সে-কথা আমাদের সকলের মনে আসে বার-বার।

দুর্গার জীবনের সব স্বপ্ন ঠিক যে সময় আমরা জানতে পারছি, ঠিক সেই সময় জুড়েই আকাশে জমতে শুরু করেছে নিকষ কালো মেঘ। এই মেঘ থেকে যে-বৃষ্টি নামবে– সেই বৃষ্টিই হবে দুর্গার মৃত্যুর কারণ। সুতরাং ওর স্বপ্নগুলো জানার সঙ্গে সঙ্গে এটাও আমরা বুঝতে পারছি, ঠিক কোন কোন স্বপ্ন ওর জীবনে কোনওদিন সত্যি হবে না।

আসলে ব্রতকথার মধ্যেই ধরা ছিল সেই সময়কার বাঙালি মেয়েদের ইচ্ছে ও আকাঙ্ক্ষাগুলো। আর সেটাই গেঁথে আছে সমগ্র বাঙালি জাতির স্মৃতির মধ্যে। যেমন গুপী-বাঘা যে-তিনটে বর চেয়েছিল ভূতের রাজার কাছে, সেটাই ছিল বাঙালির সারা জীবনের ‘চাওয়া’।

মেয়েদের ব্রতকথাও কিন্তু অনেকটা একইরকম। দুর্গার ওইখানি জীবনের সমস্ত স্বপ্নই বিবৃত হয়েছে ওর বৃষ্টি-স্নানের ঠিক আগেই– যখন দুর্গা পুণ্যি-পুকুর ব্রত উদ্‌যাপন করছিল।

আমরা যারা শহুরে মানুষ, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, জীবনের প্রাপ্তি-অভিযোগ-অনুযোগগুলো সম্পূর্ণ আলাদা। তা সত্ত্বেও আমাদের প্রাণে আজও দোলা দেয় ব্রতকথার পদ। কারণ, ওটা আজও রয়ে গিয়েছে আমাদের বুকের অতলে।

তাই পুণ্যি-পুকুর মন্ত্রের বাকিটুকুও মন দিয়ে শুনি আমরা। দ্রুত-বলা সেই মন্ত্রের মধ্যেই অনুভব করি– জীবনে আর কী-কী চাওয়ার ছিল দুর্গার মতো মেয়েদের। ভরা সংসারের স্বপ্ন দেখেছিল দুর্গা। ওর সমস্ত স্বপ্নের কথা ছবিতে বলা হয়েছিল ব্রতকথার মধ্যে দিয়ে–

‘ছয় পুত্র মরবে না।
পৃথিবীতে ধরবে না।।
পুত্র দিয়ে স্বামীর কোলে।
মরণ যেন হয় গঙ্গাজলে।।

হে হর-পার্বতী।
দাও মা-গো সুমতি।।
আমি অতি হীনমতি।
নাহি জানি স্তবস্তুতি।।

সতী-সাবিত্রী-সীতা।
হই যেন পতিব্রতা।।
মনের সুখে করি ঘর।
দাও মা-গো এই বর।।’

পথের পাঁচালীর স্টোরি-বোর্ড, সত্যজিৎ রায়ের স্কেচ

শুনতে-শুনতে আমাদের মনে ভেসে ওঠে আলো-ছায়া, হাসি-কান্না মেশানো দুর্গার ভবিষ্যতের এক ছবি। যেখানে ‘মরণ’-এর কথা যেমন আছে, তেমনই আছে ‘সুখে ঘর’ করার কথাও। ‘কালচারাল এক্সপ্লয়টেশন’-এর পাশেই স্বপ্ন। ছ’টি সন্তান হবে দুর্গার। তারা এমন হবে রূপে-গুণে, যে, তাদের রূপ-গুণ ধরার জায়গা থাকবে না গোটা পৃথিবীতেও। ভবিষ্যতের এই আভাস কোন মুহূর্তে আঁকা হল দর্শকের সামনে? জীবনে শেষবারের মতো ভাইয়ের সঙ্গে দুর্গা মাঠে বৃষ্টি-স্নান করতে বেরনোর ঠিক আগের মুহূর্তে। জীবনে কী-কী সে কোনও দিনই পাবে না– তা আমাদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যই যেন ‘পুণ্যি-পুকুর’ ব্রত ব্যবহার করা হয়েছে ‘পথের পাঁচালী’তে। দুর্গার স্নান-দৃশ্যের অন্তর্নিহিত সত্য লুকিয়ে আছে দুর্গার পুণ্যি-পুকুর ব্রতকথায়।

‘পথের পাঁচালী’র এমন এক সূত্র এই ব্রত, যার নাগাল বিদেশিরা পাননি। সেই কারণে ‘পথের পাঁচালী’ সারা পৃথিবীর দর্শকের হয়েও শুধুমাত্র খাঁটি বাঙালির মনের গহীনের সম্পদ।

Aam Antir Bhepu 01
‘আম আঁটির ভেঁপু’র অলংকরণ। অপু-দুর্গার বৃষ্টিস্নান। শিল্পী: সত্যজিৎ রায়

বৃষ্টিই জন্ম এবং মুক্তি। আবার বৃষ্টিই মৃত্যু এবং অবলুপ্তি– এইটা রবীন্দ্র-দর্শনের একটি জোরালো ধারা। রবীন্দ্রনাথের এই দর্শন ব্যঞ্জনা পেয়েছে সত্যজিৎ রায়ের হাতে। সেই গানটি মনে করা যেতে পারে– ‘বজ্র-মানিক দিয়ে গাঁথা/ আষাঢ় তোমার মালা…’

এই গানের মাঝের দু’টি লাইন এই রকম–

‘সবুজ সুধার ধারায়
প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধরায়
বামে রাখো ভয়ঙ্করী
বন্যা মরণ-ঢালা!’

রবীন্দ্রনাথের এই ভাবনাই ব্যঞ্জনা পেয়েছে দুর্গার স্নানদৃশ্যে। যে বৃষ্টি প্রাণ এনে দিচ্ছে দুর্গার জীবনে, সেই বৃষ্টিই দুর্গার মরণ-ঢালা!

বৃষ্টি-স্নানের ঠিক আগের মুহূর্তেই দুর্গার স্বপ্নের খতিয়ান দিয়েছেন সত্যজিৎ। তারপর বৃষ্টিধারায় নিজেই মুছে দিয়েছেন দুর্গার সমস্ত স্বপ্নকে। স্বপ্নের অস্থায়িত্ব, স্বপ্নের ভঙ্গুরতাকেই সত্যজিৎ ব্যঞ্জনা দিলেন এইভাবে।

“I made Durga’s death follow the rain, linking them as cause and effect– unlike the original, where they were unrelated.”

নিউ ইয়র্ক রেডিও-তে ১৯৫৮ সালে এক সাক্ষাৎকারে একথা বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়।

Pather Panchali (1955) – The Movie Crash Course

এই জুন মাসেই ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তির ৭০ বছর পূর্ণ হল। মনে পড়ে যায়, দুর্গাকে ওর মা দু’বার পিছু ডেকেছিল, ততক্ষণে সে অপুর সঙ্গে মাঠ পেরিয়ে কালো মেঘ তাড়া করে অনেক দূর চলে গেছে। বৃষ্টিতে তৃপ্তি করে ভিজতে-ভিজতে ভাইয়ের সঙ্গে খুনসুটি করে, আবার কাক-ভিজে চুপ্পস হয়ে বসে থাকে দু’জনে। এর পরিণতি সম্পর্কে আমরা অবগত। এই দ্বৈততা সত্যজিৎ রায়ের ছবির শ্রেষ্ঠ বৈশিষ্ট্যগুলোর একটি– যেখানে স্বপ্ন ও বিপর্যয়ের নিখুঁত বুনন থাকে। দুর্গার স্বপ্নের রূপরেখা যখন দর্শক বুঝে ফেলে, তখনই শুরু হয় সেই বৃষ্টি।

আর দুর্গার এই আনন্দ-স্নানই হবে ওর মৃত্যুর কারণ। বৃষ্টিধারাকে দুর্গা যত বেশি উপভোগ করছে– ততই সে ডেকে আনছে নিজেরই মৃত্যুকে। নিজেকে নিজেই দিচ্ছে মৃত্যুদণ্ড, যদিও অজান্তেই। আর আমরা এত বছর পরেও সেই অমেয় দুঃখের বিশালতা বহন করে নিয়ে চলছি।